somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি

১৪ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজকের রাতটা অদ্ভুত। ঢাকাগামী বাসস্ট্যান্ডে বাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এখানে এত শোরগোল কিন্তু কেমন যেন নীরব। মাঝে মাঝে এমন লাগে। আমি সব সময় নাইট কোচে ঢাকা যাই, এতে পরদিন পুরোটা হাতে পাই। আর সব সময় A3 টিকিট কাটি, ড্রাইভারের পিছনের সিটটা। বাস ছাড়বে এখনি। কিন্তু ড্রাইভার আর সুপারভাইজারের মধ্যে ঝগড়া লাগছে। বিষয় হল কোথা থেকে তেল ভরবে। আমি তখন একটা সিগারেট জ্বালালাম। জানি, এই ঝগড়া ২-৩ মিনিটে থামবে না।

বাসের ঠিক সামনে এসে বাসের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি আর বাসের লেখা পড়তেছি। বাসের নাম সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস। S টা বড় করে ২ লাইনে লেখা, উপড়ের লাইনে বাকি Atkhira আর নিচের লাইনে Express. কোন কারণে উপড়ের লেখা কিছু মুছে গেছে, এখন মনে হচ্ছে সেক্সপ্রেস! এমন সময় বাস থেকে একটা মেয়ে নামল। এক পাশ থেকে বাইরের আলো আর উপর থেকে চাঁদের আলো মেয়েটার মুখে পড়ে এক ধরনের আভা ফুটে উঠছে। টি-শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার পরা, চুলে বেণী করে মাথার দুই পাশে ঝুলানো, কপালে কালো একটা টিপ - একেবারে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মত মেয়ে। চাঁদের আলোতে সব মেয়েদেরই সুন্দর লাগে। কেমন যেন ঘোর লাগা। ভাগ্যিস আমি প্রেমে পড়ি না, না হলে আজ আর উপায় ছিল না। মেয়েটি হেঁটে কাউন্টারের দিকে চলে গেল। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। তাকিয়ে থাকলে মায়া বাড়ে। মায়া অনেক আজব চীজ। মায়া আপনার হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আপনাকেই নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে।

আরো কিছুক্ষণ হেঁটে গাড়ীতে উঠলাম। আমার পাশের সীট এখনো খালি। আমি A1 এ বসে মোবাইল বের করে একটু পত্রিকা পড়তে লাগলাম। বাস ছেড়ে দিতে দিতে দরজা থেকে সেই মেয়েটা উঠল। আমি সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম মোবাইলের দিকে। সাবধান, মায়া বাড়ানো যাবে না। তখনই একটা মিষ্টি কণ্ঠের আওয়াজঃ

- ভাইইইইইইইয়া
(তাকিয়ে দেখি সেই মেয়েটা। মনে মনে বলতে লাগলাম অল ইজ ওয়েল, অল ইজ ওয়েল। আমি উত্তর দিলাম না।)
- ভাইইইইইইইইইইইয়া (আবার)
(সুন্দরী মেয়েরা ব্যাকরণের সাথে নিজেদের কিছু নিয়ম যোগ করে নেয়। যেমন স্বরবর্নের কার থাকলে সেটাকে লম্বা করতে হবে - শুনছওওওওওও, আমাকে দিতে হবেইইইইই হবে। তেমনই ভাইইইইইইইইইইইয়া)
- হ্যা, বলুন
- আমাকে একটু জানালার পাশে বসতে দিবেন?
- ফেরী ঘাটে আমি বাইরে যাব, যতক্ষণ বাইরে থাকব ততক্ষণ বইসেন
- না মানে, ওপাশে আমার ব্যাগ আছে তো, তাই
- ব্যাগটা তো বক্সে দিতে পারতেন
- আসলে ব্যাগে কিছু জিনিস আছে তো
- বলতে চাচ্ছেন যে আমার ব্যাগে কিছু নেই? খালি ব্যাগ বক্সে দিয়েছি?
- না আসলে একটু ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস তো
- আচ্ছা, ব্যাগ এপাশেই থাক, আপনি ওপাশে বসুন
- ভাইয়া, আমার কিন্তু বমির সমস্যা আছে
(বুঝেছি ভাঁওতাবাজি)
- সমস্যা নেই, আমার গায়েই করে দিয়েন পাইলে, তবু আমি ওপাশে যাব না

