somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবা, আমার বাবা, যাকে ছাড়া আমার আমি হয়ে ওঠা হত না!!

০৬ ই জুলাই, ২০১০ দুপুর ১২:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেদিন মা সেজে গুজে দিলেন, সাথে প্রিয় বলটা নেঁটে জড়িয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে নিতে ভুললাম না। এরপর উঠে বসলাম সাইকেলের রডে। বাবা চালিয়ে যাচ্ছেন সাইকেল স্কুলের পানে, আমার তখনও প্রাইমারী স্কুলে পড়ার বয়স হয়নি, এরপরও মনযোগী ছাত্রের মত বাবার সাথে প্রতিনিয়ত স্কুলে যেতাম। এটা এমনই একটা স্বাভাবিক কর্মকান্ডে পরিনত হয়েছিলো যে, বাড়ির প্রায় সাথে লাগানো প্রাইমারী স্কুলে কখনই যাওয়া হয়নি। বাবার সাথে স্কুলে গিয়ে আমার কাজ আর কি, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কোলে বসে থাকা, না হয় নিজের ফুটবলটা নিয়ে ‘বন্ধু’ হয়ে ওঠা আব্বার কলিগদের সাথে, বড় ক্লাসের ছাত্রদের সাথে খেলা। কখনো আবার বাবার কোলে বসে ক্লাস নেয়া দেখা, কখনো আবার ছাত্রদের সাথে বেঞ্চে বসে আগামীর ছাত্র হবার প্রকাটিস করা, স্কুলে পরীক্ষার সময় বাবার সাথে ডিঊটি দেয়া, ছাত্রদেক ল্যুজ পেজ দেয়া, এমনকি নকলও ধরে দিতাম। এই হলো আমার সব কর্মজজ্ঞ স্কুলের ভর্তি হবার আগেই । যা হোক এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম আর সাইকেলের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে ছিলাম, হঠাত দেখি আমি মাটিতে পড়ে গেছি, বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি নাক দিয়ে সবুজ রস বেরুচ্ছে, কিছুই বুঝায় বয়স হয়নি, শুধু বাবা বাবা বলে কাঁদছিলাম যে বাবা মনে হয় খুব আঘাত পেয়েছে। আসলে সাইকেলের সামনের চাকা আর রডের মাঝে ফুটবল ঢুকে যাওয়ায় বাবা তাল সামলাতে না পেরে রাস্তা থেকে নিচে পড়েগিয়েছিলাম। বাবা আমার কান্নাকাটি দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে সাহস দেন যে কিছু হয়নি, বাসা থেকে বের হবার সময় টাটকা যে পান খেয়ে এসেছিলেন সেটাই নাক দিয়ে বেরিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা এতই প্রভাব ফেলে আমার মনে তার স্থায়ীত্ব ছিল বেশকিছুদিন। স্কুলে গিয়েও কেঁদেছি সেদিন ভয়ে.........


