খুব ছোটবেলায় দেখতাম ট্রেনে বা বাসে যেতে আসতে বাতের মলম বা দাঁতের মাজন যারা বিক্রি করে তারা দারুন সুরে প্রথমে গান গায়। তারপর গান শেষে পাবলিককে নিজের পণ্য বিক্রির চেষ্টা করে। বিক্রি বাট্টা ছাড়া শুধু গান গেয়ে বেড়ায় একমাত্র ভিক্ষুকরা। তাও আবার প্রায় সবাই ডিজএ্যাবলড অর্থ্যাৎ কেউ অন্ধ কেউবা পঙ্গু। এদেরকে দেখলেই মা যেভাবেই হোক পয়সা দিতো। এমনও হয়েছে ট্রেন হয়তো দূরে চলে গেছে কিন্তু মা অনেক জোরে সে পয়সা ছুড়ে প্লাটফর্মে ছুড়ে দিতো। তাই ছোটবেলা থেকেই এদের প্রতি এক ধরনের মায়া অনুভব করতাম।
প্রথম যখন ইউরোপের ট্রেনে এরকম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান শুনানোর পর টুপি খুলে সাহায্য চাইলো তখন একটু অবাকই হলাম মনে মনে। এরকম স্যুটেড ব্যুটেড কাউকে ভিক্ষা করতে প্রথমই দেখলাম। তাও আবার চমৎকার গান শুনিয়ে ভিক্ষা। নিজের আগের অভিজ্ঞতার সাথে মেলাতে মেলাতেই তারা নেমে গেল একটা স্টপেজ এ। এরপর থেকে যেখানেই গেছি ইউরোপের বা আমেরিকার দেশে ওদেরকে পেয়েছি রাস্তা ঘাটে মাঠে ট্রেনে বাসে। পরে জেনেছি এভাবে গান গেয়ে বেড়ানোই তাদের নেশা ও পেশা।
কানাডার প্রায় প্রতিটি সাবওয়ে বা ট্রেন প্লাটফর্মে এদেরকে দেখা যায়। কি যে অসাধারন বাজায়। এরা প্রত্যেকেই লাইসেন্সধারী মিউজিশিয়ান। অনেকেরই একাধিক মিউজিক সিডি আছে মার্কেটে। অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত। তারপরও ওরা এ প্লাটফর্মে বা ট্রেনে বাজায়ে ভিক্ষা করে। আমি যখনই এদেরকে দেখি খুব ব্যস্ততা না থাকলে দাড়িঁয়ে ওদের মিউজিক শুনি ও কিছু পয়সা দিয়ে গন্তব্যে রওনা দেই। অবশ্য এটাকে ভিক্ষা বলা যায় না পুরোপুরি এটাও একটি পেশা। গভ: লাইসেন্স ছাড়া এরা যেখানে সেখানে বসতে ও পারে না। লাইসেন্স নিয়ে তবে্ এরা পথে পথে গান গেয়ে বেড়ায়। যা পায় তা দিয়েই চলতে থাকে তাদের জীবন।
তবে আমি প্রায় ওদের ভিক্ষার ঝুলির দিকে তাকাই ও গোনার চেস্টা করি কেমন ইনকাম তারা করেছে। নিজে এ পেশার যাবার কোনরুপ কোন ইচ্ছে নয় জাস্ট কিউরিসিটি। কিন্তু কখনই তেমন কোন টাকা পয়সা সেখানে দেখিনি। খুব সামান্য কিছু খুচরা পয়সাই পড়ে থাকতে দেখি। ভাবতে খুব অবাক লাগে ইউরোপ বা আমেরিকার মতো দেশে এক দুই ঘন্টা কাজ করলে যে ইনকাম হয় তা দিয়ে সারাদিনের খাওয়ার পয়সা জোগাড় হয়ে যায়। তারপরও তারা তা না করে দিনের পর দিন এভাবে ভিক্ষা করে দিন কাটায়। দেশে ভিক্ষুকরা ভিক্ষা করে পেটের দায়ে আরে পশ্চিমা বিশ্বে এরা ভিক্ষা করে শখে।
আরেক শ্রেনীকে পেয়েছি বিশেষ করে জার্মান এর বার্লিনে বেশী দেখেছি তারা হলো জীবন্ত স্টাচু। অর্থ্যাৎ সারা গায়ে চুন বা কালি বা যেমন খুশি সাজোঁর মতো করে সেঁজে দাড়িঁয়ে থাকে একেবারে স্টাচুর মতো করে। কোনভাবেই আপনি বুঝতে পারবেন না এরা জীবিত নাকি স্টাচু। বিশেস করে ঠান্ডার মতো দেশে এরকম স্বল্প পোষাকে প্রবল বাতাসে কিভাবে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িঁয়ে থাকে দেখলে মায়াই লাগে। ওদের থালাতেও তেমন কিছু দেখিনি ইনকাম হিসেবে।
তবে বার্লিন এর জীবন্ত স্টাচু ওয়ালারা কিন্তু পুরোদমে কর্মাশিয়াল। কেউ হিটলার সেজেঁ, কেউ মুসোলিনি সেজেঁ কেউবা মিকি বা গ্যাস চেম্বারের মুখোশে আছে। পয়সা দিবেন আর পাশে দাড়িঁয়ে ছবি তুলবেন। কিন্তু যদি পয়সা না দেন আপনি কোনভাবেই ছবি তুলতে পারবেন না। মুখ ঘুরিয়ে নিবে সাথে সাথে।
ছবির মিউজিশিয়ানের সাথে আমার খুব সখ্যতা। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় দাড়িঁয়ে তার গান শুনি। সে আমাকে দেখলেই গানের মাঝেই একগাল হেসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানায়।
একে দেখে কি মনে হচ্ছে চমৎকার স্টাচু... তাই নয় কি!!! কিন্তু আপনি পয়সা দেবার সাথে সাথে টুপি খুলে আপনাকে অভিবাদন জানাবে। জার্মানীরে ড্রেসডান শহরে তোলা।
একে দেখে আমার খুব মায়া হয়েছে। এতো ঠান্ডা ও প্রবল বাতাস ছিল কিন্তু এর মধ্যে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। এটি জার্মানীর ড্রসলডাফ এ তোলা।
উপরের সবগুলো জার্মানীর বার্লিনে তোলা। সেখানে স্টাচু থেকে যেমন খুশি তেমন সাজের লোকজনই বেশী দেখা যায়। পয়সা দিবেন ছবি তুলবেন পাশে দাঁড়িয়ে এবং এর নির্দিষ্ট রেট ও আছে।
এটা বোনাস....
সব ছবিই আমার তোলা এবং যথাযথ পার্মিশন নিয়েই তুলেছি
লিখার অনুপ্রেরণা: ব্লগার খায়রুল আহসান ভাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ৯:৪৮