বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানিদের মধ্যে বিতর্ক খুবই সাধারন ব্যাপার। এমন কোন আবিস্কার নাই যেটা নিয়ে প্রথমে বিতর্ক হয় নি। প্রত্নতাত্বিক জগতেও এই বিষয়টার কমতি নেই। বরঞ্চ প্রত্নতাত্বিক জগতে এগুলো আরো দুই ধাপ বেশি। এখানে যে কোন কিছু আবিস্কৃত হলেই আগে সেটা নিয়ে ব্যাপক মাত্রায় বিতর্ক হয় তার পরে যথেস্ট তথ্যপ্রমানের ব্যাবস্থা হবার পরেই সেগুলো ইতিহাস এর পাতায় স্থান পায়। এরকমই কিছু প্রত্নতাত্বিক বিতর্কিত আবিস্কার নিয়ে আলোচনা করবো যা নিয়ে দির্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে বিজ্ঞানিদের মধ্যে।
২৫) Nefertiti Bust
প্রচীন মিশরের রানি নেফারতিতিকে চেনেনা এমন মানুষ খুব কমই আছে। ইনি ছিলেন ফারাও সম্রাট Akhenaten এর স্ত্রি। সম্রাট এর মৃত্যুর পরে তিনি মিশরের ক্ষমতায় বসেন। নেফারতিতিকে মানুষ সবচেয়ে বেশি চেনে তার অসাধারন সৌন্দর্যের কারনে। তিনি তৎকালিন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরি মহিলা ছিলেন বলেই সবাই এক বাক্যে মেনে নেয়। কিন্তু একটি বিষয় নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে ইতিহাসবিদ এবং আর্কিওলজিস্টদের মধ্যে্ আর সেটি হচ্ছে তার একটি মুর্তি।
এই মুর্তিটি আবিস্কৃত হয় ১৯১২ সালে একদল জার্মান আর্কিওলজিস্টদের দ্বারা মিশরের Thutmose নামক এক প্রাচীন ভাস্করের ঘরের মধ্যে। ধারনা করা হয় এই ভাস্কর্যটি Thutmose 1350 খ্রিস্টপুর্বে নির্মান করেন। কিন্তু মার্কিন বিজ্ঞানিরা কিছুতেই বিষয়টা মানতে চান না। কারন তাদের ধারনা জার্মানরা নিজেদেরকে বিখ্যাত করার জন্য এটিকে নিজেদের হাতে রিমডেলিং করে বর্তমানের এই অবস্থায় আনে। যদিও পরবির্তিতে কিছু কার্বন টেস্টের মাধ্যমে বিষয়টির কিছুটা সুরাহা হয় কিন্তু আজও বিতর্কটি থেকেই গেছে।
২৪) Spanish Hill
এটি আমেরিকার পেনিসেলভিনিয়া রাজ্যে অবস্থিত একটি রহস্যময় প্রচীন প্রত্নতাত্বিক স্থাপনা। মুলত এটি একটি ২৫০ ফিট উচু মানুষ্য নির্মিত পাহার যাতে ছিল জীবন যাপনের সবধরনের উপকরন। পাহারটি খোরার পরে বিজ্ঞানিরা অবাক হয়ে যান এই দেখে যে এই পুরো পাহাড়টি সরাসরি মানুষ নির্মিত। মানে কাছেই যে নদীটি রয়েছে সেটির তলাতে পাওয়া নুরি এবং কংকর