somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিয়তি (গল্প)

২১ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তালপাকা গরম শরীর নিংড়ে যেন সব রস বের করে ফেলছে। দমবন্ধ করা গুমোট আবহা্ওয়ায় হাড়গোরসব সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঢাকা শহরটাকে একটা বড় চুলার উপর বসিয়ে অল্প আঁচে সেদ্ধ করছে কেউ। সন্ধ্যা থেকেই যে ধীরে ধীরে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে, সেটা টের পা্ওয়া যায়নি, হঠাৎ দমকা বাতাসে উড়ে এলা রাজ্যের ধুলো, ময়লা, কাগজের টুকরা আর পলিথিনসহ নানা নাগরিক আবর্জনা। ঢাকা শহরে ঝড়ের আগমন ঘোষণার এটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাগ্য যদি আরেকটু খারাপ হয়, তাহলে আশপাশের কোনো খোলা ডাস্টাবিন থেকে শুকনো ময়লা উড়ে এসে গায়ে পড়া্ও বিচিত্র নয়।
ভাগ্যিস ঝড় শুরুর আগে আগেই কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে হাজির হতে পেরেছে.....মনে মনে নিজের ভাগ্যকেই ধন্যবাদ দেয় আরিফ। রাত দশটায় বাস ছাড়বে, এখনো সময় আছে প্রায় চল্লিশ মিনিট। বাস কাউন্টারের তীব্র গন্ধযুক্ত টয়লেট থেকে কাজ সেরে এসে ব্যাকপ্যাকটা কোলে নিয়ে গুছিয়ে বসে। অভ্যাসবশতই হাতে চলে আসে স্মার্ট ফোনটা, কিন্তু কি ভেবে আবার পকেটে ভরে রাখে। গতকাল থেকে ফেসবুক ব্যবহার করছে না। ইচ্ছে করেই। এই সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে যে তাকে এভাবে সমাজছাড়া করবে কে ভাবতে পেরেছে? অজান্তেই বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। গত ছত্রিশ ঘন্টায় জীবনটা নরক হয়ে উঠেছে।
চকিতে একবার চারপাশ দেখে নেয়, না, পরিচিত কোনো মুখ দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য ঢাকা শহরে তার পরিচিতির গণ্ডি খুব বড় নয়। ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা আর চিটার, এর পাশাপাশি ঢাকায় থাকা কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন- ব্যাস। যাই হোক আশপাশে পরিচিত কাউকে না দেখে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আরিফ।
বাসে উঠার আগ মুহুর্তে শেষ এককাপ চা খেয়ে নেয়, আর কিনে নেয় দশটি বেনসন। ব্যাস, এখন যাত্রার জন্য তৈরি। এর মধ্যে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ব্যাকপ্যাকটায় মাথা ঢেকে দৌড়ে কোনোরকমে বাসে উঠে যায়। টিকিট দেখে আসন মিলিয়ে বসে পড়ে। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে। সুপারভাইজারের (এসব কুলীন বাসে কোনো এক বিচিত্র কারণে কন্ডাকটরকে সুপারভাইজার বলা নিয়ম) ডাকে তন্দ্রা ভাঙ্গে। কী আশ্চর্য, বাস ছাড়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো? আারিফ বুঝতে পারে, দু-দিনে কতোটা ক্লান্তি ভর করিছিলো তার শরীরে। বাস্তব পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আবারো চকিতে চারদিকে চোখ বুলায়, আর তখনই নজরে আসে পাশের সিটের সহযাত্রী। বৈশিষ্ট্যহীন সাধারণ চেহারার মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। চোখাচোখি হতে ভদ্রতার হাসি দেন ভদ্রলোক। অনেক কষ্টে ঠোটদুটো প্রসারিত করে প্রত্যুত্তরের চেষ্টা করে, কিন্তু হাসিটা ঠিক ফুটে উঠেনা আরিফের চেহারায়।
