0১. যে কথা না বল্লেই নয়ঃ
প্রতিদিনের ঘুম ভাঙ্গে যে পৃথিবীতে মানষের আহাজারির ভারী বাতাসে, প্রতিটি নিশ্বাসে যেখানে মিশে থাকে মৃত মানুষের লাশ পঁচা গন্ধ, বন্ধ চোখে যে মর্তে দেখতে পাওয়া যায় অযুত নিযুত দুঃখী আত্মার মাতম, সেই নষ্ট, পঙ্কিল, দুর্গন্ধময় জঞ্জালে দঁড়িয়ে এ অসময়ের হাত থেকে আপনাকে বাঁচাবার কোন চেষ্টাই আমি করবো না। শুধু কিছু কথা বলে যাব........বলে যাওয়া উচিত বলে, শুধু কিছু বিষয়ে আপনার দৃষ্টিপাত কামনা করবো.......আপনি জানতে চান বলে। আর যদি এ ধৈর্য্যটুকু এখনও আপনার উপার্জনে না থাকে, তবে নিচের বাকি লেখাটুকু নিয়ে আপনার মাথাব্যথার কোন কারনই নেই।
০২. একটি ছোট্ট সহজ প্রশ্নঃ
যদি প্রশ্ন করি এই যে আমাদের চারপাশের নিদারুন বাস্তবতা, এত অস্থিরতা, এত আকাঙ্খা, চাহিদা, পাওয়া, না পাওয়া, আচার-ব্যবহার, সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি, বিস্ময়, হাসি, কান্না, হত্যা, লুন্ঠন, ভাল-মন্দ, বিচার-অবিচার, শাসন, দুঃশাসন; এত এত শব্দ, এত এত জীবন-রুপ, জীবনের এত আঙ্গিক, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় বস্তু কোনটি? আরেকটু সহজ করে যদি বলি, জীবনের বিষয় বস্তুগুলোকে যদি কয়েকটি সাধারন ভাগে ভাগ করি যেমন, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগলিক, ধর্মীয় ইত্যাদ; আর যদি আপনাকে প্রশ্ন করি, এর মধ্য থেকে আপনি একটিমাত্র বিষয় নির্বাচন করবেন যা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং যা অন্যান্য বিষয়গুলোর উপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করে, তবে আপনি কোন বিষয়টিকে বেছে নিবেন।
০৩. আমার সাথে কি একমত?
প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে কিংবা রাতে ঘুমাতে যাবার আগে, কষ্ট করে বাসে ঝুলতে ঝুলতে কিংবা গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপের রাত্রিতে বাসায় এসে বিদ্যুত না থাকাঃ এত সব যন্ত্রনার পরও যে বস্তুটি আপনাকে প্রতিদিন বাসা হতে বের করে আনে, তা হল অর্থ প্রাপ্তির চাহিদা। অর্থ অনর্থের মূল হলেও অতি অমূল্য এ বস্তুটির জন্যই আপনি এত কষ্ট দিবানিশি সহ্য করে আসছেন আর ভবিষ্যতেও করবেন। আর এ বস্তুটিই আপনার অন্যান্য সকল বিষয় বস্তুর উপর প্রভাব বিস্তার করে। সেই প্রভাবের প্রখরতা এতই প্রবল হয় যে আপনার পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রই প্রকম্পিত হয়। তাই অর্থনৈতিক মুক্তিই আপনার অন্যান্য সকল বিষয়ের যথাযথ যত্ন নিতে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে পারে।
০৪. নানা মুনির নানা মতঃ
এখন কথা হচ্ছে এই অর্থনৈতিক মুক্তি কিভাবে আসবে? অর্থনীতিবিদ বলে যাঁরা নিজেদের দাবী করেন তাঁরা প্রায়শয়ই দোদূল্যমান মতবাদের উপর থাকেন। কখনো একটি মতবাদ বা তত্ত্ব তাঁদের কাছ থেকে আসেনা। একটা মজার কৌতুক এ নিয়ে প্রচলিত। বিশ্ব-মাতবর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুমেন তাঁর সারা জীবনেও নাকি এক হাত ওয়ালা কোন অর্থনীতিবিদ পাননি। যখনই তিনি কোন অর্থনীতিবিদকে অর্থনীতি বিষয়ে কোন প্রশ্ন করতেন তখন তাদেঁর উত্তর হত, "Well, Mr. President, on the one hand ....... And then again, on the other hand .......". আরও বলা হয়ে থাকেঃ An economist is someone who, when he finds something that works in practice, tries to make it work in theory. অর্থ্যাৎ আশেপাশে দেখে অর্থনীতিবিদরা নিজেদের তত্ত্ব তৈরী করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল জীবন থেকে উপাত্ত নিয়ে এই তত্ত্বগুলোর জন্ম দিলেও তত্ত্বগুলোই আবার আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে সংগতিপূর্ণ হয় না। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারনটি কাজ করে তা হলঃ অর্থনীতি জীবনের অন্যান্য আরও যে সব বিষয় বস্তুগুলো রয়েছে তার উপর নির্ভর করে। আর মানব চিন্তা চেতনার মাত্রা ও পরিধি দুটোই সীমিত হওয়ায় এই ব্যাপক বিষয়টির অনেক গিরিপথ অর্থনীতিবিদদের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থাকে। আর তাই জীবন থেকে উপাত্ত নিয়ে তত্ত্ব তৈরী করলেও তা কাজ করেনা। বরং প্রাত্যহিক জীবনের অর্থনৈতিক বিষয়াবলীকে বিষিয়ে তোলে। সাথে সাথে জীবনের অন্যান্য সকল দিককে অস্থির করে দেয়। মূলত এই চিরসত্য কারনটি আমাদের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে না থাকায় আমরা প্রকৃত সত্য উপলব্দি করতে ব্যর্থ হচ্ছি।
০৫. এখন শুনি আসল কথাঃ
বিস্তারিত আলোচনার আগে চলুন জানি যে বস্তুটির জন্য এত এত ভূমিকা সেই 'সুদ' নামক বস্তুটি আসলে কি? 'সুদ' আরবীতে যাকে বলা হয় 'আল রিবা' আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে 'অতিরিক্ত' বা 'বেশী'। প্রায়োগিক দিক থেকে ইসলামে 'সুদ' বলতে বুঝায় সেই আয় যা কোন প্রকার পরিশ্রম ছাড়া অর্জিত হয় বা অতিরিক্ত আয় যা কোন প্রকার ব্যয় বা বিনিময় ছাড়া অর্জিত হয়। সহি হাদিসে বলা হয়েছে অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থই সুদ।
পবিত্র কোরআর মজিদের সুরা বাকারার ২৭৫ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলছেনঃ
"যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছেঃ ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লা’হ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।"
আবার ২৭৬ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলছেনঃ
"আল্লাহ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে।"
এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে সুদ নামক এই বস্তুটি সম্পর্কে আল্লাহপাক এত হুঁশিয়ারী কেন জানান দিলেন? সুদে এমন কি আছে যে এ বিষয়টি নিয়ে এত আলোচনা সমালোচনার দরকার পড়ে? কি তার ক্ষতিকর দিক? চলুন এত সব প্রশ্নের ব্যাখা বাস্তবতার পাল্লায় পরখ করে দেখি।
০৬. সুদ ও ব্যষ্টিক অর্থনীতিঃ
অর্থনীতিকে যে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, 'ব্যষ্টিক অর্থনীতি' বা 'Micro Economics' অর্থনীতির ক্ষুদ্রাংশ, ব্যক্তি বা বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক আলোচনা করে থাকে। যেমন একটি দেশের একজন একজন করে কৃষকের উৎপাদনের হিসাব করা হলে তা ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচনা হবে। আর সকল কৃষকদের উৎপাদনের হিসাব করা হলে তা 'সামষ্টিক অর্থনীতির' (Macro Economics) আলোচনার বিষয় হবে। অন্য কথায় বলা যায়, ব্যষ্টিক অর্থনীতির সমষ্টিই সামষ্টিক অর্থনীতি।
