somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের মুদ্রাপ্রভুরা ১

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৃথিবী আজ পুঁজিপতিদের দখলে। তারা প্রতিনিয়ত মানুষকে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর বানিয়ে যাচ্ছে। এই শোষণযন্ত্রের পিস্টন-সিলিন্ডার হল মুদ্রা ও ব্যাংকিং। পশ্চিমা দেশগুলোতে মুদ্রা ছাপানো ও ব্যাংকিং ব্যাবসা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রাইভেট কিছু প্রতিষ্ঠান যেগুলোর মালিকানায় আছে মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতি। যাদের বিত্ত সাধারণের পক্ষে অচিন্তনীয়।

মুদ্রা ছাপানো আর তার বণ্টনের মনোপলি নিয়ন্ত্রণে থাকা মানে প্রকৃতপক্ষে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে থাকা। টাকা এমনই এক পণ্য যার চাহিদা অসীম, জোগানে সবসময় স্বল্পতা। আপনি যখন এমন একটা পণ্যের উৎপাদনের একচেটিয়া ক্ষমতা রাখবেন তখন আপনার ক্ষমতা হবে ভয়ংকর। আপনি বিশ্ব রাজনীতি থেকে শুরু করে সবকিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন।

পশ্চিমা বিশ্বের ইতিহাসের দিকে একটু খেয়াল করে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় এই মুদ্রাব্যাবস্থা আর ব্যাংকিং এর সুদের কারবারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এ হেন কোন কাজ নেই যা তারা করেনি। আর তাদের এই কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দিতেও তারা যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। সব যুগেই জনপ্রিয় মিডিয়া কে নিজেদের দখলে রেখে, বুদ্ধিজীবী পুষে, তারা আমাদের অজ্ঞতায় রাখতে সচেষ্ট।

এই সিরিজে পশ্চিমা বিশ্বের মুদ্রা ও ব্যাংকিং এর এড়িয়ে যাওয়া ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে। অবশ্যই অধমের সল্প জ্ঞানে যথাসাধ্য সরল ভাষায়।

কোথা থেকে শুরু হল এই টাকা ছাপানোর বুদ্ধি? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে ২০০০ বছর আগে যিশু খ্রিষ্টের সময়ের ইউরোপে, চিনতে হবে প্রাচীন মুদ্রা ব্যাবসায়ি দের।

ঐ সময়ে ইহুদীরা জেরুজালেমে আসত তাদের উপাসনালয়ের কর পরিশোধ করতে। সমস্যা ছিল যে তারা সেই কর পরিশোধ করতে পারত শুধুমাত্র বিশেষ এক মুদ্রায়। তার নাম ‘half shekel of the sanctuary’। আধা আউন্স রুপায় তৈরি এই মুদ্রা ছিল ওজনে সঠিক আর তার গায়ে পাগান শাসকের ছবি ছিল না। তাই ইহুদীরা মনে করত যে এটাই ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য।

কিন্তু তখন বাজারে আরও অনেক মুদ্রা চালু ছিল এবং আধা শ্যাকল বাজারের প্রধান মুদ্রা ছিল না। মুদ্রা ব্যাবসায়িরা উপাসাল আশেপাশে দোকান খুলে বসত এখনকার মানি এক্সচেঞ্জ এর মত। পার্থক্য হচ্ছে তখন আলু পটোলের মত দরদাম করে মুদ্রা বেচাকেনা হত। সম্মিলিতভাবে কাজ করে ঐ মুদ্রা ব্যাবসায়িরা এমন ভাবে বাজার থেকে ঐ মুদ্রা সরিয়ে ফেলতে লাগল যাতে এসময় এমন অবস্থা দাঁড়াল যে ঐ মুদ্রা তাদের কাছে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। তখন তারা ঐ মুদ্রার দাম বাড়াতে থাকল আর বিশাল মুনাফা লুটতে থাকল।

