ছবি -sharechat.com
বাংলাদেশের আকাশে রজব মাসের চাঁদ দেখা গেছে ২ ফেব্রুয়ারি বুধবার । ফলে রজব মাসের গণনা শুরু হয়েছে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে, সে হিসাবে আগামী ২৬ রজব তথা ২৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে পালিত হবে পবিত্র শবে মিরাজ। রজব মাস হিজরি সনের বিশেষ ও মহিমান্বিত মাসের নাম। এ মাস আসে রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে। আর তাই আমাদেরকে এই রজব মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি নিতে হবে। মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে রজব মাস একটি। আরবি চন্দ্রবর্ষের সপ্তম মাস হলো রজব। হারাম তথা সম্মানিত ও যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ মাসগুলোর মাঝে অন্যতম হলো রজব। ইসলামে ৪টি মাসকে হারাম মাস হিসেবে ধরা হয়। এগুলো হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব।
রজব মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা -
রজব মাসের মর্যাদার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, "যে ব্যক্তি রজব মাসে (ইবাদত দ্বারা অন্তরের) জমিন চাষাবাদ করল না আর শাবান মাসে (ইবাদতের মাধ্যমে মনের) জমিন আগাছামুক্ত করল না, সে রমজান মাসে (ইবাদতের) ফসল তুলতে পারবে না"।(বায়হাকি)
মর্যাদাপূর্ণ রজব মাসের পুরো নাম ‘রজবুল মুরাজ্জাব’ বা ‘আর-রজব আল-মুরাজ্জাব’ হলেও এটি রজব মাস নামেই বেশি পরিচিত। এ মাসটির অর্থগত তাৎপর্যও রয়েছে কারন রজব শব্দের অর্থ হলো সম্ভ্রান্ত, মহান বা প্রাচুর্যময়। আর ‘মুরাজ্জাব’ অর্থ ‘সম্মানিত’। সুতরাং রজব এর অর্থ দাঁড়ায় " প্রাচুর্যময় সম্মানিত মাস" ।
মুসলমানদের কাছে মর্যাদার এ মাসটিকে মহান আল্লাহপাক যাবতীয় যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি ও রক্তপাত নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।এ ব্যাপারে রাসুল(সাঃ) বলেন, " আল্লাহ তাআলা আসমান-জমিন সৃষ্টি করার দিন থেকেই বৎসর হয় বারো মাসে। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।তিনটি একাধারে জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এবং চতুর্থটি হলো রজব মুদার , যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী"। (মুসলিম শরীফ)।
ছবি - kalerkantho.com
রজব মাসের আমল ও ইবাদত -
যদিও মুসলমানদের প্রতিদিনই ৫ ওয়াক্ত ফরজ সালাত আদায় করতে হয় এবং আল্লাহর ইবাদত করতে হয় তারপরও মহান আল্লাহপাক মুসলমানদের জন্য ইবাদতের কিছু বিশেষ দিন বা মাসের কথা বলেছেন যে সময় বা দিনে একজন মুমিন অল্প আমলেও অধিক সাওয়াবের অধিকারী হতে পারেন। যেমন - জুমার রাত, ২ ঈদের রাত, শবে কদর-শবে বরাতের রাত ,রমজান মাস ও রজব মাস । আর এসবের মধ্য থেকে একটি অন্যতম মাস হলো রজব মাস। মর্যাদার এ মাসটি মুমিন মুসলমানের ইবাদতের মাস, বরকত লাভের মাস।এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহপাক বলেন, " নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে গণনায় মাস বারটি , তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস , এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন"। (সুরা তাওবাহ, আয়াত - ৩৬) ।
রাসূল (সাঃ) এ মাসে বেশী বেশী ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত হতেন। রোজা রাখতেন এবং বেশি বেশি বরকত পেতে এ দোয়া পড়তেন এবং তাঁর উম্মতকেও দোয়া পড়তে বলতেন।" আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান" অর্থ্যাৎ " হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন, রমজান মাস আমাদের নসিব করুন"। (বুখারি শরীফ ও মুসলিম শরীফ)। রজব বহুবিদ কল্যাণের সম্মিলনে এ মাস। রমজানের আগে আমাদের নিজেদের আমল ও ইবাদতের জন্য উপযোগী করে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাসও রজব। তা ছাড়া রজব ও শাবান হলো পাশাপাশি দু’টি জোড়া মাস। মাস দু’টিকে একত্রে রজবান বা রাজাবাইনও বলা হয়। তাই বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি, দোয়া-ইসতিগফার ও রোজা রাখার মতো আমল ইবাদত করে এ দুই মাসে নিজেদের রমজানের জন্য প্রস্তুত করার উপযুক্ত সময়।
