আহমেদ ছফার লিখা যে আগে পড়িনি তা নয় কিন্তু তরুন বয়সে অপরিপক্ক ভাবনায় সে লিখা উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান ছিল না। যাহোক, আমার অসম্ভব পছন্দের তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিনকে নিয়ে পড়তে যেয়ে আহমেদ ছফার কিছু মন্তব্য দেখে তাঁর লিখা পড়তে আবারো আগ্রহী হলাম। তাই একে একে পড়ে ফেললাম ওঙ্কার, হারানো লেখা, যদ্যপি আমার গুরু, গাভী বৃত্তান্ত, বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাঙ্গালী মুসলমানের মন ও অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী।
একজন ছফাকে বিশ্লেষন করার মতো যথেস্ট জ্ঞান আমার নেই। শুধুমাত্র পাঠক হিসেবে নিজের ভাবনাটুকু শেয়ার করতে পারি। যদি পলিটিকেল লিখার বিশ্লেষন করি তাহলে বলবো, সমসাময়িক যেকোন পলিটিকেল ঘটনা নিজের আঙ্গিকে বিশ্লেষন করেছেন তিনি। এখন যদি বলি উনার আঙ্গিকটা কি? তাহলে উত্তরে বলবো, যখন উনার মন যেদিকে ধাবিত হতো। তবে যদি আরো গভীরে যাই তাহলে বলবো, প্রায় সব লিখায়ই উনার ব্যাক্তিগত বায়াসের উর্ধ্বে ছিল না। নিজস্ব চিন্তাধারায় উনি যেকোন কিছুর ব্যাখ্যা দিতেন। এর বাইরে যে কোন চিন্তা বা ব্যাখ্যা থাকতে পারে তা নিয়ে তেমন বিশ্লেষন করেননি।
আহমেদ ছফার পুরো জীবনেই কেটেছে বলতে গেলে অভাব অনটনে। তার প্রভাব দেখা যায় প্রায় প্রতিটি লিখায়। সারা জীবন লিখালিখি করে, সবার উপকার করে, আড্ডা, আন্দোলন করে কাটিয়েছেন। বৈষয়িক ছিলেন না বলে অর্থ সম্পদ তাঁর কাছে ধরা দেয়নি। উনি এটাকে অহংকার হিসেবে হয়তো নিতেন। নিজের পেটের ভাতের খোঁজ না করে অন্যের পাতের ভাত জোগাড় করতে যেয়ে উনি পদে পদে ভোগান্তির স্বীকার হয়েছেন। তবে যাদের জন্য করেছেন তা তিনি কোন না কোনভাবে উল্লেখ করেছেন উনার লিখায়।
আহমেদ ছফার ব্যাক্তি জীবনের প্রেম নিয়ে লিখা অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী পড়ে আমি সবচেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছি। দু'জন নারী, শামীম শিকদার ও সুরাইয়া খানমের মতো প্রতিভাবাময় দু'জন নারীর প্রেমে ব্যার্থ হয়ে উনাদের বিরুদ্ধে সে অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছেন এ বইটিতে। এ উপন্যাসের প্রতি পদে পদে হেনেস্থা করে ছেড়েছেন এ দু'জন নারীকে। তাদের ব্যাক্তিজীবনের কষ্টকর মূহুর্তগুলো জনসম্মুখে এনেছেন অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায়। এমন কি শামীম শিকদার এর ব্রেস্টে হাত দিয়ে তার সাইজও জানিয়েছেন এ বইটিতে। সবচেয়ে অপমান করেছেন সুরাইয়া খানমকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইংরেজী শিক্ষককে উনি যেভাবে চিত্রায়ন করেছেন তা দু:খজনক। সুরাইয়া খানম আমেরিকায় চলে গেছেন বলে উনি অভিযোগ করেছেন, যারা আমেরিকা যায় তারা শুধু সেখানে হোটলে বেয়ারা বা ড্রাইভার আর মেয়েরা ডেকেয়ারে কাজ করে, এর বাইরে নয়।
একজন শামীম শিকদার কে চিনে না এমন কেউ নেই্। একজন ভাস্কর্য্য শিল্পী হিসেবে অত্যন্ত সমাদৃত। আর অপর দিকে সুরাইয়া খানম শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকই ছিলেন না একজন কবিও ছিলেন, নাট্যশিল্পী ছিলেন এবং অসম্ভব আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ঢাবিতে শিক্ষকতা করে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব অ্যরিজোনাতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন সুরাইয়া। পিএইচডি শেষ করে অ্যরিজোনার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। এমন দু'জন স্কলারের চরিত্র হনন আমার কোনভাবেই ভালো লাগেনি।
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী পড়ার পরই আমি সুরাইয়াকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি। তার একমাত্র কবিতার বইটি ডাউনলোড করি। কি অদ্ভুত সে লিখা, সে ভাবনা, সে প্রতিবাদী স্বর..........। সেখান থেকে একটি কবিতা শেয়ার করলাম,
আত্মলীনা কবিতায়—
সত্যের গোপন ঘ্রাণ রাখো বক্ষে
রাখো ঐ আত্মার অনল উষ্ণ
তেজস্বী মনন-মনস্বীতা,
নিজের দহনে এত দুঃখিত হয়ো না।
লিখাটা লিখলাম কারন ক'দিন ধরে আহমেদ ছফা মাথায় ঘুরছে। তাই লিখে মাথা থেকে ঝেঁড়ে ফেললাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:২১