ছবি - বিবিসি
আমেরিকানরা থাকা অবস্থায়ই তালেবানরা ঝড়ের গতিতে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে আফগানিস্তানের পুরোটাই দখল করে নিয়েছে।কাবুল দখলের পর থেকেই তালেবানরা সারা বিশ্বকে নানা রকম আশার কথা শুনিয়েছিল। আফগানিস্তান আর আগের মতো হবে না। এদেশ সবার, সবাই স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে। নারীরাও স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে। পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে মিডিয়া।সরকারে সব জাতির মানুষের প্রাধান্য থাকবে ইত্যাদি। তখন অনেক বিশ্লেষকই মনে করেছিলেন, আগের সেই তালেবান আর নেই। তাদের মাঝে পরিবর্তন এসেছে এবং ভবিষ্যতে আরো পরিবর্তন হবে। কিন্তু তালেবানদের সরকার গঠনের পর তা সবাইকে বিস্মিত করেছে এবং এখন অনেকেই আশাহত। আফগানিস্তান আবার অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ফিরে যাচ্ছে এখন এমনই আশঙ্কাই সবার।
এত দ্রুত কাবুল তথা পুরো আফগানিস্তান তালেবানরা দখল করতে পারবে এমন ধারনা মনে হয় খোদ তালেবানদের মনেও ছিলনা।আর তাইতো পুরো আফগানিস্তান দখলের পর সবকিছুতেই তাদের সিদ্ধান্তহীনতা-সমন্বয়হীনতার ছাপ দেখা গেছে। কাবুল দখলের পর ১ মাস পার হয়ে গেলেও তারা তা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারছেনা।আর এর সাথে সাথে চরম দারিদ্রতা এবং দূর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সাথে নগদ অর্থের সংকট,খাদ্য সংকট এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাবের সাথে অভ্যন্তরীণ আরো নানা সংকটে জর্জরিত তালেবানদের টিকে দিনে দিনে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে দাড়াচছে বলে প্রতীয়মান হচছে।এ সকল সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে তালেবানদের বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং সহযোগীতাই তালেবানদের এ প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে।আর তা না হলে তালেবানদের ব্যর্থতার পাশাপাশি আফগানিস্তান ও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার দিকে ধাবিত হবে এবং যার ভুক্তভোগী আফগানদের সাথে সাথে পুরো বিশ্বই হতে পারে।
আসুন দেখি ,তালেবানদের সামনে বর্তমান কিসব সমস্যা বিরাজ করছে এবং এসব সমস্যা সমাধানে তাদের করণীয় বা কি হতে পারে -
ছবি- বিবিসি
বড় ধরনের মানবিক সংকটের মুখোমুখি আফগানিস্তান -
তালেবানরা ক্ষমতা নেওয়ার পর এক মাস পার হয়েছে আর এই সময়ের মাঝেই বড় ধরনের মানবিক সংকটের মুখোমুখি আফগানিস্তান। ক্ষমতা দখলের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে তালেবানরা। কিন্তু তারপরও তাদের স্বীকৃতি দেয়নি বিশ্বের কোনো দেশ। এই পরিস্থিতিতে দেশটিতে চরম মানবিক সংকটের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।যদিও তাদের শপথ নেয়ার কথা ১১ ই সেপ্টেম্বর তবে নানা কারনে তারা সেদিন শপথ নেয়নি। শপথ না নিলেও সরকারের কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। ব্যাংক খোলা, কিন্তু টাকা নেই। এটিএম বুথের সামনে দিন-রাত মানুষের অপেক্ষা, কখন টাকা ঢুকবে মেশিনে।গত ১৫ আগস্ট তালেবান যোদ্ধাদের রাজধানী কাবুলে প্রবেশ এবং গোটা আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই আফগানদের নগদ অর্থের সংকট শুরু। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে অর্থ-প্রবাহ বন্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের রিজার্ভ আটকে দেওয়ায় পরিস্থিতি এখন চরম আকার নিয়েছে।
ছবি - বিবিসি
তালেবানদের কথা ও কাজে মিল নেই - তালেবানদের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন না তালেবানের নতুন সংস্করণ ?
