মানুষের দেহের ক্ষয়পূরণ, পুষ্টিসাধন এবং দেহকে সুস্থ, সবল ও নীরোগ রাখার জন্য নানা ধরনের শাক-সবজি ও ফলমূল অতি প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য। এতে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান কমবেশি রয়েছে। তবে ফলমূল ও শাক-সবজিতে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন 'এ' ও 'সি' এবং ক্যালশিয়াম ও লৌহ থাকে। বিভিন্ন শিম জাতীয় সবজিতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন আছে। এজন্য শাক-সবজি ও ফলমূল মানুষের পুষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি শাক-সবজি ও ফলমূল দেহের রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই অধিক শাক-সবজি ও ফলমূল খেলে অনেক রোগ দূর হয় এবং শরীর সুস্থ থাকে। দামী মাছ-মাংস না জোটাতে পারলে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। আজকাল চিকিৎসা ও পুষ্টি বিজ্ঞানীরা শাক-সবজি ও ফলমূল খেয়ে দীর্ঘায়ু লাভের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
'নিউট্রিশন অ্যাকশন হেলথ লেটার'-এর এক ইসু্যতে ক্যান্সার প্রতিরোধে শাক-সবজি ও ফলমূল গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, শাক-সবজি ও ফলমূল 20 শতাংশ ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া শাক-সবজি ও ফলমূল হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র এবং অতিশয় স্থূলতায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ সব খাদ্যে ক্যান্সার বিরোধী রাসায়নিক পদার্থ থাকে। সমপ্রতি ব্রিটেন ও নিউজিল্যান্ডের গবেষকরা জানিয়েছেন, মাংসভোজীদের চেয়ে যারা শাক-সবজি বেশি খেয়ে থাকেন তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যর আশঙ্কা শতকরা 40 ভাগ কম। গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, যারা পর্যাপ্ত শাক-সবজি খেয়ে থাকে তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যর আশঙ্কাও কমে যায়। সুতরাং আমাদের পরিবারে বাবা, মা ও শিশুর খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং দেহকে সুস্থ, সবল ও নীরোগ রাখার জন্য প্রতিদিন বেশি করে শাক-সবজি ও ফলমূল খাওয়া একান্ত প্রয়োজন। শীতকালে আমাদের দেশে হরেক রকম শাক-সবজি পাওয়া যায় এবং দামও অনেক সস্তা থাকে। এখানে শীতের কয়েকটি শাক-সবজি ও লেবুজাতীয় ফলমূলের পুষ্টি ও অন্যান্য গুণাগুণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
পালংশাক: এটা আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক মানুষের একটা প্রিয় শাক। এ শাক আমাদের দেশে শীতের সময় প্রচুর পাওয়া যায়। পালংশাকে ভিটামিন-এ ভিটামিন-সি, ফলিক অ্যাসিড জাতীয় ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স থাকে। এ ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকার কারণে নিয়মিত পালংশাক খেতে পারলে হৃদরোগ, স্ট্রোক বা অঙ্গ অবশ, উচ্চ রক্তচাপ, চোখের ছানি, মাংসপেশীর দুর্বলতা এমনকি মানসিক ভারসাম্য হারানোর সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
পালংশাকের অন্য পরিচয় হলো এটা একটা লুটিন জাতীয় অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এর প্রধান গুণ হলো বয়স বেড়ে যাওয়াকে প্রতিহত করে। গাজরেও একই ধরনের অক্সিডেন্ট রয়েছে। প্রতিদিন সালাদ বা অন্য কোন উপায়ে গাজর ও পালংশাক এক সঙ্গে গ্রহণ করলে সোনায় সোহাগা। যে সব শাকের রঙ গাঢ় সবুজ (যেমন_পুঁই, কলমি, ডাঁটা, ঢেঁকি শাক) সেগুলোর মধ্যে গুটাথিয়ন নামে এক ধরনের উপাদান থাকে। গুটাথিয়ন শরীরে এনজাইম উৎপাদন করে যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে এগুলো কাঁচা খেতে পারলে বেশি উপকার হয়। আমরা যেভাবে ভেজে, পুড়িয়ে খাই তাতে এর গুণ অনেক কমে যায়।
ধনিয়া ও লেটুস: শীতকালীন শাকের মধ্যে ধনিয়া ও লেটুস শাকে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন (ভিটামিন-এ), ক্যালশিয়াম, লৌহ এবং ভিটামিন বি-1 (থায়ামিন), ভিটামিন বি-2 (রাইবোফ্লাবিন) প্রভৃতি রয়েছে। এ দুটি শাক সহজেই কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যায়। ফলে প্রকৃত পুষ্টিগুণ প্রায় পুরোটাই এক্ষেত্রে বজায় থাকে। বিশেষ করে ভিটামিন সি'র গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে।
বাঁধাকপি: এটাও একটা জনপ্রিয় শীতকালীন পুষ্টিকর সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ ও সি এবং ক্যালশিয়াম, ফসফরাস ও অন্যান্য খনিজ লবণ রয়েছে। বাঁধাকপিতে এক ধরনের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে। অ্যান্টি অক্সিডেন্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন বেরিয়ে যাওয়ার ফলে মহিলাদের স্তনে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে। এছাড়া অন্ত্র, মলদ্বার এবং পাকস্থলীর ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমায়। বাঁধাকপি শীতের সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং দামেও সস্তা।