পুরো রজব মাসজুড়েই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যধিক আমল-ইবাদত করতেন, রোজা রাখতেন, দোয়া পড়তেন। রমজানের জন্য নিজেকে তৈরি করতে, নিজের মন-মানসিকতাকে পরিচ্ছন্ন করতে এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতেন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, " রজব হলো আল্লাহর মাস, শাবান হলো আমার মাস আর রমজান হলো আমার উম্মতের মাস" । (তিরমিজি শরীফ)।
রজব মাসের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মাহাতুল মুমিনিনদের বর্ণনা
রজব ও শাবান মাসে রাসূল (সাঃ) যে বেশী পরিমাণ ইবাদত-বন্দগি করতেন তা উম্মাহাতুল মুমিনিনদের বর্ণনা থেকেও পাওয়া যায় । হাদিসে এসেছে, হজরত উম্মে সালমা (রাঃ) বলেন, " রাসূল (সাঃ) রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতপর রজব মাসে"। হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন," যখন রজব মাস আসত, রাসূল (সাঃ) এর আমলের আধিক্য দেখেই আমরা তা বুঝতে পারতাম"। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, " রাসূল (সাঃ) রজব মাসে ১০টি রোজা রাখতেন, শাবান মাসে ২০টি রোজা রাখতেন আর রমজান মাসে ৩০টি রোজা রাখতেন"। (দারিমি)।
রজব মাসের বিশেষ আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বেশি বেশি নফল রোজা পালন করা,১,১০, ১৩, ১৪, ১৫; ২০, ২৯ এবং ৩০ তারিখ রোজা পালন করা।
ছবি - sharechat.com
সাহাবায়ে কেরামগণও এ মাসের ইবাদত ও ফজিলত বর্ণনা করেছেন। সাহাবায়ে কেরামদের দৃষ্টিতে রজব মাসজুড়ে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাজ, ইশরাক নামাজ, চাশত-দোহার নামাজ, সালাতুল আউয়াবিন,তাহিয়াতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ ইত্যাদি নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া খুবই জরুরি। হজরত ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, " রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, অতি মহান (মর্যাদার) চারটি রাত হলো- রজব মাসের প্রথম রাত; শাবান মাসের মধ্য দিবসের রাত (শবে বরাত); শাওয়াল মাসের প্রথম রাত (ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদের রাত); জিলহজ মাসের দশম রাত (ঈদুল আজহা বা কোরবানি ঈদের রাত)"। রজব ও শাবান মাস হলো রমজান মাসের প্রস্তুতির মাস। এ প্রস্তুতি শারীরিক, মানসিক, আর্থিক অর্থাৎ সার্বিক বা সামগ্রিক। রমজানে যেহেতু মাসব্যাপী ইবাদত করতে হবে, তাই আগে থেকেই তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
রজব মাসে বর্জনীয় বিষয়সমুহ -
রজব মাসকে ঘিরে আমাদের মাঝে এবং কারো কারো কিছু কুসংস্কারও আছে। অনেকেই মনে করেন রজব মাসের একদিন রোজা রাখলে হাজার রোজার সওয়াব পাওয়া যায় (আমাদের সমাজে এ ধারনা প্রচলিত আছে যে, ২৭ রজবে রোজা রাখা অনেক ফজিলত। এমনকি অনেকের মধ্যে এ বিশ্বাস রয়েছে যে এই একটি রোজার ফজিলত এক হাজার রোজার সমান। এ জন্য তাকে কেউ কেউ হাজারি রোজা বলেও অভিহিত করেন) । রজব মাসে হাজারি রোজা বলতে কোনো রোজা নেই, এটি বানোয়াট। (কিতাবুল মাওদুয়াত, ইবনুল জাওজি : ২/২০৮, তালখিসুল মাওদুয়াত, পৃষ্ঠা ২০৯, তাজকিরাতুল মাওজুয়াত, পৃষ্ঠা ১১৬, আল আসারুল মারুপা, পৃষ্ঠা-৫৮)