হ্যাঁ, উপড়ের কথাগুলি আজ থেকে প্রায় ২৪/২৫বছর আগেকার স্মৃতিচারণ।দিন চলে যায় কিন্তু স্মৃতিগুলি বারে বারে নাড়া দিয়ে যায়। আজ ১৫ই জুলাই আমার জীবনের অন্যতম একজন আদর্শ, পথপ্রদর্শক, কান্ডারী, অভিভাবক, শিক্ষক, সর্বপরি আমার বাবা, তারঁ দীর্ঘদিনের কর্মময় শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন। স্কুল নিয়ে এতটাই মগ্ন থাকতেন যে, অনেক সময় নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতেন, মাঝে মাঝে খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম ছিলো স্বাভাবিক রুটিন, যার জন্য পেটে এসিডিটি ধরে ফেলেছেন, আর এই ফাইনাল পরিনতি হিসাবে সাম্প্রতিক সময়ে দু’বার স্ট্রোক। আগে থেকেই বলেছেন স্কুল থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেবেন না, এটা নাকি সহ্য করতে পারবেন না। আসলে মমতায় জড়ানো প্রতিষ্ঠানটি ওনার আরো একটি সন্তানের মত হয়েছে।তার হাতে গড়া হাজার হাজার ছাত্র এখন দেশে ও বিদেশে সুনামের সাথে কর্মজীবন অতিবাহিত করছেন। অনেকে বাবার কাছে এসে তাদের ছোট ভাই-বোন-সন্তানকে বিশেষ নজর দিতে বলেন। আমাদের পুরা পরিবার এর ভাই-বোন সব ওনার হাতে মানুষ হওয়া পড়াশুনায়। সাথে দরকার মত শাসন করতেও পিছপা হতেন না। সবাইকে নিজের সন্তানের মতি দেখতেন, আমি একমাত্র সন্তান হয়েও বাবার কাছে “বিশেষ” কিছু ছিলাম না, পড়াশুনার বিষয়ে। কঠোর শাসনের কারনেই হয়ত আমার এতদুর আসা। স্বজনপ্রীতি ধারে কাছেও ছিলেন না, আমার অনেক কাজিন, মামারা বাবার স্কুলের ছাত্র হলেও বাবা তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা প্রকাশ করেন নি। আমি যখন হাইস্কুলে স্কুলে ভর্তি হলাম, পরীক্ষার প্রশ্ন করার সময় বাবার রুম আমার জন্য পুরাপুরি নিষিদ্ধ ছিলো, হয়ত পারতেন আমাকে প্রশ্ন বলে দিয়ে ফাষ্ট করে দিতে, তাহলে হয়ত স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আর এতদুর আসতে হত না। অন্যায়ের সাথে কখনো করেননি আপোষ, শক্তহাতে স্কুল চালিয়ে নিয়েছেন, এখনও তাঁর কথায় ছাত্রা কাঁপতে বাধ্য যেখানে অন্যান্য শিক্ষকদের কেয়ারই করছে না ছাত্ররা।
অন্যান্যদের চেয়ে বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ বোঝাপড়াময় ছিলো, যেটা আরো বেশি হয়েছিল স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যাবার পর থেকে। এত কড়া শাসনে মানুষ হয়েছি যে, বড় রকমের আড্ডা দেওয়া ছিলো অসম্ভব। নিয়ম করে পড়াশুনা আর খেলাধুলা, মার খেয়েছিও প্রচুর। অবশ্য এক্ষেত্রে বাবার উইক পয়েন্ট বের করতে পেরেছিলাম, মার খাওয়ার সময়ে সুযোগমত ভো দৌড় দিতাম বড় চাচার কাছে, নইলে রক্ষা নাই। কলেজে পড়ার সময় থাকতাম খালার বাসায়, এখানেও প্রায় বাড়ির মত আদর-যত্ন আবার বাবার শাসনের মধ্যেই ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেকটা ফিকে হয়ে আসে বাবার শাসন। আগে যেখানে সন্ধ্যার সাথে সাথে বাড়ি না ফিরলে হাজারতা প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হত, সেখানে দেখলাম তেমন কোন প্রশ্ন আসছে না। বাবার নজরদারীতে অভ্যস্ত আমি মাকে বলি, বাবা কি আমার উপড় কোন কারনে অসন্তুষ্ট আমার উপড়ে, আগের মত কেন জানি খেয়াল রাখছে না, শুনে বাবা আমাকে বললেন, “ট্র্যাকে ঊঠার আগপর্যন্ত আমার দায়িত্ব ছিলো, যাতে ট্র্যাক থেকে ছিটকে না পড়ো, এখন একটা ট্র্যাকে ঊঠেছো, নিজের ভালো-মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে, আর ভয় নেই, এজন্যই আগের মত খেয়াল রাখা লাগে না ”। নিজেই ধন্ধের মাঝে পড়ে গেলাম। পরে চিন্তা করে দেখলাম, বাবার কথাই সত্যি, আগে যদি ভালো মন্দ বিচার করে শাসন করে আগলে না রাখতেন, তাহলে এই আমিই আর আমি থাকতাম না, বদলে যেতাম। কারন সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড় .........

কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বাবা সাইকেল চালিয়ে, অনেক বছর পর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে মটরসাইকেল কিনলেন, চালিয়ে যেতেন বাড়ি থেকে প্রায় সাত মাইল দুরের স্কুলে। তার এই দীর্ঘ চলার সময়ে যাত্রী হয়েছে আমার কিছু কাজিন, কিছু ছাত্রী আর আমি। আর শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিনের পর থেকে দীর্ঘ এই চলার পথের পরিচিত রাস্তা দিয়ে তাকে আর যেতে হবে না, শরীর ক্লান্তির ভারে কিছু ন্যুয়ে পড়লেও মন কি পারবে সেই পথে চলতে???? সাম্প্রতিক স্ট্রোকের পর বাড়িতে প্রায়দিনই ১৫/২০জন করে ছাত্র-ছাত্রীরা দেখে গিয়েছে বাবাকে, আর সবাইকে ধরে হুহু করে কেঁদেছেন, আমার যে বাবা সুস্থ অবস্থাত শত দুঃখ-কষ্ট ও পরিবারের উপড় দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ে মহিরুহের মত সবাইকে আগলে রেখেছেন, সেই বাবাই আজ নিজেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন, ফোন আগে কথা বললে আমাকে শান্তনা দিতেন, এই প্রবাসে একা একা থাকার জন্য, এখন প্রায়ই শুনি তা ভেজা গলা। সেদিন কেঁদেই বলছিলেন, “বাবা, যেভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম, আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম, যে আর হয়ত দেখা হবে না, এখন অন্তত সেই সাহস হচ্ছে.........।” আমার আর কিছু কানে আসছিলো না, টপটপ করে পানি পড়ছিলো..........[এই লেখাটার সময়ও চোখের পানি পড়ছে, নিষ্টুর কেন এই নিয়ম, কেনই বা সেই চিরাচরিত শেষ হবার দিকে যাওয়া, যেটা অলংঘনীয়] অসহায় লাগছিলো নিজেকে নিজের কাছে, যদি সাথে থাকতে পারতাম, আর কিছু না পারি বাবার মাথায় হাত তো বুলিয়ে দিতে পারতাম......

বাবা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি, পরিবারের সবাইকে মানুষের মত মানুষ করবেন এই আশায় আগেই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন এবং পারিবারের অর্থনৈতিক দুর্বলতায় বিএবিএড করে আর সামর্থ্য কুলায়ে না ওঠায় আর এগুতে পারেন নি, কিন্তু সেই দুঃখ ঘুচিয়েছেন হাজার হাজার সন্তানরুপি মানুষকে শিক্ষা দিয়ে। আজ এই দিনে, যদি কাছে থাকতে পারতাম, হয়ত বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখতাম, হয়ত মুখে বলতে পারতাম না, মনে মনে হলেও বলতাম, ছেলের সাথে বাবার আত্নার যে সম্পর্ক সেই সুত্রে বাবা হয়ত বুঝে নিতেন মনের ভাষা, “বাবা তোমাকে বড় ভালোবাসি, তোমার কোন অবদানই আমি শোধ করতে পারবো না, কিন্তু দোয়া করিও কখনও যেন তোমার অবাধ্য না হই, তার আগেই যেন মরণ আসে”। প্লিজ সবাই দোয়া করবেন বাবার জন্য, বাকিটা সময় যেন সুস্থভাবে সবাইকে নিয়ে হাসিখুশিতে থাকতে পারেন।

[বাবার অবসর আগামী ১৫ই জুলাই হলেও নিজের ব্যস্ততার জন্য ঐদিন নেটে আসা হবে না, এজন্যই এখনি লিখে ফেললাম]
২৪টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×