somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর’: পল্লীকবি জসীমউদ্দীন-এর একটি কবিতা

০২ রা এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। একটা সময় ছিল যখন- পশ্চিম বাংলায় কাঁথাকে শুধু কাঁথাই বলা হত। ১৯২৯ সালে কবি জসীমউদ্দীন লিখলেন ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ (The Field of the Embroidered Quilt )। তারপর থেকে পশ্চিম বাংলায় কাঁথাকে বলা হয় নকশী কাঁথা। এই হল বাংলার অবিস্মরণীয় এক দিক। এভাবেই যুগে যুগে বাংলার কবিকূল বাংলার লোকজজীবনে দান করেন ভাব, ভাষা ও নৈকট্য।

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন-এর জন্ম ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি। কবির কাব্যশক্তি কৈশরকাল থেকেই লক্ষিত হয়েছে। কলেজ জীবনে ‘কবর’ কবিতাটি রচনা করে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে এম এ পাস করেন। পল্লীসাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দান করেন। পরে অবশ্য সরকারী চাকরি করেন।
কবির মৃত্যু ১৯৭৬ সালে ।



সম্প্রতি, জসীমউদ্দীন-এর একটি কবিতা পাঠ করে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
কবিতাটি ছেলেবেলায় পড়েছিলাম-তখন কবিতাটির ভিতরের মানে ততটা বুঝতে পারিনি-আজ বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে গেলাম। কবিতার নাম:‘প্রতিদান’। কবিতার ভাব এমন মহৎ - এমন মানবিক -যে তার অনিবার্য অভিঘাতে অভিভূত হয়ে যেতেই হয়। অসাধারন ছন্দে কবিতাটি রচনা করেছেন কবি।

যে মোরে করিল পথের বিবাগী;-
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;

যেন ভিতর থেকে ওহির মতন নাজিল হয়েছে।
কবিতাটি পাঠ করা যাক।

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;-
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হয়েছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,

আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল-মালঞ্চ ধরি
যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

এমন মহৎ ভাবনা কী করে একজন মানুষ ভাবতে পারেন?

যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর

ভাবতে উদবুদ্ধ হই-প্রতিদানের সমতূল্য কোনও কবিতা কি বিশ্বসাহিত্যে রয়েছে। যদি বলেন-কবিতায় নীতিবাক্য ছড়ানো অনুচিত-প্রতিদান তা হলে কি? এ কি কবিতা না স্বর্গীয় শ্লোক? যে শ্লোকের বাস্তবায়নের জন্য রচিত হয়েছে জগৎ।
কবি জসীমউদ্দীনের শুভবোধের উৎস কি? আবহমান বাংলা? দক্ষিণ বাংলায় তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে ...আমরা বলি বাংলা মানবিক। তার বারো মাসে তেরো পার্বণ-যে পার্বণে অনাহূত কেউই নয়-এমন কী পথের কুকুরও! কিন্তু, কবির এমনতরো গভীর শুভবোধের উৎস কি? আমি ভাবি আর ভাবি। আর, এলোমেলো হয়ে যাই। প্রাচীন বাংলার কত ছবি যে ভাসে মনে। মনে ভাসে পদ্মার মাঝিদের গান। লালনের গান। আমি ভাবি আর ভাবি। আর, এলোমেলো হয়ে যাই।

আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান;

কী আশ্চর্য!
ভাবতে উদবুদ্ধ হই-প্রতিদানের সমতূল্য কোনও কবিতা কি বিশ্বসাহিত্যে রয়েছে।
কবির এমনতরো গভীর শুভবোধের উৎস কি?
তখন বলছিলাম: যুগে যুগে বাংলার কবি লোকজীবনে দান করেন ভাব, ভাষা ও নৈকট্য। যা ভিন দেশিয়রা ঠিক বুঝবেন না। যেমন, আমরা বলি: নকশী কাঁথা মাঠ। অন্যরা বলে:The Field of the Embroidered Quilt . কী এর মানে? ফ্রান্সে বসে কেউ এই লাইনটি পড়লে তার তো কোনও প্রকার ঝিমঝিম আবেগ বোধ করার কথা নয়। অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের কোনও বাঙালি 'নকশী কাঁথা মাঠ' -এই কথায় কেঁপে ওঠার কথা। তখন বলছিলাম: একটা সময় ছিল যখন- পশ্চিম বাংলায় কাঁথাকে শুধু কাঁথাই বলা হত। ১৯২৯ সালে কবি জসীমউদ্দীন লিখলেন ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ । তারপর থেকে পশ্চিম বাংলায় কাঁথাকে বলা হয় নকশী কাঁথা। এই হল বাংলার অবিস্মরণীয় এক দিক। যা ভিন্ দেশিয়রা ঠিক বুঝবেন না। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন যে প্রতিদানের মতন কবিতা লিখছেন তা কত জনে জানে?

সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুক ভরা গান;

ভাবা যায়!
এ কবিতা না স্বর্গীয় শ্লোক? যে শ্লোকের বাস্তবায়নের জন্য রচিত হয়েছে জগৎ।
ভেবে ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না।

কবির ছবি: বাংলাপিডিয়ার সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:১৪
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×