প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই দেখি বিশাল ক্যাচাল, উত্তর আর দক্ষিন কোরিয়ার মতো দুই শ্রেনীতে বিভক্ত ক্লাস। এর এক শ্রেনী হলো ঢাকার বাসিন্দা যারা নিজেদেরকে শের শায়ের বংশধর মনে করে। আর দ্বিতীয় শ্রেনী হলো আমরা যারা গ্রাম গন্জ মফস্বল থেকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। তো এ ভিআইপি শ্রেনী মনে করে আমরা মনে হয় এইমাত্রই সদরঘাট থেকে নেমে ক্লাসে ঢুকছি। ঢাকা শহরের লাল নীল বাত্তি আমরা জীবনের এ প্রথম দেখছি।
তো এই প্রথম শ্রেনী রীতিমত ভাব নিয়ে ক্লাসে ঢুকে, নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব করে, তুই তোকারী করে ক্লাসে কথা বলে, হৈচৈ আড্ডায় মেতে থাকে ক্লাসে, বিশাল জন্মদিনে পার্টি করে, আর আমাদেরকে নিয়ে বেশ তুচ্ছ তাচ্ছিল ভাব নিয়ে চলে। একজনতো রীতিমত প্রশ্নই করে বসলো তুমি কি এর আগে কখনো কারেন্ট দেখেছো, তোমাদের বাসায় নিশ্চয় কোন কারেন্ট নাই!!! হাহাহাহা.......
যাহোক, তাদের দাপটে আমরা মোটামুটি মাইনকার চিপায় বইসা পড়লাম। এদিকে আমারতো মোটামুটি হার্টফেল করার অবস্থা। কই আইসা পড়লাম, কেমনে দিনকাল কাটামু, কেমনে পড়ুম এই আঁতেলগো লগে। বাসায় কিছু কওয়া যাচ্ছিল না কারন নিজের ইচ্ছায় জোর কইরা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইছি্ আবার এদিকে সহ্যও যায় না এদের ভাব!
এদিকে আবার গোপন সূত্রে জানতে পারলাম ব্রাম্মণ গ্রুপে আবার তিন ভাগ। ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ আর নটেরডেম কলেজ। মেয়েরা দুইভাগে বিভক্ত হলিক্রস আর ননহলিক্রস। যদিও আমাদের আমরা সর্ব সাকূল্যে ১৩ জন মেয়ে ছিলাম। কারন একেতো বানিজ্য বিভাগ তারউপ্রে এ্যাকাউন্টিং তাই মেয়েরা খুব কমই এ পথ মাড়াতো।
এই ভাগাভাগিতে যখন আমি দিশেহারা তখন দেখলাম ক্লাসে আসল ভাগ হলো সেকশান... সেকশান A ও সেকশান B। অর্থাৎ যারা ভর্তি পরীক্ষার মেধায় তালিকায় আগে ছিল তারা সেকশান এ আর পিছনেরগুলো সব সেকশান বি। আমি যদিও সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১২১ নাম্বারে ছিলাম কিন্তু কিছু কাগজ পত্রের সর্টের কারনে সময়মতো ভর্তি হতে না পারায় সেকশান বি তে পড়লাম। অবশ্য বলে নেই, সে সময়ে এ কাগজ পত্র নিয়ে আমাকে দৈাড়াতে বেশ সাহায্য করেছিল আমার বন্ধূ সুধীর, সেও গাঁও গেরাম থেকে আসছিল আমারই মতো। মফস্বল থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বিশাল রেজিস্টার বিল্ডিং এর প্যাঁচ বোঝা খুব কঠিন একটা কাজ ছিল। কলাভবনের প্যাচঁ বুঝতেই মাথা খারাপ অবস্থা ছিল। আর তখন এখনকার মতো বানিজ্য ভবন না থাকার কারনে কলা ভবনেই আমরা ক্লাস করতাম অনেকটা কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার মতো অবস্থা। সে গল্প আরেক পর্বে।
যাক, যা বলছিলাম। তো সেকশান ভাব নিয়েও বিশাল অবস্থা। যারা সেকশান এ তে ছিল তারা আবার সেকশান বি কে দেখলে নাক মুখ কান গলা সবকিছুই ছিটকাতো। আর সেকশান বি তাই নিজেদের মাঝেই চলার চেস্টা করতো। তবে এ সেকশান বি তে ও কিছু ঝামেলা তৈরী হলো। কিছু মিডল গ্রুপ ছিল যারা ঠিক জায়গা করে নিতে পারছিলনা ব্রাম্মণদের গ্রুপে। কিছুদিন পর অবশ্য তারা অবশেষে জায়গা করে নিল আমাদের মতো ক্ষেতে কাজ করা কৃষক মজুরদের সাথে।
তবে ক'দিন এদের ভাব সহ্য করে আমরা ক্ষেত মজুররা নিজেরাই বন্ধুত্ব করা শুরু করলাম। এরই মাঝে আমার সাথে বন্ধূত্ব হলো হাফ ভিআইপি হাফ ক্ষেত মজুর শ্রেনী নারায়নগন্জের দল। এরা অবশ্য কিছুটা মাইনকার চিপায় ছিল প্রথম থেকেই, না ভিআইপি বেশ ধরতে পারছিল, না ক্ষেত শ্রেনীর খাতায় নামও লিখাতে পারছিল। হাজার হোক নারায়নগন্জ ঢাকার বাড়ির পাশের মানুষ। তবে এদের একটা স্ট্রং দিক ছিল এরা সবাই একসাথে দল বেধেঁ চলতো। সকালে নারায়নগন্জ থেকে আসতো সবাই মিলে আবার ক্লাস শেষে একসাথে ফিরে যেত এক সাথে। ওদের বন্ডিং এর কারনে ব্রাম্মণরা এদেরকে খুব একটা ঘাটাতো না।
আজ এ পর্যন্ত। নেক্সট নিয়ে আসবো বন্ধুত্ব পর্ব।
সোহানী
জুন, ২০২১
বি: দ্র: একটু কারেকশান করছি। আমার বন্ধুরা জানিয়েছে ক্লাসের সেকশান ভাগের যে পদ্ধতি আমি বলেছি তা ঠিক নয়। ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকা নয়, যে আগে ভর্তি হবে তার আগে রোল হবে। এবং এর মাঝেই প্রথম ভর্তিকৃত ৭৫ জন সেকশান এ তো ও বাকি ৭৫ জন সেকশান বি তে যাবে। একেকটি বিষয়ে ১৫০ জন করে ৪টি বিষয় এ্যাকাইন্টিং, ফিন্যান্স, ম্যানেজমেন্ট ও মার্কেটিং এ মোট ৬০০ জন ভর্তির সুযোগ পেতো।