
কবি স্তেফান মালার্মে। স্তেফান মালার্মে সম্বন্ধে অবহিত না-থাকলে ফ্রান্সের -বিশেষ করে প্যারিসের শিল্পসাহিত্যর ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য অনেকখানিই অজানা রয়ে যায়। সেই রকম কবি স্তেফান মালার্মের কবিতা সম্বন্ধে কমবেশি ধারনা না-থাকলে আধুনিক কবিতা সম্বন্ধে ধারণাও থেকে যায় অসম্পূর্ন; কেননা, মালার্মে বলেছিলেন: Poetry is the language of a state of crisis!তাঁর এই সর্বনাশা যুগান্তকারী উক্তির সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিক কবিতার দিশেহারা আত্মার স্বরুপটি উদঘাটিত হয়ে গিয়েছিল সেই উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে ...
কবি স্তেফান মালার্মের জন্ম প্যারিসে- ১৮৪২ সালের ১৮ মার্চ । কবিতা- শৈশব থেকেই লিখতেন। প্রথম প্রথম ফরাসি কবি বদলেয়ারের প্রভাব ছিল মালার্মের ওপর। যা হোক। ইংরেজি শিখেছিলেন মালার্মে। ইংরেজির শিক্ষকতাই ছিল জীবিকা এবং শিক্ষকহেতু জীবনভর অর্থনৈতিক দারিদ্র ছিল মালার্মের; তবে মালার্মের হৃদয়েরঐশ্বর্যের অভাব ছিল না বলেই এই একুশ শতকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি কবিকে।
প্যারিসের রু দি রোম সড়কে ছিল কবির বাড়ি । সে বাড়িতেই বসত সালোন। ফরাসি ভাষায় সলোন-এর অর্থ, একটা ছাদের নিচে সমমনা সাহিত্যিকদের আড্ডা। তো, ঐ সময়ে কে যায়নি স্তেফান মালার্মের সালোনে? আইরিশ কবি ওয়াই বি ইয়েটস থেকে শুরু করে জার্মান কবি রিলকে- লেখক আদ্রে জিদ, কবি ও নিবন্ধকার পল ভালেরি, প্রতীকবাদী কবি পল ভার্লেইন, জার্মান কবি ও অনুবাদক স্তেফান জর্জ, ফরাসি কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও সাহিত্য সমালোচক পিয়েরে জুল থিওফাইল গঁতিয়ে (যিনি বলেছিলেন, শিল্পের জন্য শিল্প ...) -অনেকেই যেতেন মালার্মের সালোনে -এত নাম বলে শেষ করা যাবে না। ফরাসি কম্পোজার ক্লোদ দেবসিও যেতেন মালার্মের সালোনে। প্রখ্যাত সব ছবি আঁকিয়েরাও যেতেন। বিশেষ করে মাশহুর ফরাসি চিত্রকর এদুয়ার্দ মানে।

এদুয়ার্দ মানের আঁকা স্তেফান মালার্মে
বলা বাহুল্য, প্যারিসের রু দি রোম সড়কের বাড়িটির সালোনের মধ্যমনি ছিলেন স্তেফান মালার্মে। তিনি অনর্গল কথা বলতেন ইতিহাস, শিল্পসাহিত্য কবিতা ও দর্শন নিয়ে। সবাই শুনত। কথা অন্যরাও বলত। সালোন বসত প্রতি মঙ্গলবার। ফরাসিতে মঙ্গলবার কে বলে- মারদি। এই কারণে প্যারিসের রু দি রোম সড়কের মালার্মের বাড়ির সালোনে যারা যারা নিয়মিত যেতেন তাদের নাম হয়েছিল- মারদিসতেস। বাড়িটি হয়ে উঠেছিল প্যারিসের সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম কেন্দ্র। যে কারনে তখন আমি বলছিলাম- কবি স্তেফান মালার্মে সম্বন্ধে অবহিত না-থাকলে ফ্রান্সের -বিশেষ করে প্যারিসের শিল্পসাহিত্যর ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য অনেকখানিই অজানা রয়ে যায়।
