আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে আসলাম পাঠকদের জন্য। কারন হঠাৎ মরে টরে গেলে কেউই জানবে না কি চ্যালেন্জ আমি ফেইস করেছিলাম। তবে সব দেশে সব খানেই মেয়েদের এমন চ্যালেন্জ খুব স্বাভাবিক। একটি প্রফেশনাল মেয়ে একটি ছেলের চেয়েও হাজার গুন বেশী চ্যালেন্জ ফেইস করে ঘরে বা বাইরে, রাস্তা বা ঘাটে....।
যা বলছিলাম;
কাজ শুরু করেছিলাম দেশের খুব নামকরা একটা ননপ্রফিট সেক্টরে। কিন্তু হঠাৎ করে সেখানে থেকে রিজাইন করার কারনটা অনেকেই জানতে চেয়েছিল কিন্তু তখন রুচিতে কুলায়নি এটা নিয়ে কথা বলতে। তাই আজ থেকে গুনে গুনে ১৪ বছর পর তা নিয়ে লিখতে বসলাম।
পুরো ইন্টাভিউ প্রসেসে আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি যে এক সময় যে ছেলেটি সরাসরি আমার এ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করেছে সে এখানের আমার বস হবে। এটা জানলে কখনই আমি সেখানে জয়েন করতাম না। কারন আমার এ্যাসিসটেন্ট এর আন্ডারে কাজ করার মতো যথেস্ট মানসিক শক্তি আমার নেই। তার উপর আমি যে ক'বছর তাকে দেখেছি, একজন প্ররিশ্রমী বা অনেষ্ট হিসেবে দেখেনি। তাকে দেখেছি একজন তেলবাজ হিসেবে। এবং সে যে এ প্রতিষ্ঠানে কাকে কিভাবে তেল ঘি মেখে ঢুঁকেছে এবং সে বস কেন তাকে ঢুঁকিয়েছে তা আমি ভালো ভাবেই জানি। তারচেয়েও বড় কথা যে ছেলেকে আমি সকাল বিকেল ধমকের উপর রাখতাম, তাকে এখন স্যার স্যার বলবো সেটা কখনো আমার দ্বারা হবে না।
যাহোক,পুরো ইন্টাভিউ প্রসেসে সে কোনভাবেই আমার সামনে আসেনি। কারন সে জানে আমি তাহলে আমি জয়েন করবো না। সব মিলিয়ে সে আমার সাথে একটা গেইম খেলার সুযোগ নিলো।
কিন্তু কেন সে এমন একটা গেইম প্লেন করলো?
কারন, সে আমাকে বোঝাতে চেয়েছে, দেখ এখন আমি তোর বস। খুবতো ভাব নিছোস আমার সাথে, এবার তোর একদিন কি আমার একদিন!! এছাড়াও, মফস্বলের কলেজ থেকে পড়াশোনা করে সে এখন আমার বস পজিশনে ও আমাকে বিট করেছে। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে কি এমন করলাম!!!
জয়েন করার পর তাকে দেখেতো আমি থতমত খেলাম। কিন্তু কিছু করার নেই তখন, ইউএন এর জব ছেড়ে এখানে জয়েন করেছি। তাই আপাতত সে সব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে কাজ শুরু করলাম। দেখা যাক কত দূর গড়ায়....... এ চিন্তা করলাম।
আমি ছিলাম একটা প্রজেক্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার এবং অফিস ম্যানেজার। এবং আমার অফিস ছিল অন্য এরিয়ায় তাই ভাবলাম হয়তো কিছুটা বেচেঁ গেছি। তার সাথে ডে টু ডে মুখোমুখি হতে হবে না। যদিও পরে বুঝলাম তার হাত থেকে আমার বাঁচার কোন পথ ছিল না।
তো আমার প্রথম ধাক্কা:
