অবতরণিকাঃ
'ভবিষ্যৎ' কি পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত একটি ব্যাপার নাকি এটা কল্পনাযোগ্য... নিয়মের আওতাধীন, এটার এক যৌক্তিক বিশ্লেষণ এর অপচেষ্টা থেকেই লেখাটির উৎপত্তি।
একেবারে শুরুতে স্বাভাবিকভাবেই এই বিশ্ব কে মানুষ নিয়মবিহীন মনে করতো। প্রাকৃতিক ঘটনা গুলোর ব্যাখ্যা করার জ্ঞান মানুষের ছিল না। বন্যা, মহামারী বা এ ধরনের দুর্যোগ গুলো ঘটার সম্ভাব্য কারন হিসাবে ধরা হত বিভিন্ন দেব- দেবীর অসন্তোষ। তাই দেব দেবী কে খুশি রাখার জন্য , তাদের মন জয় করার জন্য বিভিন্ন প্রার্থনা, আচার বা উপঢৌকন এর ব্যবস্থা থাকত। এই বিশ্বাস টা এখনও কিছু কিছু মানুষের মধ্যে বর্তমান। ব্যাপারটা অনেকটা অদৃষ্টের সাথে চুক্তি করার মত!
আভাস ও বিকাশঃ
প্রকৃতির মধ্যে যে কিছু নিয়মের ছাপ রয়েছে এটার আভাস মানুষ খুব ধীরে ধীরে অনুভব করে। আকাশের স্বর্গীয় বস্তুগুলোর গতি এবং পর্যায়বৃত্ততা দেখে নিয়মের অস্তিত্বের ব্যাপারে মানুষ অনেকটাই নিশ্চিত হয়। এ কারনে বলা যায়... জ্যোতির্বিদ্যা দিয়েই বিজ্ঞানের পথচলা শুরু। প্রায় ৩০০ বছর আগে নিউটন ব্যাপারগুলোকে কিছু মজবুত গাণিতিক ভিত্তি দেয়ার চেষ্টা করেন, এবং আমরা কিন্তু এখনও এসব (স্বর্গীয়)বস্তুর গতি নির্ণয়ে সেই অভিকর্ষের সূত্র সমূহ ব্যবহার করি। জ্যোতির্বিদ্যার উদাহরন গুলো অনুসরন করে বুঝে গেল অন্য প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোও বিজ্ঞানের সূত্র মানে। এই ধারনাগুলো থেকেই জন্ম নেয় 'সাইন্টিফিক ডিটারমিনিজম' এর, যেটা প্রথম জনসমক্ষে আনেন ল্যাপ্লাস।
ল্যাপ্লাস বড় বড় জটিল বাক্যে তার কথা গুলো লিখতেন। কথা গুলোর মূলভাব এমন- আমরা যদি কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে জগতের সকল কনার অবস্থান ও গতি জানতে পারি তবে অন্য কোন এক সময়ে তাদের আচরণ হিসাব করতে পারব। তারমানে কোন এক সময়ে মানগুলো জেনে, অতীত বা ভবিষ্যতে মান গুলো কি ছিল বা কি হবে সেটা হিসাব করা যাবে।
একটা কাহিনী কথিত আছে, সম্রাট নেপলিয়ান ল্যাপ্লাস কে জিজ্ঞাসা করলেন- তোমার এই সিস্টেম এ স্রস্টার অবস্থান কোথায়? ল্যাপ্লাস জবাব দেন- মহামান্য, আমার এই অনুকল্পটির দরকার হয় নি।
এতে মোটেও দাবী করা হয় নি স্রস্টার অস্তিত্ব নেই। তিনি বিজ্ঞানের সূত্রের মধ্যে স্রস্টাকে আনতে চান নি, এই যা। বিজ্ঞানীদের অবস্থান টা এমনই হওয়া উচিত।
যদি কোন অতি প্রাকৃতিক চরিত্র ঘটনা গুলো ঘটায় এবং সে গুলোতে হস্তক্ষেপ করে , তবে 'বৈজ্ঞানিক সূত্র' কে আসলে 'বৈজ্ঞানিক সূত্র' বলা যায় না।
'সাইন্টিফিক ডিটারমিনিজম' কতটা প্রয়োগযোগ্যঃ
একটি সময়ে মহাবিশ্বের অবস্থা জেনে অন্য একটি সময়ে অবস্থা নির্ণয়ের এই ধারনাটি বৈজ্ঞানিক মতবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটা সময়। এই কনসেপ্ট আমাদের বলে- তাত্ত্বিক ভাবে হলেও ভবিষ্যৎ অনুমানযোগ্য। যদিও বাস্তবে ভবিষ্যৎ অনুমানের সামর্থ্য আমাদের অনেকটাই কম, বিভিন্ন সমীকরণের কাঠিন্য ও জটিলতার কারনে। এখানে আরেকটি ব্যাপার কাজ করে - কেওস বা বিশৃঙ্খলা। জুরাসিক পার্ক যারা দেখেছেন