বাঞ্ছা করি যুগল পদে
সাধ মেটাব ঐ পদ সেধে;
বিধি বৈমুখ হল তাতে
দিল সংসার যাতনা ... (লালন)
প্রথমে বেতন ঠিক করা হয়েছিল ছয় হাজার টাকা। যখন সে পরে শুনল: খাওয়া আলাদা-তখন সে অনেকটা মরিয়া হয়েই গাড়ির মালিকের সঙ্গে প্রায় বাকযুদ্ধ করে বেতন এক হাজার টাকা বাড়িয়ে সাত হাজার টাকা করে। কিন্তু, তাতেও পরতা পরল কই? এ শহরের এক হাজার টাকায় কি খাওয়া জোটে?
গাড়ির মালিকের কাপড়ের ব্যবসা। দুটি হোল সেলের দোকানই পুরান ঢাকায় । সকালের দিকে সেদিকে একবার যেতেই হয়। সন্ধ্যার পরও একবার যেতে হয় । অবশ্য তখন সে ঠিক ইসলামপুর পর্যন্ত যায় না। যাবে কি করে-যে জ্যাম! হোন্ডা সি আর ভিটা সে স্টেডিয়ামের কাছেই কোথাও পার্ক করে রাখে। গাড়ির মালিক রিক্সা করে আসে। তখন প্রায় আটটা-নটার মতন বেজে যায়।
গাড়ির মালিকের দেশের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। সপ্তাহে একবার তাকে মুন্সিগঞ্জ শহরেও যেতে হয়। কখনও কখনও সপ্তাহে দু-বার। গাড়ির মালিকের পৈত্রিক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরে; সে বাড়ির সামনে পৌঁছানোর পর গাড়ির মালিক সপরিবারে বাড়ির ভিতর সটান ঢুকে যায়; যেন ড্রাইভার বলে কেউ নেই-কখনও ছিল না, যেন ড্রাইভার একটা নিছক যন্ত্র-মানুষ না; তার পেশাব-পায়খানা পায় না-পেলেও সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই ওসব সারতে পারে কিংবা ছুটতে পারে নিকটস্থ কোনও মসজিদে। ড্রাইভার মানুষ নয় বলেই তার চা-বিসকিট খেতে ইচ্ছে করে না।
সে বাড়ির বাইরে গাড়ির ভিতরে বসে কি গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। তখন তার এক ধরনের অভিমান হয়। সে নিঃসঙ্গ বোধ করে। গাড়ির মালিক পয়সাওলা- ভিতরে খানাপিনা চলছে। কি হয় কাজের ছেলের হাতে এককাপ চা পাঠিয়ে দিলে। এসব ভেবে সে ওপরের আকাশটির দিকে তাকায়- নীল আর সাদামেঘের অনুভূতিশূন্য একটা ছড়ানো আকাশ। ধলেশ্বরী আর মেঘনা নদীর ভেজা বাতাস এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তার তখন ফেলে-আসা নিজের গ্রামটির কথা মনে পড়ে যায়। সে গ্রামের অনেকেই তাকে চিনত-এই মুন্সিগঞ্জ শহরের কেউই আমাকে চেনে না-ঢাকা শহরের কেউই আমাকে চেনে না ... এমন একটা অনুভূতি হয় তার ...
তারপর বেলা বাড়তে থাকলে খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হয়। সাবধানে। তার বেতন সব মিলিয়ে সাত হাজার টাকা। খাওয়া পিছনে ডেইলি ৪০ টাকা খরচ হলে মাসে খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ১২০০ টাকা । ৭০০০ থেকে ১২০০ বাদ গেলে থাকে আর কত? আর, তিনবেলায় ৪০ টাকায় কি-ইবা হয়? কাজেই, সাবধানে খরচ করতে হয়। টাকা যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে দৌলতপুর পাঠাতে হয়। মা এখনও বেঁচে: অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে রোগশোকে কাতর।
যে মায়ের গর্ভেই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মহিষকুন্ডী গ্রামে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
তার বাবার পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ফলের বাগান ছিল । সেসব বছরওয়ারি ফল মহিষকুন্ডী হাট বেচে কোনওমতে সংসার চলত । বাউলিয়া গান শুনে শুনে আম-কাঁঠাল আর পেয়ারার বাগানে কেটেছে তার সবুজ-নির্জন শৈশব। একদিন টের পেয়ে যায় সে - সেও বাউলা গান গাইতে পারে:
কপালের ফের নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার ...
