somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাথায় গিট্টুঃ

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৫:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিশ্বের বয়স ১৩৮০ কোটি বছর। বিগ ব্যাংয়ের মধ্য দিয়ে সে সময়েই হয়েছিল মহাবিশ্বের সূচনা। আমরা জানি, আলোর বেগই মহাবিশ্বে সর্বোচ্চ। তাহলে ৯৩০০ কোটি আলোকবর্ষ বড় মহাবিশ্ব আমরা দেখছি কীভাবে?
প্রশ্নটা বেশ মজার। জ্যোতির্বিজ্ঞান, কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহীমাত্রই জানেন, বিগ ব্যাং ঘটেছিল আজ থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। অর্থাৎ ১৩৮০ কোটি বছর আগে (১ বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি বছর)। এর প্রথম ৩০০ মিলিয়ন বছরের মতো মহাবিশ্ব ছিল অন্ধকার। পদার্থ-প্রতিপদার্থের সংঘর্ষ ও মৌলিক কণাদের স্যুপ বা ঝোলে বারবার বাধা পেয়েছে ফোটন। প্রায় ৩৮০ মিলিয়ন বছর পরে সৃষ্টি হয় মহাবিশ্বের প্রথম পরমাণু। ইলেকট্রনের মতো অস্থির কণা বাঁধা পড়ে প্রোটনের চারপাশে। তখন আলোয় ভেসে যায় মহাবিশ্ব। তার মানে, আমাদের প্রায় ১৩০০ কোটি বা ১৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের বেশি মহাবিশ্ব দেখতে পাওয়ার কথা নয়।
গুগল মামা সব জানে। কাজেই, গুগলে চট করে সার্চ করলেই দেখবেন, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। ব্যাসার্ধ ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। খুব স্বাভাবিকভাবেই মাথায় ধাক্কা মারার কথা প্রশ্নটার—কীভাবে?
ঝামেলাটা আলোর বেগে। মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মূল বিষয় হিসাবে ধরে নিয়েছেন, আলোর বেগই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ বেগ। এর চেয়ে জোরে ছুটতে পারে না কিছুই। তাহলে, ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে কীভাবে?
মাথায় গিট্টু লেগে গেলে একটু থামুন। আসলে কোনো ঝামেলা নেই এতে। খুলে বলি।
আমরা যখন দূরত্বের কথা ভাবি, যতই বিষয়টা জানা থাকুক, দূরত্ব বললেই আমাদের মাথায় সরলরেখা ভেসে ওঠে। কিন্তু মহাবিশ্বটা, আপেক্ষিকতা তত্ত্বের হাত ধরে আমরা জানি, এরকম সরলভাবে কাজ করে না। স্থান-কাল সরল নয়, বক্র। ভরের জন্য স্থান-কাল বেঁকে যায়। এর উদাহরণ হিসাবে বিখ্যাত ‘স্থান-কালের চাদর’-এর কথা হয়তো শুনেছেন। এ উদাহরণে বলা হয়, স্থান-কাল একটা চাদরের মতো। এতে ভর, যেমন একটা বল রাখলে, বলটা তার চারপাশের চাদর বাঁকিয়ে ফেলে। ফলে পৃথিবী যে সূর্যকে ঘিরে ঘোরে, সে আসলে সূর্যের ভরের কারণে বেঁকে যাওয়া চাদরের বাঁকা তল ধরে ঘুরে চলেছে।

এই উদাহরণ থেকে স্থান-কালের বক্রতার বিষয়টি বোঝা যায় বটে, তবে মহাবিশ্বের বিস্তৃতির বিষয়টি ঠিক বোঝা যায় না। এটা বোঝার জন্য একটা বেলুনের কথা ভাবতে হবে। একটা বেলুনের ওপরে বেশ কিছু বিন্দু নিন। তারপর বেলুনটা ফোলাতে থাকুন। দেখা যাবে, এর ওপরের বিন্দুগুলো সব পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্বটাও এভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। প্রতিটি গ্যালাক্সি সরে যাচ্ছে পরস্পর থেকে দূরে।

এই বিষয়টি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন এডুইন হাবল। তাঁর হাত ধরে আমরা জানতে পারি, গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তো বটেই; যে গ্যালাক্সি যত দূরে, সেটি তত দ্রুত সরে যাচ্ছে দূরে। ডপলার এফেক্ট বা প্রভাবের মাধ্যমে এটা সহজেই বোঝা যায়। হাজারবার এই প্রভাবের কথা শুনেছেন বা পড়েছেন হয়তো। তাই বিস্তারিত না বলে সংক্ষেপে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। একটা ট্রেন বা অ্যাম্বুলেন্স আমাদের দিকে এগিয়ে আসার সময় এর হুইসেল বা সাইরেনের শব্দের তীব্রতা বাড়ে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যায়। আবার ট্রেন বা অ্যাম্বুলেন্স দূরে সরে গেলে শব্দের তীব্রতা কমে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। আলোর ক্ষেত্রেও এটা খাটে। আলোর তরঙ্গ (পড়ুন, তরঙ্গের উৎস) আমাদের দিকে এগিয়ে এলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যায়, তখন সেটাকে নীলচে দেখায়। এর নাম নীল সরণ বা ব্লু শিফট। আর আলোর তরঙ্গ দূরে সরে গেলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। তখন সেটাকে লালচে দেখায়। এর নাম লোহিত বা লাল সরণ। কারণটা আর কিছু নয়, লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, আর নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। কথাটা এভাবেও বলা যায়, বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে লালচে দেখায়, আর কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে নীলচে দেখায়।


