somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুশদেশের সত্যিকথা ১৫

০১ লা অক্টোবর, ২০০৭ বিকাল ৩:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আবারো নিকোলাসের দিকে ফিরে আসা যাক । আসলে নিকোলাসের মাথা নষ্ট করার জন্যু শুধু তাঁর আত্বীয় স্বজন, গৃহশিক্ষক আর আমলারাই চেষ্টা করেননি, নিকির রাজকীয় আত্বীয় স্বজনদেরও বিরাট ভুমিকা ছিল এতে । কাছে যাঁরা ছিলেন তাঁরা তো সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেনই, দূরের কুটম্বরাও ত্রুটি রাখেন নি কাজে । এদের একজন প্রধান ব্যাক্তি ছিলেন জার্মানীর সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় ভিলহেল্ম ।

এই দুই সম্রাট আবার সম্পর্কে জ্ঞাতি ভাই ছিলেন । আলিক্সের মতো ভিলহেল্ম ভিক্টোরিয়ার আপন মেয়ের ঘরের নাতি । রাণী ভিক্টোরিয়া তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যাটিকে প্রাশিয়ার যুবরাজ ওতৃতীয় ফ্রিডরিখের (ইংরেজিতে ফ্রেডারিক) কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন । এতে অবশ্য রাজকীয় প্রটোকল খুব ক্ষুন্ন হয় নি ।

জন্মগতভাবে জ্যেষ্ঠতা সবসময় মেয়েদের সিংহাসনের দাবীদার করতো না (সপ্তম এডওয়ার্ড আসলে ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় পুত্র) । ভিক্টোরিয়ার কন্যা (তাঁর নামও আবার ভিক্টোরিয়া!) কন্যা যখন জার্মানীতে শ্বশুর বাড়িতে আসেন তখন তাঁর শ্বশ্বুর সম্রাট প্রথম ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ প্রাশিয়ার সম্রাট ।

শ্বশুর সাহেব অষ্টাদশ শতকে জন্মেছিলেন । এবং মার্শাল ব্ল্যুখারের বাহিনীর হয়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন অল্পবয়সে । ১৮৩০ আর ১৮৪৭ এর বিপ্লব তাঁর জীবদ্দশাতেই হয়েছে । সে সময় জার্মানী বলে কোনো দেশ অবশ্য ছিল না । প্রাশিয়ার রাজারাই জার্মান রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী । প্রধানমন্ত্রী বিসমার্কের কুটনীতি ও নানাবিধ ধড়িবাজির ফলে তাঁরা প্রায় সমস্ত জার্মানভাষী অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব আরোপ করেন (অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ার সাম্রাজ্য আর সুইজারল্যান্ড বাদে) ।

১৮৭০ সালে পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্সকে হারানো প্রাশিয়ার জন্য সোনায় সোহাগা হয়েছে বলা যায় । ১৮৭১ সালে বিসমার্কের পরামর্শে প্রাশিয়ার প্রথম ভিলহেল্‌ম নিজেকে প্রাশিয়ার রাজা ও জার্মানীর সম্রাট ঘোষনা করেন ।

ভিলহেল্ম পুত্র ও ভিক্টোরিয়া জামাতা ফ্রিডরিখ বা তৃতীয় ফ্রিডরিখ অতীব সজ্জন ব্যাক্তি বলে ইউরোপময় সুবিদিত ছিলেন । তবে তাঁকে সিংহাসনে বসার জন্য সাতান্ন বছর বসে থাকতে হয়েছিল । নব্বই বছর বয়সে তাঁর বাবা পরলোক গমন করেন ১৮৮৮ সালের ৯ ই মার্চ । বিধিবাম, মসনদে মাত্র নিরানব্বই কর্মদিবস তিনি আসীন ছিলেন । এবং এর মধ্যে প্রত্যেকটি দিনই প্রাণঘাতী ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে কেটেছে । কিন্তু তার আগের বছর নভেম্বর মাসেই ফ্রিডরিখের ল্যারিংক্সের ক্যান্সার ধরা পড়ে

