somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বাগান বিলাস
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়। আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

চিলেঘুড়ির অষ্টপ্রহর

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছোটকাল থেকেই আমার নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ হওয়ার শখ ছিল।
আমি যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমার সামনে
নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগও ছিল।

নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ খুব বড় মাপের কবি বা লেখক
এজন্য তাঁরা আমার অনুকরণীয় ছিলেন না
বরং তাঁরা ম্যাট্রিক পাশ না করেই বিখ্যাত হতে
পেরেছিলেন একারণেই তাঁরা আমার কৈশোরের
সব মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন।

আমি খুব ভয়ে থাকতাম ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসলেই
আমার সব আশাভরসা উবে যাবে। তখন আমার সামনে আর
নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ হওয়ার ন্যূনতম সুযোগ থাকবে না।
তখন আমার সামনে এগুবার আর কোনো দৃষ্টান্ত থাকবে না।
সত্যি বলতে কি-মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে ছেড়ে দিয়ে
কেউ বিখ্যাত হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত আমার একটাও জানা ছিল না।
মূলত আমি ম্যাট্রিক পাশ না করে, কম পরিশ্রমে
সত্যিকার অর্থেই একজন নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের মতো
বিখ্যাত ও স্বার্থক মানুষ হতে চেয়েছিলাম।

আমার দাদাজান ও আমার বাবা ছিলেন নজরুলের
মতোই প্রতিভাধর।
এবং তারা স্কুলে না গিয়েই দশগ্রামজুড়ে তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন।
আমার দাদাজান ছিলেন বিজ্ঞ ও সৎ। তিনি ছিলেন চার মেয়াদে
কাউন্সিলের মেম্বার।
আমার বাবা ছিলেন পরিশ্রমী কৃষক।
তিনি পদ্মার ইলিশের মতো ভালো উৎপাদক ছিলেন।
তিনি উৎপাদন করতেন টন-কে-টন ধান।

স্কুলের পড়ালেখা আমার মোটেই ভালো লাগতো না।
পড়ালেখা ছেড়ে শর্টকাটে বিখ্যাত হতে চাওয়ার
পেছনে এটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড়োসড়ো কারণ।
পড়াশুনা ছিল আমার কাছে এক দুঃস্বপ্নের নামান্তর।
বই খুললেই আমার সামনে যেন নাজিল হতো
কেটু পর্বতের গিরিখাত।
মৃত্যুসম সেই গিরিখাতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে
আমার পা ঠকাঠক কাঁপত।
আমি তাই বই খুলে প্রায় সাথেসাথেই বন্ধ করে ফেলতাম।
আর তক্ষুনি আমার বুকে জেট প্লেনের ককপিটের মতো
উদয় হতো এক সুরক্ষিত শান্তি।
আমি চোখ বন্ধ করে বরাবর সে শান্তি উপভোগ করতাম।

আমি প্রায়শ মাঠে যেতাম।
বাবার মতো নামকরা কৃষক হওয়ার চেষ্টা করতাম।
অথচ আমাকে নিয়ে বাবার এ বিষয়ে লেশমাত্র
উচ্ছ্বাস ছিল না।
পান্তাবেলায় মা বাবার জন্য মাঠে গামছায় বেঁধে
জলপান নিয়ে আসতো। সাথে কলসিতে পানি
এবং ঢোপপড়া আধাসেরি টিনের মগ।
আমি দেখতাম খেতে গরুর হাল দাঁড় করে রেখে
বাবা খুব তৃপ্তিসহকারে আইলের পাশে বসে আহার করছে।
আর তার চোখের আয়নায় খেলা করছে
সবুজ ধানখেতের ন্যায় এক বিসারিত পরিতৃপ্তি।

বাবার পাশে আমাকে দেখে মা তেড়ে আসতেন।
উদ্বিগ্ন হয়ে বলতেন,‘স্কুলে যা ছানোয়ার, বাবার মতো
জানোয়ার হইসনে, মানুষ হ’।
আমি বাবার নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম-
বাবা তো বিখ্যাতই। বিখ্যাতরা কি তবে মানুষ নয়?
আমার সমবয়সীরা তখনও একই মাঠে খণ্ডকালীন কৃষক
তারা তখনও নিজ নিজ খেতে শস্য বুনছে
অথবা জল সেচে মাছ ধরছে।
তাদের অবাধ স্বাধীনতার বিপরীতে সভ্যতার নামে মায়ের
ধনতন্ত্রকামী অনুশাসন আমার শখ-আহলাদগুলোকে পিষে মারত।
অনন্যোপায় হয়ে আমি টিয়ারশেল খাওয়া পাবলিকের মতো
চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরতাম।