আবারো চোখ বন্ধ করে ঘটে যা্ওয়া ঘটনাগুলো ভাবতে থাকে। সুষ্মীর সুইসাইডের আগ পর্যন্ত বিষয়টা এতোটা ঘোড়ালো হয়ে উঠেনি। সুষ্মী যে এই কাণ্ড করে বসবে, আরিফের কল্পনাতেও ছিলো না। এরপর একে একে দ্রুত ঘটতে থাকলো সব। তার খোঁজে মেসে পুলিশের আগমন, এক কাপড়ে মেস ছেড়ে আত্মগোপন, পরে জামিকে দিয়ে কোনোমতে টাকা-পয়সা আর পাসপোর্টসহ ব্যাগটা নিয়ে আসা.....সব যেন সিনেমার এক একটি দৃশ্যের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠে।

ভাগ্যিস ডিপার্টমেন্টের স্টাডিট্যুর উপলক্ষ্যে ইন্ডিয়ার ভিসাটা লাগানো ছিলো, তাইতো এই বিপদের সময় লেজ গুটিয়ে একেবারে দেশ ছেড়ে পালানোর সুযোগ পেয়েছে আরিফ। পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠাণ্ডা হ্ওয়ার আগ পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে থাকাই নিরাপদ। পালানোর আগে জামি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশটা দিয়েছিলো, ভুলও মোবাইল ফোনটা অন করবি না। এখন র্যাব, পুলিশের হাতে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে কাউকে ধরার মতো সফস্টিকেটেড টেকনোলজি আছে।
অক্ষরে অক্ষরে সেই পরামর্শ মেনে চলছে আরিফ। আর সেজন্যই ঢাকা ছেড়ে পালানোর আগে গ্রামের বাড়িতে থাকা মা-বাবাকেও কিছু জানাতে পারেনি। যাক, কয়েকদিন ফোনে যোগাযোগ না করলেই যে তারা আরিফের খোঁজ করবে, সেই আশঙ্কা নেই। এমনিতেই সপ্তাহে-দুসপ্তাহে আরিফ ফোনে মা-বাবার খোঁজ নেয়। এতো সময় কই!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শরীরটা আবারো ঘুমে ঢলে পড়ে। এবার ঘুম ভাঙ্গে আলো আর যাত্রীদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। একটু ধাতস্ত হয়ে বোঝার চেষ্টা করে, সমস্যাটা কোথায়।
বাস কোথায় দাঁড়ালো? সহযাত্রীর দিকে ফিরে প্রশ্ন করে আরিফ।
পাটুরিয়া ঘাট থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে।
কেন, সমস্যা কী?
আবহাওয়া খারাপ, নদীতে প্রচণ্ড ঝড়। চার নম্বর বিপদ সংকেত চলছে। বিকাল থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ। কখন চালু হবে কেউ বলতে পারছে না।
একে একে দুঃসংবাদগুলো পেশ করেন সহযাত্রী। বেশ নিশ্চিন্ত মনে বসে আছেন। মুখটা কিছুটা হাসি হাসি। যেন পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের সাত কিলোমিটার দূরে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে থেমে থাকা বাসে বসে থাকাটা বেশ আনন্দের বিষয়।
মনে মনে কষে একটা কুৎসিত গাল দেয় আরিফ, কাকে, সেটা নিজেও জানেনা।
আরেকবার সহযাত্রীর দিকে তাকায়, হঠাৎ বুকের ভেতরটা হীম হয়ে আসে। আরে এই লোকটাতো পরিচিত। কপাল কুচকে ভাবতে থাকে, কোথায় দেখেছে, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। অথচ মুখটা খুব চেনা, অন্তত আরিফ যে তাকে চেনে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অদ্ভুত অস্বস্তি।
অবাক ব্যপার হচ্ছে, তার এই অসহায় অবস্থা লোকটি রীতিমতো উপভোগ করছে! আরিফের হতভম্ব চেহারার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আরো ধাঁধায় পড়ে যায় আরিফ। তাহলে কী লোকটা তাকে চিনে ফেলেছে? এক্ষুনি পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবে? নাকি বাসের সবাই মিলে গণপিটুনি-- কী আছে ভাগ্যে?