কবি স্তেফান মালার্মে ছিলেন ফরাসি দেশের প্রতীকবাদী শিল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যাক্তিত্ব। সেই সময়টায় প্রতীকবাদ ছিল বাস্তববাদের বিরুদ্ধে প্রবল দ্রোহ। জার্মান দার্শনিক শোওপেনহাওয়ারের দর্শনে প্রতীকবাদের স্ফুরণ ঘটেছিল। বিক্ষুব্দ পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে শিল্পে পরম আশ্রয় নেওয়ার ইঙ্গিত ছিল শোওপেনহাওয়ারের দর্শনে। আধ্যাত্বিক কিংবা অতিজাগতিক ...প্রতীকবাদীরা নিজস্ব ধারনাকে প্রকাশ করবার জন্য এ ধরনের বৈশিষ্ট্যপূর্ন বিষয় বেছে নেয়। এ ছাড়া ক্ষণিক জীবনের বিমর্ষতা, অতৃপ্ত যৌনবোধও প্রতীকবাদী কবিতায় প্রকাশ পায়। এ ধরনের বিষয়বস্তু মালার্মের কবিতাতেও রয়েছে।
মালার্মের অন্যতম কবিতা- দি আফটারনুন অভ আ ফাউন। রোমান মিথ অনুযায়ী ফাউন হল জ্বিন বা কোনও নির্জন অরণ্যময় স্থানের অপদেবতা। মালার্মের দি আফটারনুন অভ আ ফাউন কবিতায় এক বিকেলে ফাউনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে স্বগত সংলাপে নিমফদের (কামার্ত পরী) সঙ্গে যৌনসংলাপের বর্ননা দেয়। ফরাসি প্রতীকবাদী সাহিত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন এটি। পল ভেলেরির মতে ফরাসি সাহিত্যের ...
ফরাসি কম্পোজার ক্লোদ দেবসি দি আফটারনুন অভ আ ফাউন -এর ওপর তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কম্পোজিশনটি করেছেন।
মালার্মের শিল্পদর্শন পরবর্তী যুগের শিল্প আন্দোলনকেও প্রভাবিত করেছিলেন। যেমন-দাদাবাদ, সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্ততবাদ। বিশুদ্ধ কবিতা লিখতেন মালার্মে। প্রায়ই বলতেন-nothing lies beyond reality, but within this nothingness lies the essence of perfect forms and it is the task of the poet to reveal and crystallize these essences.
৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮ সালে প্যারিসে কবির মৃত্যু।
বাংলায় মালার্মের কবিতার অনুবাদ সহজ কাজ নয়-একটি লাইনের সঙ্গে পরের লাইনের ভাবগত কি বাক্যগত মিল একেবারেই নেই। তার পরও মালার্মের কবিতার ধরণ ও প্রকরণ সম্বন্ধে আভাস দেওয়ার জন্যই কয়েকটি কবিতার অনুবাদের চেষ্টা করা করলাম।
সমুদ্র-বাতাস
সে মাংস বিষন্ন, হায়!আর সব ছোট নদীগুলি লাল।
সংগ্রাম, কেবলি সংগ্রাম! মনে হয় পাখিরাও হয়ে উঠছে বন্য
অচেনা ফেনার শরীর, আকাশের দিকে ঝুঁকে-থাকা!
না, চোখে তো ভেসে উঠছে না প্রাচীন উদ্যান
যে স্নান করেছে আনন্দে- তার আত্মা স্থির থাক
হে, রাত্রি! আমার নির্ঘুম প্রদীপ-যার নিঃসঙ্গ আলো
খালি পৃষ্ঠার ছায়া, সাক্ষীর অশেষ ফল লাভ,
এমনকী বুকের ওপর শিশু দোলানো অল্প বয়েসী স্ত্রীটিও নয়
আমি বিদায় নেবো! হে স্টিমার, দোলানো রশির খুঁটি
দূরবর্তী আশ্চর্য দেশের অভিমূখে তোল নোঙর!
একটু অস্বস্তি, নিষ্ঠুর আশায় দিশেহারা, এখনও ধরে আছে
শেষ বিদায়ের শেষ রুমাল!
এবং এসব নয়, ঝড়কে ডাকছে মাস্তুল, এসবও নয়
এক সচেতন ঝড় বেঁকে যাচ্ছে বিধস্ত সমুদ্রে,
লুপ্ত, পাল নয়, একটি পাল, একটি পুষ্পিত দ্বীপ, অনেক আগের?
কিন্তু, হে আমার হৃদয়, তুমি শোন, তুমি নাবিকের গান শোন!