ক্রমে ক্রমে প্রথমে মহিষকুন্ডী গাঁয়ের রসিক গ্রামবাসী ও পরে ছেঁউরিয়ার শাঁইজীর আখড়ার বিদগ্ধ
সাধুগন জানতে পাররেণ তার চমৎকার কন্ঠের কথা। সে যখন শাঁইজির গান গাইত-
আশা পূর্ণ হল না
আমার মনের বাসনা
তখন নিমগ্ন শ্রোতাদের চোখ দিয়ে পানি ঝরত। এমনই গভীর মহিমা তার কন্ঠের, শাঁইজীর বাণী ও সুরের ...সে শাঁইজীর মাজারে গিয়েছিল কিশোর বয়েসেই। শাঁইজী ভক্ত বাবাই নিয়ে গিয়েছিলেন। তো, গান শুনে সবাই মুগ্ধ। সবাই তাকে ছেঁউরিয়ার শাঁইজীর আখড়ায় থেকে যেতে বলেছিল। নাঃ, পারেনি সে- তখন তার কিশোর বয়েস; ঘন ঘন মায়ের কথা স্মরণ হয়।
ছেঁউরিয়ার ইব্রাহীম সাধু তাকে একটি একতারা উপহার দেয়। সেটিই তার জীবনের প্রথম একতারা। ইব্রাহীম সাধু তাকে একটি গানও শিখিয়েছিল:
কোথা আছে রে সেই দীন দরদী সাঁই?
চেতন-গুরুর সঙ্গ লয়ে খবর কর ভাই।।
চক্ষু অন্ধ দেলের ধোঁকায়
কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়
কি রঙ্গ সাঁই দেখছে সদায়
বসে নিগুম ঠাঁই।।
একা একা সে গান গায় সে।
তারপর বাবা মারা গেলেন। পৈত্রিক ব্যবসার দেখভাল করতে হল তাকেই- অথচ তার মন উচাটন ছিল। ফলের ব্যবসা মার খেল-কী কারণে প্রকৃতিও বৈরী হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া, দুবোনের বিয়ের আগে বাগানের অর্ধেকটাই বেচে দিতে হল। বাবার মৃত্যুর পরপরই মায়ের কী এক অসুখ ধরল। সম্ভবত দু-মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে মা নিঃসঙ্গ পড়েছিলেন। মা তাকে বিয়ে করতে বলেন। দুটি কারণে তা সম্ভব হয়নি। (১) অর্থাভাব। (২) তার হাতে হাফিজ মাষ্টার তার ছোট মেয়েকে তুলে দেবে না ...
ওদিকে মায়ের অসুখটা বেড়েই যাচ্ছিল । কিন্তু, চিকিৎসার খরচ যোগাবে কে? কাজেই, একতারাটি মায়ের ঘরে রেখে তাকে রাজধানী শহরে আসতেই হল। তার মাথায় তখন কাঁধ ছড়ানো বাদামী রঙের জটাপড়া চুল, মুখে গোঁফ-দাড়ির জঙ্গল, চকচকে ছোট দুটি চোখে বাউলা গানের বাণীর গভীর মায়াঘোর।
জানাজানি হয়ে যাবে বলে শহরে সে তার একতারাটি আনে নি।
তার এক চাচাতো ভাই-হানিফ-থাকত যাত্রাবাড়ি; দর্জির কাজ করত সে । হানিফই তাকে ড্রাইভিং শেখার পরামর্শ দিল। হানিফ আরও বলল, চুলদাড়ি কাট রে লোকমান। এমন বেশে থাকলি চাকরি পাবি না নে।
সে শ্রেফ জানিয়ে দিয়েছিল, তা আমি পারব না। এমনি হলি হবে, নয়তো মহিষকুন্ডী ফির্যা যাবো।
হানিফ চুপ করে থাকে।
বর্তমান মালিকের গাড়ি চালানোর আগে সে প্রায় পাঁচ বছর মগবাজারে এক দাঁতের ডাক্তারের গাড়ির ড্রাইভার ছিল । তারপর দাঁতের ডাক্তারটি সপরিবারে বিদেশ চলে যায়। সে বিপাকে পড়ে। যা হোক। চেনাজানা এক লোকের মারফত বর্তমান গাড়ির মালিকের ইসলামপুরের দোকানে উপস্থিত হয়েছিল সে । আজ থেকে ৫ বছর আগে। তাকে দেখে বর্তমান গাড়ির মালিক মুচকি হেসে বলেছিল-কি মিঞা, তোমার তো দেখি বাউলাগো মতন চুলদাড়ি-গানটাও গাও নাকি?
