উৎসর্গ এবং যে পোস্টের সূত্র ধরে এই লেখা - ব্লগার রাজীব নুর ভাইকে এবং তার লেখা " ধোঁয়া ও দোয়া " পোস্ট - লিংক Click This Link
ছবি - jagonews24.com
মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেন, "তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে দাখিল হবে লাঞ্ছিত হয়ে"। (সুরা মু’মিন,আয়াত -৬০)। উক্ত আয়াতে মানুষকে পরকালের সৌভাগ্য অর্জনে ইবাদাতের প্রতি মনোযোগী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ দোয়ার প্রকৃত অর্থ হলো চাওয়া । আর প্রয়োজনপূরণে আল্লাহর নিকট চাওয়াই ইবাদাত।
দোয়া কি বা দোয়া কাকে বলে -
দোয়া শব্দের অর্থ আল্লাহকে ডাকা, তার কাছে কিছু চাওয়া, প্রার্থনা করা অর্থাৎ বিনয়ের সঙ্গে মহান আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে এবং ক্ষতি ও অপকার থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা করাই হল দোয়া। কুরআন হাদিসে দোয়াকেও ইবাদাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, " দোয়া-ই ইবাদত " । (তিরমিজি শরীফ )।
আমাদের সবারই আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়া এবং তার নৈকট্য লাভ করা ব্যতিত দুনিয়ার উন্নতি ও পরকালের মুক্তি কোনোভাবেই সম্ভব নয় বিধায় আমাদেরকে দোয়া করার মাধ্যমে তাঁর সঠিক ইবাদাত করতে হবে।এই দোয়াকে আল্লাহ তাআলা ইবাদত হিসেবে অভিহীত করেছেন এবং সাহায্য লাভের মাধ্যম বানিয়েছেন। কারণ দোয়া বা ইবাদাত ছাড়া মানুষের মুক্তির কোনো উপায় নেই।
ছবি - barta24.com
দোয়া কেন করতে হবে -
মানুষের সমস্ত ইবাদতের মূলবিষয় হচ্ছে, আল্লাহর নিকট তার বিনয় ও আনুগত্য প্রকাশ করা। আর প্রয়োজনের সময় বান্দা যখন আল্লাহর কাছে দুয়া করে তখন সে আল্লাহকে খুব কাছে অনুভব করে থাকে। আল্লাহ আমার ভাত নেই, আল্লাহ আমার টাকা নেই, আল্লাহ আমার অসুখটা ভালো করে দাও। তুমি ছাড়া আর কে-ই বা আমাকে সাহায্য করবে? ইত্যাদি শব্দে দুআর সময় বান্দা আল্লাহকে অত্যন্ত কাছে অনুভব করে। আল্লাহকে এভাবে স্মরণ করতে পারা হল ইবাদত। আল্লাহ তো সব সময় বান্দাকে দেখেন, তাঁর প্রয়োজন সম্পর্কে জানেন। কিন্তু বান্দার এ বিষয়ে অনুভূতি থাকে না। আল্লাহর স্মরণ যার যত বেশি হবে তিনি ততই কামেল বা বুযুর্গ হবেন। আর এই অনুভূতি দুআর মধ্যে যেভাবে প্রকাশ পায় অন্য ইবাদতে সেভাবে প্রকাশ পায় না। তাই দুআকেই ইবাদত বলা হয়েছে এবং দুআকে ইবাদতের সারবস্ত্ত বা মগজ বলা হয়েছে।
আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয় ব্যতীত দুনিয়া ও আখেরাতের যে কোন বস্ত্তই দুআর বিষয় হতে পারে। হাদীস শরীফে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ বস্ত্তও আল্লাহর কাছে চাওয়ার কথা এসেছে,আর এই চাওয়াকেই দুআ বলা হয়। এটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয়।
দোয়া কবুলের পূর্ব শর্ত
দোয়া কবুলের অনেক শর্ত আছে। আল্লাহর উদ্দেশ্যে একমাত্র তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য খালেস দিলে দোয়া করতে হবে। দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে হারাম খাদ্য, বস্ত্র, পানীয় ইত্যাদি পরিহার করা। হালাল খাদ্য খাওয়া দুআ কবুল হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত । হারাম উপার্জনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে যতই দোয়া করা হোক, তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না। যে মানুষ আসমানের দিকে হাত প্রশস্ত করে বলে, হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে?