নবীকরণ
এখন নিয়েছে বিদায় রুগ্ন বসন্ত
শীত, বিশুদ্ধ শিল্পের ঋতু, নির্মল শীত
আমার সত্তায় ঐ বিষন্ন রক্তের দাহ
দিনভর হাই তুলে জরুরি বিস্তার
কুয়াশার সাদা ভোর আমার করোটিতে কবোষ্ণ বাড়ে
সমাধির মতন লোহার আঙটিতে বন্দি
বিষন্ন আমি খুঁজি চমৎকার আবছা স্বপ্ন
মাঠে-যেখানে কুঁড়িরা শস্যের সবকিছু
তারপর গাছেদের ঘ্রানে সন্তষ্ট আমি
মুখ দিয়ে খুঁড়ি আমার কল্পনার কবর
যেখানে লাইলাকেরা বাড়ছে সেই উষ্ণ মৃত্তিকায় দিই কামড়
নিজেকে র্ভৎসনা করে অপেক্ষা করি বিষাদ অবসানের
এরই মধ্যে চকিত নীলের হাসি ঝোপের ওপর
পাখিদের কলকাকলী আর সূর্যের বাৎসরিক শপথ

শিল্পী রেনোয়ার আঁকা মালার্মে
সনেট
বিস্মৃত অরণ্যে যখন বিষাদিত শীতেরা নেয় বিদায়
তোমার অভিযোগ নিঃসঙ্গ চৌকাঠে বন্দি
আমাদের অহংকারের এই নিবিড় সমাধিতে
নেই কবিতা ও ফুলের তোড়া
মধ্যরাত্রির অর্থহীন গননা শোনা ব্যাতিরেকেই
রাতের প্রহরী তোমাকে জাগিয়ে রাখবে
তারপর পুরনো আর্মচেয়ারের হাতলে
সর্বশেষ অগ্নিজ্যোতি আমার ছায়াকে দীপ্যমান করে
যার কাছে প্রায়শই অতিথিরা আসে তারা যেন
বহুবিধ ফুল নিয়ে সমাধিতে না আসে
আমার আঙুল নিঃশূন্য বিষন্নতাকে করে নির্দেশ
সার সার সমাধি দেখে কাঁপে আত্মা
এর প্রত্যয়ে বাঁচার জন্য আমি তোমার ঠোঁট থেকে নেব ঋন
দীর্ঘক্ষণ আমার নামের নিঃশ্বাস মর্মর করবে সন্ধ্যায়
স্বাগত-সম্ভাষণ
কিছুই না- এই ফেনিল কুমারী কাব্য
পেয়ালাই সর্বাধিক গুরুত্ব পাবার যোগ্য
এভাবে, দুরে সৈন্যদলের পদধ্বনি
এলোমেলো শিঙার ধ্বনি
আমরা জলপথে চলেছি হে আমার বিচিত্র
বন্ধুরা! আমি এরই মধ্যে মাস্তুলে
তুমি শীত ও বিদ্যুত কেটে কেটে
অগ্রসর হওয়া মহার্ঘ গলুয়ে
এক চমৎকার নদী আমাকে ডাকছে
তার ঢেউয়ে ভীত না হয়ে
এই দৃঢ় স্বাস্থপানের জন্য
নিঃসঙ্গতা খাড়ি নক্ষত্র
যাই হোক না কেন
আমাদের পালের শ্বেত উদ্বেগ
একটি কবিতার উপহার
প্রাচীন রাত্রির শিশুটিকে আমি তোমার কাছে আনি
কালো, ডানায় রক্ত, ফ্যকাশে পালকহীন
কাচ এর ভিতরে পুড়ছিল স্বর্ণ ও আগর
জানালার কাচের ওপাশে জমাট তখনও বিষন্ন -হায়
দেবদূত প্রদীপে বিস্ফারিত হয় ভোর
করতল! এবং যখন এটি দেখায় ভগ্নাবশেষ
আবারও শক্রর হাসির জন্য চেষ্টা করছে
নীল অনুর্বর নিঃসঙ্গতার শিহরণ
ও ধাত্রি, তোমার নিষ্পাপ শিশু
তোমার শীতল পা, এই জন্মকে গ্রহন করে
তোমার স্বরে মনে পড়ে ক্লাভেচিনের বেহালা
তোমার ভাঁজ করা আঙুলে তুমি কি চাপ দেবে স্তনে
যখন শ্বেত পুরোহিত নারীরা হয় প্রবাহিত
নীল কুমারী বাতাসে ঠোঁটেরা হয়ে ওঠে ক্ষুধার্ত
(উৎসর্গ: নাজিম উদদীন। যাঁর ফরাসি ভাষাজ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করেছে।)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