যারা এনজিও সেক্টরে কাজ করেন তারা জানেন যে দেশের প্রতিটি প্রজেক্টের আইএমইডি রিপোর্ট জমা দিতে হয় প্রতি বছর বাজেটের আগে। আমার প্রজেক্টের সে রিপোর্ট গত অনেক বছর জমা হয়নি বলে সেখান থেকে কড়া চিঠি আসলো। তো সে চিঠি পাওয়া মাত্রই ভদ্রলোক আমাকে কড়া ভাষায় বিশাল চিঠি পাঠালো কেন রিপোর্ট জমা হচ্ছে না বছরের পর বছর? কিন্তু সে চিঠির কোথাও সে উল্লেখ করেনি যে আমি মাত্রই জয়েন করেছি এ প্রজেক্টে, এটা তারই দায়িত্ব ছিল এতোটা বছর।
"বস ইজ অলওয়েজ রাইট" তাই কথা না বাড়িয়ে রাত-দিন খেটেখুটে সব বছরের রিপোর্ট শেষ করার পর অফিসের প্রটোকল অনুযায়ী প্রজেক্ট ডিরেক্টর এর সই এর আগে তাকে দেখাতে গেলাম। তো সে তখন রিপোর্ট হাতে নিয়ে বললো, আপনি বসেন আমি একটু আসছি। ঠিক তার দশ মিনিট পর দেখি স্বয়ং প্রজেক্ট ডিরেক্টর এসে রিপোর্টটা আমার হাতে দিয়ে বেশ কড়া সুরে বললো, মিস নাহিদ, এবারের মতো রিপোর্টে সই করে দিয়েছি। কিন্তু আপনি প্রজেক্টের দায়িত্বে আছেন, এ রিপোর্ট করার দায়িত্ব আপনার, উনার না। আপনি উনাকে দিয়ে আপনার প্রজেক্টের রিপোর্ট করাচ্ছেন কেন? আর এরপর থেকে রিপোর্ট দিতে দেরী হলে আপনাকে কারন দর্শনার নোটিশ দেয়া হবে।
আমি এতেটাই হতভম্ব হলাম যে কথাই হারিয়ে ফেললাম।
দ্বিতীয় ধাক্কা:
আমার অফিসের জন্য একজন পিয়ন নেয়া হবে। সুতরাং রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে আমি একজন মেম্বার ছিলাম। তো ভদ্রলোক আমাকে ডেকে বললো যে অমুক ডেপৃুটি সেক্রেটারীর ভাই এখানে এপ্লাই করেছে তাকে যেন আমি সিলেক্ট করি। তারপর তার সিভিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি তার সিভি দেখে হতভস্ব হয়ে গেলাম, ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করা ছেলে এবং যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে বিশেষকরে আইটি সেক্টরে। আমি তাকে জানালাম, ছেলেটি ওভার কোয়ালিফাইড। আর তার উপর একজন সেক্রেটারীর ছোট ভাইকে দিয়ে অফিসের বাথরুম পরিস্কার করানো বেশ কঠিন হবে। পান থেকে চুন খসলেই সবার চাকরী ধরে টান দিবে। তারপরও বললাম, ওকে যদি ফেয়ার রিক্রুটমেন্টে সে আসে তাহলে তাকে নিতে আমার আপত্তি নেই।
কিন্তু দু:খের বিষয় ছেলেটিকে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের বাকি মেম্বাররা সিলেক্ট করেনি। তারচেয়ে অনেক অভিজ্ঞতা সম্পর্ন একটা উপজাতি ছেলেকে সিলেক্ট করা হয়েছিল। তারপর বাকি গেইম খেললো ভদ্রলোক। তো সেই সেক্রেটারী সাহেবকে জানালো যে আমিই সে কালপ্রিট তার ভাইকে সিলেক্ট হওয়ার পরও যে চাকরী দেইনি।
তারপর আর যায় কোথায়, এর পর থেকে পুরো প্রজেক্টের কাজ মোটামুটি বন্ধ ও আমার জীবন সে সেক্রেটারী সাহেব মোটামুটি তেজপাতা বানায়ে ছাড়লো। যায়ই মিনিস্ট্রতে সাবমিট করি না কেন তাই ফেরত পাঠায়। প্রজেক্টের ফান্ড আটকে দেয়, সমস্ত খরচের হিসাব বাতিল করে দেয়। এ দিকে ডোনার থেকে কড়া চিঠি কেন কাজ হচ্ছে না আবার মিনিস্ট্রি থেকে ধাতানী কেন কিছু হচ্ছে না। মাঝখান থেকে সে ভদ্রলোক দারুন মজা নিচ্ছে সব দেখে আর ডিরেক্টর সাহেবকে আমার নামে অভিযোগের পর অভিযোগ করে যাচ্ছে।