দ্বারা পুরো পাহাড়টি নির্মান করা হয়েছে। তাছারা পাহারের চারিপাশে দারুন একটা পরিখা খনন করা হয়েছে। কিন্তু বিতর্কের স্থানটি হচ্ছে কারা এটি নির্মান করেছে আর তাদের ভাগ্যে কি হয়েছিল। বিশেষ করে মার্কিন প্রত্নতত্ববিদরা বলেন এটি সুপ্রাচিন কালে এখানকার একদল বসতি স্থাপনকারিরা নির্মান করেছিল বসাবাসের জন্য।
কিন্তু অন্যান্য প্রত্নতত্ববিদরা বলেন এটি রেড ইন্ডিয়ানদের একটি প্রসাসনিক কেন্দ্রস্থান ছিল যেখানে একটি প্রাসাদ সহ পুরো একটি ছোট খাট শহর ছিল। পরিখাটি প্রমান করে তারা এগুলো নির্মান করেছিল শহরকে আক্রমনের হত থেকে ডিফেন্স করার জন্য। ধারনা করা হয় আমেরিকানরা যে কয়েক কোটি রেডইন্ডিয়ান হত্যা করেছিল তার একটা দালিলিক প্রমান ছিল এই পাহড়টি। তাই তারা এই পুরো পাহাড়টি ধংস্ব করে দেয় আরো ৩ শত বছর আগে। যদিও এখনো এখানকার মাটির তলা রেডইন্ডিয়ানদের ব্যাবহৃত জিনিষপত্র পাওয়া যায়। এবং ইন্টারনেটে এই পাহাড় সম্পর্কিত কোন লেখালেখিই আমেরিকানরা মোটেই সহ্য করে না।
২৩) Tikal Temple 33
এটি একটি মায়ান টেম্পল বা মন্দির। মায়ানরা এই মন্দিরটি নির্মান করে ৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে মানে আজ থেকে আরো ১৬০০ বছর আগে। এটি বর্তমানে গুয়েতামালা নামক দেশে অবস্থিত। মায়ান এই মন্দিরটি মুলত নির্মান করা হয় একটি অন্তস্টক্রিয়ার স্থান হিসাবে। যেখানে মৃতদের নিয়ে আসা হত। প্রায়ই এখানে জিবিত মানুষ মেরে তাদের বলি দিতো মায়ানরা তাদের দেবতাদের তুস্ট করার জন্য।
প্রন্ততত্ববিদদের মধ্যে বিতর্ক কিন্তু এটার উৎপত্তি বা এটা উদ্দেশ্য নিয়েও না। তাদের বিতর্কের স্থানটা হচ্ছে এই মন্দিরটা ধংস্ব করা নিয়ে। মুলত গল্পটা হচ্ছে এই মন্দিরের নিচেই অবস্থিত ছিল তৎকারিন মায়ান রাজা Siyaj Chan K'awiil II এর সমাধি। মুলত এই সমাধিটাই মন্দিরটার ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। আমেরিকান আর্কিওলজিস্টরা মুল মন্দিরটা ভেঙে ফেলেন এই সমাধিটাতে ঢোকার জন্য। এবং এখানেই বাধে বিপত্তি। পুরো পৃথিবীর সকল বিজ্ঞ আর্কিওলজিস্টরা এর জোর প্রতিবাদ করেন কারন যারা ভেঙেছিল তারা আর নতুন করে সেই মন্দিরটিকে আগের স্থানে ফিরাতে পারেনি। কিন্তু আমেরিকনরা কখনো কি কারো কথা শুনেছিল??
