সবার দারুন সব স্মৃতিকাতর পোস্ট দেখে নিজেরটাও লিখতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। কিন্তু লিখি নাই কারন আমি কোন হুমায়ুন আহমেদ না যে সবাই খুব আগ্রহ ভরে আমার সেসব গল্প শুনবে। তারপরও লিখা শুরু করলাম আমার সন্তানদের জন্য। তারা হয়তো কোন এক সময় আমার এ লিখাগুলো পড়ে খুব আপ্লুত হবে।
চলুন তাহলে শুনি আমার ছেলেবেলা কিংবা মেয়েবেলার গল্প।
আমার বাবা ছিলেন সরকারী চাকরীজীবি, তার উপর ছিলেন বিভিন্ন প্রজেক্টের দায়িত্বে। যার কারনে প্রায় প্রতি বছরই বাবা ট্রান্সফার হয়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলাতে ঘুরে বেড়াতেন। এবং সাথে করে আমাদেরকে ও নিয়ে যেতেন। যার কারনে আমার দশ বছরে স্কুল জীবনের স্কুল চেইন্জ করেছি নয়টা। এভাবে ফি বছর স্কুল চেইন্জ করার কারনে আমার বন্ধু-বান্ধব শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা যেমন প্রচুর তেমনি জীবনে ঘটে যাওয়া অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা ও প্রচুর।
একবারের ঘটনা, বাবার চাকরী সূত্রে তখন আমরা থাকতাম কক্সবাজারে। আমি ক্লাস ফাইভে পড়তাম। বাকখালী নদীর পাশে ছিল বাবার অফিস আর অফিসের উপরের তালায় আমাদের বাসা। নদীর তীর ঘেষেই অফিসের কর্মচারীদের বাসা। একদিন হঠাৎ বাবুর্চি কুদ্দুস আংকেল সন্ধায় দৈাড়াতে দৈাড়াতে বাসায় ঢুকলো।
কুদ্দুস আংকেল কখনোই আমার রাসভারী বাবার সামনে কথা বলতেন না। উনার যা কিছু বলার তা আম্মুকেই বলতেন। আম্মু ভায়া হয়ে আব্বাকে বলতেন। যদি বাবা কিছু বলতো কখনই সে মুখ তুলে তাকাতো না, মাটির দিকে তাকিয়েই উত্তর দিতো। আমাদেরকে খুব ভালোবাসতেন। যখন যা বলতাম আমরা তাই উনি তৈরী করে দিতেন। (উনার সম্পর্কে একটু হিন্টস্ দিলাম কারন উনাকে নিয়ে কোন এক পর্ব লিখবো ভবিষ্যতে।)
কি ব্যাপার মা জানতে চাইলে সে হাফাঁতে হাফাঁতে জানালো যে বাড়ির উঠোনে নাকি বিরাট এক গোখরা দেখেছে তার বউ। অল্পের জন্য আধো অন্ধকারে সেটার উপর পা দেয় নাই। এখন সে ভয়ংকর আতংকে আছে। তার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা কান্নাকাটি করছে। কারন তাদের বেড়ার ঘরে সহজেই সাপ ঢুকতে পারবে। এবং রাতে যদি ঢুকে কামড় দেয় তাহলে কেউই টেরই পাবে না।
মা ছুটলো বাবার কাছে। সব শুনে বাবা খুব একটা পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না। বাবা বললো, গোখরা কোথা থেকে আসবে। নদীর পাড়ে বাসা হয়তো ডোরা সাপ টাপ দেখেছে। তারপরও সাবধানতার জন্য তাদেরকে রাতে অফিসের গেস্ট হাউজে থাকতে বললো। আর সকালে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় দেখবে বলে আস্বস্থ্য করলো। এদিকে সাপের কথা শুনে আমরা ভাই-বোনদের মাথা খারাপ। কুদ্দুস আংকেল এর পিছ আর ছাড়ি না। কেমন দেখতে, কত বড়, কিভাবে পালিয়েছে, কোথায় পালিয়েছে এরকম হাজার প্রশ্ন করতে করতে উনার জান কাবাব বানিয়ে ফেল্লাম। আমাদের সে রাতের পড়াশোনা টিভি দেখা সব মাথায় উঠলো। অতি উত্তেজনায় কারো বলতে গেলে ঘুমই আসলো না।
সকালে উঠেই আমাদের কারো পেট ব্যাথা, কারো জ্বর জ্বর লাগছে..... কেউই আর সেদিন স্কুল মুখো হবার চেস্টা করলাম না। মা সব বুঝে সেদিনের মতো স্কুল বাদ দিতে দিলো। কিন্তু যেহেতু গোখরা বলেছে তাই সবাধানতার জন্য আমাদের সবাইকে নীচে নামতে নিষেধ করে দিলেন মা।