এমতাবস্থায় জেরুজালেমে যিশুর আগমন ঘটে। যিশু ও তার অনুসারীরা পুরো ব্যাপারটা বন্ধ করেন। কিন্তু মুদ্রাব্যাবসায় এই মানুষ ঠকানোর সংস্কৃতি থেকেই যায় যা পরে মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের স্বর্ণকারদের হাতে পরিপূর্ণ রূপ পায়।

১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইংল্যান্ডে মুদ্রা তৈরির কাজ করত স্বর্ণকাররা। সেই সাথে তারা ছিল প্রথম ব্যাংকার। মানুষ নিজেদের স্বর্ণ ঐ স্বর্ণকারদের সিন্দুকে জমা রাখত নিরাপত্তার খাতিরে। স্বর্ণকাররা সেই জমার বিনিময়ে কাগজের রসিদ দিত।

পশ্চিম ইউরোপ প্রথম চালু হওয়া কাগজের মুদ্রা আসলে কিছুই না ঐ স্বর্ণকারের দেওয়া স্বর্ণ জমা রাখার রসিদ। মানুষ সরাসরি সোনার বদলে ঐ রসিদ দিয়েই লেনদেন করা শুরু করল। ভারি সোনা বহন করা যেমন কঠিন, গোনাগুনি ঝামেলা, নিরাপত্তা এসবই ছিল এই চল শুরু হওয়ার প্রধান কারণ। লেনদেন হত রসিদের গায়ে নতুন মালিকের নাম লিখে আগের মালিকের সাক্ষর দিয়ে। আমরা একে এন্ডোর্স করা বলি।

কিন্তু এ রকম বার বার সই দিয়ে লেনদেন করার ঝামেলা এড়ানোর জন্য স্বর্ণকারেরা ‘to the bearer’ অর্থাৎ ‘চাহিবা মাত্র বাহককে’ লিখে রসিদ দিতে শুরু করল। এতে লেনদেন সহজ হল বটে কিন্তু কার সোনা এখন কার কাছে গেল তা বোঝার আর কোন উপায় থাকল না। অর্থাৎ আসল সোনার সাথে কাগজের রসিদ চিরদিনের জন্য তার সম্পর্কচ্ছেদ করল। সেই সাথে ঐ স্বর্ণকারদের হাতে তুলে দিল মানুষকে শোষণ করার মোক্ষম অস্ত্র।

কিছুদিনের মধ্যেই তারা বুঝে ফেলল যে খুব কম মানুষই তাদের কাছে আসছে জমা রাখা সোনা তুলতে। মানুষ ঐ রসিদ দিয়েই কাজ চালাচ্ছে। তখন তারা নিজেদের কাছে থাকা গ্রাহকদের স্বর্ণ মানুষকে ঋণ দিতে থাকল এবং সুদের মাধ্যমে টাকা কামানো শুরু করল। তারা স্বর্ণকার থেকে হয়ে গেল সুদের কারবারি।

কিন্তু এই লোভীর দল আরও কিছুদিনের মধ্যে এটাও আবিষ্কার করে ফেলল যে তাদের স্বর্ণ ধার দেওয়ার দরকার নেই, রসিদ ধার দিলেই লোকে খুশি, কারণ তাই দিয়েই বাজারে কাজ চলে। সুতরাং শুরু হয়ে গেল ইচ্ছামত রসিদ ছাপানো। একসময় দেখা গেল ঐ স্বর্ণকার ওরফে সুদের কারবারি নিজের সিন্দুকে জমা থাকা স্বর্ণের ৫ গুণ এমনকি ১০ গুণ পর্যন্ত রসিদ বানিয়ে ধার দিয়ে বসে আছে। এবং এই জোচ্চুরির মাধ্যমে মানুষ ঠকিয়ে তারা বিশাল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া শুরু করল।