২২) Grolier Codex
এটি একটি মায়ান হাতে লিখিত বই যা পাওয়া গিয়েছিল বিংশ শতাব্দির শুরুতে মেক্সিকোতে। কোন এক অখ্যাত পর্যটক তৎকালিন সময়ে মেক্সিকোতে ঘুরতে গেলে তিনি এই বইখানা আবিস্কার করেন। কিন্তু দির্ঘদিন তিনি এটিকে নিজের কাছে রেখে দেন। পরবর্তিতে একজন মায়ান সভ্যাতা গবেষকের চোখে এটি পরলে তিনি বইটিনিয়ে একটা আলাদা গবেষনা পত্র প্রকাশ করেন। আর তখনই মুলত এই বইটি মানষের গোচরে আসে। বইটি চামরার উপরে প্রাকৃতিক কালি ব্যাবহার করে লিখিত। মজার বিষয় হচ্ছে এই বইটার বিভিন্ন পেইজে মায়ানদের প্রযুক্তি সাথে যে ভিনগ্রহের প্রানিদের যোগাযোগ ছিল সেটার উপর জোর দেয়া যায়। বিশেষ করে কিছু পেইজে তো সরাসরি ভিনগ্রহে প্রানিদের ছবিপর্যন্ত আকা রয়েছে।
তবে এখানে অনেক প্রত্নতত্ববিদরা আপত্তি জানিয়েছেন। তাদের ধারনা বইটি পুরোপুরি ভুয়া। অর্থাৎ ওই ব্যাক্তি বইটি নিজের হাতেই বানিয়েছেন। তবে বিষয়টি প্রমান করার জন্য তারা আসল বইটি ওই ব্যাক্তির কাছথেকে নিয়ে মেক্সিকোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা কিছুদিন আগে পরিক্ষা নিরিক্ষা চালান। তারা রংএর ব্যাবহার এবং চামরার আসল বয়স নির্ধারন করতে গিয়ে হতবাক হয়ে যান কারন এগুলো সত্যি সত্যি মায়ান আমলেরই সাক্ষ্য দেয়। তবুও এখন পর্যন্ত অনেক বিজ্ঞানিই এই বইটিকে আসল মানতে নারাজ। বিশেষ করে আমেরিকান বিজ্ঞানিরা।
২১) Repatriation and reburial of human remain
এই বিষয়টা একটু জটিল এবং একটু বেশিই বিতর্কিত। বিষয়টি হচ্ছে বিশ্বের হাজার খানেক বিখ্যাৎ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত অবস্থায় থাকা বিভিন্ন আদিম এবং বিখ্যাৎ মানুষের দেহাবশেষগুলোকে আবার তাদের নির্দিস্ট স্থানে পুনঃসমাধিত করা। এই বিষয়টা প্রথম দাবি জানিয়ে সবার সামনে আনে উত্তর আমেরিকার আদিবাসি সম্প্রদায়গুলো এবং অস্ট্রোলিয়ার আদিবাসিরা। তাদের বক্তব্য ছিল যে কিছুতেই আমাদের পুর্বপুরুষদের দেহাবশেষ কে অসম্মানিত হতে দেব না। কিন্তু বিষয়টা মিউজিয়ামওয়ালারা মোটেই পাত্তা দেননি। উপরুন্তু বিষয়টা নিয়ে তারা আর্কিওলজিস্টদের ব্যাখ্যা চান।
আর্কিওলজিস্টরা বিষয়টা নিয়ে পুরোপুরি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পরেন। এক পক্ষ বলেন এটাই সঠিক যে এইসব মৃতদেহের অংশগুলো স্ব স্ব স্থানে আবার পুনরায় স্থানান্তর করা হউক কারন এগুলো ওই সব মানুষের পুর্বপুরুষ এবং তারা এটাকে সম্মান করে। আবার অনেক আর্কিওলজিস্ট বিষয়টা নিয়ে বলেন যে এগুলো যেহেতু বিভিন্ন ঐতিহসিক বিষয়ের অংশ তাই এগুলো মিউজিয়ামেই থাকবে। বিষেশ করে যেহেতু এগুলো আধুনিক দেশগুলোতে টুরিস্ট আকর্ষনের এবং ব্যাবসার একটা অংশ তাই দ্বিতিয় মতটাকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমার নিজস্ব মতামত হচ্ছে এগুলো আসলেই ফেরত দেয়া উচিত এবং পুনরায় এদেরকে স্ব স্ব সমাধিতে সমাধিত করতে দেয়া উচিত।
২০) Treasure hunting
