অফিসের পর ক্লাস শেষে বাসার লিফটে উঠে খুবই টায়ার্ড ফিল করছিলাম। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। এখানে সাধারনত কেউই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়ায় না। ওদেরকে স্কুল থেকেই শিক্ষা দেয় হেলান দিয়ে দাড়ানো মানে তোমার কোন স্ট্রেংথ নেই। যাহোক দোতালায় উঠতেই এক বোরকাধারী কেনিয়ান মহিলা লিফটে উঠেই আমার দিকে তাকিয়ে বললো আর ইউ টায়ার্ড। আমি বললাম হুম, যতটুকু টায়ার্ড তারচেয়েও বেশী টায়ার্ড ফিল করছি কারন যখনই মনে পড়ছে বাসায় যেয়ে রান্না করতে হবে, হাড়ি পাতিল ধুতে হবে কারন সকালে তাড়াহুড়া করে সবকিছু এভাবে রেখে চলে গেছিলাম। এখন ফিরে সব করতে হবে.... এখানেতো আর কাজের মেয়ে নেই!!
আমার ফ্লোরে আসতেই একসাথে নেমেই মহিলা হেসে বললো তুমিও একই ফ্লোরে থাকো? ও তুমিতো আমার নেইবার কিন্তু তোমাকে দেখি না কেন। কারন আমি সকালে বের হই আর রাতে ফিরি তাই আমাকে লবিতে দেখো না। কথা বলতে বলতে বাসায় ঢুকে পড়লাম। যাহোক ঘর ক্লিনিং এর যুদ্ধ শুরু করেছি কিছুক্ষন পরেই দেখি দড়জায় নক। খুলেই দেখি সে কেনিয়ান মহিলা হাতে এক বিশাল ট্রে।
আরে তুমি?
হাঁ তোমার যাতে রান্না না লাগে তাই আমি দিয়ে গেলাম।
মানে কি? ততততুমি....
আরে তুমি আমার নেইবার, আমার মুসলিম বোন, আমরাইতো আমাদের জন্য। এখন থেকে যখনই তোমার টায়ার্ড লাগবে, আমাকে নক করো। আমি সবসময়ই বেশী রান্না করি।
এরপর থেকে সে মহিলা প্রায় সময় অসময় আমাকে খাবার দিয়ে যায় এবং একবারে যা দিয়ে যায় তা দিয়ে আমি মোটামুটি তিনদিন চলতে পারি ....হাহাহাহাহাহা...... এভাবে ভালোই দিন পার করছি। তবে আমার ভাগ্য অনেক ভালো কারন শুধু এ কেনিয়ান আন্টি না অনেকেই খাবার দিয়ে যায়। এক দেশী ভাবী আছেন প্রতিদিন অফিসের পর এসে জানতে চাইবে চা করে দিব কিনা বা কোন নাস্তা। দারুন সব খাবার খাই ভাবীর হাতের। অসাধারন রান্না করেন তিনি........ যখনই কিছু খেতে ইচ্ছে করে সোজা ভাবীর কাছে আবদার।
কানাডায় আসার পরই অনেকদিন পর সেই ছোটবেলার অভ্যেসটা আবার মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় যেকোন পূজা বা ঈদে আমাদের পাশের হিন্দু দিদিমার বাসায় খাবার আদান প্রদান হতো। গোঁড়া দিদিমা কখনই কোন মুসলিমের খাবার স্পর্শ করতো না কিন্তু কেন যেন শুধু আমার মায়ের রান্না খেতো। আর আমরাতো সারা বছরই অপেক্ষা করতাম কখন পূজা শুরু হবে আর মজার নাড়ু সন্দেশ পাবো....। কানাডায় আসার পর সে পুরোনো স্মৃতি আবার ফিরে আসলো নতুনভাবে। এখানে আমরা সবাই থাকি অনেক মিলেমিশে, নতুন কিছু বা ভালো কিছু রান্না করলে কখনই পাশের কাউকে না দিয়ে আমরা খাই