সরকার গঠনের আগে বেশ কিছুদিন ধরেই তালেবান নেতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার বলে আসছিলেন, "আমরা এমন একটি সরকার গঠন করার চেষ্টা করছি যাতে আফগানিস্তানের সকল জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে"।তাছাড়া তালেবানদের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ্ মুজাহিদ বলেছিলেন, "আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই," । আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর গত ১৫ই অগাস্ট কাবুলে তালেবানের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং এও বলেছিলেন,"আমরা দেশের ভেতরে বা বাইরে কোন শত্রু চাই না।" তবে বাস্তবে এসবের কোন কিছুরই প্রতিফলন নেই যাতে একথা বলা যায় যে তারা কথা ও কাজে এক।
ছবি - বিবিসি
তালেবানরা সবাইকে নিয়ে সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা একেবারেই হয়নি।তালেবানরা মুখে ভালো ভালো কথা বললেও সরকার গঠনে তার প্রমাণ নেই। তালেবানের নেতৃত্বে পুরনো কাঠামো, এর নানা ধরনের কমিশন, ডেপুটি এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আমির হেবাতুল্লাহ্ আখুনজাদা - এদের সবাইকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে মন্ত্রিসভার কাঠামোর মধ্যে, যেমনটি অন্য দেশের সরকারের রাজনৈতিক কাঠামোতেও দেখা যায়। পুরনো তালেবান সরকারের নৈতিকতা সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়টি পুনর্বহাল করা হয়েছে। মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাদ দেয়া হয়েছে। সরকারের সদস্যরা বেশিরভাগই পশতু জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। মন্ত্রিসভায় রয়েছেন একজন তাজিক এবং একজন হাজারা - তারা দু'জনেই তালেবানের সদস্য। একজন নারীকেও মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়নি। এমনকি উপমন্ত্রীর মর্যাদায়ও কোন নারী নেই।
তালেবানের এই নতুন সরকার গঠিত হয়েছে পুরনো তালেবান নেতা এবং নতুন প্রজন্মের মোল্লা ও সামরিক অধিনায়কদের নিয়ে। ১৯৯০য়ের দশকে তালেবানের যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা ফিরে এসেছেন। তাদের দাড়ির রঙ এখন সাদা, দাড়ির দৈর্ঘ্যও বেড়েছে। সরকারে রয়েছে গুয়ানতানামো বে থেকে ফিরে আসা কিছু সদস্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত ক'জন সদস্য। গত ক'মাস ধরে তীব্র লড়াইয়ে যুক্ত ছিলেন এমন ক'জন অধিনায়ক, আর কিছু স্বঘোষিত শান্তি আলোচনাকারী, যারা নানা দেশে চক্কর দিয়ে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে এটি তালেবানের নতুন সংস্করণ।
আফগানিস্তানে নারী এবং নারী বিহীন সরকার গঠন -
দেশটিতে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে দেড় কোটি পুরুষ এবং ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি নারী। আফগান নারীদের অধিকার বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালের সংবিধানে নারীদের পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়। ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে নারীরা ছিল গৃহবন্দি। ১০ বছরের বেশি বয়সের মেয়েদের শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। ২০০১ সালে তালেবান সরকারকে হটিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতায় আসে হামিদ কারজাইয়ের সরকার। নারীরা আবার অধিকার ফিরে পায়। তাদেরকে শিক্ষা, গাড়ি চালনা, অলিম্পিক এবং ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেওয়া হয়। এখন অনেকেই বলছে,তালেবানরা ফিরে আসায় নারীরা আবার ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। তারা বিক্ষোভও করতে দিচ্ছে না। তালেবান এখন বিশ্বের সুপারপাওয়ারকে ভয় পায় না, তাদের ভয় নারীদের নিয়ে।