সকালেই অফিসের লোকজন খোঁজ দিলো কক্সবাজারে নাকি এক সর্প সম্রাট সাপের খেলা দেখাবে বলে ঝাউ বনের ধারে আস্তানা গেড়েছে। তাদেরকে অফিসের লোকজন বেশ বলে কয়ে নিয়ে এসেছে। তবে তারা সাপ ধরার বিনিময়ে বেশ টাকা দাবী করলো ও বিকেলের দিকে সাপ ধরা শুরু করবে বলে ঘোষনা দিলো। চারপাশে সে খবর চাউর হতেই হৈহৈ রৈরৈ অবস্থা। এদিকে তো উত্তেজনায় আমাদের মাথা খারাপ। কিন্তু মায়ের হুকুম কোনভাবেই নীচে নামা যাবে না। আমাদের এতো আগ্রহের কথা শুনে বাবা তাদের সাপ ধরা শেষে চা নাস্তার দাওয়াত দিলেন বাসায়।
একে একে তারা প্রায় ত্রিশটা গোখরা ধরলো সে বাসা ও তার আশপাশ থেকে। বিশেষকরে বাড়ির উঠোনে কিছু ইট ফেলে রেখেছিল বাইরের বাথরুমে যাবার জন্য। সে সব ইটের নীচ থেকেই পাওয়া গেল মেক্সিমাম সাপ। সে এক এলাহি কান্ড।
যাহোক, সাপ ধরা শেষে তারা প্রায় ৭/৮ জন মহিলা পুরুষ বিশাল বিশাল বাক্স প্যাটরা নিয়ে বাসায় হাজির। তারা আসার পর আব্বু আমাদের সবাইকে ড্রয়ইরুমে ডেকে পাঠালেন। তাদের চেহারা পোষাক আষাক কথা-বার্তা সব কিছুই আমাদের কাছে ভয়ংকর লাগছিল। তারা যাই বলছিল তাই আমরা ভয়ে ভয়ে শুনছিলাম। কারন গল্পের বই পড়ে পড়ে ওদেরকে যাদুকরই মনে হচ্ছিল আমাদের কাছে।
যে লোকটি সবকছিু ডিল করছিল সে এসে স্মার্টলি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সবচেয়ে ভয়ংকর দেখতে যে মহিলা ছিল তার মাথায় ছিল জটা, চোখ ছিল টকটকে লাল, হাতে ছিল অসংখ্য আংটি, গলায় বিভিন্ন ধরনের মালা, তাকেই সর্দার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিল লোকটি। এবং জানিয়ে দিল যে সে এ মহিলার স্বামী। দীর্ঘদিন সে ছিল এ মহিলার বাবার শিষ্য। বাবা মারা যাবার পর মেয়েই এখন দলটির প্রধান। যদিও সেই সবকিছু দেখাশোনা করে। পুরোটা সময় মহিলা তেমন কোন কথা বলছিল না। কেমন যেন নেশা নেশা চোখে চারপাশ দেখছিল। পরে জেনেছিলাম এ মহিলা সাপের বিষের নেশা তার। বিষাক্ত সাপ তার জিহবায় কামড় দিয়ে নেশা করে। এবং তার দাঁত নাকি যেকোন বিষাক্ত সাপ থেকেও বিষাক্ত।
এক সময় আমাদের আগ্রহের কথা শুনে তারা তাদের সাথে আনা বিভিন্ন সাপ দেখাতে লাগলো। অজগর, গোখরা, সূতিনালী.... সবগুলোর নাম ও এখন মনে নেই। তবে সেগুলো ছিল অনেক অনেক রং এর। কোনটা ছিল অনেক বড় আবার কোনটা এতো এতো ছোট। একটা বললো বেহুলার বাসর ঘরের সাপ, আরেকটা বললো উড়ন্ত সাপ, আরেকটার ফেনাতে আল্লাহু লিখা ছিল। যদিও মনে হচ্ছিল রং তুলি দিয়েই সেখানে লিখা। জীবনের এ প্রথম ভয়ংকর সেই সাপ এতো কাছ থেকে দেখতে লাগলাম।।
বাবা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করছিল আর আমাদের উৎসাহ দিচ্ছিল প্রশ্ন করার। তারা সুন্দরভাবে সে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল আর আমাদেরকে একটা একটা করে সাপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল ও চাইলে ধরতে দিচ্ছিল। যদিও আমি বড় অজগরকে সামান্য একটু ছোয়া ছাড়া বাকিগুলোর ধারে কাছে যাইনি। তাদের কাছেই প্রথম কামরুপ কামাক্ষার গল্প শুনলাম ও কিছু ছবি দেখলাম সেখানকার যেখানে কারো গায়েই কোন কাপড় চোপড় ছিল না। লোকটি বললো, সে কামরুপ কামাক্ষায় অনেক বছর সাধনা করে এসেছে। তাই কালো যাদু জানে সে। এবং জানালো সে ইচ্ছে করলেই কাউকে বান দিয়ে মেরে ফেলতে পারে। যদিও বাবা তার কথা খুব একটা পাত্তা দিলেন বলে মনে হলো না।
চা পর্বের এক ফাকেঁ সে লোকটি হঠাৎই বাবাকে বলে উঠলো, স্যার আপনি কি সাপের মনি কিনতে ইচ্ছুক?
