অবরুদ্ধ গাজাবাসীর জন্য ত্রাণ সাহায্যবাহী নৌবহরে হামলা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। গতকাল সোমবার ভোরে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় চালানো এই হামলায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চ্যানেল টেন। নিহতদের বেশির ভাগই তুরস্কের নাগরিক। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তুরস্ক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
গত রোববার সাইপ্রাস থেকে ১০ হাজার টন ত্রাণসামগ্রী ও সাত শতাধিক যাত্রী নিয়ে ছয়টি জাহাজের ওই বহরটি গাজার উদ্দেশে রওনা দেয়। তুরস্ক, গ্রিস, কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে এই ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। ইসরায়েল অবশ্য আগে থেকেই বলে আসছিল, তারা এই উদ্যোগকে বাধা দেবে। ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বৈঠকের আগে এ ঘটনা ইসরায়েলের জন্য একটি কূটনৈতিক সংকট তৈরি করবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
নৌবহরটির অগ্রভাগে থাকা তুরস্কের পতাকাবাহী একটি জাহাজে মূল হতাহতের ঘটনা ঘটে। গুলি চালানোর ব্যাপারে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ভাষ্য, সেনারা জাহাজ তল্লাশি করতে চাইলে প্রথমে জাহাজ থেকে তাদের ওপর গুলি ছোড়া হয় এবং ছোরা ও গলফ খেলার ছড়ি দিয়ে হামলা করা হয়। এর জবাবে সেনারা গুলি চালায়। এতে অন্তত ১৯ জন নিহত ও ৩৬ জন আহত হয়।
তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জেনারেল অ্যাভি বেনাইয়াহু বলেন, জাহাজে ওঠার পর কে সেনাসদস্যদের গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল, তা এখনো শনাক্ত করতে পারেননি তাঁরা। তবে সেনারা সহিংস হামলার মুখে পড়েছিল বলে তিনি দাবি করেন।
এ ব্যাপারে ত্রাণ বিতরণ উদ্যোগের আয়োজক সংগঠন ফ্রি গাজা মুভমেন্টের মুখপাত্র ম্যারি হুিঘেস থম্পসন বলেন, ‘যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, ইসরায়েলি কমান্ডো সেনারা হেলিকপ্টার থেকে জাহাজে নেমে এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।’ ওই নৌবহরের সঙ্গে থাকা সংগঠনটির আরেকজন মুখপাত্র অদ্রি বোমসে বলেন, এ ধরনের হামলা অনৈতিক। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো ধরনের সহিংস পদক্ষেপ নিইনি। জাহাজের দু-একজন যাত্রী সেনাদের খালি হাতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তা ছিল প্রতীকী বাধা।’ জাহাজের যাত্রীদের কোনো ধরনের গুলি চালানোর কথা নাকচ করে দেন তিনি।
ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা নৌবহরটিকে আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাবে। সেখানে নৌবহরের যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হবে। তুরস্কের টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য যাত্রীদের মারধর করছে। বেশ কয়েকজন আহত যাত্রী জাহাজের ডেকে শুয়ে রয়েছে। আল-জাজিরা টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, ইসরায়েলি নৌবাহিনীর সদস্যরা যাত্রীদের সরাসরি গুলি করেছে এবং জাহাজে উঠে তারা ক্যাপ্টেনকে আহত করেছে। এ সময় সেনাদের একজন হিব্রু ভাষায় চিৎকার করে বলছিলেন, ‘সবাই চুপ থাকুন।’
ইসরায়েলের পুলিশ জানিয়েছে, হামলার ঘটনার পর সামরিক বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। ইসরায়েলের এক মন্ত্রী বেনিয়ামিন বেন-এলিয়েজার নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তুরস্ক সে দেশে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি তেলআবিব থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার এবং ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া বাতিল করেছে আংকারা। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, নৌবহরে হামলার ঘটনায় দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। তিনি বলেন, ‘বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ইসরায়েল আবার প্রমাণ করেছে মানুষের জীবন ও শান্তিপূর্ণ উদ্যোগের ব্যাপারে তারা উদাসীন।’ তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তাইপ এরদোগান দক্ষিণ আমেরিকায় সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরেছেন।
হামলার খবর জানার পর তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুুলে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী প্রতিবাদ সমাবেশ করে। রাজধানী আঙ্কারায় বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে সেখানকার ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেয়। পুলিশ তাদের দূতাবাসে ঢুকতে বাধা দেয়। তুরস্ক ওই অঞ্চলে ইসরায়েলের অন্যতম মুসলিম মিত্র। কিন্তু ১৮ মাস আগে ইসরায়েলের গাজা হামলারও তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল তারা।
ত্রাণবাহী নৌবহরে হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে আরব লীগ। সংস্থার প্রধান আমর মুসা বলেন, ‘এই মানবিক কর্মসূচি ও বেসামরিক মানুষদের বিরুদ্ধে হামলার নিন্দা জানাই আমরা।’ জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এই হামলার ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি করেছেন।
হামলার ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউ পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ক্যাথেরিন অ্যাশটন হতাহতের ঘটনায় সমবেদনা জানিয়েছেন। গতকাল এ ঘটনায় জরুরি বৈঠক আহ্বান করে ইইউ। গ্রিস সরকার সে দেশে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নৌবহরে থাকা ৩০ জন গ্রিক নাগরিকের অবস্থা দ্রুত তাদের জানানোর দাবি জানিয়েছে। ফরাসি সরকারও সে দেশে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দাবি করেছে। জার্মানি এই হামলাকে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই হামলার ঘটনাকে ‘হত্যাযজ্ঞ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এর নিন্দা জানিয়েছেন। এ ঘটনায় তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। এই হামলাকে অমানবিক উল্লেখ করে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, এই ঘটনা ইসরায়েলকে ধ্বংসের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। লেবাননের ইসরায়েলবিরোধী সংগঠন হিজবুল্লাহও এই হামলার ঘটনাকে মানবতাবিরোধী উল্লেখ করে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