সে কি বলবে? তখন তার বয়স পয়ত্রিশ। যাত্রাপথে সময় কখন ফুরুত করে শেষ হয়ে গেল। সে বরং খুশি। যাত্রাপথের শেষে নাহারের সঙ্গে দেখা হবে। মহিষকুন্ডী গ্রামের হাফিজ মাষ্টারের মেয়ে নাহার। ছেলেবেলা থেকেই নাহারকে দেখলেও আঠারো বছর বয়েসেই যেন নাহারকে প্রথম দেখেছিল সে... সেই পেয়ারা বাগানে ...সইদের নিয়ে এক রোদ ভরা নির্জন দুপুরে এসেছিল হাফিজ মাষ্টারের মেয়ে। নির্জন বাগানে সেও যে ছিল -প্রথম প্রথম মেয়েদের দলটি সেটি টের পায়নি । পরে তাকে গাছের আড়ালে দেখতে পেয়ে সবাই থতমত। নাহার দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, ধরা পইরে গেলাম-এখন কি বিচার বসাবেন? সে কি বলবে। সে কি উত্তর দিবে। সে তখন মুগ্ধ বিস্ময়ে শ্যামলা কিশোরীটির অপরুপ মুখে দিকে চেয়ে ছিল ...যেন ... পূর্ণিমার রাতে পদ্মা নদীতে ভেসে উঠেছে বিশাল এক রুপালি রঙের চিতল মাছ ... আর পেয়ারা বাগানের বাতাসে ছড়িয়েছে আতরের গন্ধ। সে কি বলবে। সে কি উত্তর দিবে।
তার বেখেয়ালে খিলখিল করে হাসতে হাসতে মেয়েদের দলটা ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল।
তারপর নাহারের সঙ্গে বেশ ক’বার দেখা হয়েছিল তার। বিয়েবাড়িতে কিংবা মহিষকুন্ডীর হাটে কি চৈত্র সংক্রান্তির মেলায়- কখনও কুষ্ঠিয়া কিংবা দৌলতপুর সদরের দিকে যেতে-বাসে । নাহারও ওর দিকে অন্যদৃষ্টিতে চেয়েছিল।
আর কী আশ্চর্য! শাঁইজীর মাজারে একবার নাহার ওর গানও শুনেছিল। তখন তার একুশ বছর বয়েস। সে গাইছিল-
এ দেশেতে এই সুখ হল
আবার কোথা যাই না জানি।
পেয়েছি এক ভাঙ্গা নৌকা
জনম গেল ছেঁচতে পানি।।
ছেঁউরিয়ার ইব্রাহীম সাধুর শেখানো গান। গান শুনতে শুনতে নাহার অবাক হয়ে চেয়েছিল তার মুখের দিকে। ওর চোখের কোণ চিকটিক করছিল। নাহার কাঁদছিল কি? এইটুকুই সারা জীবনের জন্য শান্ত্বনা হয়ে রইল। সে বছরই নাহারের বিয়ে হয়ে যায়।
আর সেও বাউলের দলে ভিড়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াল। সীমান্ত পেরিয়ে নদীয়ার মায়াপুরও গেল। মহাপ্রভূর থানে তন্ময় হয়ে গাইল-
শ্রীরূপের আশ্রিত যারা
অনায়াসে প্রেম সাধল তারা
হল না মোর আন্তসারা
কপালে এই ছিল।।
এলো বুঝি কঠিন সমন
নিকাশ কি করব তখন,
তাইতে এবার অধীন লালন
গুরুর দোহাই দিল।।