নারী আলোচনাকারীদের সাথে কথা বলার সময় তারা বার বার আশ্বস্ত করেছিলেন যে একমাত্র প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়া যে কোন পদে নারীদের ভূমিকা থাকবে। এমনকি মন্ত্রী পদেও।এখন আফগানিস্তানের একটি বড় সমস্যা দেখা যাচ্ছে, "অন্তর্ভুক্তিমূলক " সরকার গঠনের প্রসঙ্গটি। তালেবানবিরোধী বিশেষত পাশ্চাত্যপন্থী মহলের আশা ছিল "অন্তর্ভুক্তিমূলক" মানে হবে- দেশের নানান জাতিগোষ্ঠী, নারী, সংখ্যালঘু প্রমুখের প্রতিনিধিত্ব। তবে তালেবান ‘অংশগ্রহণমূলক’ কথাটি একেবারে খুলে না বলে কিছুটা হলেও রাখঢাক করেছে। এ দিকে তাদের নতুন সরকারে কোনো মহিলা এখনো নেই এবং সম্ভবত কোনো অমুসলিম দূরের কথা, সম্ভবত একজনও নেই অ-পশতুন ব্যক্তি।তবে এ ক্ষেত্রে তালেবানের জবাব হলো, "এ সরকার অস্থায়ী ও অন্তর্বর্তীকালীন এবং সাময়িক। তাই সবার জায়গা হয়নি এতে"। কিন্তু তারা যে ২০ বছর পর রাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসেই "অন্তর্ভুক্তিমূলক" সরকার গঠনের আশ্বাস দিয়েছেন এবং সমাজে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন,তা ভুলে গেলে চলে না।তালেবানদের প্রমাণ করতে হবে, তালেবানরা ইসলামের শিক্ষা মোতাবেক ওয়াদা রক্ষা করে এবং নিজেদের কথাকে মূল্য দেয়।
"অন্তর্ভুক্তিমূলক" প্রশাসন গড়ার ওয়াদা সত্ত্বেও কোনো নারীকে নতুন মন্ত্রিপরিষদে না নেয়া এবং একই সাথে এ দাবিতে কাবুল-হেরাতে নারীদের বিক্ষোভের বিষয়ে তালেবান সরকার কী বলে ? নারীদের এই মিছিলের পেছনে কার হাত সক্রিয়, তা না খুঁজে এবং গতানুগতিকভাবে নতুন যেকোনো সরকারের মতো ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ এস্তেমাল না করে বরং জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক যে নারী, তাদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার-মর্যাদা এবং তাদের অশিকারের দিকে নজর দেয়াই তালেবান সরকারের উচিত।অন্যথায় এর কারণ-পটভূমি-প্রেক্ষাপট তুলে ধরা দরকার।অতীতে নারী, শিশু, সংখ্যালঘুসমেত মানবাধিকারের অবমাননা তালেবানের একটি "মেজর ব্ল্যাক স্পট"। এই গুরুতর অভিযোগের যথাযথ প্রতিবিধান তালেবানদের শিগগিরই দূর করতে হবে। অন্যথায় সবাই মনে করবে যে, তালেবানরা বদলায়নি এবং তাদের কথা মিষ্টি হলেও কাজগুলো তেতো ।
সম্প্রতি আফগানিস্তানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিভিন্ন মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে তালেবানরা। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় তারা কোনো নারী সদস্যকে স্থান দেয়নি।তবে এটাও ঠিক যে,তালেবানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভাই বর্তমান বিশ্বের একমাত্র নারীবিহীন মন্ত্রিসভা নয়। বিশ্বের আরো ১২টি দেশের মন্ত্রিসভায় কোনো নারী সদস্য নেই।তালেবানের নতুন গঠিত আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমানে বিশ্বের ১৩তম সরকার, যার মন্ত্রিসভায় কোনো নারী নেই।
বিশ্বের দেশগুলোর জাতীয় পার্লামেন্টসমূহের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) তথ্য অনুসারে, অন্য ১২টি দেশ হচ্ছে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, ব্রুনাই, উত্তর কোরিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, সেইন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডিনজ, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, টুভালু, ভানুয়াতু, ভিয়েতনাম ও ইয়েমেন।
তারপরেও ২০০১ সালের আগের আফগান নারী এবং আজকের নারী এক নয় বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তালেবানের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও নারীরা কাবুলসহ বিভিন্ন প্রদেশে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। যদি তাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা হয় তবে তাই হতে পারে তালেবানদের পতনের প্রথম এবং প্রধান কারন।
তালেবানদের সরকার পরিচালনা ও বিদ্যমান সামাজিক সমস্যা এবং কারিগরী দক্ষতার অভাব -
এখনো তালেবানদের সরকার গঠন চলছে। তালেবানরা কঠোর নীতির মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রেখেছে। তাদের ভয়ে দুর্নীতি বা চুরি কিছুটা হলেও কমেছে। তারা জনগনের করের টাকা পাচ্ছেন। তারা দুর্বল অর্থনীতি সামাল দিতে কাজ করছে। তারা পপি চাষ বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছে। তারা এখন বিশ্বের নানা দএশের সহায়তা পেতেও শুরু করেছেন। কিন্তু বিদ্যুত এবং পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে তাদের প্রযুক্তিগত সামর্থ্য নেই। তারা এখনো ক্ষুদ্র অর্থনীতিকে সামাল দেওয়ার পরিস্থিতিতেও নেই।
