অনেকদিন থেকেই ভাবছি নিজের প্রিয় মানুষগুলোর একটা তালিকা করবো। এ মানুষগুলো নিয়ে প্রায়ই ভাবি। আমার জীবনে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে এ মানুষগুলো অনেক ভূমিকা রেখেছেন, অনেকভাবে প্রভাবিত করেছে আমাকে। নিজের খেরো খাতায় তাই তাদের পরিচয় লিখে রাখার চেস্টা করছি ও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি সবার সাথে।
আমার বাবার বড় চাচা আরশাদুল্লাহ চৈাধুরী, আমার দাদা। যিনি আমার বাবার পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন। আমার অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ। আজকে উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।
দাদা চাকরী করতেন তখনকার গ্রীন্ডলেজ ব্যংকে (পরে তা মার্জ হয় স্টানডার্ড চার্টাড ব্যাংক এর সাথে)। দাদা সেখানকার চিফ ফাইনানসিয়াল অফিসার (সিএফও) ছিলেন। আর উনার পোস্টিং ছিল চিটাগাং এ। বাবার চাকরীর সুবাধে আমাদের জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছিল চিটাগাং, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই। আর যার কারনে আমাদের বাসায় দাদার আসা যাওয়া ছিল প্রায়। দাদা খুব মজা করে গল্প বলতেন। তাই দাদা যখনই বাসায় পা দিতেন আমরা সব ভাই-বোন দাদার চারপাশে মৈামাছির মতো ঘুরে বেড়াতাম। দাদার হাতে সবসময়ই থাকতো একটা ছোট ব্রিফকেস। ওটা ছিল আমাদের কাছে রাজ্যের বিস্বয়। কারন ওটা থেকেই বেড়িয়ে আসতো আমাদের জন্য নানা কিছু। চকলেট মিঠাই ছাড়াও পেপার ক্লিপ, রঙ্গীন কলম, পেন্সিল সহ যাবতীয় জিনিসে ঠাসা ছিল সে ব্রিফকেস।
সবাইকে ছাড়িয়ে আমি ছিলাম দাদার কঠিন ভক্ত। দাদার গল্পগুলো আমি চোখ গোল গোল করে শুনতাম। আর দাদাও অজানা কারনে আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। আমাদের সম্পর্ক উনার আশি বছরে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একই রকম ছিল। ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম তখন, দাদা যখনই চিটাগাং থেকে ঢাকায় ফুফুর বাসায় আসতেন তখনই তিনি সবাইকে জ্বালিয়ে মারতেন আমাকে হল থেকে নিয়ে আসার জন্য। আমাকে উনি ডাকতেন সুহানী বলে। আমি আসলেই আমার হাত ধরে থাকতেন। কত গল্প করতাম আমরা। বেশীরভাগই রাজনীতি নিয়ে, দেশের সমস্যা নিয়ে, আমাদের পরিবারের অনেক কথা জানাতেন। আমি মন্ত্রোমুগ্ধের মতো শুনতাম সে সব গল্প।
দাদা খুব সৈাখিন ছিলেন পোষাক আসাক সহ সব কিছু নিয়ে। সবসময়ই সাদা ডায়ালের ঘড়ি পড়তেন, সাদা শার্ট/পান্জাবী/ফতুয়া পড়তেন। আমি হেসে বলতাম, দুনিয়ার এতো রং থাকতে সাদা কেন? দাদা ব্যাখ্যা করতেন সাদা ডায়ালে রাতে ঘড়ি দেখতে সুবিধা। সাদা রং এ নিজেকে পবিত্র মনে হয় আর সাদা রং নিয়েইতো দুনিয়া ছেড়ে যাবো। তারপর থেকে কেন যেন সাদাই আমার প্রিয় রং হয়ে উঠলো।
দাদাকে নিয়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি যেমন আছে তেমনি অনেক কষ্টের স্মৃতিও আছে। দাদা ছিলেন একজন আপাদমস্তক উদাসীন মানুষ। কোনভাবেই বৈষয়ক মানুষ ছিলেন না। এতো বড় পজিশানে থাকার পরও ছিলেন খুবই সহজ সরল। যে যাই বলতো তাই খুব সহজে বিশ্বাস করতেন। মানুষের দু:খে কস্টে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যার কারনে এতো অর্থ আয় করার পরও তেমন কিছু ছিল না উনার। এমন কি উনার রিটায়ারমেন্টের পর উনার টাকার বড় অংশই বলতে গেলে উনার সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজনরা ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। কারো ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য, কারো মেয়ে বিয়ের জন্য, কারো জমি-জমা নিয়ে ঝামেলার জন্য বা কারো অভাবী দেখে নিজেই যেচে টাকা দিয়ে আসতেন। আমি প্রায়ই বলতাম, দাদা আপনিতো জানেন এ লোকটা আপনার টাকা ফেরত দিবে না। তা জেনেও কেন আপনি দিলেন? উনি এক গাল হেসে বলতেন, বইনরে ওই টাকাতো আমার কাছে বাড়তি। না হলেও তেমন ক্ষতি নেই কিন্তু ওর তো সেটা জীবন মরন। তাই তার প্রয়োজনটা আমার চেয়েও বেশী।
রিটায়ারমেন্টের পর একসাথে অনেক টাকা পাওয়ার পর উনার এক শুভাকাঙ্খী উনাকে বুদ্ধি দিলো রামুর পাহাড় কেনার জন্য। উনাকে বললো, এ পাহাড় কিনে যদি উনি রাবার গার্ডেন করেন তাহলে দারুন লাভ হবে। প্রাথমিক খরচের পর আর তেমন কোন খরচ নেই। এরপর বছর বছর শুধু উৎপাদন। তারপর দাদা সেখানে বিশাল অংকের টাকা ইনভেস্ট করলেন। তখন আমরা ছিলাম কক্সবাজারে। যার কারনে দাদা প্রায়ই আসতেন আমাদের বাসায় রামুতে যাওয়া আসার সময়। রামুর পাহাড়ের চূড়ায় ছোট ঘর করে দাদা সেখানে থাকা শুরু করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে প্রায় বছর দুয়ের উনি দিন-রাত পরিশ্রম করে পাহাড় কেটে, জঙ্গল সাফ করে, শ্রমিকদের জন্য ঘর বানিয়ে, পানি/সেনিটেশানের ব্যবস্থা করেছিলেন। সব কাজ যখন শেষ হলো তারপর এক রাতে স্থানীয় নেতা, গুন্ডা পান্ডারা উনার উপর হামলা করলো। উনাকে জানে মারেনি বলে আমরা কৃতজ্ঞ তবে জীবনের বাইরে আর কিছুই উনি ফেরত পাননি। অবশ্য এ নিয়ে উনাকে কখনো দু:খ করতে দেখেনি। উনি হাসতে হাসতে বলতেন, বইন, মনে করো জানের সদকা ওটা। জীবনটাকে যত সহজ ভাববে ততই সহজ হবে। জটিলভাবে চিন্তা করলে অশান্তিই বাড়বে। যা হারিয়েছি মনে করি ওটা আমার জন্য ছিল না। তাই ওটা নিয়ে ভেবে নিজের বর্তমানকে কেন নষ্ট করবো।
বাংলাদেশের আর সব গ্রামের মতই উনার বাড়িতে তখন বিদ্যুত ছিল না। তবে উনার একটা ফ্রিজ ছিল যা কেরোসিনে চলতো। আমার জীবনে প্রথম কেরোসিনের ফ্রিজ দেখা। একটা বিদেশী জাহাজ থেকে উনি কিনেছিলেন। যখনকার কথা বলছি তখন ফ্রিজ ছিল সাধারনের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো। আমরা যখন দাদার বাড়িতে যেতাম তখন উনি সে ফ্রিজটা চালাতেন আমাদের জন্য। কারন এতো বেশী কেরোসিন খরচ হতো যে তা অন্য সময় চালাতে চাইতেন না দাদী। কিছু বাটিতে পানি, কিছু বাটিতে দুধ চিনি দিয়ে আইসক্রিম বানানোর চেস্টা করতেন দাদা-দাদী। আমরা পাগলের মতো খেতাম তা। তখন শুধু বরফ খাওয়াই ছিল আমাদের জন্য স্বপ্ন। তার উপর ফ্রিজ থেকে নামিয়ে এনে তা খাওয়ার যে আনন্দ তা বলে বোঝানো যাবে না।
দাদা প্রায় আশির কাছাকাছি বয়স বেচেঁছিলেন। শেষ দিকে আমি খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম চাকরী, সংসার. সন্তান নিয়ে। তাই সেরকম ভাবে যাওয়া হতো না উনার কাছে। কিন্তু মনটা প্রায় উনাকে দেখার জন্য আনচান করতো। মৃত্যুর শেষ সময়ে উনার পাশে হাত ধরে বসেছিলাম। তারপর একদিন চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। এখনো প্রায় ভাবি সে নিরংহকার সাধাসিধে ভালো মানুষটির কথা, উনার সাথে কাটানো দিনগুলোর কথা, উনার বলে যাওয়া আদর্শের কথা। ওপারে ভালো থাকুক আমার প্রিয় মানুষটি।
দাদার কোন ছবি আমার কাছে নেই একটি ছাড়া যা উনার শেষ বয়সের ছবি। সেটাই শেয়ার করলাম সবার সাথে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২১ সকাল ১০:১৯