তার ভক্তিসিক্ত কন্ঠের গান শুনে মাঝবয়েসি এক নীলনয়না বৈষ্ণবী তার প্রতি প্রবল আকর্ষন বোধ করেছিল। মাঝবয়েসি সেই বৈষ্ণবীটির নাম ছিল নির্মলা। প্রথম জীবনে বৈষ্ণবী নির্মলার জন্ম হয়েছিল আমেরিকায়; ক্রিস্টিন তার দ্বিতীয় জীবন লাভ করেছিল বাংলায়। নাঃ, সে নীলনয়না বৈষ্ণবীর মায়ায় জড়ায়নি। তার মনে বারবার নাহারের মুখখানি ভাসছিল। নাহারকে সে শেষবার দেখেছিল দৌলতপুরগামী একটি বাসে; নাহারের পাশে নাহারের প্রেমিক পাশে বসেছিল। ছেলেটি আমলাপাড়ার কামরুল। নাহারের বিয়ে তার সঙ্গেই হয়েছে। তা, ছেলে হিসেবে ভালোই কামরুল ... বৈষ্ণবী নির্মলা নারী বলেই সবই টের পেয়েছিল। কেবলি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। সেও মন শক্ত করে সরে আসে; সবার অগোচরে সীমান্ত পাড়ি দেয়। তারপর রামকৃষ্ণপুরের শহীদুলের মুখে মায়ের অসুখের কথা শুনে মহিষকুন্ডী ফিরে আসে সে।
নাহার তার সাধনসঙ্গীনি না হওয়ায় মনে তার অশেষ দুঃখ আছে ঠিকই-তবে শান্ত্বনাও আছে। শাঁইজীও তো জীবনভর একাই ছিলেন। সে জানে যাত্রাপথের শেষে নাহারের সঙ্গে তার আবার দেখা হবে। জীবনের চল্লিশটা বছর কেটে যাওয়াতে সে বরং খুশিই।
দেরি করলে গাড়ির মালিক আবার চিৎকার চেঁচামেচি করবে। কাজেই তাকে তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করতে হয় । খাওয়া আর কি-বেশির ভাগ সময়ই তো ডাল আর ভাত। কখনও কখনও কমদামি পাউরুটি আর কলা। দু-নম্বরী করে অনেক ড্রাইভারই উপড়ি পয়সা উপার্জন করে । তার চেয়ে আরও ভালো খায়, ভালো থাকে । সে পারে না। শাঁইজির গান যে গায় সে কি আর ‘আল ডেঙায়ে ঘাস খেতে’ পারে? শাঁইজী বলেছেন-
সত্য বল
সুপথে চল
ওরে আমার মন ...
চা ছাড়া বিড়ি-সিগারেটের অভ্যেস নেই তার।
শাঁইজী এসব পছন্দ করতেন না।
মুন্সিগঞ্জ থেকে মাঝে মাঝে ঢাকায় গাড়ির মালিকের আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসে। তাদের সঙ্গে তার কমবেশি খাতিরও হয়ে যায় । সম্ভবত তার জটাপড়া চুল ও বাউল-বাউল শ্যামলা মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল আর খয়েরি পাঞ্জাবি তাদের আকর্ষন করে। ( তার বাঁ হাতের তামার ব্রেসলেটটিও তাদের আকর্ষন করে থাকবে; ওটি মায়াপুরের সেই নীলনয়না নির্মলা বৈষ্ণবী তার বাঁ হাতে পড়িয়ে দিয়েছিল) তারা বলে- ও ডেরাইভার ভাই, ডেরাইভার ভাই। চিড়িয়াখানায় নিয়া চলেন। সে তখন মনে মনে বলে, আমি ডেরাইভার না গো ডেরাইভার না। আমি হলাম যাত্রী। আমি অকূল পাথারে ভেইসে চলা এক যাত্রী। যে পাথারের কূল নাই কিনারা নাই ...
