ছাগুলে দাঁড়ি চিনাম্যান বললো, 'তেক দিস কুকিজ, ইত ইউল তেল ইউল ফলতুন।’
এই চীনা দোকানদারের ইংরেজি বোঝার চেয়ে চীনা ভাষা বোঝা সহজ।
আমার হতভম্ব চেহারা দেখে দোকানের অল্পবয়সী মেয়েটা এগিয়ে এলো। খাঁটি অ্যামেরিকান ইংলিশে আমাকে ফরচুন কুকি বা সৌভাগ্যের বিস্কুটের মাহাত্ম বুঝিয়ে দিল। বাদামি রঙ্গের ছোট্ট বিস্কুটগুলো অনেকটা সিঙ্গারা বা নিমকির মতো দেখতে। এগুলোর প্রতিটির ভেতরে একটি কাগজে লেখা থাকে খানেওয়ালার জন্য এক একটি ভবিষ্যতবানী।
নিছক কৌতুহলের বশেই তিন ডলার খরচ করে ফরচুন কুকির একটা ছোট্ট প্যাকেট হাতে তুলে নিলাম। তক্ষুণি প্যাকেট খুলে একটা বিস্কুট ভেঙ্গে ভেতরের কাগজটা বের কলাম। চীনা হরফে কিছু লেখা, তার চ্চিই ইংরেজি অনুবাদ- আজ তুমি প্রিয়জনদের জন্য উপহার কিনবে।
মনে মনে হাসলাম।
চায়না টাউনে এসে শপিং করবে না এমন বেকুব কী আর আছে? এখানে এসে প্রিয়জনদের জন্য উপহার কেনা হবে- এটা বলার জন্য জ্যোতিষি হওয়ার প্রয়োজন নেই।
চীনাদের নানা রকম কুসংস্কারের মধ্যে ফরচুন কুকিও একটি। পাকা ব্যবসায়ী চীনারা জানে কিভাবে একটি রীতি বা প্রথাকে পুঁজি করে ব্যবসা ফাঁদা যায়। সানফ্রান্সিসকোর এই বিশাল চায়না টাউন ঘুরে পদে পদে চীনাদের ব্যবসায়ীক বুদ্ধির পরিচয় পাচ্ছি। দোকনগুলো এতো সুন্দরভাবে সাজানো, মনে হয় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিছু কিছু দোকানতো রীতিমতো মিউজিয়াম। পাথরে খোদাই করা এবং পিতলের কারুকাজ করা বিশাল বিশাল মুর্তি, বিরাট বড় হাতির দাঁতে শিল্পীর সুè কারুকাজ, পাথরের গয়না, উৎকৃষ্টমানের সিল্ক থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, ক্যামেরা, ঘড়ি কি নেই এসব দোকানে।
এ দোকান সে দোকান ঘুরে আমার ছেলের জন্য চমৎকার কয়েকটি খেলনা কিনলাম, আর কিনলাম স্কুল ব্যাগ। স্ত্রীর জন্য কিনলাম সিল্কের শাল। আফসোস হচ্ছিলো, খুব বেশি ডলার সঙ্গে নিয়ে আসিনি বলে। বেশিরভাগ টাকা হোটেল রুমেই রয়ে গেছে। সানফ্রান্সিসকো শহরের এই যে পাঁচতারা হোটেলটিতে আমি উঠেছি সেটি ১০০ ভাগ নিরাপদ, রিসেপশনের সুন্দরী মেয়েটি প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছে। তাই হোটেলের কামড়াতে নিশ্চিন্ত মনে টাকা-কড়ি রেখে এসেছি। এখন মনে হচ্ছে সঙ্গে আনাই ভালো ছিল।
এক মাসের একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামে যোগ দিতে মার্কিন মুল্লুকে এসেছি। কাল সোমবার থেকে প্রোগ্রাম শুরু হবে। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টানা ট্রেনিং ক্লাশ চলবে। আজকে একটু ফ্রি আছি। আর এ সুযোগে সানফ্রান্সিসকোর বিখ্যাত চায়না টাউনে ঢু মারতে এসেছি। হোটেলের লোকগুলো এ আইডিয়া দিয়েছে। আর আমার হোটেল থেকে চায়না টাউন পায়ে হাঁটা দূরত্ব।
হোটেল রুমে টেবিলের উপর পড়ে ছিল ফরচুন কুকির প্যাকেট টা। সকালে তাড়াহুড়ো করে ট্রেনিং সেশনে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো। একটা কুকি হাতে তুলে নিয়ে ঝুড়ের বেগে বেরিয়ে গেলাম। লিফটের বোতাম টিপে হাতের কুকিটার ভেতওে ভাগ্য গননার কাগজটা খুলি। ‘আজকে তোমার ভাগ্যে আছে অপ্রত্যাশিত আনন্দ।’ সকাল সকাল ভালো কথা শুনতে কার না ভালো লাগে। হোক মিথ্যে, তারপরও ফরচুন কুকির ভাগ্য গননায় মনটা ভালো হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় রুমে ফিরলাম ঝাঁ-চকচকে নতুন ল্যাপটপ নিয়ে। ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে আসা প্রত্যেককেই আয়োজকেরা একটি করে ল্যাপটপ দিয়েছে। ব্যপারটা আমাদের কারোই জানা ছিলো না। অপ্রত্যাশিত এই উপহারে ট্রেনিংয়ে অংশনেওয়া প্রত্যেকেই দারুন খুশি। আমার আনন্দ আরো বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে আমার একমাত্র শালা একটা ল্যাপটপের বায়না করেছে। যাক, এখন আমার পুরানটা তাকে গছিয়ে দেওয়া যাবে। পয়সা খরচ করে আর কিনতে হবে না।
ল্যপটপ টেপাটেপি করে অনেক রাতে বিছানায় গেলাম। যথারীতি সকালে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরুলাম। হোটেলের লবিতে ছোট্ট একটা সিড়ি ভাঙ্গতে গিয়ে বেকায়দায় পা-টা মচকে গেল। তীব্র ব্যথা। এ অবস্থায় ট্রেনিংয়ে যাওয়া সম্ভব না। অগত্যা ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটরকে ফোনে আমার অবস্থা জানিয়ে রুমে ফিরে এলাম।
কাপড় বদলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে টেবিলে রাখা সৌভাগ্যের বিস্কুটের প্যাকেটটা চোখে পড়লো। আরেকটা বিস্কুট ভেঙ্গে ভাগ্যটা যাচাই করি। ভেতরের কাজটা পড়ে চমকে উঠি। এ কী করে সম্ভব! বিষয়টা নিছক কাকতালীয় বলেও উড়িয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। গত দুদিনের ঘটনা মনে মনে সাজাই। ল্যাপটপ পাওয়ার দিন ফরচুন কুকির ভবিষ্যতবানীতে লেখা ছিল অপ্রত্যাশিত আনন্দের কথা। এটা হয়তো কাকতাল। কিন্তু আজ কিভাবে ভবিষ্যতবানী মিলে গেল? কিভাবে এই বিস্কুটের ভেতরের কাগজে লেখা থাকলো, ‘আজকের দিনটা দুর্ভোগের।’
এরপর প্রতিদিনই একটা করে বিস্কুট ভাঙ্গছি আর ভাগ্য মিলিয়ে দেখছি।
আমার যুক্তিবাদী মনকে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রতিদিনই চীনা বুড়োর বিস্কুটের ভবিষ্যতবানী সত্যি হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রতিদিন এক ধরণের আতঙ্ক নিয়ে বিস্কুট ভেঙ্গে দেখতে থাকি। ফরচুন কুকির ভাগ্য গননা আমাকে নেশার মতো পেয়ে বসে। ‘আজ তোমার পুরোনো বন্ধুর সনঙ্গে দেখা হবে’ গত পরশুর এ ভবিষ্যত বানীটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাওয়ার পর আমি তেমন অবাক হলাম না। কারণ গত দশ দিনে আমি মোটামুটিভাবে ফরচুন কুকির কেরামতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। অবাক হওয়ার ক্ষমতাও চলে গেছে।
ভবিষ্যতবানী নির্ভুল হওয়ায় অবাক হইনি, অবাক হয়েছি প্রায় দশ বছর পর নুজহাতকে এখানে এ অবস্থায় দেখে। জানতাম, স্বামী-সন্তান নিয়ে মার্কিন মুল্লুকে সুখেই আছে। কিন্তু সানফ্রান্সিসকোতেই যে সে সংসার পেতে বসেছে সেটা জানা ছিলো না।
একটি সুপার স্টোরে নেহায়েত মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল, তাই বোধ হয় নুজহাতের পক্ষে আমাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। কী খবর, কেমন আছেন.. .. .. .. মামুলি কুশল বিনিময়ের পর স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো নুজহাত। স্বামী ড. ইফতেখার পেশায় কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। ভাগ্যলী নুজহাতের ব্যপারে বিশেষ সুপ্রসন্ন, তাদের বিশাল বিএমডব্লিউ গাড়িটি দেখে সেটা বোঝা গেল।
একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে ধীর পায়ে রাস্তায় নেমে আসি।