এ ছাড়া জাহেলি যুগে এ মাসে পশু জবাই করে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হতো, যাকে ‘আতিরা’ বলা হতো। রাসুল (সাঃ) এ ধরনের কুসংস্কার থেকে বিরত থাকার আদেশ করেছেন। (বুখারি শরীফ, হাদিস নং - ৫৪৭৩)। তাই রজব মাসকে ঘিরে এ ধরনের কোনো কুসংস্কারে লিপ্ত হওয়া যাবে না। অনেকের মধ্যে আবার সন্দেহ কাজ করে এই মাসে বিয়েশাদি করা যাবে কি না যেহেতু তা নিষিদ্ধ মাস? রজব মাসে বিয়েশাদি নিষিদ্ধ এমন কোনো নির্দেশনা কোরআন-হাদিসে পাওয়া যায় না, তাই এ ধরনের প্রশ্ন করাই অবান্তর।
আমাদের সকলকে রজব ও শাবান মাসে বেশী বেশী নেক আমল ও পাপ বর্জনের মাধ্যমে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। তওবা ও ইস্তিগফার করতে হবে। মোহমুক্তি ও পাপ পরিহার করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সমাজে একে অন্যকে সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে হবে। রমজান মাসে যেন ইবাদতের পরিবেশ রক্ষা হয়, সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। সকল মুমিন মুসলমানের উচিত, রজব মাসের মর্যাদা, ফজিলত ও আমলের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। রমজানের পরিপূর্ণ ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে রজবের মাসের ফজিলত, মর্যাদা ও আমলের প্রতি গুরুত্বারোপ করার তাওফিক দান করুন। তাই আসুন, আমরা রজব মাসের যথাযথ ফজিলত অর্জনের চেষ্টা করি। অনর্থক বিদয়াত কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখি।
তথ্যসূত্র - আল কোরআন,হাদীস ও ইসলামী বিশ্বকোষ ।
===================================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
ঈমান ও আমল - ১২ Click This Link
" দোয়া " কি এবং কেন ? কাদের জন্য দোয়া শুধু ধোঁয়া বা কাদের দোয়া কবুল হয়না ?
ঈমান ও আমল - ১১ Click This Link
" পবিত্র ও সম্মানিত মাস মহরম " - হিজরি সনের প্রথম মাস এবং পবিত্র আশুরা ।ইসলামে আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আশুরার দিনে করণীয় ও বর্জনীয় ।
ঈমান ও আমল -১০ Click This Link
("পবিত্র মাস জিলহাজ্জ"-জিলহাজ্জের প্রথম দশ দিন মুসলমানদের নিকট বছরের সেরা দশদিন-ঈমান ও আমলের জন্য)।
ঈমান ও আমল - ৯ Click This Link
(" শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা " - যা সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব হাসিলে সাহায্য করে। পবিত্র রমজানের পর যা সকল মুসলমানেরই রাখা উচিত)।
ঈমান ও আমল - ৮ Click This Link
(আজ পবিত্র " লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত "। মহিমান্বিত এ রজনীতে মুসলমানদের করণীয় ।)
ঈমান ও আমল - ৭ Click This Link
("যাকাত " ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ । যা আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির ও প্রতিশ্রুতি দেয়)।
ঈমান ও আমল - ৬ Click This Link
("রোযা" ইসলামের তৃতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ । যার বিনিময় বা প্রতিদান আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন নিজেই দিবেন)।
ঈমান ও আমল - ৫ Click This Link
(" নামাজ " ইসলামের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ । যা মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে পার্থক্যকারী সূচক হিসাবে বিবেচিত এবং মুসলমান মাত্রই দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে)।
ঈমান ও আমল - ৪ Click This Link
("ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ"- যার শুরুটা কালেমা বা ঈমানে। যা শুধু মুখে বলা নয়,অন্তরে বিশ্বাস ও কর্মে পরিণত করার বিষয়)।
ঈমান ও আমল - ৩ Click This Link
(তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব )।
ঈমান ও আমল - ২ Click This Link
("শুক্রবার - পবিত্র জুমা"- মুসলমানদের জন্য এক মর্যাদা ও ফজিলত পূর্ণ দিন এবং জুমার দিনের কতিপয় আমল )।
ঈমান ও আমল - ১ Click This Link
(যেসব আমলে মানুষের অভাব দূর হয় ও জীবন সুখের )।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২২ বিকাল ৫:০৩