বাবা হেসে উত্তর দিলো সাপের কখনই কোন মনি হতে পারে না।
লোকটি ইষৎ বিরক্ত হয়ে সাথে সাথেই কোমড়ে গোজা ঠিক হোমিও পাথের শিশির মতো ছোট একটা শিশি বের করলো। সেখানে লাল নীল সবুজ কমলা রং এর ছোট ছোট বেশ উজ্জ্বল কিছু পাথর। সেখান থেকে কয়েকটি পাথর নিয়ে বাবার হাতে দিল। তারপর বললো, সাপের মনি পেতে হলে বছরের পর বছর ধরে সাধনা করতে হয়। আর আমাদের এ সাধনার ফলই এ পাথরগুলো।
বাবা খুব গম্ভীরভাবে পাথরগুলো নেড়েচেড়ে দেখে বললো, এগুলো খুব সাধারনই মনে হচ্ছে। তা, এগুলো অন্য যেকোন পাথর থেকে আলাদা কিভাবে?
লোকটি বললো, এগুলো অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে।
আব্বু কৈাতুহলী হয়ে বললো, তাহলে লাইট নিভিয়ে দিয়ে দেখি!
তারপর ঘরের সব লাইট নিভিয়ে দেয়ার পর দেখা গেল তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাবা সে কথা বলতেই তারা বললো, ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলে এর জ্যোতি দেখা যায় না।
বাবা, আরো কৈাতুহলী হয়ে জানতে চাইলো কেমন অন্ধকার লাগবে?
তারা বললো, এমন অন্ধকার যেন আলোর ছিদ্র না থাকে।
বাবার অফিসে বেশ কয়টা কোল্ড স্টোরেজ ছিল বিশাল বড় বড়। বাবা সাথে সাথেই মার্কেটিং ম্যানেজার আংকেলকে ফোন করে স্টোরেজ এ ঢোকার ব্যাবস্থা করলেন। তারপর বাবা সে লোকটিকে নিয়ে সেখানে রওনা দিলেন। যদিও আর কাউকে তেমন এ্যালাউ করলেন না সাথে কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা অতি মাত্রায় কৈাতুহলী বাবার পিছে পিছে ছুটলাম। তারপর একটা বিশাল কোল্ড স্টোরেজ এর ভীতর ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে হোমিওপ্যাথের শিশি বের করলো লোকটা। কিন্তু হায় বাবা বা আমি কিছুই দেখতে পেলাম না।
সে কথা বলতেই সে বললো, কি বলেন স্যার, এইতো দেখা যাচ্ছে। কি রকম আলো। বাবা বলতে লাগলেন, কোথায় আলো, আমিতো কিছুই দেখছি না।
এভাবে কথা চালাচালির পর বাবা সেখান থেকে বের হয়ে এলেন। কিন্তু লোকটি তখনো বলে যাচ্ছে, স্যার এটা না কিনলে ঠকবেন কিন্তু। এতো আসল জিনিস কেউ আপনাকে দিতে পারবে না।
বাবা তখন বললেন, আমি কেনার আগ্রহে এটা দেখতে যাইনি, নিছক কৈাতুহল। কারন আমি জানি যে সাপের মাথার মনি বলে কিছুই নেই।
যাই হোক, তাদের খেলা দেখানো ও চা পর্বের পর লোকটি বাবাকে বিশেষ রিকোয়েস্ট করলো যে তারা এখন ঝাউবনে খোলা আকাশের নীচে আছে। কারন কোন হোটেল তাদেরকে সাপ নিয়ে থাকতে দিচ্ছে না। বাবা যদি একটু বলে দেয় তাহলে তাদের থাকার একটা ব্যবস্থা হবে।
বাবা সম্ভবত তখন ডিসি আংকেলকে ফোন করে তাদেরকে কোন একটা হোটেলে থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। তবে শেষ খবর হলো, কক্সবাজারের বেশ পয়সা ব্যবসায়ীকে সাপের মনি বলে নকল পাথর বিক্রি করে বেশ টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। তারপর ৭/৮ দিন হোটেলে থাকার পর একদিন ভোরে হোটেলের কোন টাকা পয়সা পে না করে দলবল নিয়ে পালিয়ে গেছে।
আজ এ পর্যন্ত। পরে অন্য কিছু নিয়ে আসবো নিশ্চয়।
ওওও যাবার আগে কানাডার ম্যানিটোবায় সাপ কিলবিল ভিডিওটা দেখেন, খ্রাপ না ......
National Geographic
ছবি: গুগুল মামা
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০২১ সকাল ৯:৫৫