somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘আত্বতত্ত্ব জানে যাঁরা, শাঁইর নিগূঢ় লীলা দেখছে তাঁরা।’

১৫ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ৮:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলার বাউল জীবন ও জগৎ দেখে; অন্যদের মতোই দেখে। দেখে আর তাঁর দেখার প্রতিক্রিয়া বলে যায়। গানে। সে বাউল গানে থাকে বোধ ও উপলব্দির পরম প্রকাশ। যে কারণে, সে গান কালস্রোতকে অগ্রাহ্য করে হয়ে যায় কালজয়ী। কখনও কখনও সে গানে থাকে গভীরতম দার্শনিক বিবৃতি । যেমন: ‘নিরাকারের নিগম ধ্বনি/ সেও সত্য সবাই জানি।’ নিরাকারের (নিগম) ধ্বনি কী করে হয়? বিভ্রান্তি এখানেই। তো, লালনের ‘কে বোঝে তোমার অপার লীলে’ সেই রকমই একটি গান।

১ গান।

কে বোঝে তোমার অপার লীলে।
আপনি আল্লাহ ডাকো আল্লাহ বলে।

নিরাকারের তরে তুমি নুরী ছিলে ডিম্ব অবতরী।
সাকারে সৃজন গঠলে ত্রিভুবন আকারে চমৎকার ভাব দেখালে।

নিরাকারের নিগম ধ্বনি সেও সত্য সবাই জানি।
তুমি আগমের ফুল নিগমে রসুল আদমের ধড়ে জান হইলে।

আত্বতত্ত্ব জানে যাঁরা শাঁইর নিগূঢ় লীলা দেখছে তাঁরা।
তুমি নীরে নিরঞ্জন অকৈতব ধন লালন খুঁজে বেড়ায় বনজঙ্গলে।

২ বয়ান।

কে বোঝে তোমার অপার লীলে।

সত্যিই তো। কে অপার লীলা বুঝতে পারে। যা ঘটছে ঘটেছে ঘটবে-সবই তো অপার লীলামাত্র। পাশ্চাত্যে লীলাকে বলে ফেনোমেনা বা ফেনোমেনোলজি। কখনও কখনও অনটোলজি। আমরা বলি লীলা-অপার লীলা। লালনের (নদীয়ার) ভাষায়: অপার লীলে।

আপনি আল্লাহ ডাকো আল্লাহ বলে।

লালনের এই কথায় শরিয়তপন্থিরা নির্ঘাৎ আপত্তি তুলবেন। কেননা, শাস্ত্রে যে স্রষ্টা ও সৃষ্টি পৃথক বলা হয়েছে। লালনের বাউল মতবাদ বাংলায় উত্থিত বলেই বেদান্ত দর্শন একেবারেই উপেক্ষিত হয়নি। ফলে, বেদ-এর ‘একমেবাদ্বিতীয়াম’ তত্ত্বানুযায়ী স্রষ্টা ও সৃষ্টি একাকার- যা যুক্তিসংঙ্গতই বোধ হয়। লালনের অন্য একটি গানে রয়েছে:‘যে মুর্শিদ সেই তো রসুল, খোদাও সে হয়।’ লেখাবাহুল্য, এই কথাতেও শরিয়তপন্থিরা নির্ঘাৎ আপত্তি তুলবেন। কেননা, শাস্ত্রে যে স্রষ্টা ও সৃষ্টি পৃথক। সে যাই হোক। বেদান্ত দর্শন স্বীকার করে লালন বলেছেন: ‘আপনি আল্লাহ ডাকো আল্লাহ বলে।’ কে বোঝে তোমার অপার লীলে। সত্যিই তো। কে অপার লীলা বুঝতে পারে। যে নিজে আল্লাহ-সে-ই কি না ডাকছে আল্লাহ বলে। সত্যিই তো। অপার লীলা কে বুঝতে পারে।
এবার আল্লাহর পরিচয়।

নিরাকারের তরে তুমি নুরী ছিলে ডিম্ব অবতরী।

নিরাকারের তরে তুমি নুরী। তার মানে, তুমি নিরাকার আলো। কোন্ বিন্দুতে লুকিয়ে ছিলে। লালন বোধহয় এমন কথাই বোঝাতে চেয়েছেন? নিরাকার আলো। কথাটা কেমন হয়ে গেল না? নিরাকারের তরে তুমি নুরী/ ছিলে ডিম্ব অবতরী। কী এর মানে? সামান্য অসহায় বোধ করি।
যা হোক। অগ্রসর হই।

সাকারে সৃজন গঠলে ত্রিভুবন/ আকারে চমৎকার ভাব দেখালে।

সাকারে সৃজন গঠলে ত্রিভুবন। ছন্দের মহিমা দেখুন। (সুরের কথা আর কী বলব।) সাকারে সৃজন গঠলে ত্রিভুবন। সাকারে সৃজন-কথার মানে বোঝা যায়। কিন্তু, গঠলে ত্রিভুবন-এই কথার মানে কী? ত্রিভুবন কি? স্বর্গ? মত্ত্য? পাতাল?