না। যে কোন প্রয়োজনে বা যে কোন উৎসবে একে অপরকে সহযোগীতা করি আমরা প্রান খুলে। ঢাকায় বা অন্যান্য বড় শহরগুলোতে যা চিন্তা ও করি না, এখানে এসে অনায়াশে আপন হয়ে যাই আমরা। ঢাকার বাইরে অন্যান্য শহরগুলোতে হয়তো বা কিছু সম্পর্ক আছে প্রতিবেশীর সাথে কিন্তু ঢাকায়তো এখন পাশের বাসায় কে থাকে অনেক সময় আমরা তাও জানি না, সম্পর্ক তৈরী করাতো দূরে থাক।
আসলে এটা কানাডিয়ান ইমিগ্রান্ট কালচার... বারো দেশের প্রতিবেশী এবং বারো রকমের কালচার। কিন্তু মজার বিষয় সবাই সব কিছুই সহজে মেনে নেয় বা বলা যায় আনন্দ দু:খ ভাগ করে নেয় সহজেই। পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা, বড়দিন সবই আমরা একসাথে আনন্দ করি। ঘুরতে যাওয়া, সময় অসময়ে পিকনিক করা, একসাথে শপিং এ যাওয়া....... এক সাথে এভাবে আনন্দ করার আনন্দ এখানে এসেই পেয়েছি।
শুধু দেশি লোকজন নয় অন্য দেশের সবাই ও খুব আপন হয়ে যায় খুব সহজেই। আমার এক কাশ্মিরি প্রতিবেশী অাছে এমন কোন দিন নেই যে আমার খোঁজ নেয়নি। যেকোন প্রয়োজনে বা যেকোন অনুষ্ঠানে সবার আগে আমার পাশে থাকে। আমি রান্না কম জানি বলে দারুন সব কাশ্মিরি রান্না আমাকে খাওয়ায়। অনেক কাশ্মিরি গিফট পেয়েছি উনার থেকে ......। বাচ্চাদের নিয়ে কোন টেনশানই করতে হয় না, একটু আসতে দেরী হবে জাস্ট কাশ্মিরি ভাবীকে ফোন করে দেই, উনিই সব ব্যবস্থা করে রাখেন। এ সম্পর্কের কোন নেয়া দেয়া নেই, কোন হিসেব নিকেশ নেই।
প্রথম আসার পর একবার আমার মেয়ের জ্বর হলো, কি করবো কোথায় যাবো বুঝতে পারলাম না, কাউকেই চিনি না। বাঙ্গালী বলে শুধু লিফটে পরিচয় হয়েছিল এক চিটাগাং এর ভাবীর সাথে। তাকেই ফোন দিলাম। সাথে সাথে দৈাড়ে আসলো। উনার গাড়ি দিয়ে নিয়ে গেল আমার মেয়েকে হাসপাতালে। সারাক্ষনই পাশে ছিল। এতোটা ভালো মানুষের দেখা পেয়ে মনে হয়েছিল সাক্ষাৎ কোন দেবদূত।
তার উপর এখানে আছে মারাত্বক মুসলিম বন্ডিং। যা দেশে চিন্তাও করি না। সারা বিশ্বের মুসলিমরা এক কাতারে দাড়িঁয়ে নামাজ পরি, রোজা রাখি ঈদ পালন করি..... কে বাংলাদেশী, কে ভারতীয় বা কে আফ্রিকান তা নিয়ে ভাবি না। সবাই সবার বাসায় ইফতারের ট্রে নিয়ে হাজির হয় পরিচিত বা কোন অপরিচিতের বাসায়।
সবাই এখানে সবার প্রয়োজনে এগিয়ে আসে, সময় অসময়ে সাহায্যের হাত বাড়ায়। আর সে কারনেই আপনজনকে ছেড়ে ও আমরা এতােটা ভালোভাবে থাকতে পারি। আপনজন চেয়েও আত্বীয় থেকে অনাআত্বীয়ই আপন হয়ে যায় এখানে।
আপন ভালো তো সব ভালো.............সবাই ভালো থাকুন।
আগের পর্ব:
আমার নিকটতম প্রতিবেশীরা - পর্ব ৪
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ৯:৪৩