সকালে মেইল বক্স খুলে ব্রাউন খামটা হাতে পেয়েই বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো। লাল না নীল না একিবারেই ব্রাউন খাম!! কানাডার ব্রাউন খাম মানে সরকার বাহাদুর আপনাকে স্মরণ করছে। এবং সে স্মরণ সাধারনত সুখকর কোন স্মরণ না। চিঠিটা হাতে পেয়েই দুরুদুরু বুকে ভাবতে লাগলাম গত দুই সাপ্তাহে কোন আকাম কুকাম করেছি কিনা!! নাহ্ তেমন কিছুইতো মনে পড়ছে না, আমি যতদূর জানি আমি নিতান্তই আলাভোলা ভালো মানুষ!!
যাহোক, অনেক সাহস সঞ্চয় করে চিঠি খুলতেই বেড়িয়ে আসলো আমার চমৎকার দুইখান ফটোগ্রাফ! আমি দারুনভাবে রেড লাইটের উপর গাড়ি চালাচ্ছি! একটি ছবিতে স্পষ্টই আমাকে দেখা যাচ্ছে আর আরেকটিতে আমার গাড়ির নাম্বার প্লেট! (আগে জানলে আরেকটু সাজুগুজু করে গাড়ি চালাতাম)। আর সাথে সোনার অক্ষরে লিখা একটি চিঠি যেখানে বলা হয়েছে যে ১.০৮ সেকেন্ড লাল বাতির উপর গাড়ি চালানোর অপরাধে আপনাকে ৩২৫ ডলার + ট্যাক্স জরিমানা করা হইলো!! এখন আপনার জন্য তিনখান পথ খোলা!
নাম্বার ওয়ান পথ: ভালোই ভালোই সরকারী কোষাগারে উক্ত টাকা জমা দেন!
নাম্বার টু পথ: চাইলে সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনী পক্রিয়া চালাইতে পারেন।
নাম্বার থ্রি: মাপ চাহিয়া আদালতে নির্দিষ্ট সময়ে হাজিরা দেন। মাননীয় আদালতের কাছে আপনার আকুল আবেদন পেশ এর নিমিত্তে তা বিবেচনায় আনা হইবে। ও পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানানো হইবে।
আমি পড়ি কি মরি করিয়া নাম্বার থ্রি টিক চিহ্ন দিয়া আদালত পানে ছুটিলাম পরেরদিন। গুগুল ম্যাপে এড্রেস দিয়ে আদালত এরিয়ায় পৈাছালাম ঠিকই কিন্তু গাড়ি রাখার জন্য কোন পার্কিং চারপাশে খুঁজে পেলাম না। এখানে সেখানে যা দু'একটা পার্কিং পেলাম তা ফুল, কোথাও ঠাঁই নাই। অনেক কষ্টে একটা পাবলিক পার্কিং লটে ঢুকে চিতা বাঘ যেমন শিকার ধরে তেমনি উৎ পেতে থাকলাম কোন গাড়ি বের হলেই ঢুকবো। যাহোক, ঘন্টা খানেকের কসরতের পর একটা গাড়ি বের হলো ও একটা জায়গা পেলাম। সমস্যা হলো গাড়ি রেখে টিকেট কেটে গাড়ির ডিসপ্লেতে রাখতে হবে। চারপাশে খুঁজে পার্কিং টিকেট এর মেশিন দেখে ছুটলাম সেখানে। তাড়াতাড়ি ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করে টিকেট প্রিন্টিং এর যেই বাটন টিপ দিলাম দেখলাম টিকেট বাবাজি অর্ধেক বের হয়ে আর বের হয় না।
এদিকে আমি ঘড়ি দেখছি, আদালত ৫ টায় বন্ধ, তার আগেই পৈাছাতে হবে। আর অর্ধেক বের হওয়া টিকেট ধরে টানাটানি করছি। বেশী জোড়েও টানতে পারছি না যদি ছিড়ে যায় আবার আস্তে টেনেও বের করতে পারছি না। সে এক ইলাহী কান্ড! কিন্তু নাহ, আমার সকল চেস্টাকে ব্যার্থ করে টিকেট বাবাজি কোনভাবেই বের হচ্ছে না। পার্কিং মেশিনে টানাটানি থাপড়া থাপড়ি সমানে চালাতে লাগলাম। এদিকে আবার যে কেডিট কার্ড দিবো তারও উপায় নাই কারন প্রিন্টই তো কাজ করছে না। আর এভাবে টিকেট না কেটে গাড়িও রেখে যেতে পারছি না। কারন টিকেট না কাটলে কম করে আড়াইশ ডলার জরিমানা। কি ঝামেলায় যে পড়লাম!