টমেটো ও গাজর: টমেটো অতি প্রিয় ও পুষ্টিকর শীতকালীন সবজি। আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের গবেষকরা টমেটোর ওপর গবেষণা করে দেখেছেন যে, এতে রয়েছে এক ধরনের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যার নাম লাইকোপেন (খুপড়ঢ়বহ)। এই লাইকোপেন দেহকোষ হতে বিষাক্ত ফ্রির্যাডিক্যাল সরিয়ে প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ মূত্রথলি, অগ্নাশয় ও অন্ননালীর ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এ ছাড়া টমেটোতে থাকে ভিটামিন-সি, পি-কুমারিক অ্যাসিড ও ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড। এগুলোও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। আর শরীরের ক্যান্সার রোধ করে এগুলোই। গবেষকরা দেখেছেন, দৈনিক অন্তত একটা করে কাঁচা টমেটো খেলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা 60% কমে যায়। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখেছেন, যেসব পুরুষ তাদের খাদ্যের সঙ্গে দিনে কমপক্ষে দু'বার টমেটো স্যস গ্রহণ করেন, তাদের প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি যারা মোটেই টমেটো খান না তাদের তুলনায় শতকরা 21 থেকে 34 ভাগ কম। অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব মহিলার স্তন কোষে লাইকোপেন এবং অন্যান্য ক্যারোটিনয়েডের মাত্রা বেশি তাদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কম। বলা বাহুল্য, এরা লাইকোপেন সমৃদ্ধ এই টমেটো খাওয়ায় অভ্যস্ত। ইতালীর একদল গবেষক দেখেছেন, যেসব নারী-পুরুষ সপ্তাহে অন্তত 7 থেকে 8 বার টমেটো খান তাদের ক্ষেত্রে পাকস্থলী, কোলন ও বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। টমেটোকে খাওয়া যায় নানাভাবে, কাঁচা কিংবা রান্না করে, সালাদ, জ্যাম, জেলী, চাটনি কিংবা স্যস্ করে। তবে কাঁচা অবস্থায় খাওয়াই শ্রেয়। রান্না করলে বেশ কিছু ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়।
গাজরও একটি শীতকালীন অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি। এ সবজিতে 'বিটা ক্যারোটিন' নামে এক ধরনের জৈব রাসায়নিক উপাদান থাকে। বিটা ক্যারোটিন যাদের ইতোমধ্যে স্ট্রোক হয়েছে তাদের মধ্যে পরবর্তী স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা 50% হ্রাস করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সপ্তাহে পাঁচদিন মধ্যম আকারের একটা করে গাজর খেলে মহিলাদের স্ট্রোকের সম্ভাবনা হ্রাস করে এবং পুরুষদের 10% কোলেস্টেরল হ্রাস করে। গাজরে লুটিন জাতীয় অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। তাই প্রতিদিন একটি গাজর খেলে ফুসফুসের ক্যান্সারের সম্ভাবনা 50% হ্রাস করা ছাড়াও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের চোখের রোগ প্রতিহত করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গাজর কাঁচা অবস্থাতেও সরাসরি খাওয়া যায়, সালাদ হিসেবেও চমৎকার, তা ছাড়া সবজি হিসেবেও গাজর যথেষ্ট উপাদেয়। তবে কাঁচা অবস্থায় গাজর খাওয়া সবচেয়ে ভাল। কেননা কাঁচা গাজরে পুষ্টি উপাদাসমূহ বিশেষ করে ভিটামিন বি-1 এবং ভিটামিন 'সি' অক্ষুণ্ন থাকে এবং দেহের কাজে লাগে বেশি।
লেবু জাতীয় ফলমূল: কমলালেবু, পাতি লেবু, কাগজী লেবু এ শ্রেণীর অন্তভর্ুক্ত। লেবুজাতীয় ফলের (কমলাতে সবচেয়ে বেশি) ভেতর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট জরায়ুর মুখে, পাকস্থলী ও খাদ্যনালীতে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং রক্তের কোলেস্টেরল নাটকীয়ভাবে হ্রাস করে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত কমপক্ষে 30টি গবেষণা এ তথ্যের সত্যতা প্রমাণ করেছে। যার জন্য আমেরিকার ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এটাকে 'ঈড়সঢ়ষবঃব চধপশধমব ড়ভ বাবৎু পষধংং ড়ভ ধহঃরবপধহপবৎ রহযরনরঃড়ৎ' নামে আখ্যায়িত করেছে। লেবুজাতীয় ফলে ক্যারোটিনয়েড, টারপিনস ফ্লাভিনয়েড এবং ভিটামিন 'সি' প্রচুর পরিমাণে থাকে। পেয়ারাতেও প্রচুর ভিটামিন 'সি' থাকে। লেবুতে ফ্লাভিনয়েডের অবস্থান হচ্ছে খোসার নিচে সাদা পর্দাগুলোর মধ্যে এবং খোসার মধ্যে। এর অর্থ হচ্ছে শুধু লেবুর রস খেলে আমরা ফ্লাভিনয়েডের উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হব। অর্থাৎ লেবুর খোসা ক্যান্সার প্রতিরোধের সহায়ক। প্রতিদিন একটা বড় লেবু পুরোটা খেলে আমাদের শরীরের অনেক পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।
কাজেই আপনার ও শিশুর প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এ সব ফলমূল ও শীতের শাক-সবজি যাতে বেশি থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
সৌজন্যে: আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০