আপনি বোধ হয় আমার পরিচয় জানতে চাইছেন? মুখে হাসিটা ধরে রেখেই প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক।
কথা বলার শক্তি নেই। শুধু উপর-নীচে মাথা নাড়ে আরিফ।
ভাই আমার নাম আলী হোসেন মোল্লা। অবশ্য এই নামে আমাকে খুব কম লোকই চেনে। যারা আমাকে চেনে তারা বল্টু মোল্লা নামেই চেনে।
সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায় আরিফের কাছে। বল্টু মোল্লা, ঢাকাই ছবি খুব বেশি দেখা না হলেও বল্টু মোল্লাকে চেনে আরিফ। বাংলা ছবির নাম্বার ওয়ান কমেডিয়ান।হালের প্রায় সব ছবিতেই তার উপস্থিতি। এ জন্যই চেহারাটা এতো চেনা চেনা লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা, কালো প্যান্টের উপর সাদা ফূল সার্টে বল্টু মোল্লাকে একেবারেই নিপাট একজন সাধারণ মানুষের মতো লাগছে। ফিল্মি কোনো ব্যাপারই এখানে নেই। অথচ, সিনেমায় কাতুকুতু দিয়ে সাহানোর জন্য এই লোককেই কতো না বিচিত্র সাজ-পোশাকে ক্যামেরারা সামনে আসতে হয়। লোক হাসানর জন্য উদ্ভট মুখভঙ্গী-অঙ্গভঙ্গী করতে হয়। এই সরল চেহারার লোকটিকে তাই পর্দার বল্টু মোল্লার সাথে মেলানো কঠিন।
যাই হোক, হঠাৎ টেনশনমুক্ত হয়ে মনটা হালকা হয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টিটাও কিছুটা ধরে এসেছে, তবে ঝড়ো হা্ওয়ার বিরাম নেই। ভেজার রিস্ক নিয়েই নেমে পড়ে আরিফ। বদ্ধ বাসে বসে থাকার চেয়ে নীচে নেমে সিগারেট সহযোগে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে। আরিফের পিছু পিছু সহযাত্রী বল্টু মোল্লাও নেমে আসেন।
দুজন একটু দৌড়ে রাস্তার পাশে ঝুপড়ি চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ায়। এখানে তিলধারণের জায়গা নাই। থেমে থাকা বাসগুলোর যাত্রীরা নেমে চা-কলা-বিস্কুট-চিপস-চানাচুর সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট দোকনটার পোয়াবারো। দুহাতে খদ্দের সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। অগত্যা দুকাপ চা হাতে নিয়ে পাশের আরেকটি বন্ধ দোকানের ছাউনীর নিচে আশ্রয় নিতে হয়।
কতোক্ষণ এখাবে আটকে থাকতে হয় আল্লাই জানে। নিজের মনেই বিরবির করে বলে উঠে আরিফ।
তার মুখের কথা লুফে নিয়ে বল্টু মোল্লা বলে উঠেন, কয়েক মাস আগে এমন বিপদে পড়েছিলাম। সেবার সারা সাত নদীর এই পাড়ে বসেছিলাম। সকালে ফেরি পার হয়ে সন্ধ্যার পর বেনাপোল বর্ডারে পৌছাই।
আপনি বুঝি প্রায়ই ইন্ডিয়া যান?
সেটা প্রায় নিয়মিতই। আমার আথ্রাইটিসের সমস্যা। কলকাতার এক ডাক্তারের চিকি_সায় দারুন সুফল পাচ্ছি। বছরে তিন-চারবার যাওয়া-আসা করি।
ভালোই হলো আপনাকে পেয়ে। আমি প্রথম যাচ্ছি। কলকাতার কিছুই চিনি না। কোন হোটেলে উঠবো, কোথায় খাবো, কিছুই জানা নেই। আপনার সাথে যদি কলকাতা পর্যন্ত যাই, অন্তত হোটেলটা ঠিক করতে যদি সাহায্য করেন...