হাবল এই বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করেন। দেখেন, গ্যালাক্সিগুলো থেকে আসা আলোর লাল সরণ হচ্ছে। অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি আরও দেখলেন, যে গ্যালাক্সি যত দূরে, তা তত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে।
এই সরণের হাত মাপার জন্য হাবলের ধ্রুবক ব্যবহার করা হয়। ধ্রুবকটি প্রথম মাপেন হাবল নিজে। তাঁর নাম থেকেই ধ্রুবকের এই নাম। ১৯২৯ সালে মেপে তিনি এর মান পান প্রতি মেগাপারসেকে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার বা ৩১০ মাইল। এর অর্থ, প্রতি ১ মেগাপারসেক দূরের ছায়াপথ আমাদের থেকে সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার বেশি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। ১ পারসেক হলো আলোর বেগের ৩.২৬ আলোকবর্ষের সমান। আর মেগা হলো তার ১০ লাখ গুণ। ১ মেগাপারসেককে কিলোমিটারে বুঝতে হলে ৩০৯ লিখে তার ডানে ১৭টি শূন্য বসাতে হবে।

গত প্রায় ১০০ বছরে হাবলের পরিমাপকে অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ পরিমাপ বলছে, এ ধ্রুবকের মান ৭৪.০৩ ±১.৪২। বর্তমানে ধ্রুবকটির মান ৬৭ থেকে ৭৪ ধরা হয়। আমরা হিসাবের সুবিধার্থে ৭০ ধরে নিই। এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি ১ মেগাপারসেক দূরের ছায়াপথ আমাদের কাছ থেকে সেকেন্ডে ৭০ কিলোমিটার বেশি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। তার মানে, ১০০ মেগাপারসেক দূরের কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে সেকেন্ডে ৭০০০ কিলোমিটার বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। আবার ৪,৩০০ মেগাপারসেক দূরের গ্যালাক্সিগুলো সরে যাচ্ছে সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার বেগে।


ঠিক আপনার ‘ফুঁ’-র মতো, মহাবিশ্বটাকে যেন ফুলিয়ে চলেছে অদৃশ্য এক শক্তি। এই শক্তি যেন মহাকর্ষকে পাত্তাই দিচ্ছে না। (কারণ, আমরা জানি, মহাকর্ষ সব কিছুকে কাছে টেনে আনতে চায়।) অদৃশ্য এই শক্তি কী, বিজ্ঞানীরা জানেন না। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন অজানা শক্তি বা গুপ্ত শক্তি, ইংরেজিতে ডার্ক এনার্জি।
এই ডার্ক এনার্জিতে ভর করেই বেলুনের মতো মহাবিশ্বের আরও দূরের গ্যালাক্সিগুলো আরও বেশি বেগে ছুটছে দূরে। তাহলে, এ ক্ষেত্রে কি আপেক্ষিকতা তত্ত্বের লঙ্ঘন হচ্ছে না? না, হচ্ছে না। কারণ, গ্যালাক্সিগুলো নিজেরা আসলে দূরে ছুটে যাচ্ছে না। বরং মহাবিশ্ব, স্বয়ং স্থান-কাল প্রসারিত হচ্ছে। ঠিক বেলুনের ওপর আপনার বিন্দুটি যেমন নিজের জায়গায় বসেছিল আর প্রসারিত হচ্ছিল বেলুনটা, সেরকম!

আমরা জানি, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ; ব্যাস, অর্থাৎ চারদিকে এটি ৯৩ বিলিয়ন বা ৯৩০০ কোটি আলোকবর্ষ বিস্তৃত। এটুকু আসলে গোটা মহাবিশ্ব নয়, তার ক্ষুদ্র একটা অংশ—এটুকু আমরা দেখতে পাই। (বলে রাখি, এমনিতে মহাবিশ্বের কোনো কেন্দ্র নেই। তবে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবীকে ধরেই হিসেব কষা হয়, কারণ আমরা দেখছি, নিজেদের চারপাশে।) মহাবিশ্ব আসলে আরও অনেক অনেক বড়। কত বড়, সে ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। এর অনেকখানি অংশ থেকে কোনো আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাইনি। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সেই বিপুল অংশটির অনেকখানি হয়তো আমরা কোনোদিনই দেখতে পাব না।

সূত্র: নাসা, ব্রিটানিকা, উইকিপিডিয়া
উচ্ছ্বাস তৌসিফ
সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
মহাবিশ্ব কত জোরে প্রসারিত হচ্ছে?/ আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ/ বিজ্ঞানচিন্তা
মহাবিশ্বের প্রথম আলো/ আবুল বাসার
ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস/ ওয়াল্টার লিউয়েন

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০১
১৬টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×