তারা হয়ত জানেন, কেওস মানে হলো এক স্থানের অতি ক্ষুদ্র অনিয়ম অন্য একটি স্থানে বিশাল পরিবর্তনের কারন হওয়া। যেমন, একটি প্রজাপতির ঝাপটানো ডানাই হয়ত সেন্ট্রাল পার্কে বৃষ্টির কারন! একটা সমস্যা অবশ্য আছে... এইটার পুনরাবৃত্তি হয় না। যেমন, প্রজপাতির পরের বারের ঝাপটানো ডানা হয়ত অন্য কোন নিয়ামক কে প্রভাবিত করবে যেটা আবহাওয়ায় পরিবর্তন আনবে। এত সেনসেটিভ সব ব্যাপার জড়িত থাকে বলেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস এত অনির্ভরযোগ্য।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সঃ
বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু ঝামেলা থাকলেও, 'সাইন্টিফিক ডিটারমিনিজম' উনিশ শতকের আনুষ্ঠানিক একটি মতবাদ ছিল। ল্যাপ্লাসের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কে নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করা যে আদৌ বাস্তব কোন ব্যাপার না , সেটার ব্যাপারে দুটি মতবাদ পাওয়া যায় বিংশ শতকে এসে। ১ম মতবাদ টির নাম 'কোয়ান্টাম মেকানিক্স'। ১৯০০ সালে একটি চমৎকার ধাঁধা সমাধান করার লক্ষ্যে জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক প্রথম ধারনাটির উদ্ভব ঘটান। যদিও শুরুতে এটি একটি সাময়িক অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহন করা হয়েছিল।
উনিশ শতকের দিককার চিরায়ত ধারণা ছিল- খুব উত্তপ্ত কোন বস্তু (যেমনঃ লোহিত তপ্ত কোন ধাতু) থেকে বিকিরণ হয়। বেতার তরঙ্গ, অবলোহিত, দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনী, এক্স রে, গামা রে প্রভৃতি সকল তরঙ্গের সমান হারে বিকিরনের মাধ্যমে বস্তুটি শক্তি হারায়। তাই যদি হয়ে থাকে, আমাদের সবার ত্বক ক্যান্সারে মারা যাওয়ার কথা! শুধু তাই না... জগতের সকল বস্তু একই তাপমাত্রায় চলে যাওয়ার কথা । সেটা তো হয় না।
প্ল্যাঙ্ক এই ধাঁধার একটা সমাধান দিয়েছিলেন এমন, ঘটনা টা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যদি আমরা, 'বিকিরন যে কোন পরিমানে হতে পারে' এমন (চিরায়ত পদার্থবিদ্যা হতে প্রাপ্ত) ধারণা টি বাদ দেই। সাথে সাথে কি ধারণা গ্রহন করতে হবে বলে দিলেন সেটাও- বিকিরণ বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্রতম কোন একটি এককের(বা প্যাকেট এর বা কোয়ান্টার) গুনিতক হিসাবে নির্গত হয়। কথাটা অনেকটা এমন, বাজারে যে কোন পরিমান চিনি কেনা যাবে না... কিনতে হবে '১ কেজির প্যাকেট' হিসাবে।
সেই বিছিন্ন ছিন্নায়িত প্যাকেট গুলোর শক্তি, কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক হয়। তাই অতিবেগুনী বা এক্সরের জন্য কোয়ান্টা গুলোর শক্তির মান অনেক বেশি। দৃশ্যমান আলো বা অবলোহিতর জন্য শক্তির মান তুলনামুলক কম। এখান থেকে বুঝা যায়, একটা বস্তু যদি অতিবেগুনীর বা এক্সরের অন্তত একটা কোয়ান্টাও বিকিরণ করতে চায়... বস্তুটিকে হতে হবে সূর্যের মত প্রচণ্ড উত্তপ্ত, অন্যথায় একটি মাত্র কোয়ান্টা নিঃসরণের যথেষ্ট শক্তিটিও এর থাকবে না।
এই কারনেই এক কাপ চা থেকে আমাদের 'সানবার্ন' হয়ে যায় না!!