এমনকি খরা নিয়ন্ত্রণ করার মতো ব্যবস্থাও তাদের নেই। এসব সেবা দিতে তালেবানের দরকার নীতি প্রণয়ন করা এবং সময়। এজন্য টেকনোক্র্যাট ও বিদেশি সহায়তা দরকার। যেমন পরামর্শ দরকার, তেমনি বাস্তবে কাজের লোকও চাই। এমনকি এনজিওর সহায়তা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তালেবান যদি প্রতিশোধের শাসনের দিকে যায়, তাহলে টেকনোক্র্যাটরা ভয়ে দেশ ছাড়বে। তালেবান যদি নিষ্ঠুর শাসন পরিচালনা করে তাহলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। বিদেশিরা বিনিয়োগ থেকে সরে যাবে।
চীন ৩ কোটি ডলারের বেশি অর্থসহায়তা দিয়েছে। কিন্তু এখনই কেউ তাদের স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। আফগানিস্তানের ৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বিদেশের ব্যাংকে আটকা আছে যার মধ্যে ৭ বিলিয়ন ডলারই যুক্তরাষ্ট্রে। তালেবানের তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকেও একটি চ্যালেঞ্জ উঠে আসছে। সম্প্রতি এক তরুণ তালেব বলেন, ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তালেবান আগের মতো জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে ২০০১ সালের পূর্ববর্তী সরকারের মতোই আবার তারা ক্ষমতাচ্যুত হবে। তালেবানের সরকার নিয়ে আরেকটা অস্বস্তির কারণ হলো কেবল ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছেন এমন অনেক নেতাকে নানা ধরনের পদ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন মন্ত্রী বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন এবং সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে নানা প্রশ্ন
আফগানিস্তানে তালেবানে সরকার গঠনের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। চীন ও পাকিস্তান অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু স্বীকৃতির জন্য উন্মুখ থাকা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না কেউ। সবাই তালেবানের ভবিষ্যত কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করছে। এই চ্যালেঞ্জ এখন আফগানিস্তানের পথে পথে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সারা বিশ্বের রাজধানীগুলো থেকেও এই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হচ্ছে।"সারা বিশ্ব গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য রাখছে," বলে এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। "তালেবান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব শিগগীরই স্বীকৃতি পাবে, এমন সম্ভাবনা কম," মতামত দিয়েছে রাশিয়ার নেজাভিসিমিয়া গাজেটা পত্রিকার এক সম্পাদকীয়। শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালেও রাশিয়া অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়েছে। কেবল চীন এবং পাকিস্তান পুরোপুরি তালেবানের সঙ্গে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
শত চেষ্টা সত্ত্বেও কারোরই স্বীকৃতি মিলছে না তালেবানদের -
আফগানিস্তানে তালেবানের সরকার গঠনের পাঁচ দিনের মাথায় গত রবিবার কাবুল সফরে যান কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি এবং তিনি আফগান প্রধানমন্ত্রী মোল্লাহ হাসান আখুন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু দোহায় ফিরে সোমবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, "তালেবানের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এখনও আসেনি"।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে অধৈর্য তালেবানরা -