কিন্তু এই দুর্নীতি আজ আর দুর্নীতি নেই। এটা এখন একটা আইনসিদ্ধ কাজ। প্রতিটা ব্যাংক তার গ্রাহকের জমাকৃত টাকার ৯০% ঋণ হিসেবে দিতে পারে। কিন্তু এই ঋণ তারা গ্রাহকের টাকা থেকে দেয় না। ঋণ গ্রহীতার একাউন্টে টাকাটা খালি কলম দিয়ে লিখে যোগ করে। কিন্তু ব্যাংকের ডিপোজিট থেকে টাকাটা বিয়োগ করে না। মানে পুরো টাকাটাই তৈরি হয় কাগজে কলমে কোনপ্রকার সত্যিকারের সম্পদের বিনিময়ে না। ব্যাংক সুদ খায় সম্পূর্ণ গাছ থেকে পাড়া টাকায়। (আরেকটু বিস্তারিত এখানে অথবা গুগল এ গিয়ে Fractional Reserve Banking লিখে চিপি দিন) আর যেহেতু ব্যাংক ঋণের ওপর পুরো অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে এই সুদের বোঝা গিয়ে চাপে শ্রমিক আর ভোক্তার ওপর। আর এইভাবেই পুঁজিবাদ মানুষকে শোষণ করে নিঃস্ব করে ছাড়ে। মুষ্টিমেয় লোকের কাছে থাকে টাকার গাছ আর বাদবাকিদের ওপর থাকে সেই টাকার ঋণের বোঝা।

এই আইনসিদ্ধ জোচ্চুরি এখন এমন যায়গায় পৌঁছেছে যে কোন আধুনিক ব্যাংকের কাছেই আজকাল তার কাগজে কলমে জমাকৃত টাকার ৩% এর বেশি ক্যাশ থাকে না। অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট সময়ে একসাথে ৩% এর বেশি গ্রাহককে তারা কখনোই সামলাতে পারে না। পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন ব্যাংক দেউলিয়া, শেয়ার বাজার ধস, কিংবা মন্দা এসবের কারণও এটাই।

ফিরে আসি মধ্যযুগের সুদের কারবারিদের কথায়। ঐ চতুর ব্যাবসায়িরা ওইখানেই থেমে থাকেনি তারা আবিষ্কার করে ফেলে পুঁজিবাদের ভয়ংকরতম অস্ত্র – Business Cycle। তারা টের পায় যে কিছুদিন পরপর হঠাৎ ধার দেওয়া থামিয়ে দিলে বা খুব কমিয়ে দিলে প্রতিবার কিছুসংখ্যক মানুষ ঋণ শোধ করতে পারেনা। কারণ জটিল ঋণনির্ভর অর্থনীতিতে একজনের ঋণ শোধ প্রায় সবসময়ই আরেকজনের ঋণ পাওয়ার ওপর নির্ভর করে। যেমন কৃষকের ঋণ শোধ নির্ভর করে চালকল মালিকের ঋণ পাওয়ার ওপর। এখন যারা ঋণ শোধ করতে পারেনা তারা নিজেদের সহায় সম্পত্তি হারায় ঐ সুদের ব্যাবসায়িদের হাতে।

এই চরমতম দুর্নীতিটাও এখন আইনসিদ্ধ। এটা এখন করা হয় ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে কমিয়ে। সুদের হার কম তো ঋণ সহজলভ্য, বেশি তো ঋণ দুর্লভ। যারা শেয়ার ব্যাবসা করেন তারা তো হাড়ে হাড়ে টের পান এই Business Cycle এর মজা।

এই চরম দুর্নীতিগুলোকে আজকের আইনসিদ্ধ ব্যাবসায় পরিণত করতে পুঁজিব্যাবসায়িরা যুগে যুগে যে রাজনৈতিক গুটিবাজি আর নোংরামি করেছে তা জানলে যে কারো মাথা ঘুরে ওঠার কথা। সেসব আমি সিরিজের আগামী পর্বগুলোতে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:৪৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×