আরে ভাই সেটা কোনো ব্যপার হলো। আমার সাথে যাবা তুমি, আমার হোটেলেই রুম ঠিক করে দেবো। তুমি আমার ছেলের বয়সী......আমাকে চাচা বলে ডাকবা। নানা, সিগারেট নিয়ে বিব্রত হ্ওয়ার কিছু নাই। আজকাল এসব কোনো ব্যপারই না।
বল্টু মোল্লার আতি আন্তরিকতায় কিছুটা বিরক্ত হলেও শেষের বাক্যটি পছন্দ হয় আরিফের। আর সত্যি বলতে কী বল্টু মোল্লার মতো একজন অভিজ্ঞ লোকের সাহায্যওতো দরকার কলকাতায় একটা ঠেক খুজে নিতে।
গল্পজুড়ে দেয় বল্টু মোল্লার সাথে।
ভাই ফিল্মের নায়ক-নায়িকাদের সম্পর্কে আমার দারুন কৌতুহল। তাদের সম্পর্কে কিছু গল্প বলেন।
হুম...আসলে ফিল্মি লাইনে যে যতো ভাব নিতে পারে সে ততো বড় স্টার। ভাবটাই আসল। ফিল্মের নায়করা ইচ্ছে করেই সামজিক অনুষ্ঠানগুলোতে কম যায়। গেলেও দুই-চার মিনিট পরই চলে আসে। কেন? কারণ তারা চায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের নিয়ে কৌতুহল থাকুক। ধরো, একটা বিয়ে বাড়িতে যদি তুমি দেখো শাহিন খান ওয়েটারেকে মুরগির সিনার বদলে রানের পিস দেওয়ার জন্য ঝুলাঝুলি করছে, কিংবা নায়িকা রেশমী বোরহানিতে লবন কম হইছে কেন বলে চিল্লাচিল্লি শুরু করলো, তাহলে একজন সাধারণ মানুষের সাথে রূপালী পর্দার হিরো-হিরোয়িনের আর কী পার্থক্য থাকলো? তাই সব সময় তারা ভাব নিয়া থাকে। মানুষের সাথে মিশেও কম। আর তাদের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প বললেতো সেটা কিচ্ছা-কাহিনী ছাড়া আর কিছুই না। তুমি ছোট মানুষ, তোমারে কেমনে এসব কথা বলি, তার উপর ভাতিজা ডাকছি। বাদ দেও। তার চেয়ে আমার কাহিনী শোন। সিনামার চেয়ে কম ইন্টারেস্টিং না।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সিগারেটে একটা লম্বা দম দেয় বল্টু মোল্লা।
বাস এখনো অনড়-অচল। সময় কাটানোর জন্য বল্টু মোল্লার 'রিয়েল লাইফ ফিল্মি স্টোরি' শোনা যেতেই পারে। আপত্তি করলো না আরিফ, তার মৌনতাকে যথার্থই সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নিয়ে গল্প শুরু করে বল্টু মোল্লা।
আমার বয়স তখন ১৫-১৬। লেখা-পড়ায় মন নাই। মাথায় চাপলো ফিল্মের ভুত। ফিল্ম মানে সিনেমা। আর আমার খায়েস এক্কেবারে হিরো হওয়া। গ্রামের যাত্র-পালায় অভিনয় করে স্থানীয়ভাবে কিছুটা নামডাক ছিলোই। সেটাকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফিল্মে নামতে হবে। সুযোগ বুঝে একদিন বাবার তোষকের নীচ থেকে ধার বিক্রির মোটা টাকা চুরি করে ঢাকার ট্রেনে উঠে বসি। এর পরের কয়েক বছরের ইতিহাস বড়ই করুন। বিস্তারিত বলে তোমার ধৈর্য্য নষ্ট করবো না, শুধু এটুকু বলে রাখি, হাতের টাকা শেষ হওয়ার পর টানা বেশ কয়েকমাস কমলাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফরমে খবরের কাগজ বিছিয়ে ঘুমাতে হয়েছে, খুব কম দিনই তিন বেলা খাবার জুটেছে। টাকার জন্য গামছায় মুখ ঢেকে রাতে কুলির কাজও করেছি। যাই হোক, রাতে স্টেশনে ঘুমাই, দিনে এফডিসিতে ঘোরাঘুরি করি...