আমার এরকম টানাটানি থাপড়া থাপড়ি সম্ভবত: সিসি ক্যামেরায় দেখে এক পার্কিং পুলিশ দেখি পো পো করতে করতে হাজির।
এনি প্রবলেম? জানতে চাইলো।
তাহাকে সব কিছু বলার পর সে নিজের পকেট থেকে মোবাইল টিকেট কাটার মেশিন বের করে টিকেট হাতে ধরায়ে দিলো। সেটা নিয়ে দৈাড়াতে দৈাড়তে গাড়িতে রেখেই ছুটলাম আদালতের পানে।
কিন্তু হায় কোথায় আদালত! গুগুল ম্যাপে দেখাচ্ছে যে রাজকীয় বিল্ডিংটা সেখানের সব দরজা জানালা বন্ধ, চারপাশে শুনশান নিরবতা। আমি আবার হাটা ধরলাম কারন মনে মনে দেশের আদালতের কথা চিন্তা করে ভাবলাম এটা কোনভাবেই আদালত হতে পারে না। আদালত মানেই ভীড় ভাট্টা হৈচৈ.... এতো নীরব কোনভাবেই হতে পারে না। চারপাশ হেটে আবারো সেই একই বিল্ডিং এর সামনে আসলাম, গুগল ম্যাপ এটাই দেখাচ্ছে। কিন্তু কাউকে যে জিজ্ঞাসা করবো সেরকম কাউকেইতো দেখছি না আশেপাশে! অনেক খুঁজে একটু দূরে একজন ভিক্ষুক যাকে এখানে হোমলেস বলি তাকে পেয়েই দৈাড়ে গেলাম। তাকে বলতেই সে একই রাজপ্রাসাদ ই দেখিয়ে দিলো। আমি একটা অবাক হতেই সে হেসে বললো বিশ বছর ধরে এখানে আছি। তুমি দরজার কাছে একটা বেল দেখবা. সেখানে টিপলেই গার্ড দরজা খুলে দিবে।
তার কথায় আস্বস্ত হয়ে ছুটলাম দরজার দিকে কারন প্রায় সারে চারটা বাজে। পাঁচটায় আদালত বন্ধ তা গুগুল ম্যাপ দেখাচ্ছে। কলিং বেল টিপতেই উর্দি পড়া অতি বৃদ্ধ গার্ড দরজা খুলে দিলো। আয়েশ ভঙ্গীতে কি চাই জানতে চাইলো, মনে হলো যেন রাজার বাসার দাড়োঁয়ান গেইটে ইন্টারোগেট করছে। আমার আর্জি শুনে তবেই ডিসিশান নিবে রাজার কাছে পাঠানো যায় কিনা। বল্লাম, পার্কিং টিকেটের জরিমানার আদালতে যাবাে। বৃদ্ধ গার্ড অতি আস্তে আস্তে বললো, চিঠি দেখাও? আমি তাড়াহুড়া করে ব্যাগ থেকে চিঠিটা তার হাতে দিলাম। আমি যতই তাড়াহুড়া করি না কেন সে অতি ধীরে ধীরে চিঠিটার প্রতিটি ভাজ একটা একটা করে খুললো। যেন সে রাজকীয় ফরমান পেয়েছে, দ্রুত খুললেই তার আনন্দ ফুরিয়ে যাবে। এদিকে আমি বার বার ঘড়ি দেখছি আর অস্থির ভঙ্গীতে উঁশখুঁশ করছি।
এক সময় তার চিঠিতা পড়া শেষ হলো, তারপর অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকালো। এরপর নিজের ঘড়ির দিকে একবার তাকালো, হয়তো সময় শিউর হবার জন্য পাশের দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর অতি আস্তে আস্তে বললো, আদালতের সময় শেষ তুমি কালকে আসো।
মানে কি? আমি কিঞ্চিত রাগে ও যথেস্ট হতাশ হয়ে বল্লাম, আদালত পাঁচটা পর্যন্ত খোলা এখন সারে চারটা বাজে। সে সম্পূর্ন আমাকে ইগনোর করে বললো, অফিস পাঁচটা পর্যন্ত খোলা ঠিক আছে কিন্তু সারে চারটায় পাবলিক ডিলিংস বন্ধ করা হয় যাতে তারপর অফিসিয়াল কাজ করতে পারে! তুমি আরেকদিন আসো, বলেই বন্ধ করার জন্য দরজা প্রায় টানাটানি শুরু করলো।
মেজাজ খারাপ করে সেখানেই দাড়িঁয়ে থাকলাম কিছুক্ষন!!
কোর্টের দু'টি ছবিই আমার তোলা!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২১ সকাল ৮:১০