চাঁদের মত সুন্দর মুখে অমাবস্যার অন্ধকার নামিয়ে মেয়েটি আমার পাশে বসে পড়ল। সুন্দরী মেয়েরা না শুনে অভ্যস্ত না। যেখানে যা চায়, মোটামুটি পায়। তাই হটাত যখন না শুনে, তখন রাগে গজগজ করতে থাকে। মনে মনে আঁচড়াতে থাকে, সময় থাকে একটু লবণও ছিটিয়ে দেয়।

আমি কখনো জানালার পাশে ছাড়া বসি না। সব সময় আমি জানালা খোলা রাখি। শো শো করে মাথার পাশ দিয়ে বাতাস যায় - আমার খুব ভালো লাগে। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আমি চাই না এখন জোড়ে বৃষ্টি হোক। রিমঝিম বৃষ্টি মানুষকে উদাস করে দেয়। এক ধরনের রোমান্টিক বিরহ। যতোই রোমান্টিক হন, বুকটা একটু ভারী হয়ে আসে। আর পাশে সুন্দরী একটা মেয়ে রেখে বুকে বিরহের সুর তোলা অপরাধ। এমন সময় নীরবতা ভাঙ্গল।

- ভাইয়া, আপনার নাম কি?
- আদর। কেন বলেন তো?
- বাহ সুন্দর আর অদ্ভুত নাম তো
- হ্যা, আমার নাম যে, তাই
- আপনার নাম বলেই অদ্ভুত হতে হবে?
- শুধু অদ্ভুত না, সাথে সুন্দরও হতে হবে
- ওওওও। আপনি কি করেন?
- বেকার, আপাতত বৃষ্টি দেখি, আর প্রার্থনা করি যাতে জোড়ে না হয়। (ফ্রীল্যান্সিং করি এটা বোঝানোর মত প্যারা আর নাই, তাই বেকারই ভাল)
- আসলেই জোড়ে বৃষ্টি হলে ভয় ভয় লাগে গাড়ীতে
- আমার ভয় লাগে না, মন খারাপ হয়। আমি চাই না, এখন আমার মন খারাপ হোক। যদিও বৃষ্টি এখন থেমে গেছে, এখন প্রার্থনা করা বন্ধ করে দিব।
- ওহ আচ্ছা! আমার নাম জ্যোতি।
- অনেক সুন্দর নাম তো, কিন্তু আপনার মত না
(দুম করে তাকে কেউ সুন্দরী বলবে সেটা সে ভাবেনি। আমি জানি সে ভড়কে গেছে। সুন্দরী মেয়েদের ভড়কে দিলে চেহারাটা দেখার মত হয়। বাসের মধ্যে অন্ধকার বিধায়, দেখতে পারলাম না)
আমিই পাল্টা প্রশ্ন করলামঃ
- ব্যাগে করে কাচের জিনিস এনেছেন নাকি?
- আরে না। প্রথম বার একা ঢাকা যাচ্ছি। জগন্নাথ ভার্সিটিতে পড়ি আমি। তাই মা রান্না করে দিয়েছে। বক্সে দিলে শুনেছি ব্যাগ নাকি হারিয়ে যেতে পারে। ব্যাগ হারালে সমস্যা নেই, কিন্তু এই খাবারটুক হারালে আমার অনেক মন খারাপ হবে।
- আগে কার সাথে যেতেন? আগে সব সময় বাবা দিয়ে আসত। এবার বাবার শরীর টা একটু খারাপ। তাই একা যেতে হচ্ছে। বাসে আসার পড় শুনি বাবা আবার পরে কাউন্টারে চলে আসছে। তাই গিয়ে দেখা করে এসেছি।
- আপনার বাবা প্রতিবার আপনার সাথে ঢাকা যেতেন শুধু আপনাকে দিয়ে আসতে?
- হ্যা
- আপনি নিষেধ করেননি?
- করলে শুনে নাকি?
- আপনাকে অনেক ভালোবাসে, ওনাকে কষ্ট দিয়েন না কখনো।

বলেই আমি আবার জানালার দিকে তাকালাম। না, এই মেয়ের সাথে কথা বলা যাবে না। বৃষ্টি ছাড়াই আমার মন খারাপ হয়ে যাবে। এখন আমার ওর জন্য হিংসে হয়। ইচ্ছে করে থাপড়ে দাঁত ফেলে দেই। কত ভাগ্যবান! তার জন্য চিন্তা করার জন্য অন্তত পৃথিবীতে ২ জন মানুষ আছে। আমার আছে ১ জন, অন্যজন হারিয়ে গেছেন। জানালা দিয়ে বাইরে মাথা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। বৃষ্টি থেমে আকাশটা আবার একদম ঝকমকে পরিস্কার। হাজার হাজার তারা। এত এত তারার ভীড়ে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই তারাটা - হারিয়ে যাওয়া একজন - বাবা। অনেক তারার মাঝে সে ওই তারাটা খুঁজে পায় না। তার বিশ্বাস, একদিন সে ঠিকই খুঁজে পাবে।

