পশু-পাখী খাঁচায় বন্দী করে রাখা আমি কোনভাবেই পছন্দ করি না। বিশেষ করে পাখী খাঁচায় পালা আমি অসম্ভব অপছন্দ করি। পাখী থাকবে আকাশে, উড়ে বেড়াবে যেখানে খুশী, ওদেরকে খাঁচায় রাখা আমার কাছে অমানবিক মনে হয়। তাই মেয়ে যখন বায়না ধরলো পাখী পুষবে, আমি সরাসরিই না বলে দিলাম। কিন্তু প্রতিদিন তার ঘ্যানর ঘ্যান শুনতে শুনতে আমি সত্যিই দিশেহারা হয়ে গেলাম।
কানাডায় বলতে গেলে সবাই কমবেশী প্যাট রাখে, হয় কুকুর, নয় বিড়াল আর অল্প কিছু মানুষ পাখী বা হ্যামেস্টার। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে তার বন্ধু-বান্ধবদের প্যাটের গল্প বলে মন খারাপ করে আর সাথে প্যানপ্যানানিতে। তার এতো এতো আগ্রহ দেখে কিছু কেনার চিন্তা করলাম। কিন্তু কি কিনে দিবো তাকে! হিসেব করে দেখলাম কুকুর বিড়াল পালা মারাত্বক পেইন। বিশেষকরে শীতে বরফের উপর ওদেরকে বাইরে নিয়ে এ্ক্সেসাইজ করানো, রেগুলার ভ্যাট এর কাছে নেয়া, হাগু-পিসু পরিস্কার করা বিশাল ঝক্কি। তাই প্রথমেই ওইগুলা বাদ দিলাম। শেষে মেয়ের পাখীর অপশনই রাজি হলাম কিন্তু ভেবে চিন্তে কিছু শর্ত দিলাম তাকে। যেমন,
প্রথমত: পাখী হতে হবে ছোট কোন জাতের যেন বাসায় উড়তে পারে। কোন ধরনের বড় পাখী কেনা যাবে না। এছাড়া ছোট হলে এগুলো হাগু পিসু কম করবে, ঘর কম নোংরা হবে।
দ্বিতীয়ত: মেয়ে আমাকে বাংলায় "পাখী চাহিয়া" একটি পত্র লিখতে হবে। এবং তাতে আমাকে কনভিন্স করতে হবে কেন আমি তাকে পাখী কিনে দিবো? এছাড়াও পাখী তার কি কি উপকারে লাগবে তা আমাকে জানাতে হবে। ও বলে রাখি আমার মেয়ে এখানে বাংলা বলতে পারলেও লিখতে পারে না। আর আমি জানি ওর জন্য বাংলা শিখে ও তা লিখা অনেক কঠিন কাজ। তাই ইচ্ছে করেই এ কঠিন শর্ত জুড়ে দিলাম।
তৃতীয়ত: পাখীর খাবার, হাগু পিসু পরিস্কার, খাঁচা পরিস্কার সহ সব কাজ তাদেরকে করতে হবে।
কিন্তু আমাকে সত্যিই অবাক করে দিয়ে আমার মেয়ে মাস খানেকের মাঝেই পুরোপুরি বাংলা লিখতে শিখে গেল। এবং আমার শর্ত মত একটি চিঠি লিখে ফেললো আমাদের কারো সাহায্য ছাড়াই।
যাহোক, পরবর্তীতে তারা ছোট দু'টি প্যারাকিট পছন্দ করলো। একটি ছেলে, নাম দিলো এ্যাটাগো ও আরেকটি মেয়ে, নাম দিলো সাফায়ার।
এরপর থেকে এ দু'টি ঘরের সদস্য হয়ে গেল। এগুলোকে পাখী না বলে আমার ছেলে/মেয়ের খেলার পার্টনার বলাই ভালো। যতক্ষন বাসায় থাকে পাখীগুলো তাদের হাতে/মাথায় থাকে, তাদের সাথে খেলা করে, ওরা পড়তে বসলে বা কম্পিউটারে কাজ করলে ওরা চুপচাপ ঘাড়ে বসে থাকে। এরা কখনই খাঁচায় থাকে না, সারা ঘরেই উড়ে বেড়ায় এখান থেকে সেখানে।