এই বিষয়টা আরো একটু জটিল। বিষয়টার শুরু হয় যখন আমেরিক সহ বেশ কিছু দেশের সরকার সরাসরি ট্রেজার হান্টিং বা গুপ্তধন খোজার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই আইনের মধ্যে যেটা থাকে তা হচেছ কোন গুপ্তধন বা দামি কোন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়ার আশায় কোন প্রাচীন স্থাপনাতে কোন ধরনের খোরাখুরি এবং খোজ চালানো যাবে না। যদি কোন খোরাখুরি করতেই হয় তবে সেটা সরকারি ভাবে করতে হবে।
বিষয়টা নিয়ে আর্কিওলজিস্টদের মধ্যে ব্যাপক দ্বিমত পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ আর্কিওলজিস্টরা মনে করেন এই আইনের জন্য প্রত্নতাত্বিক নিদর্ষন খোজার গতি অনেক মন্থর হয়ে গিয়েছে। কারন যেহেতু এই আইনের কারনে গুপ্তধন খোজ কারিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ফলে অনেক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনও আর আবিস্ক্রিত হচ্ছে না। উনিশ শতকে শুরুতে প্রচুর প্রাচিন নিদর্শন আবিস্ক্রিত হতে থাকে। কারন হচ্ছে গুপ্তধন খোজকারিরা গুপ্তধন খুজতে গিয়ে এগুলো বের করে ফেলতেন। কিন্তু এখন এই আইনের কারনে আর গুপ্তধনও খোজ করা হয় না ফলে নতুন কোন গুরুত্বপুর্ন প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনও বের হয় না।
১৯) Piri Reis Map
Piri Reis ছিলেন একজন মুসলিম অটোমান সামরিক কর্মকর্তা। তিনি মুলত মহাপরাক্রমশালি অটোমান নৌবাহিনির একজন এডমিরাল এবং নেভাল আর্কিটেক্ট ছিলেন। মুলত তার প্রধান দক্ষতা ছিলো শক্তিশালি অটোমান নৌবাহিনির নেভিগেশন বা পথপ্রদর্শন করা। যেহেতু তৎকালিন সময়ে মানে ১৫২০ এর দিকে এখনকার মতন জিপিএস বা স্যাটেলাইট ছিল না তাই নৌবাহিনির জাহজগুলোকে হাতে তৈরি ম্যাপের উপরে নির্ভর করতে হত। কিন্তু সেই ম্যাপগুলোও একেবারে সঠিক ছিল না। বিভিন্নধরনের ভুল ছিল কারন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা না থাকাতে নির্ভুল ম্যাপ তৈরি করা সম্ভবও ছিল না।
মজার বিষয় হচ্ছে Piri Reis এমন একটা ম্যাপ তৈরি করেছিলেন যেটা একেবারে নির্ভুল ছিল। এতটাই নির্ভুল ছিল যে প্রত্যেকটা বন্দর এর অবস্থান এবং পুরো আফ্রিকা উপকুলের প্রত্যেকটা খানাখন্দ পর্যন্ত নির্ভুল ভাবে উঠে এসেছিল। ম্যাপটা এমনভাবে অংকিত হয়েছিল যে মনে হবে কেউ একজন আকাশে বসে গোলাকার পৃথিবীটার প্রত্যেকটা অংশ নির্ভুলভাবে একেছিলেন। প্রত্নত্ববিদদের মধ্যে দুইটা বিষয়ে দ্বিমত। একটা হচ্ছে আসলেই কি এটা Piri Reis এর হাতে তৈরি নাকি ভুয়া। আর একটা বিষয় হচ্ছে যদি তিনিই একে থাকেন তবে তিনি অবশ্যই পৃথিবীকে গোলকারা ভেবেছিলেন।
যেটা তৎকালিন সময়ে একটা হাস্যকর ভাবনা ছিল। এমনকি খ্রিস্টানধর্মে পৃথিবীকে গোলাকার ভাবা ছিল মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়ার মতন অন্যায়। তবে কিছুদিন আগে এই কাগজগুলোর কার্বটেস্ট করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে যে আসলেই এটা ১৫০০ শতকে অংকিত। কিন্তু বিজ্ঞানিদের ভাবনায় আসেনা তিনি পৃথিবীকে গোল ধরে যদি এই ম্যাপটি একে থাকেন তাহলে কেন তিনি সেই ধারনা পুরো পৃথিবীকে জানাতে চাননি। তাহলে তো পৃথিবী আরো অনেকখানি এগিয়ে যেত।
লেখাটি ভালো লাগলে আমার ফেসবুক আইডিতে ঘুরে আসতে পারেন। আমন্ত্রন রইলো।
আমার ফেসবুক আইডিতে যেতে এখানে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:২১