প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টার ধারনাটি কেবলই একটি গাণিতিক কৌশল হিসাবে নিয়েছিলেন। ভৌত ভাবে অবাস্তব। ইতোমধ্যে পদার্থবিদরা এমন সব আচরণ গুলোর খোঁজ করতে থাকলেন যে আচরণগুলো কোন একটি রাশির অবিছিন্নতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, কেবল বিছিন্নতা (ছিন্নায়িত মান) বিশিষ্ট চলক দিয়েই ভালো ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন- দেখা গেল, মৌলিক কণিকাগুলো ক্ষুদ্র লাটিমের মত আচরণ করে, যারা কোন একটা অক্ষের সাপেক্ষে ঘূর্ণায়মান। কিন্তু ঘূর্ণনের পরিমান যা খুশি তাই হতে পারে না। পরিমাণটা হতে হয় মৌলিক একটা এককের গুনিতক হিসাবে। এককের মানটা অতি ক্ষুদ্র বিধায়, সাধারন একটা লাটিমের ঘূর্ণন যে কয়েকটা বিছিন্ন ধাপের পরই কমতে থাকে সেটা আমরা খেয়াল করতে পারি না। আমাদের এটাকে একটা অবিছিন্ন(continious) ঘটনা মনে হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র লাটিমরূপী কনার জন্য ঘূর্ণনের এই বিচ্ছিন্নতার(discrete nature) ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অনিশ্চয়তার শুরুঃ
'ডিটারমিনিজম' এ বস্তুর এই কোয়ান্টাম চরিত্র কি কাজে লাগে সেটা মানুষ পুরাপুরি বুঝার আগেই ১৯২৬ সালে ওয়ারনার হাইজেনবার্গ মতবাদ দেন, কোন কনার অবস্থান ও বেগ একই সাথে সঠিকভাবে নির্ণয় করা যাবে না। একটা ব্যাখ্যা এমন হতে পারে- কনা টি কোথায় আছে দেখার জন্য কণাটিকে আলোর উপস্থিতিতে আনতে হবে। আর যখনি কণাটির উপর আলো ফেলা হবে, প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব অনযায়ী, কেও চাইলেও ইছছামত ক্ষুদ্র পরিমান আলো ফেলতে পারবে না। ফেলতে হবে অন্তত একটা কোয়ান্টাম। সেই একমাত্র কোয়ান্টামটিই পতিত হওয়ার পর কনাটিকে বিচ্যুত করবে। কণাটির গতি কে পরিবর্তন করে দিবে। পরিবর্তিত বেগ টি কত হবে সেটা অনুমান করা সম্ভব না।
তারমানে ভালোভাবে অবস্থান পরিমাপের সময় খুব কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করতে হবে, যেমন- অতিবেগুনি,এক্স রে বা গামার মত। কিন্তু প্যাঙ্কের তত্ত্ব অনুযায়ী এসব ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোর কোয়ান্টা গুলোর শক্তি, দৃশ্যমান আলোর কোয়ান্টা গুলোর শক্তির চেয়ে অনেক বেশি হবে।সুতরাং এরা যে কনার উপর আপতিত হবে তার গতিকেই প্রভাবিত করবে... পরিবর্তন করবে... উচ্চ মাত্রায়।