ডাক পড়ল সে যুগের সেরা নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞ, ব্রিটিশ ডাক্তার স্যার মোরেল ম্যাকেঞ্জির পরীক্ষায় । ম্যাকেঞ্জি, ফ্রিডরিখের গলা থেকে খানিকটা টিস্যু তুলে পরীক্ষা করে বললেন 'এ খুব সম্ভবত ক্যান্সার নয়,' এবং অপারেশান করে ল্যারিংক্স কেটে ফেলে দেবার বিরোধিতা করলেন তিনি । এই নিয়ে ফ্রিডরিখের জার্মান চিকিৎসক, বের্গমান আর ফিরখোভের খানিকটা মতবিরোধ দেখা দিলো স্যার ম্যাকেঞ্জির ।

ব্যাপারটা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তারদের (এবং পারিষদদের মধ্যে) খানিকটা হাউকাউ লেগে গেল । জার্মান-ব্রিটিশের প্রতিদ্বন্দীতা (যদিও ফ্রিডরিখ ব্রিটিশ মহারাণীর জামাতা) আছেই, তার সাথে আরো যোগ হয়েছিল ক্যান্সারের মতো নিরাময় অযোগ্য কোনো রোগ নিয়ে কেউ নতুন বর্ধিত জার্মান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসতে পারবে কি না ।

ফ্রিডরিখ যদি সিংহাসনে বসতে না পারেন বা উত্তরাধিকার ত্যাগে বাধ্য হন তাহলে নিঃসন্দেহে তাঁর পুত্র ভিলহেল্‌ম বসবেন মসনদে । এটা পরবর্তীকালে খুব পরিস্কার হয়ে উঠেছিল যে চিকিৎসক দের একটা বড় অংশ রাজনৈতিক ঘোঁট পাকানোর শরিক ছিলেন ।

ব্যাপারটা পরিস্কার হলো যখন ফ্রিডরিখের মৃত্যুর পরে জার্মান চিকিৎসকরা একটা 'প্রাক্তন সম্রাটের অসুস্থতা' বলে একটা শ্বেতপত্র ধাঁচের রিপোর্ট প্রকাশ করে ফেললেন । স্যার ম্যাকেঞ্জি বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? তিনিও একটা পাল্টা বই ছেপে ফেললেন, এবং সেজন্য রোগীর গোপন ও ব্যাক্তিগত তথ্য প্রকাশের জন্য রয়্যাল কলেজ অভ সার্জন কর্তৃক ধাতানি খেলেন ।

মোদ্দা কথা হলো এই যে তৃতীয় ফ্রিডরিখে দুঃখজনক মৃত্যুর পরে তাঁর জেদী ও উচ্চভিলাষী পুত্র ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক ফ্রিডরিখ ভিলহেল্ম দ্বিতীয় ভিলহেল্ম নাম নিয়ে ১৫ ই জুন ১৮৮৮ সালে গদিতে বসলেন । ঘটনাটা পৃথবীর ইতিহাসে সাংঘাতিক প্রভাব ফেলবে সোয়া শতাব্দী পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুচনায় । ঐতিহাসিকদের অনেকেরই ধারনা তৃতীয় ফ্রিডরিখ বেঁচে থাকলে তিনি জার্মানীকে উচ্চভিলাষী, সাম্রাজ্যবাদী সামরিকীকরণের পথে হাঁটতেন না । অন্তত তাঁর কর্মকান্ড চিঠিপত্র থেকে তাঁকে শান্ত মেজাজের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসক বলেই মনে হয় ।

আর এই দ্বিতীয় ভিলহেল্মই হচ্ছেন নিকির কাজিন "ভিলি" !