এভাবেই চলছিলো। নায়কতো দূরের কথা, সিনেমায় যে কোনো একটা রোল পেলেই বর্তে যাই। বিখ্যাত হ্ওয়ার জন্য নয়, তখন এক শিফটে একজন এক্সট্রাকে দেয়া হতো ত্রিশ টাকা, আর ভরপেট খাবার। এটাই ছিলো মূল আকর্ষণ। এ সময় আমার পরিচয় হয় রশিদার সাথে। স্ওে ফিল্মের এক্স্ট্রা। দারুন সুন্দরী। প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলো, তারপর নানা হাত ঘূরে, নানা ঘাটের পানি খেয়ে ফিল্মি পাড়ায়। নায়িকা হও্য়ার সব যোগ্যতা থাকলেও শুধু কোনো রকম মামা-চাচা নেই বলে এক্সট্রা হিসেবে দিন পার করছিলো।
কোনো এক বিচিত্র কারণে রশিদার নজরে পড়ে যাই আমি। কী কারণে জানা নেই, স্যুটিং শেষে আমার সাথেই মুগদার বস্তিতে ফিরতো রশিদা। নানা গল্প হতো দুজনার মধ্যে। তবে আমি কখনোই তার অতীত জানতে চাইনি। জানি, সেটা নানা রকম গ্লানিময় ঘটনায় ভরা। তবে ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কথা হতো। বিষয় হিসেবে এটি অতীত নিয়ে আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।
খোলা প্ল্যাটফরমে থাকি শুনে একদিন রশিদা একটি ভয়ঙ্কর প্রস্তাব দিয়ে বসলো।
তুমি আমার বস্তিতে এসে থাকলেই পারো।
রশিদার কথা শুনে ভাবলাম বুঝি সেখানে আরেকটি ঘর ভাড়া নিতে বলছে। সুন্দরী বলে রশিদা অনেক বেশি চান্স পায়, আমার ভাগ্য কথনো অতোটা ভালো নয়। বস্তিার ঘর ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য নেই। রশিদা সব জানে, তারপরও এমন একটা প্রস্তাব কেন দিল!
আমার মৌনতা দেখে সে বুঝতে পারে সব। আরো পরিষ্কার করে বলে, তুমি আমার ঘরে উঠে এসো।
এই নিরীহ কথাটির পেছনে যে চরম একটা সাহসী প্রস্তাব আছে, সেটা না বোঝার মতো বয়স বা অবস্থা রশিদার নেই। আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
পাছে মত পাল্টে ফেলে, তাই সেদিনই রশিদার সাথে তার ঘরে উঠে যাই। কাগজে-কলমে, ধর্মীয় মতে বা আইন অনুযায়ী আমাদের বিয়ে না হলওে আমরা স্বামী-স্ত্রীর মতোই বসবাস করতে থাকি। এর মধ্যেই আমার ভাগ্য ফিরে যায়। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে অল্প-স্বল্প নাম-ডাক হচ্ছে। ফিল্মের এক্সট্রা থেকে চরিত্রাভিনেতায় প্রোমশন হয়েছে। আর এদিকে রশিদাও নজর কেড়েছে এক উঠতি পরিচালকের। একটি সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেল। তবে অভিনয় করলো একেবারে যা-তা। আমি বুঝে গেলাম অভিনয়ে বেশিদূর যাওয়ার কপাল নেই তার। এ কথাটা বুঝিয়ে বলতে গিয়েই বাধলো বিপত্তি। তেলে-বেগুনে আমার উপর জ্বলে উঠলো সে। যা-তা ভাষায় আমাকে অপমান করলো। বললো, তার সাফল্যে আমার নাকি ঈর্ষা হচ্ছে, তাই আমি এসব আবোল-তাবোল বকছি। যাই হোক চুপ করে হজম করে গেলাম।