যাহোক, প্রজেক্টের এর নিয়ম অনুযায়ী স্টেকহোল্ডারদের মিটিং কল দিতে হয় প্রতি বছর। যেহেতু এতােটা বছর কিছুই করা হয়নি তাই আমি ভদ্রলোককে বললাম মিটিং কল দেয়ার কথা। ভেবেছিলাম মিটিং এ সবকিছু খোলাসা করে ঝামেলা মিটিয়ে নিবো। তা্ই মিনিস্ট্রিতে মিটিং কল দিলাম। মিটিং এর আগ মূহুর্তে ভদ্রলোক আমাকে বললো, যেহেতু সেক্রেটারী এবং স্বয়ং প্রজেক্ট ডিরেক্টর মিটিং প্রিসাইড করবেন সেহেতু আমি যেন কোন কথা না বলি। যদি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তাহলে প্রটোকল অনুযায়ী উনিই দিবেন। আমি ওকে বলল্লাম।
তারপর, যখন সিটিং শুরু হলো এবং এবার সেই ডেপুটি সেক্রেটারী মোক্ষম সুযোগ পেলো আমাকে ঘায়েল করার। একের পর এক আক্রমণ করে যেতে লাগলো মিটিং এ। কেন প্রজেক্ট এতোদিন কিছু করেনি, কেন প্রজেক্ট এর টাকা আনা হচ্ছে না, কেন প্রজেক্ট বন্ধ আছে? ব্লা ব্লা ব্লা......
তখনই সে ধান্ধাবাজ ভদ্রলোক তার আসল চেহারা প্রকাশ করলো, বলে উঠলেন, এটা আমাদের প্রজেক্ট ম্যানেজার এর দায়িত্ব এবং এটা তার ব্যার্থতা, আমরা অফিসিয়ালি প্রজেক্ট ম্যানেজার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিবো।
আমি আবারো হা হয়ে গেলাম তার সুন্দর এ গেইম প্লান এ। এক ঢিলে দুই পাখি না, সে কয়েক'শ পাখি মেরেছে। কারন সবকিছু তারই দায়িত্বে ছিল এতোদিন। কিছুই করেনি সে। আমি বরং সে মরা প্রজেক্ট জীবিত করেছি। যদি ব্যাবস্থা নিতে হয় তাহলে তার বিরুদ্ধেই নিতে হবে, আমি মাত্রই জয়েন করেছি।
তারপর!! তারপর আর কি হবে?? ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে চাকরীটা ছেড়ে দিলাম।।
তবে অবশ্যই ভালো হয়েছিল আমার জন্য, এর চেয়ে দ্বিগুন বেতনে ফিরে গেছিলাম ইউএন এ।
সোহানী
মার্চ ২০২৪
বি:দ্র: একটা কথা প্রায় জিজ্ঞাসা করবো বলে মনে করি কিন্তু করা হয়ে উঠে না। একবার আমি দেশে যেয়ে ব্লগার নীল সাধুর কাছে বেশ কিছু ব্লগারদের নাম লিখে চকলেট এর প্যাকেট ও ফ্লেভারড চা এর প্যাকেট দিয়ে এসেছিলাম। এ চা প্যাকেটগুলো কানাডায় খুব জনপ্রিয়, ডেভিস টি বলি আমরা। উনাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম সবাইকে যেন কষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়। আর বাড়তি কয়েক কেজি চকলেট দিয়ে এসেছিলাম যেন যতটুকু পারা যায় সবাইকে দেয়। কিন্তু কেউ কোন জানান দেয়নি যে তারা তা পেয়েছে কিনা। যাদের নাম লিখে দিয়েছিলাম তারা হলো, জাদিদ, মনিরা, বিদ্রোহী ভৃগু, লিটন ভাই, আহমেদ জি এস ভাই, খায়রুল ভাই, করুণাধারা আপু, সেলিম ভাই, শেরজা ভাই, অপু তানভীর, ছবি আপু, রজিব সহ আরো ক'জনের জন্য । এখন সবার নাম ভুলে গেছি। (শায়মার নাম নেই কারন সে কারো সাথে দেখা করে না)।
কেউ কি পেয়েছিলেন?????????????
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৯