আঠারোশো উনষাট সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার এই প্রথম নাতিটির জন্ম । জন্মটি ছিল জটিল এক সিজারিয়ান বার্থ, কর্তব্য ডাক্তারের ফর্সেপের টানে ভিলহেল্মের বাঁ হাতটা প্রায় অচল হয়ে যায় । অচল ও কুঁকড়ে যাওয়া হাতটি ভিলহেল্ম বিশেষ ভাবে বানানো একটা পকেটে লুকিয়ে রাখতেন । নাকে রনীচের পেল্লাই গোঁফটাও হতে পারে নষ্ট হাতটা থেকে নজর ফেরানোর কৌশল । দ্বিতীয় ভিলহেল্মের যতগুলি অফিশিয়াল ছবি আছে তার কোনোটাতেই হয় বামহাতটা ভাল করে দেখা যায় না, অথবা বাঁ হাতটা কায়দা করে কোনো ছড়ি তরবারীর বাঁটে রাখা ।

অবশ্য ডানহাতে প্রচন্ড শক্তি রাখতেন জার্মান সম্রাট । যে সব অধীনস্থদের সম্রাটের সাথে করমর্দন করার দুর্ভাগ্য হয়েছে তাঁরাই বলেছেন আক্ষরিক অর্থেই বজ্রমুষ্ঠি ছিল সম্রাটের । হাতের আংটিগুলো আবার উল্টো করে মানে পাথরগুলো নীচের দিকে দিয়ে পরতেন সম্রাট যাতে হাড়ে হাড়ে হাতের চাপ টের পাওয়া যায় !

ভিলহেল্ম তাঁর কাজিনের সাথে ইংরেজিতেই লেখতে । চিঠির নীচে সই থাকতো "Your Dear Cousin Willy" . নিকিও একই ভাবে চিঠিতে স্বাক্ষর করতেন । দুনিয়াদারী সম্বন্ধে খানিকটা অজ্ঞ জ্ঞাতি ভাইটিকে নানান বিপদজনক পরামর্শ দিয়েছিলেন ভিলহেল্ম । বয়সে প্রায় নয় বছর বড় হওয়াতে মুরুব্বিয়ানা ফলাতে বেশ সুবিধা ছিল ভিলির । এগুলোর মধ্যে ছিল 'পীত বিপদ' বা ইয়েলো পেরিল সম্বন্ধে রাশিয়াকে 'সতর্ক' করা ।

'পীত' হচ্ছে এশিয়ানরা, বিশেষ করে চীন ও জাপানীদের উদ্দেশ্য করে বলা । হুঁশিয়ার না হলে এশিয়ানরা পুরো দুনিয়াটা গিলে ফেলবে । এবং এ ব্যাপারে অর্থাৎ পীত বিপদের হাত সভ্য ইউরোপকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে রাশিয়ার একটী পবিত্র কর্তব্য আছে । আশা করা যায় কাজিন নিকি এ ব্যাপারে অবগত আছেন । একবার ভিলহেল্ম, নিকিকে একটা তৈলচিত্র পাঠালেন যাতে নিকি আর ভিলির ছবি আঁকা ছিল ।

ভিলহেল্ম লোহার বর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছেন, নীচে বাইজান্টাইন আলখেল্লা পরা উবু হয়ে বসে থাকা নিকি প্রশংসা ও সমভ্রমের সাথে তাকিয়ে আছেন ভিলির দিকে, তাঁদের পিছনে সমুদ্রের দৃশ্য; সেখানে অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ ভেসে যাচ্ছে । ছবির সাথে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন তাতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছিল । নিকিকে তিনি 'প্রশান্ত মহাসাগরের অ্যাডমিরাল' মনে করেন আর নিজেকে আটলান্টিকের নৌ সেনাপতি, ছবিটা তারই প্রতিকৃতি । জাপানের দিকে নজর রাখতে হবে, আবার মনে করিয়ে দিলেন ভিলহেল্ম ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ৮:৫৬
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×