একদিন খেত থেকে ফিরে দেখি
উঠোন ভর্তি মানুষজন। দাদাজান সালিশে বসেছেন।
আমাদের প্রতিবেশী লোকমান হোসেন রুবেলের পুকুরে
মাছ চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে।
পুকুরঘাটের জনৈক মাছরাঙা এর প্রধান সাক্ষী।
হঠাৎ সবার মুখে মুখে ফিসফিসানি-লোকমান, লোকমান।
ঘটনাটি যেন সবার মাঝে লোকমান হোসেনকে
নতুন করে খ্যাত করে তুলেছে।
তবে কুখ্যাতি বা খ্যাতি যাই হোক, লোকমান হোসেনকে
আমার খুব কাঁচা চোর মনে হলো।
এখানে দুটি বিষয় আমার ঠিক মাথায় ধরে না।
এক-পানি চুরি না করে
সে মাছ চুরি করতে গেল কোন দুঃখে?
জগতে পানির মূল্য কি মাছের চেয়ে কম?
দুই-আচ্ছা, চুরিকে কেন কাজের মর্যাদা দেওয়া হয় না?
আমরা কি কেউ চুরির বাইরে?
পক্ষ-বিপক্ষ ও সাক্ষীকে শুনে
দাদাজান ঘোষণা দিলেন, একশ বেত্রাঘাত।

রায় শুনে তখনই আমার চোখে ভেসে ওঠে
আমাদের পাড়ার স্কুলে ক্বারিহুজুর বেত নিয়ে
বারান্দায় ঘোরাফেরা করছেন।
তিনি হয়তো দাদাজানের হুকুম তালিম করতে
শীঘ্রই এখানে চলে আসবেন।

আমার খুব দুঃখ হয়
ইচ্ছে করলেই লোকমান হোসেন আমার দাদার চেয়ে
বেশি নামকরা কিছু হতে পারত। কারণ দাদাজান
নাম স্বাক্ষর পারলেও হোমারের
মতো লোকমান হোসেন কখনও স্কুলেই যায়নি।

আমার মা পিছন থেকে আমার কাঁধে চাপ দিয়ে
দাঁতে দাঁত পিষে চাপাকণ্ঠে বলে উঠলেন-
‘তোকে না কখন স্কুলে যাইতে কইলাম! তুই এখনও যাসনি?’
আমার আর সালিশ দেখা হয় না।

আমার সামনে বই খোলা।
আমার পা কাঁপছে, কপালে স্বেদবিন্দু।
ক্বারিহুজুরের নির্দেশে ক্লাসে দাঁড়িয়ে
আমি রামদেব যোগির মতো আমার হাত প্রশস্ত করে ধরি।
চুরি করে বই দেখে লেখার অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে
আমি চোখ ও দম বন্ধ করে
ক্বারিহুজুরের বেত চালানোর অপেক্ষায় থাকি।
সেসময় হঠাৎ আমার চোখে টেলিভিশনের
পর্দার মতো বাবার মুখ ভেসে ওঠে।
তার কী হবে কে জানে!
সে তো এবছর দক্ষিণের সব হাওয়া চুরি করে
তার ফসলগুলোকে খেতে দিয়েছে।
সাথে সাথে আমার লোকমান হোসেনের কথাও মনে পড়ে।
এতক্ষণে বেচারা নির্ঘাত বেত্রাঘাত খেয়ে
গোমড়া মুখে বাড়ি ফিরেছে। আর তার বউ-বাচ্চারা
ব্যথা উপশম করতে হয়তো সমানে তার গায়ে
কুসুম-গরম সরিষা তেল মালিশ করছে।
আমার চোখ খুলে হুজুরকে জিজ্ঞাসা করতে মন চায়
-আচ্ছা হুজুর, চুরিচামারি জিনিসটা কি খারাপ?
আর চুরি করলে সবাই কি শাস্তি পায়?

আমার হাতে বেত চালাতে চালাতে ক্বারিহুজুর বলতে থাকেন,
‘লোহা মরিচা পড়ে নষ্ট হলেও তাকে দিয়ে নুন বদল পাওয়া যায়।
গাধা কোথাকার! তোকে দিয়ে নুন বদলও হবে না।
তোর কপালে ম্যাট্টিক পাশ, সে অনেক দূরের কথা।’
আমি হুজুরের কথায় আশ্বস্ত হই। বেত্রাঘাতের ভয় ভুলে
প্রাণ খুলে ঠা-ঠা করে হেসে উঠি।
আমার চোখে বরফকণার মতো জমা হতে থাকে
খ্যাতির স্বপ্নবীজ-তবে কী সম্ভব? মারহাবা।
আামার পক্ষে সত্যিই কি নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ হওয়া সম্ভব?

না, স্বজনদের চাপাচাপিতে আমার আর তাঁদের মতো
বিখ্যাত হওয়া হয়নি। এমন কি বাবা-দাদাজানের মতো
দশ গ্রামের হাঁক-ডাকওয়ালা অলকনন্দাও হওয়া হয়নি।
উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সুতাকাটা চিলেঘুড়ির মতো
আমি আমার স্বপ্ন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
বাবার মৃত্যুর পর হাজারো মানুষের লোনা ঘামের ভিড়ে
আমি চিরতরে হারিয়ে যাই। নুন বদলের প্রতিযোগিতায়
শামিল হওয়ার সাহস আমার আর হয়নি।

বাবার মৃত্যুর পর আমি হই-ভিড়ের মানুষ,
লোকমান হোসেনের মতো বৃন্ত বিযুক্ত পতিতপ্রবণ এক
ফুলের পাপড়ি, মানুষ নামের কেবলই একটি সংখ্যা।
শেষবধি আমি হই-
সোনাডাঙ্গার এক অখ্যাত ছাপাখানার অকুল মুদ্রাকর।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:১৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×