ছুটিছাঁটাও তেমন নেই তার। যেকোনও সময়ে গাড়ির মালিক ডাকলেই তাকে হাজির হতে হয়। যেন, সে মানুষ না-সে কেবল একটা যন্ত্র। গত ঈদের পর সে একবার দৌলতপুর যাবে বলে ঠিক করেছিল। কপাল মন্দ। পরিবার-পরিজন নিয়ে গাড়ির মালিক বান্দরবান বেড়াতে গেলেন। কি আর করা। গাড়ির মালিক কখনও পরিবার-পরিজন নিয়ে বিদেশে বেড়াতে গেলেও তার ছুটি মেলে না। তখন তাকে দারোয়ানের সঙ্গে বাড়ি পাহারা দিতে হয়। গাড়ির মালিক তাকে বিশ্বাস করে। হ্যাঁ, এই কথাটা সতি।
অনেকদিন হল মহিষকুন্ডী যাওয়া হয়নি তার; দাঁড়ানো হয়নি সেই পেয়ারা বাগানে । মায়ের মুখখানিও দেখা হয় নি। মোবাইলে অবশ্য মাঝে মাঝেকথা হয়। ... এ জীবনে সাধ তার সামান্যই। না, মায়ের মুখখানি দেখা নয়- একবার কেবল সেই পেয়ারা বাগানে গিয়ে দাঁড়ানো। কিন্তু, কী ভাবে তা সম্ভব? ছুটিছাঁটা তেমন নেই তার। মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরিটা ছেড়ে দেয়। পরক্ষণেই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে। চাকরিটা ছেড়ে দিলে হুট করে আবার চাকরি কোথায় পাবে সে। কে তাকে বিশ্বাস করবে? টাকা পয়সা নিয়ে যতই ক্যাঁচক্যাঁচ করুক - বর্তমান গাড়ির মালিক তাকে ভীষন বিশ্বাস করে। ...তাছাড়া মালিকের ব্যবসা মন্দা বলে এ শহরের কত ড্রাইভার বেকার হয়ে গেছে। পেটে খিদের জ্বালা নিয়ে ঘুরছে তারা, তারপরে চোখে ঝাপসা দেখলে ... মুখে তিতা পানি উঠলে বাধ্য হয়েই তাদের কেউ মলম পার্টি কি ছিনতাই পার্টিতে নাম লেখাচ্ছে ...তারপর তাদেরই কেউ ধরা পড়ে হাজতে দিন কাটছে। কারও হয়তো একটা হাত কি একটা পা চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে ...হ্যাঁ। এসব নিঠুর ব্যাপারস্যাপারও সে জানে। কাজেই সে চাকরিটা ছাড়তে পারে না-মহিষকুন্ডী গ্রামের পেয়ারা বাগানে গিয়ে একবার দাঁড়ানোও হয় না।
গাড়ির মালিকের বাড়িটি শ্যামলীর রিং রোডে। লাল রঙের সিরামিক ইটের ছ’তলা ফ্ল্যাটবাড়ি। এক থেকে চারতলা পর্যন্ত ভাড়া। পাঁচতলা আর ছতলা মিলিয়ে বাড়ির মালিক থাকে। আর সে থাকে নিচ তলার গ্যারেজের এক কোণে ছোট একটা ঘরে । গাড়ির মালিক এই ঘরটিও মাগনা দিতে চায়নি। বলেছিল, থাকা-খাওয়া তোমার।
তখন সে বলেছিল, সকালে যাত্রাবাড়ি থেকে শ্যামলী আইসতে আইসতে লেট হয়া যাবি ছার।
থাকো তাইলে। গম্ভীরকন্ঠে গাড়ির মালিকের ঠান্ডা উত্তর।
বেতনের ৭০০০ টাকা থেকে ভাড়া হিসেবে ৫০০ টাকা কাটবে কি না ভাবছিল সম্ভবত।
কোনও কোনও দিন ছুটি পেতে পেতে তার মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। তখন তার বুকে
অপার আনন্দ তিরতির করে। আজকাল তার তেমন ঘুম হয় না। ভোরের আগ পর্যন্ত
জেগে থাকে সে-এই সময়টা তার। সে ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়। কাল্পনিক একতারাটি টেনে নেয়। তারপর অনুচ্চ স্বরে গান ধরে-
বিধাতা সংসারের রাজা
আমায় করে রাখলেন প্রজা;
কর না দিলে দেয় গো সাজা
কারো দোহাই মানে না
যেন মনের আনন্দে গান গাইছে এক যাত্রী । তারই একান্ত আঁধারে। আর, ঘরটির গভীর অন্ধকারে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে নির্মলা নামে নীলনয়না এক বৈষবী শোনে সে গান।
এবং এভাবেই জীবনের সময় কেটে যেতে থাকে তার ।
আর, সে টের পায়-সেও এক অকূল পাথারে ভেসে চলেছে। যে পাথারের কূল নাই কিনার নাই। সে ভেসে চলেছে অজানা এক গন্তব্যের দিকে। তবে সে জানে- যে কোনও পথেরই শেষ আছে। সে পথের যাত্রী একদিন তার সর্বশেষ গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছে যাবে। সেও একদিন যাত্রাপথের শেষে ঠিকই পৌঁছে যাবে। সে জানে, তখন, এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা নয়, ছেঁউড়িয়ার শাঁইজীও নয়, যাত্রাপথের শেষে দাঁড়িয়ে থাকবে মহিষকুন্ডী গ্রামের সেই শ্যামলা মেয়েটি ...