আকারে চমৎকার ভাব দেখালে।

লালন মহাবিশ্বের প্রশংসা করেছেন। এটি ব্যাতিক্রমী বিষয়। মহাবিশ্বের প্রশংসা কেউ করে না। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষনা করেন, ধর্মতাত্ত্বিকরা স্রষ্টার অস্তি¡ত্বেও প্রমাণ হিসেবে মহাবিশ্বের দিকে আঙুল তুলে দেখান। কিন্তু, মহাবিশ্বের প্রশংসা কেউ তো করে না। লালন করেছেন! কুষ্ঠিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় বলেছেন: ‘আকারে চমৎকার ভাব দেখালে।’
যা হোক। অগ্রসর হই।

নিরাকারের নিগম ধ্বনি সেও সত্য সবাই জানি।

নিগম হল বোধগম্য বিষয়। যা বোঝা যায় বা যা তর্কের মাধ্যমে স্থির হয়। কিন্তু, নিরাকারের নিগম ধ্বনি হয় কী করে। নিরাকার (ফর্মলেস) কি ধ্বনি (সাউন্ড) তুলতে সম? তাই তো দেখা গেল। বিগ ব্যাং? ‘নিরাকারের নিগম ধ্বনি / সেও সত্য সবাই জানি।’ বহুকাল আগে নিরাকারের একটা নিগম ধ্বনি হয়েছে। এবং সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। অনিবার্য সত্য মেনে নিতেই হবে।

আবার অপার লীলার কর্তা আল্লাহর পরিচয়।

তুমি আগমের ফুল নিগমে রসুল আদমের ধড়ে জান হইলে।

নিগম সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এবার আগম সম্বন্ধে বলি। আগম হল শাস্ত্র। যথা; বেদ-বাইবেল ও কোরান। লালনের মতে, আল্লাহ্ এই সমুদয় শাস্ত্রের ফুল বা নির্যাস (এসেন্স)। আবার নিগমে রসুল। মানে, ঋষি ও নবীগনের যৌক্তিকতা। মানবসমাজে তাঁদের অস্তিত্বের কারণ। সেই আল্লাহ্ ই আবার- ‘আদমের ধড়ে জান হইলে।’

কাজেই, কে বোঝে তোমার অপার লীলে।

আল্লাহ্র রুপ বর্ননা করে লালন এবার নিজের উপলব্দির কথা বলছেন:

আত্বতত্ত্ব জানে যাঁরা শাঁইর নিগূঢ় লীলা দেখছে তাঁরা।

এই সেই বাক্য-যা অমোঘ, গূঢ় ও অতি তাৎপর্যময়। যা ঘটছে, ঘটেছে, ঘটবে-সবই তো অপার লীলামাত্র। এই জন্মমৃত্যু, এই সুখদুঃখ। এই মানবজমন যা দেখছে, শুনছে, জানছে। সব। সব শাঁইর নিগূঢ় লীলা। যে কারণে অর্থহীন না। অ্যাবসার্ড না। আত্মতত্ত্ব না জানলে জীবন ও জগৎ অর্থহীন ও অ্যাবসার্ড মনে হয়। যে কারণে সক্রেটিস বলেছেন-‘নো দাইসেলফ’, নিজেকে জান। লালন আরও একধাপ অগ্রসর হয়ে আড়াই হাজার বছর পরে বললেন: ‘আত্বতত্ত্ব জানে যাঁরা /শাঁইর নিগূঢ় লীলা দেখছে তাঁরা।’ আত্মতত্ত্ব জানলেই সুখ ও দুঃখের অবসান হবে। এ রকম প্রত্যয় বৌদ্ধদর্শনের মূলকথা। বাউলমত ও বৌদ্ধধর্ম পাশাপাশি বিষয়।
এবার লালন ও লীলাকর্তার সম্পর্কের বিষয়। আবারও লীলাকর্তার রুপের বর্ননা।

তুমি নীরে নিরঞ্জন অকৈতব ধন লালন খুঁজে বেড়ায় বনজঙ্গলে।

তুমি নীরে নিরঞ্জন ...

নীর অর্থ পানি। নিরঞ্জন মানে রংশূন্য। তুমি (লীলার কর্তা বা আল্লাহ) পানির মতন রংশূন্য বা পানিতে রংশূন্য। লালন আসলে কী বলতে চেয়েছেন?

অকৈতব ধন

অকৈতব শব্দটির মানে সহজ সরল। জটিলতাশূন্য। তার মানে, লীলার কর্তা আল্লাহ হচ্ছেন সহজ সরল। জটিলতাশূন্য ধন বা সম্পদ। কী সাঙ্ঘাতিক কথা! কী এর মানে? তুমি নীরে নিরঞ্জন অকৈতব ধন। ছন্দের মহিমা দেখুন। তবু আমরা কবি লালন বলি না। আল্লাহ সহজ ধন কেন? সরল সম্পদ কেন? আবারও দুটি লাইন বলি:

সাকারে সৃজন গঠলে ত্রিভুবন/ আকারে চমৎকার ভাব দেখালে।
আত্বতত্ত্ব জানে যাঁরা শাঁইর নিগূঢ় লীলা দেখছে তাঁরা।

এই দুই লাইনের সঙ্গে কি ‘ তুমি নীরে নিরঞ্জন অকৈতব ধন’ এই লাইনের কোন্ ভাবগত সম্পর্ক রয়েছে?

লালন খুঁজে বেড়ায় বনজঙ্গলে।

এই কথার কী মানে? লীলার কর্তাকে বনেজঙ্গলে খুঁজতে কেন হয়? বা লালন লীলার কর্তাকে কেন বনেজঙ্গলে খোঁজেন?
বলতে পারি না।


গানটি আবদেল মাননান সম্পাদিত ‘অখন্ড লালনসঙ্গীত’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৫৯
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×