হালাল উপার্জন এর সাথে সাথে আরো অন্যতম শর্ত হচ্ছে, বিনয় ও অক্ষমতা প্রকাশ করা। আমি অক্ষম, তুমি সক্ষম। আমি অধম, তুমি উত্তম। আমি কিছুই পারি না, তুমি সব পার। নিজের হীনতা ও দীনতাকে যে যত বেশি প্রকাশ করতে পারবে তার দুআ তত বেশি কবুল হবে। তাই দেখা যায়, অনেক মূর্খ লোকের দোয়াও কবুল হয়ে যায়। মজলুমের দুআ কবুল হওয়ার নিগুঢ় রহস্যও এখানেই। মজলুম ব্যক্তি মনের কষ্টে যখন দুআ করতে উদ্যত হয় তখন তার সামনে আর কোনো গায়রুল্লাহ বা মাধ্যম থাকে না। সরাসরি আল্লাহকে সে এমনভাবে বলতে থাকে যে, তার অনুভূতিতে আল্লাহ তখন একেবারে নিকটে থাকেন। তার মনের এই অবস্থার কারণে আল্লাহ তাআলা তার দুআ সাথে সাথে কবুল করে নেন।
ছবি - banglanews24.com
যাদের দোয়া কবুল হয় না
মহান আল্লাহর কাছে প্রিয় একটি আমল হচ্ছে তাঁর কাছে দোয়া করা। যারা আল্লাহর কাছে চায় আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। তারপরেও অনেক মানুষ এমন রয়েছে যাদের দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না। নিম্নে তাদের নিয়ে আলোচনা করা হলো -
১। হারাম ভক্ষণকারী - হারাম উপার্জনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে যতই দোয়া করা হোক, তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না।দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে হারাম খাদ্য, বস্ত্র, পানীয় ইত্যাদি পরিহার করা।
২। দোয়া করে নিরাশ হয়ে যাওয়া - দোয়ার পর আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন। নেতিবাচক কোনো চিন্তা না করা। অন্যথায় এ দোয়া বিফল হয়ে যেতে পারে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, " তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়ে থাকে। যদি সে তাড়াহুড়া না করে আর বলে যে, আমি দোয়া করলাম, কিন্তু আমার দোয়া তো কবুল হলো না"। (বুখারি শরীফ, হাদিস নং - ৬৩৪০)।
৩। আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া - হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, "সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয়ই তোমরা সৎ কাজের জন্য আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করবে। তা না হলে আল্লাহ তাআলা শিগগির তোমাদের ওপর তাঁর শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তোমরা তখন তাঁর কাছে দোয়া করলেও তিনি তোমাদের সেই দোয়া গ্রহণ করবেন না"। (তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং - ২১৬৯)।
৪। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা - আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা একটি বড় ধরনের পাপ (অপরাধ)। এই পাপের শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গাতেই ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে, "কোনো মুসলিম দোয়া করার সময় কোনো গুনাহের অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের দোয়া না করলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে এ তিনটির কোনো একটি দান করেন। (১) হয়তো তাকে তার কাঙ্ক্ষিত সুপারিশ দুনিয়ায় দান করেন, (২) অথবা তা তার পরকালের জন্য জমা রাখেন এবং (৩) অথবা তার কোনো অকল্যাণ বা বিপদাপদ তার থেকে দূরে করে দেন। সাহাবিরা বলেন, তাহলে তো আমরা অনেক বেশি লাভ করব। তিনি বলেন, আল্লাহ এর চেয়েও বেশি দেন"। (আত-তারগীব, হাদিস নং - ১৬৩৩) ।
৫। অন্যমনস্ক হয়ে দোয়া করা - দোয়ার সময় পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে দোয়া না করা। আল্লাহ অবচেতন মনের দোয়া গ্রহণ করেন না। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, " তোমরা কবুল হওয়ার পূর্ণ আস্থা নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া কোরো। জেনে রেখো, আল্লাহ অমনোযোগী ও অসাড় মনের দোয়া কবুল করেন না "। (তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং - ৩৪৭৯) ।