আন্তর্জাতিক বৈধতা এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য তালেবানরা উন্মুখ হয়ে পড়েছে। তারা মনে করছে, সরকার পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশের, বিশেষ করে প্রতিবেশি কিছু দেশের স্বীকৃতি জরুরি। গত রবিবার টেলিফোনে তালেবানের সিনিয়র মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের সঙ্গে এমন কথা বলেছেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইয়েদ নিজামী। তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভী আমির খান মুত্তাকি দু’দিন আগে আফগান কূটনীতিকদের বিদেশি মিশনগুলোতে কাজে যোগ দিতে বলেছেন। কিন্তু আফগান দূতাবাসগুলো এখন কার্যত অচল। এমনকি লন্ডন এবং ওয়াশিংটনেও আফগান দূতাবাসে কোনও কূটনৈতিক তত্পরতা নেই। বলতে গেলে বন্ধ। ইসলামাবাদে দূতাবাস সচল। আবার তাজিকিস্তান এবং ইতালিতে আফগান রাষ্ট্রদূতরা তাদের ইচ্ছামত তালেবান বিরোধীদের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। নিজামী আরও বলেন, মানবিক সাহায্যের আশ্বাস থাকলেও কাবুলের সরকারের হাতে নগদ টাকা নেই। বিদেশের সঙ্গে ব্যাংকিং কাজ করছে না। অনেক সরকারি কর্মচারী কাজে ফিরলেও বেতন পাচ্ছেন না। কবে পাবেন তা নিয়েও চরম অনিশ্চয়তা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রশ্নে বিবেচনা করা হতে পারে যেসব বিষয় -
আফগানিস্তানের জন্য জাতিসংঘ জরুরী তহবিল সংগ্রহ করছে। তবে এর সঙ্গে সংস্থাটি তালেবানকে মানবাধিকার, নারী অধিকার শর্ত জুড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। বিভিন্ন আফগান জাতিগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু এবং ভিন্নমতের লোকজনকে তালেবান তাদের সরকারে শেষ পর্যন্ত কতটা জায়গা দেবে তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তাদের শিক্ষানীতিতে নারীদের শিক্ষার অধিকার মেনে নিয়েছে তালেবান, যদিও নির্দেশ দিয়েছে যে নারী-পুরুষ একসঙ্গে ক্লাশে বসা চলবে না। তবে বৈধতা এবং স্বীকৃতি পেতে তালেবানের আসল পরীক্ষা হবে সন্ত্রাস নিয়ে তাদের অবস্থানের ওপর। কারণ শুধু আমেরিকা নয়, এই ইস্যুতে চীন, রাশিয়া এমনকি পাকিস্তানও কমবেশি উদ্বিগ্ন।
পাকিস্তান চায় তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি যা পাকিস্তান তালেবান নামে পরিচিত) নেতাদের ধরে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক।চীন চায় শিনজিয়াংয়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইটিআইএমকে আফগানিস্তান থেকে হটাতে হবে।অন্যদিকে আরেক প্রতিবেশি ইরান চায় আইএস এবং আল-কায়েদা যেন আফগানিস্তানে না থাকে।আবার রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর চাওয়া হলো, আইএসকে (ইসলামিক স্টেট-খোরাসান) যেন কোনওভাবেই আফগানিস্তানে প্রশ্রয় না পায়। সুতরাং এক মাস আগে কাবুল দখল তালেবানের জন্য যত সহজ ছিল, বৈধতা অর্জন ও দেশ শাসন করা হবে ততটাই জটিল এবং কঠিন। আর এজন্যই কথায় আছে " স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন"।
স্বীকৃতি প্রশ্নে পশ্চিমা বিশ্ব দোলাচলে -
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য বলেই দিয়েছে তারা তালেবানের আসন্ন সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। তবে এসব দেশ এও বলেছে যে, তারা তালেবানদেরকে ত্যাগ করবে না। তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে। তারা স্বীকৃতি দেবে শর্তসাপেক্ষে। বিশেষ করে নারী অধিকার এবং সন্ত্রাসবাদ ইস্যুই পশ্চিমাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।আফগানিস্তানে একটা বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকার রক্ষা করার ওপরই নির্ভর করছে পশ্চিমা বিশ্ব তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে কি না। কিন্তু তালেবান যদি ইরান, উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা বা মিয়ানমারের মতো আচরণ করে তাহলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ আফগানরা।
সতর্ক অবস্থানে পাকিস্তান এবং আঞ্চলিক দেশগুলো -
১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান ওই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। আবার সেসময় পাকিস্তানই তালেবানের জন্য সৌদি আরব এবং ইউএই’র স্বীকৃতি আদায় করেছিল। কিন্তু এবার তালেবানের কাবুল দখলের এক মাস পরও স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে ইসলামাবাদ এখনও চুপ। ইসলামাবাদে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভী বলছেন, পাকিস্তান তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না। তারা এবার একা কিছু করতে চায় না। অন্য আরও দশ-পাঁচ জনের সঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। প্রতিবেশি অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ করে চীনের সঙ্গে সমন্বয় করে এবার এগুতে চাইছে পাকিস্তান। আফগান এবং তালেবানের প্রশ্নে কমপক্ষে আঞ্চলিক একটি ঐক্য চাইছে পাকিস্তান।