জানালার বাইরের শো শো করে যাওয়া বাতাস অনেক ধুলো উড়ানোর সাথে সাথে মুছে দিয়ে যায় দেবার চোখের কোণে জমে আসা কয়েক ফোটা অশ্রু।

মানুষের জীবনে যতদিন বাবা থাকে, ততদিন তাকে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয় বলে আমার মনে হয়না। বাবা হল মাথার উপরে বিশাল এক ছাতা। ছাতার সাথে তুলনা করার কারন এই যে, যখন লাগত শুধুমাত্র তখনই আমরা বাবাকে স্মরন করি। অথচ বাবা সবসময় মাথার উপরে ছায়া হয়ে থাকে। বাবা থাকতে আমি কোনো দিনও কিছু নিয়ে চিন্তা করিনি। এটা লাগবে, বাবা আছে। সেটা লাগবে, বাবা আছে। কিছু হয়েছে, বাবাকে বলি - একটা সমাধান ঠিক ই পাব।

বাবা সরকারী চাকুরি করতেন। রিটায়ারমেন্টে যখন আসেন, তখন অল্প কিছু টাকা আমাদের সংসারে নিয়ে আসেন। এ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যাথা নেই। কারন সারাজীবন সব টাকা আমাদের ২ ভাই বোনের জন্যই খরচ করে গেছেন। আমাদের পড়াশুনার জন্য কখনো কার্পন্য করেননি। আমি জীবনে কখনো জানতে চাইনি, তার কত টাকা আছে, আমাদের বাড়ীতে কি পরিমান জায়গা-জমি আছে, আমি কি পরিমান পাব - ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাবা মারা যাবার পরে যখন একে একে সব আমার ঘাড়ে এসে পড়তেছে, তখন আমি বুঝলাম - আই এম রিয়েলি নট রেডি ফর ইট। কিন্তু, আমি বুঝতে পারিনা, কিভাবে তিনি এক হাতে সব সামলে নিতেন।

বাবা কখনো নিজের জন্য কিছু করেননি। কখনো নিজে থেকে ভাল শার্ট-প্যান্ট বানাতেননা। মাঝে মাঝেই আমরা জোরাজুরি করে কিছু বানিয়ে দিতাম। স্যান্ডেল ছিরে গেলে, নতুন না কিনে আগে যেত মুচির কাছে, সেলাই টেলাই করে আরো কয়েকদিন চালানো যায় নাকি। আমার ভাল একটা চাকুরি হবার পরেও তিনি খুবই সাধারন জীবন যাপন করতেন। আমি একবার তাকে একটা ঘড়ি কিনে দেবার পরে কি যে রাগ করেছিলেন - "আগে নিজের পায় দাড়া, তারপরে আমাকে দিস"।

আফসোস, যে সময়টা ছিল তার জন্য আরামে কাটানোর, নির্বিঘ্নে কাটানোর, পায়ের উপরে পা তুলে দিন পার করার - তখনই তিনি চলে গেলেন। যেই দিন তাকে সমাধিস্থ করা হয়, সেই দিন তার ঢাকায় এসে ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসার জন্য ফাইল জমা দেবার কথা ছিল। তার খুব ইচ্ছে ছিল, ভারতের কয়েকটা জায়গা ঘুরে আসার, বিশেষ করে কাশ্মীর। আর আমারও যেহেতু সামর্থ ছিল, আমিও বেশ আনন্দিত ছিলাম, প্রথম বারের মত বাবার খুশির জন্য কিছু করতে পারব এই ভেবে।

বিধি বাম। প্রথম বারের মত বাবার ইচ্ছেমত খুবই আনন্দের দিনগুলো কাটানো আর হল না। আমারও প্রথম বারের মত বাবার জন্য কিছু করার সাধ আর মিটল না।

সত্যি - মানুষের কিছু সাধ কখনো পুরণ হয়না।

যাদের বাবা-মা আছে, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, সময় থাকতে মর্যাদা দিন। যখনই সময় - সুযোগ পান, তাদের জন্য কিছু করেন। সময় চলে গেলে, কেদেও কূল পাবেন না !!!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১২:০৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×