দশ বছরে এতোটুকু বদলায়নি নুজহাত। আগের চেয়ে বরং আরো বেশি সুন্দর হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দাম দিনগুলোতে চলছিলো আমাদের উত্তাল প্রেম। এর মধ্যেই নুজহাতের বাবা-মা প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন। মাস্টার্স পাশ করে তখন আমি ফুলটাইম বেকার। সাহস ছিলো না প্রস্তাব নিয়ে তার বাবা-মার সামনো দাঁড়ানোর। একদিন টেলিফোনে নুজহাতের বিয়ে হয়ে যায়। এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না তার সঙ্গে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে হোটেলে ফিরে আসি। আপাতত করার কিছু নেই। অভ্যাসবশেই একটা ফরচুন কুকি ভাঙ্গি।
ভবিষ্যতবানীটা পড়ে জমে যাই। ‘তোমার সন্তানকে হারাবে আজ’। এ কেমন রসিকতা? এ ধরণের ঠাট্টা কার ভালো লাগে? এমন কথা কেন লেখা থাকবে এই ফরচুন কুকিতে? একটু পর আমার মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়। গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি, এটা কোনো ঠাট্টা নয়, নির্মম সত্য। ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠি। টাকা-পয়সার হিসেব ভুলে ফাইভ স্টার হোটেলের রুম থেকেই বাংলাদেশে স্ত্রীর সেল ফোন নম্বরে ডায়াল করি।
গভীর ঘুম থেকে স্ত্রীকে তুলে ছেলের কুশল জানতে চাই।
অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে, তুমি এতো অস্থির হচ্ছো কেন? ছেলে ভালো আছে, কোনো সমস্যা নেই।’
‘ঠিক আছে, আসলে মানে, আমি.. .. আমি ওকে নিয়ে একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। কালকে স্কুলে পাঠানোর দরকার নাই। একটু সাবধানে থাকতে বলেবে।’ আমতা আমতা করে বলি। সত্যি কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারি না। আর বলবোই বা কিভাবে, একটা চীনা বুড়োর বুজরুকিতে ভয় পেয়েছি!
দিনটা যে কিভাবে কাটে সে শুধু আমিই জানি।
এর মধ্যে অন্তত দশবার ঢাকায় ফোন করে ছেলের খোঁজ নিয়েছি। স্ত্রী যতোটা অবাক হয়েছে, বিরক্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি। একটু পর পর ফোন, আর ছেলের খোঁজ-খবর নেওয়া। চব্বিশটা ঘন্টা এই উৎকন্ঠায় কাটে। পরদিন সকালে আবার ঢাকায় ফোন দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। না, ছেলে দিব্যি ভালো আছে। চিন্তার কিছু নেই। এই প্রথম ফরচুন কুকির ভবিষ্যত গননা মিথ্যা হয়। বেঁচে থাকুক চীনা বুড়ো আর তার বুজরুকি। হাঁপ ছেড়ে বেঁচে যাই আমি।
ট্রেনিং ক্লাশে গিয়ে জানতে পারি, আজকের প্রোগ্রাম স্থগিত করা হয়েছে। কোম্পানির আইটি কন্স্যালটেন্ট ড. ইফতেখার গতকাল ভয়ানক দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। এ দুর্ঘটনায় মি. ও মিসেস ইফতেখার মারাত্মক আহত হয়েছেন। তাদের একমাত্র কন্যা ঘটনাস্থলেই মারা গেছে।
দশবছর আগের সেই বিকেলটির কথা মনে পড়ে যায়।
দেশ ছেড়ে স্বামীর কাছে আসার আগে সেদিন শেষবারের মতো আমার সঙ্গে দেখা করেছিলো নুজহাত। উদ্দাম আবেগে সেদিন ভেসে গিয়েছিলাম দুজন। ভালোবাসার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যই বোধ হয় নুজহাত আমাকে অনেক বেশি প্রশ্রয় দিয়েছিলো।
ফরচুন কুকির ভাগ্য গননা এবারো নির্ভুল ছিল, বুঝতে পারি। না দেখা আত্মজার জন্য বুকটা হু হু করে উঠে। (শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:১৬