গত উইকে ছিল আমার ছেলের জন্মদিন। তাই রাতে কিছু গেস্ট দাওয়াত দিয়েছিলাম ও রান্না বান্নায় একটু বিজি ছিলাম। হঠাৎ ই দুপুর দু'টার দিকে ছেলে চিৎকার করতে লাগলো এ্যাটাগো মানে ছেলে পাখীটাকে কোথাও দেখছি না। কিসের রান্নাবান্না, সব ফেলে খুঁজতে লাগলাম তাদের। যেহেতু এখন বেশ শীত পড়েছে, সব দরজা জানালা বন্ধই থাকে। তাই আমরা ভাবলাম ঘরেই আছে কোথাও। কিন্তু সারা ঘর খুজেঁ কোথাও পেলাম না। আনাচে কানাচে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, কোথাও নেই সে।
যদিও বিশ্বাস ছিল ঘরের বাইরে যাবারতো কোন কারন নেই কারন সবই বন্ধ। তারপরও সন্দেহ থেকে ঘরের বাইরেও খুঁজতে লাগলাম। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ঘরের আনাচে কানাচে তাকে না পেয়েতো ছেলে-মেয়ে কাঁদো কাঁদো অবস্থা। এভাবে চারটা পর্যন্ত খুঁজে না পেয়ে রান্না করতে চলে গেলাম। ছয়টার দিকে চুলায়/ওভেনে সব রান্না বসিয়ে মনে হলো এতো ঝামেলায় ছেলের গিফটইতো এখনো দেই নাই। এবার জন্মদিনে ছেলের জন্য একটা ছেলের ছবিসহ কাস্টমাইজড্ মগ আর একটা বেশ পাওয়ারফুল বায়নোকুলার কিনেছি। ছেলে বায়নোকুলার হাতে নিতেই আমরা সবাই এক সাথেই বলে উঠলাম চলো বাইরে এ্যাটাগোকে খুঁজে আসি।
তখন প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা, ছেলে বাইরে এসে বায়নোকুলার দিয়ে চোখ রাখতেই সে দেখে অনেক অনেক দূরে একটা বাড়ির কার্নিসে এ্যাটাগো বসে আছে। সেটা দেখা মাত্রই আমরা যে যেভাবে ছিলাম দৈাড়ে বের হলাম। কিন্তু তাকে যেখানে দেখেছি সেটা কোন জায়গায় তাতো বুঝতে পারছিলাম না। সেটা যথেস্ট দূরে কিন্তু কোন এরিয়ায়, কতটুকু দূরত্বে তা বুঝতে পারছিলাম না। তাড়াতাড়ি গুগল ম্যাপ খুলে গবেষনা করে জায়গাটা আন্দাজ করে সে দিকে গাড়ি নিয়ে বের হলাম। প্রায় মিনিট ৬/৭ ড্রাইভ করার পর গুগুল ম্যাপের সে জায়গাটার সাথে মিল মনে হলো, এখানকার কোন বাসাই হবে বলে আমরা আন্দাজ করলাম। তাই সেখানে গাড়ি পার্ক করে চারপাশ খুঁজতে লাগলাম।
পাখিটি যে জায়গাটিতে দেখেছিল তা বাসার পিছন সাইড, ব্যাকইয়ার্ডে। তাই একটা বাসার সামনে এক ভদ্রলোক কাজ করছে দেখে তাকে ঘটনা বলার পর সে তার ব্যাকইয়ার্ডে যেতে দিল। সেখানে ঢুকেই দেখি পাশের দুইটা বাসা পরে বেড়ার উপর বসা সে। তারপর দৈাড়ে সে বাসায় নক করে তার ব্যাকইয়ার্ডে যেতে চাইলাম। চাইনীজ ভদ্রলোক তার বাসার ব্যাকউয়ার্ড খুলে দিল। কাছে যেতেই উনি একটুও ঝামেলা করলো না সোজা আমার ছেলে হাতে চলে এলো। এবং তাকে গাড়িতে ছেড়ে দিতেই সে সুন্দরভাবে ড্যাসবোর্ডে বসে পড়লো কোন ঝামেলা ছাড়াই।
কিন্তু বাসার পর টের পেলাম চুলা আর ওভেনে যে রান্না বসিয়ে দৈাড় দিয়েছিলাম তা পুড়ে কয়লা!! তখন বাজে সাতটা, এবং নতুন করে ছুটাছুটি করে রান্না বসাতে হলো!!
উৎসর্গ: ফুল-ফল, গাছপালা, পশু-পাখী বিশেষজ্ঞ মরুভূমির জলদস্যু ব্রাদার (মরুভূমির জলদস্যু)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:৩৪