আজ বাসার সবাই একসাথে খেলা (ICC) দেখছিলাম। অনেক দিন পর সবাই একসাথে। এমনিতে সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। বাকি সময় সবার হাতে যার যার মোবাইল ফোন। সরাসরি কথার চাইতে সবাই ফেইসবুকে কমেন্ট বক্স এ বেশি হয়।
মনে পরলো, একটা সময় ছিলো যখন আমাদের গ্রামে তিন- চার এলাকা মিলে একটি সার্কাস বা যাত্রাপালা হতো। সবাই মিলে যাওয়া হতো সেই যাত্রা আর সার্কাস দেখতে। আমি যেতাম বাবার হাত ধরে। তিন চার গ্রামের লোক একসাথে, একটা উদ্দেশ্যে। চেনা জানা হতো, কথা বার্তা হতো। বিনোদন সামাজিকতা একসাথে।
এলো টেলিভিশন। আনন্দ আর দেখে কে আমার! মিনা কার্টুন ছিলো আমার প্রিয়। শুক্রবারের সিনেমা আর আলিফ লায়লার কথা তো বলাই বাহুল্য। শুক্রবার এলে, টেলিভিশন বারান্দায় এনে রাখা হতো। উঠানে মাদুর মেতে দেয়া হত প্রতিবেশীদের জন্য। সবাই একসাথে একটা সিনেমা। মুখে পান নিয়ে পাড়ার চাচিরা মেতে উঠতেন সিনেমার শেষে নায়ক জসীম এর কী হবে, এসব নিয়ে। কী অদ্ভুত একটা সময়!
এলাকায় এলো বিদ্যুৎ। সাথে এলো ঘরে ঘরে টেলিভিশন। এখন আর কেউ কারো বাসায় গিয়ে টিভি দেখে না। আমাদের বাসার টিভিটা ছিলো দাদুর ঘরের ড্রয়িং রুম এ। আমাদের পরিবারে তখন সদস্য ১৭ জন। সবাই রাত ৮ টার খবর দেখতাম একসাথে। আর ফুপুদের সাথে বসে ছায়াছন্দ দেখাটা ছিলো আরেকটা প্রিয় কাজ। পারিবারিক মিলবন্ধন হয়ত একেই বলে।
এলাকায় এলো স্যাটেলাইট চ্যানেল। এক বাড়িতে একাধিক টিভি। কারো পছন্দ কার্টুন, কারো গানের চ্যানেল, কারো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, কারো নাটক। একই বাড়িতে বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন চ্যানেল। কোনমতে একসাথে রান্না খাওয়া শেষ করেই যার যার ঘরে দৌড়; যার যার টিভির সামনে।
বাড়ি ছেড়ে এলাম শহরে। কলেজ হোস্টেল অনেক ছাত্র একসাথে থাকতাম। একসাথে আড্ডা, গলা মিলিয়ে গান, পাল্লা দিয়ে পড়াশোনা। একজনের সমস্যা মানে সবার সমস্যা। কেউ বিপদে পড়লে সবাই মিলে ছুটতাম। মোবাইল ফোন তখনও হাতে হাতে পৌছায় নি। চলতো প্রেমিকার সাথে চিঠি বিনিময়। কতো চিঠি যে লিখে দিয়েছে বন্ধুদের হিসেব নেই। ইন্টারনেট ছিল তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যম। তখনও বিনোদন হিসেবে ইন্টারনেট জনপ্রিয় হয়নি। সকালে কে আগে সংবাদপত্র পরবে তা নিয়ে পাল্লা চলতো। ফেইসবুক এ ফ্রেন্ড ছিলো ৪০ জন; যার ৩২ জন ই ছিলো অপরিচিত বিদেশী।
কলেজ এর সীমানা পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম। মেস বাসায় আমরা ৪ জন। একসাথে থাকা, খাওয়া, আড্ডা, ঘোরাঘুরি, তাস খেলা, ছাদে গান গাওয়া। কোথাও কনসার্ট হলেই চলে যেতাম দল বেঁধে। বাংলা গান ইন্টারনেট এ পাওয়া যেতো না। সবাই মিলে একটা সিডি কিনতাম। বাসায় কম্পিউটার মাত্র একটা। পাড়ার সিডির দোকান থেকে ডিভিডি ভাড়া করে মুভি দেখতাম সবাই মিলে। ব্রডব্যান্ড ছিলো ১২৮ কেবিপিএস এর। মেইল দেয়া নেয়া চলতো তাতে।
মোবাইল ইন্টারনেট এলো। সবাই ইন্টারনেট এ আগ্রহী। তারপরও একসাথে থাকা হতো বিভিন্ন কাজে।
প্রযুক্তির বিস্ফোরণ ঘটলো হঠাত। সিম্বিয়ান কে পেছনে ফেলে এগিয়ে এলো এন্ড্রয়েড। হাতে হাতে ফোন। যার যার নিজের কম্পিউটারও এলো। সবার কানে হেডফোন। যার যার নিজের জগত। পার্সোনাল একটা জগত সবার; নিজের কাছে বন্দী। প্রেম ভালোবাসা, দুঃখকষ্ট সব যার যার। শেয়ার বলতে মোবাইল ফোন আর পার্সোনাল কম্পিউটার এর বেঁধে দেয়া জায়গাগুলো। মানুষগুলো মেকি হতে লাগলো।
সবাই আজ বেশিই হতাশ।আজ আর সহানুভুতি, সমানানুভুতির স্থান নেই ; সবই যেনো লোক দেখানো। প্রযুক্তি অনেক কিছুই দিয়েছে, বিনিময়ে কেঁড়ে নিয়েছে অনেক বেশি। এতোটাই বেশি যে তা থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। আমরা প্রযুক্তির সৃষ্টি করেছি আর আজ প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রন করছে আমাদের।