সম্ভবত সে কারণেই পাকিস্তানের উদ্যোগে গত বুধবার চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠক করেছেন। দু’দিন পর শনিবার আবারও পাকিস্তানের উদ্যোগেই এসব দেশের গোয়েন্দা প্রধানরা বৈঠক করেন। আমেরিকার সঙ্গেও গোপনে পাকিস্তান কথা বলছে। গত বুধবারই সিআইএ’র প্রধান উইলিয়াম বার্নস ইসলামাবাদে গিয়ে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার রশীদ বাজওয়া এবং আইএসআই প্রধান লে. জেনারেল ফায়েজ হামিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিলেও পাকিস্তান আফগানিস্তানকে সাহায্য দিয়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আটক রাখা আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান।
স্বীকৃতি দিতে অপেক্ষা চীনের -
তালেবান সরকার গঠনের পর তাদের অভিনন্দন জানিয়েছে চীন। গত সপ্তাহে চীন আফগানিস্তানের জন্য তিন কোটি মার্কিন ডলারের জরুরি খাদ্য এবং ওষুধ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আফগানিস্তানে বিনিয়োগ নিয়ে দোহায় তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে গত সপ্তাহে চীনাদের কথা হয়েছে বলে জানা গেছে।যদিও তারা এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি তালেবানদের তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এও বলছেন যে, তালেবান সরকারের প্রতি পাকিস্তান, চীন বা কাতারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অনেকটাই এখন অপ্রাসঙ্গিক, কারণ তাদের সম্পর্ক শুরু হয়ে গেছে।
যেসব বিষয় তালেবানদের ভোগাতে পারে বা তারা যে সব সমস্যার মুখোমুখী হবে -
অস্ত্রধারী বিরোধী পক্ষ - দেশের অভ্যন্তরীণ অস্ত্রধারী বিরোধী পক্ষ এবং তালেবানদের ভেতরের অনেকেই এখন তালেবানের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তালেবানকে ভাঙার চেষ্টা করেও ন্যাটো কিছু করতে পারেনি। কিন্তু তালেবানের ভেতরেই বিভিন্ন গ্রুপ আছে যাদের রাষ্ট্র সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই, ধর্মীয় বিশ্বাসই তাদের কাছে বড়। তারা বাস্তব জগত্ সম্পর্কে খুব একটা বোঝে বলেও মনে হয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকে মাঝারি মানের তরুণ কমান্ডার। তারা কেবল জেহাদ করতেই ভালোবাসে।কাজেই তালেবান নেতারা যদি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে তারাও আফগানে তালেবান শাসনের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাড়াবে।
ছবি - বিবিসি
অতীত থেকে শিক্ষা না নিলে আবার ক্ষমতাচ্যুত -
তালেবান হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠন করেছে। গত বছর দোহায় শান্তিচুক্তির পর তালেবান ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা করবে না এমন ইঙ্গিত দিলেও কথা রাখেনি। আফগানিস্তানের সামাজিক বুনন সম্পর্কে যারা জানেন না তারা গুরুতর চ্যালেঞ্জর মুখোমুখি হবে। সম্প্রতি মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, মার্কিন সৈন্যরা আবার আফগানিস্তানে যাবে। তার এই বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তালেবান যদি আগের মতো শাসন পরিচালনা করতে চায় তাহলে পরিস্থিতি সেই দিকেই মোড় নিতে পারে। এমনকি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও জোরালো হচ্ছে। আবার তালেবানের সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য ভারত সফর করেছেন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর প্রধান এবং রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। সিআইএ প্রধান পাকিস্তানও সফর করেছেন। পাকিস্তানে আট দেশের গোয়েন্দা প্রধানদের বৈঠক হয়েছে । ফলে আঞ্চলিক তথা বিশ্বের রাজনীতি অনেকটাই আফগানিস্তানকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। তালেবানের ক্ষমতা দখলে বিশ্বে উগ্রপন্থা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