কিন্তু বিষয়টা এখানেই থেমে থাকলো না। আমার আর রশিদার মধ্যে তিক্ততা বাড়তেই থাকলো। এর মধ্যেই আমি বুঝতে পারলেম, ওই পরিচালকের সাথে তার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হয়েছে। এদিকে আমাদের দুজনার সম্পর্কের কথাটা ফিল্মি পাড়ায় গোপনই আছে। আমরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ক্যারিয়ারের কথা ভেবে, বিষয়টি গোপন রাখার। এর মধ্যেই প্র্যাগনেন্ট হয়ে পড়ে রশিদা। অ্যাবরসনের জন্য আমাকে চাপ দিতে থাকে। এদিকে আমার মাথায়্ও জেদ চেপে গেছে। আমি বলি অবশ্যই তাকে এই বাচ্চার জন্ম দিতে হবে। না হলে আমি ফিল্মি পাড়ায় আমার সাথে তার এতো দিনের সম্পর্কের কথা বলে দেবো। ততোদিনে বুঝে গেছি, আমার প্রতি ভালোবাসা নয়, আসলে রশিদার দরকার হাতের কাছে যে কোনো একজন পুরুষ মানুষ। আমাকে নয়, আমার শরীরটাকে দরকার ছিলো তার। এখন এর চেয়ে ভালো বিকল্প পেয়ে যাওয়ায় আমাকে ছাড়তে চাইছে।
সম্পর্কের কথা ফাঁস করে দেয়ার হুমকিতে কাজ হয়। নিতান্ত মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, আমার ব্ল্যাকমেইলিংএর কারণে একটি সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হয় রশিদা। তবে হাসপাতাল ছাড়ার পর আর সে ওই মেয়ের মুখের দিকে চেয়েও দেখেনি। সোজা গিয়ে উঠে তার নয়া নাগরের বাড়িতে। ততোদিনে ভাগ্যলক্ষী সদয় হয়েছেন, দু-হাতে উপার্যন করছি আমি। টাকার অভাব নেই। নিয়মিত টাকা পেয়ে এবং ছেলে বিখ্যাত অভিনেতা হওয়ায় মা-বাবাও এখন আমাকে রীতিমতো তোয়াজ করেই চলেন। ছোট্ট মেয়েটিকে পালার জন্য গ্রাম সম্পর্কের এক বিধবা ফুপুকে নিয়ে আসি। আর আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি ছবির স্যুটিংয়ে।
এর মধ্যেই নেপালে একটি ছবির স্যুটিংয়ে হঠাৎ রশিদার সাথে দেখা। অনেক বছর পর দেখা হলো। কটি ফ্লপ ছবির নায়িকা রশিদা ততোদিনে অভিনয়ের ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে পুরোপুরি ওই পরিচালকের রক্ষিতা বনে গেছে। তা সেই পরিচালক বাবাজি তাকে নিয়ে নেপাল গেছে ফূর্তি করতে। একই হোটেলে উঠেছে। আমাকে দেখেও কিন্তু রশিদার চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। যেন আমি আর দশটা মানুষের মতোই অতি সাধারণ তার কাছে। এদিকে দীর্ঘদিন পর রশিদাকে হাতের কাছে পেয়ে আমার পুরোনো প্রেম জেগে উঠে। সে আমাকে ভালোবাসেনি, তাতে কী; আমিতো তাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলাম। এক সন্ধ্যায়, পরিচালক সাহেব যখন হোটেলের বারে গলা পর্যন্ত মদ গিলে প্রায় অজ্ঞান, আমি সন্তর্পণে রশিদার কামড়ায় ঢুকে যাই। ভেবেছিলাম, পুরোনো পরিচয়ের দাবিতে একটু ঘনিষ্ট সঙ্গ পাবো।
আমাকে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে রশিদা। ধর্ষণের উদ্দেশ্যে আমি তার কামড়ায় ঢুকেছি অভিযোগ করে যা-তা বলে আমাকে অপমান করে। এই মহুর্তে বেরিয়ে না গেলে হোটেলের সিকিউরিটিকে ডেকে আমাকে পুলিশে দেবে বলেও শাসায়। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বের হয়ে আসি। এতাদিন পর দেখা, অথচ রশিদা একবার তার সন্তানের খোঁজও জানতে চাইলো না!