এতসব কিছু মেনে-জেনে-বুঝে যে বা যারা দোয়া করবে মহান আল্লাহপাক তার দোয়া কবুল করে নিবেন এবং তাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন। আর যারা কিছু না জেনে-বুঝে, ধর্মের বিধি-বিধান না মেনে নিজের খেয়াল খুশিমত জীবন যাপন করবে তাদের জন্য দোয়া কোন ভূমিকা পালন না করে ধোয়া হয়ে উড়ে যাবে।
পরিশেষে…
যেহেতু কুরআন-হাদিসে দোয়ার বিষয়ে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। সেহেতু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নামাজ-রোজা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, বিপদ-মুসিবতসহ দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণ এবং পরকালের সফলতা লাভে আল্লাহর নিকট দোয়া করা উচিত।ঐ বান্দা কতই না উত্তম, যার প্রতিটি মুহূর্ত দুআয় পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দুআর হাকীকত ও দুআর মজা উপভোগ করার তাওফীক দান করুন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইহ ও পরকালীন সকল বিষয়ে আল্লাহ নিকট সাহায্য চাওয়ার তাওফিক দান করুন।
তথ্যসূত্র - আল কোরআন ও হাদীস।
===================================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
ঈমান ও আমল - ১১ Click This Link
" পবিত্র ও সম্মানিত মাস মহরম " - হিজরি সনের প্রথম মাস এবং পবিত্র আশুরা ।ইসলামে আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আশুরার দিনে করণীয় ও বর্জনীয় ।
ঈমান ও আমল -১০ Click This Link
("পবিত্র মাস জিলহাজ্জ"-জিলহাজ্জের প্রথম দশ দিন মুসলমানদের নিকট বছরের সেরা দশদিন-ঈমান ও আমলের জন্য)।
ঈমান ও আমল - ৯ Click This Link
(" শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা " - যা সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব হাসিলে সাহায্য করে। পবিত্র রমজানের পর যা সকল মুসলমানেরই রাখা উচিত)।
ঈমান ও আমল - ৮ Click This Link
(আজ পবিত্র " লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত "। মহিমান্বিত এ রজনীতে মুসলমানদের করণীয় ।)
ঈমান ও আমল - ৭ Click This Link
("যাকাত " ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ । যা আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির ও প্রতিশ্রুতি দেয়)।
ঈমান ও আমল - ৬ Click This Link
("রোযা" ইসলামের তৃতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ । যার বিনিময় বা প্রতিদান আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন নিজেই দিবেন)।
ঈমান ও আমল - ৫ Click This Link
(" নামাজ " ইসলামের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ । যা মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে পার্থক্যকারী সূচক হিসাবে বিবেচিত এবং মুসলমান মাত্রই দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে)।
ঈমান ও আমল - ৪ Click This Link
("ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ"- যার শুরুটা কালেমা বা ঈমানে। যা শুধু মুখে বলা নয়,অন্তরে বিশ্বাস ও কর্মে পরিণত করার বিষয়)।
ঈমান ও আমল - ৩ Click This Link
(তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব )।
ঈমান ও আমল - ২ Click This Link
("শুক্রবার - পবিত্র জুমা"- মুসলমানদের জন্য এক মর্যাদা ও ফজিলত পূর্ণ দিন এবং জুমার দিনের কতিপয় আমল )।
ঈমান ও আমল - ১ Click This Link
(যেসব আমলে মানুষের অভাব দূর হয় ও জীবন সুখের )।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:৪২