১৯৯০-এর দশকের তালেবানের অব্যবস্থাপনার সরকার সম্পর্কে কোনো ধারণাই তাদের নেই। জাতীয় এবং প্রাদেশিক নেতাদের চেয়ে এরা অনেক বেশি কট্টর। তালেবানকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ সব নেতা এবং কমান্ডারদের পর্যাপ্ত আয়ের ব্যবস্থা থাকবে। স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের সংযুক্ত করতে হবে। যেমন খনিতে খননকাজ।
তালেবানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হলে বিচ্ছিন্ন হওয়া নেতা বা বিদেশি যোদ্ধারা তালেবানের বিরুদ্ধে ইসলামিক স্টেট খোরাসানকে (আইএস-কে) সহায়তা করতে পারে। এদের বিরুদ্ধে তালেবান অনেক লড়াই করেছে। আইএস-কে হয়তো এখন তালেবান শাসনের অবসান ঘটাতে পারবে না, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তারা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ছবি - আল জাজিরা
আবার সহিংসতা অব্যাহত থাকলে আফগানিস্তানে চীনের বিনিয়োগও হাতছাড়া হতে পারে। কারণ তালেবান এখন চীনকেই প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার মনে করে। আফগানিস্তানের শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় আইএস-কে হামলা চালায়। তারা শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ লাগাতে চায়। যদি তালেবান এই হামলা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি হবে তালেবানের।
আবার ইরান আফগানিস্তানে তার ফাতিমিয়ুর ইউনিটকে শক্তিশালী করতে পারে। ইরান তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং যুদ্ধের জন্য সিরিয়া ও লিবিয়ায় পাঠিয়েছিল। এই যোদ্ধার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। তারা আফগানিস্তানে এসে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। তবে ভবিষ্যতে তালেবানের জন্য বড় হুমকি তালেবাবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত আহমাদ মাসুদ এবং আমরুল্লাহ সালেহ যাদের গ্রুপ পাঞ্জশির উপত্যকায় তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।
ছবি - পার্স টুডে
দূর্বল অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং নগদ অর্থের অভাব -
বর্তমানে তালেবানরা বিদেশে দেশের কোটি কোটি ডলার ফেরত পাচ্ছে না,নেই সহায়তাও। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের বরাদ্দ করা তহবিল ফেরত নিয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও আটকে দিয়েছে। দেশের অবৈধ এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিও অনেক ক্ষতির মুখে। তালেবান চাইলেই পপি অর্থনীতি দ্বিগুণ করতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক বাজার ইতিমধ্যে সিনথেটিক এবং অপিয়ডে পূর্ণ। তালেবান মাদকমুক্ত দেশ গড়তে পপি উত্পাদন বন্ধ করার কথা জানিয়েছে। অথচ আফগান অর্থনীতি এর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। হঠাৎ করে তার চাষ ও ব্যবসা বন্ধ করে দিলে অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। কৃষকরাও ক্ষতির মুখে পড়বে। এসব মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা এখন তালেবানের নেই। আবার খরা, করোনার হানায় অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ রূপে দাঁড়িয়েছে।
দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে। ৩০ শতাংশ খাদ্য অনিরাপত্তায় ভুগছে। তাই হঠাৎ করেই পপি চাষ বন্ধ করলে তালেবানের মাঝারি মানের কমান্ডার এবং যোদ্ধাদের আয়ে ধস নামবে। নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই তালেবানকে এখন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বেকার হয়ে পড়েছে বহু সেনা সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র যাদেরকে বেতন দিত। কিন্তু তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা তালেবানের জন্যও কঠিন হবে।
ছবি - আল জাজিরা