এ ঘটনার পরদিন সেই হোটেল কামড়ায় দুজনের লাশ পাওয়া যায়। কিভাবে মৃত্যু হয়েছিলো সেটা জানতে চেওনা, আমি বলবো না।
ঝড়ো বাতাস আড়াল করে আরেকটা সিগারেট ধরায় বল্টু মোল্লা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার জীবন কাহিনী শুনছিলো আরিফ। ঘটনায় চমক আছে, সেটাই শুধু বিষয় নয়, বল্টু মোল্লা দারুন কথকও বটে। অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে তার গল্প বলার ঢঙে।
আরিফ মনে করতে পারে, বেশ কয়েক বছর আগে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো বটে! তখন আরিফ খুব ছোট, প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। তাদের গ্রামেও বিষয়টা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিলো। নেপালের হোটেলে ফিল্মের দুজনের রহস্যজনক মৃত্যু, অনেক বড় ঘটনা।
একটু থেকে আবার বলা শুরু করে বল্টু মোল্লা, তাদের মৃত্যু কিভাবে হয়েছিলো, সেটা আমি তোমাকে বলবো না। তবে শুধু এটুকুই জেনে রাখো, আমার সাথে বেঈমানী করে কেউ পার পায় না।
অদ্ভুত শান্ত গলায় কথাগুলো বলে বল্টু মিয়া। আরিফ লক্ষ্য করে, অন্ধকারে যেন তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠে বল্টু মোল্লার। হঠা_ ঘাড়ের পেছনে চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠে আরিফের। বুঝতে পারে না, কেন তাকে এই গল্প শোনাচ্ছে বল্টু মোল্লা!
বৃষ্টিটা আবার চেপে এসেছে। মাল শেষ হয়ে যাওয়ায় পাশে ঝুপরি চায়ের কোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে। বাসযাত্রীদের অধিকাংশই বাসে ফিরে গেছে। জায়গাটা হঠা_ কেমন নির্জন হয়ে উঠে। বৃষ্টির ভারি পর্দা বাসটাকেও অনেকটা আড়াল করে রেখেছে।
বল্টু মোল্লা তার গল্পের শেষ অংশটাকা বলতে শুরু করে।
এবার তার গলা যেন একেবারে প্রাণহীন। আগের সেই আবেগ-উচ্ছাসের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।
তোমার নিশ্চই খেয়াল আছে, আমি আমার মেয়েটার কথা বলেছিলাম। সেই মেয়েকে আমি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমিই তার মা, আমিই তার বাবা। ইচ্ছে ছিলো দেশের বাইরে মেয়েকে পড়তে পাঠাবো। মায়ের পরিচয় যেন কোনোভাবেই তাকে কলুষিত করতে না পারে। জীবনেও কখনো তাকে ফিল্মের লাইনে আনবো না। রূপালী পর্দার জনপ্রিয়তার দরকার নেই তার। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় কী জানো? মেয়ে আমার ফিল্ম করেই মানুষের কাছে পৌছে গেল। কিভাবে? বলছি। মেয়েটা যে একটা সাজানো সিনেমায় অভিনয় করছে, সেটা তার নিজেরও জানা ছিলো না, যতোক্ষণ না তার এই পুরো চলচ্চিত্রটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষেল হাতে হাতে পৌছে যায়। মেয়ে আমার এতোটাই বিখ্যাত হয়ে উঠে যে এই খ্যাতির দায় সে চুকিয়েছে নিজের জীবন দিয়ে। অবশ্য এই ভিডিও ইন্টারনেটে দেখার পর আমি সিদ্ধান্ত নেই, মেয়ে নিজে যদি তার জীবন শেষ না করে, আমিই নিচজ হাতে গলা কেটে হত্যা করবো।
আরিফের গলা শুকিয়ে কাঠ। পায়ে যেন শেকড় গজিয়েছে। দুই হাটুতে কোনো শক্তি নেই। সুষ্মী, মানে সুষ্মী হোসেনের সাথে তার গোপন ভিডিওটা ইন্টারনেটে ছেড়ে ছিলো প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। আরিফের সাথে দুই বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে আরেকজনের সাথে তার নাকের ডগায় প্রেম করে বেড়াবে, সেটা সে কীভাবে মেনে নেয়। তাই চরম প্রতিশোধ নেয় আরিফ, তার মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিওটা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে। সুষ্মী আত্মহত্যা করার পরই পুরো বিষয়টা ঘোড়ালো হয়ে উঠে।
কাছেই কোথাও বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। সম্বিত ফিরে পায় আরিফ। তবে সেটা না হলই ভালো হতো। চোখের সামনে মূর্তিমান বল্টু মোল্লা, ওরফে আলী হোসেন মোল্লা। ডান হাতটা বাঁ হাতের চেয়ে অনেকটা লম্বা দেখাচ্ছে। হাতে ধরা বস্তুতার ছুঁচালো মাথাটা অন্ধকারেও ঝিকমিক করছে। (শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৪৩
৯টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×