অর্থাৎ কোন দিকেই সুবিধা করা যাচ্ছে না। কনার অবস্থান যতটা সঠিক ভাবে মাপতে চাইব, বেগ নির্ণয়ে ততটাই ভুল আসতে থাকবে। কিংবা বেগ মাপতে গিয়ে আমাদের স্যাক্রিফাইস করতে হবে অবস্থান নির্ণয় কে।
এই ব্যাপারটিকেই প্রকাশ করা হয় হাইজেনবার্গের বিখ্যাত 'অনিশ্চয়তা নীতি' তে।
দ্বন্দ্বঃ
আগেই বলা হয়েছে ল্যাপ্লাসের ''সাইন্টিফিক ডিটারমিনিজম' এ, কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কনার অবস্থান ও গতি জেনে পরে অন্য কোন এক সময়ে কণাটির আচরণ হিসাব করতে পারার কথা বলা হয়েছিল। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির মাধ্যমে এই তত্ত্ব টিকে নাকচ করা যায়। অবস্থান ও গতি এখন সঠিকভাবে জানা না থাকায় তখন (ভবিষ্যতে) অনুমান করাও সম্ভব হবে না। যত ভালো কম্পিউটারই ব্যবহার করা হোক না কেন... দুর্বল উপাত্ত ইনপুট দিলে আউটপুট দুর্বলই আসবে।
আইনস্টাইনের ধারনাঃ
প্রকৃতির এই আপাত বিক্ষিপ্ততায় আইনস্টাইন খুব একটা খুশি ছিলেন না। তার চিন্তা ভাবনা গুলোর বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় তার বিখ্যাত উক্তি "ঈশ্বর জুয়া(পাশা) খেলেন না" তে। তার মনে হয়েছে অনিশ্চয়তার ব্যাপারটা সাময়িক বা আপাতত কাজ চলার মত। এর বাইরেও প্রছন্ন এক বাস্তবতা আছে, যেখানে কনার সুনির্দিষ্ট অবস্থান ও গতিবেগ থাকবে। তখন ল্যাপ্লাসের সূত্র প্রযোজ্য হবে। আসলেই এটা হবে কিনা সেটা স্রষ্টাই ভালো জানবেন। তবে আলোর কোয়ান্টাম চরিত্র ধারনাটিকে সমর্থন করে না।
আইনস্টাইনের মতবাদ কে আমরা 'লুকানো চলকের তত্ত্ব' (hidden variable theory) নাম দিতে পারি। এই তত্ত্বই সম্ভবত অনিশ্চয়তা নীতিকে পদার্থবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করে। অনিশ্চয়তা নীতির এক ভৌত প্রকাশ দেয়। এই মহাজগতের এক কাল্পনিক চিত্রের ভিত্তি গড়ে দেয় এটা। কিছু বিজ্ঞানী আর প্রায় সকল দার্শনিকদের সম্মিলিত প্রয়াস ছিল এটা। কিন্তু ব্রিটিশ পদার্থবিদ জন বেল বেশ কিছু পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখান, ফলাফল সামাঞ্জস্যপূর্ণ না।
আপাতত ফলাফল! :
অনিশ্চয়তা তত্ত্বই বলবৎ রইল। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করার কোন ভিত্তি নেই। সুতরাং স্রষ্টাও পাশা খেলেন! তার খুশি মত গড়িয়ে দেন পাশার ছোট্ট কিউবটি। ইতস্তততা বিরাজমান সকল কনার অন্তরে!
.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।
# স্টিফেন হকিং এর ‘Does God Play Dice’ অবলম্বনে লিখিত।
# ২য় পর্বে থাকছে ‘ডিটারমিনিজম’ এর সংশোধন, স্রোডিঞ্জার এর ভূমিকা, ব্ল্যাক হোলের কনসেপ্ট এবং চূড়ান্ত ফলাফল!