কাজ না পেলে তারা ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়তে বা তালেবানবিরোধী মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিতে পারে। কিন্তু তালেবান ইরান, চীন, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে। তবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই তালেবানকে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইরান অর্থনৈতিকভাবে খুব বেশি সহায়তা করতে পারবে না, পাকিস্তান সামরিক এবং গোয়েন্দা সহায়তা দিলেও অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে চীন এবং উপসাগরীয় দেশগুলোই অর্থসহায়তা দিতে পারে।
তালেবানদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আইএস। আইএস মোকাবেলার জন্য তালেবানদেরকে এই অঞ্চলের সব রাষ্ট্রকে সাথে নিয়ে চলতে হবে। এই অঞ্চলের দেশগুলো শুধু সেই পরিস্থিতিতেই তালেবানের সাথে চলবে, যদি আফগানিস্তানের ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধ ব্যবহার করা না হয়। মিডিয়ার স্বাধীনতা যদিও এখনো পর্যাপ্ত নেই তারপরেও তালেবানের বক্তব্য, নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নত হলে সাংবাদিকদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তালেবানের উচিত, নিজেদের ডালপালাকে উন্নত ও উত্তম বানাতে মিডিয়াকে স্বাধীন করে দেয়া এবং তাদের তাদের প্রয়োজেন ব্যবহার করা। আগামী দিনগুলোতে গুজব আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। গুজবের বিরুদ্ধে উত্তম ভ্যাকসিন হচ্ছে স্বাধীন মিডিয়া। আজকের তালেবান আফগানিস্তানের অনেক সমস্যার সমাধানের জন্য এই ভ্যাকসিনের সাহায্য নিতে পারে। এই ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া বা সাময়িক অস্বস্তিতে তাদের ঘাবড়ানো ঠিক হবে না।
তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের একটি ভবিষ্যৎবাণী ছিল " দখলদারিত্বের ২০ বছর পূর্তির আগেই দখলদাররা বিদায় নিতে শুরু করবে আফগানিস্তান থেকে। এরপর শত বছরব্যাপী আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ আফগানদের হাতে থাকবে"। যদিও ইতিমধ্যেই মোল্লা ওমরের ভবিষ্যৎবাণীর প্রথম অংশ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে বিশ্ববাসী দেখছে তবে দ্বিতীয় অংশের বাস্তবায়ন হয় কি হয়না বা হলে কিভাবে হবে তা দেখার জন্য বিশ্ববাসীকে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুদিন।
বিদ্যমান এ সব সমস্যার সমাধান ও সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহারই তালেবানদের টিকে থাকতে ও সফল করতে সাহায্য করবে।আর না হলে তালেবানরা আবারো হারিয়ে যাবে ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে। কারন অযোগ্যরা বরাবরই হারিয়ে যায় আর যোগ্যরাই টিকে থাকে।আর তাই তালেবানদের তাদের নিজেদের যোগ্য প্রমাণের বিকল্প আর কোন অপশন তাদের হাতে নেই।আর একটি অপশনই (যোগ্যতা প্রমাণ) আছে যা ব্যবহার করে তারা সফল হতে পারে।
===============================================================
পূববতী পোস্ট -
তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ৪ Click This Link
" আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে বিদায় " - এর ফলে বিশ্ব ব্যবস্থা ও পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা আছে কি বা বিশ্বে পশ্চিমা আধিপত্যের প্রভাবের পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতটুকু?
তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ৩ Click This Link
"তালেবানদের আফগান শাসনের রোডম্যাপ (ইশতেহার) প্রকাশ । কোন পথে এবং কতদূর নিয়ে যেতে চাচ্ছে তালেবানরা আফগানিস্তানকে"?
তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ২ Click This Link
" তালেবানদের আফগানিস্তান দখল " - কেন এবং কি কারণে আফগান সেনাদের এত দ্রুত পরাজয়?
তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ১ Click This Link
" আফগানিস্তানে আমেরিকার ২০ বছর " - আমেরিকা কি নিয়ে এবং আফগানিস্তানকে কোথায় রেখে যাচছে ? এ ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দদের প্রতিক্রিয়া কি ?
তথ্যসূত্র ও সহযোগীতায় - বিবিসি,আল জাজিরা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:৩৮