আপাতদৃষ্টিতে সুদের কিছু সুবিধা আমরা দেখতে পাই। পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহপাকও এ কথা বলেছেন। আর এই সুবিধা শুধু ব্যষ্টিক অর্থনীতি কেন্দ্রিক। সাধারন একজন চাকুরিজীবির কথাই ধরুননা! সারা জীবন খাটা খাটুনির পরে বৃদ্ধ বয়সে এসে উপার্জনের আর কোন উপায় না পেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন। আর তা হতে পরে মুনাফা (সুদ) তুলে তুলে নিজের ভরনপোষনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এই জঘন্য বস্তুটির প্রভাব শুধু ঐ ব্যষ্টিক অর্থনীতির সীমিত পরিধির মধ্যে শুধুমাত্র খানিকটা সুবিধা দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অক্টোপাসের মত এর কুৎসিত কদাকার কদর্য প্রভাবে আজ দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে আমাদের নৈতিকতা, আদর্শ, পরোপকারিতা, উদারতা আরও অনেক মানবতার আবেদন। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি আর আপামর জনসাধারনের নাভিশ্বাসের কারণও যে এই সুদ! আসুন ব্যষ্টিক অর্থনীতির সীমিত গন্ডি হতে বেরিয়ে দেখি সুদের তান্ডবে আমরা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি প্রতিনিয়ত।
০৭. সুদ ও সামষ্টিক অর্থনীতিঃ
বস্তুতঃ আমরা আজ যে পূজিঁবাদী অর্থনীতির গ্যাড়াকলে নিষ্পেষিত হচ্ছি তার পুরো অবকাঠামোই গড়ে উঠেছে সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির উপর নির্ভর করে। সুদ আজ আমাদের চিন্তাজীবি এবং বুদ্ধিজীবিদের মাথা এমন ভাবে আড়ষ্ট করে রেখেছে যে তাঁরা অন্য কোন উত্তম উপায় বা পন্থা নিয়ে ভাবতে পারেননা। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, সুদের সমুদ্রে তাঁদের জ্ঞান এ পরিমান হাবুডুবু খাচ্ছে যে এ অকুল পাথারে নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও নজরে আসছেনা। এরই মধ্যে অনেক জ্ঞানপাপী আছেন যাঁরা সব জেনে শুনে বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকেন। কারণ? কারণ একটাই। নিজেদের অর্থপ্রাপ্তির ব্যাঘাত ঘটবে তাই। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এমন কয়েকজন আদম সন্তানকে জানি যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত এবং এই পূজিঁবাদী অর্থব্যবস্থার শঠতা সম্পর্কেও অবহিত। কিন্তু নিজেদের আহারের জোগান এই চলমান নষ্ট অর্থব্যবস্থার বইপত্র পড়িয়ে হয় বলে তার সম্পর্কে জেনেও না জানার ভান করেন। তাদের বিচার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলাম। যেহেতু যে নিজেকে সাহায্য করেনা আল্লাহও তাকে সাহায্য করেননা; দেখা যাক আমরা নিজেরা কি করতে পারি এই জঘন্য বস্তুটি থেকে মুক্তির জন্য!
০৮. ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ কি?
আক্ষিরিক অর্থে 'সুদ' বা আরবীতে 'আল-রিবা' বলতে বুঝায় 'অতিরিক্ত' বা 'বেশী'। ব্যবহারির দৃষ্টিকোন থেকে ইসলামে সুদ বলতে ঐ অংশকে বুঝায় যা কোন প্রকার শ্রম বা প্রচেষ্টা ছাড়া অর্জিত হয় অথবা যা কোন বিনিময় ছাড়া অর্জিত হয়। হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (রঃ) বলেছেন, "সুদ হল সেই ধার যা এই শর্তে নির্ধারণ করা হয় যে দেনাদার তার পাওনাদারকে যতটুকু ধার নিল তার চেয়ে বেশী অংশ ফেরত দিবে"।
পবিত্র কোরআর মজিদের সুরা বাকারার ২৭৮ এবং ২৭৯ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলছেনঃ
"হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না"
আপাতদৃষ্টিতে সুদের উপকার আমাদের কাছে আছে বলে মনে হয়। আমার এ লেখাটি মাত্র লিখছি। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে এক পাঠকের মন্তব্য পেলাম। তিনি জানতে চেয়েছেন সুদ ব্যবস্থা যদি না থাকে তবে উদ্যোগতার জন্ম হবে কিভাবে? কারো যদি কোন আইডিয়া থাকে আর তার কাছে যদি পর্যাপ্ত পরিমানে মূলধন না থাকে তবে সে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করবে কিভাবে?
সব প্রশ্নের জবাই পাবেন। একটি বিষয় সম্পর্কে বুঝতে হলে বিষয়টির যাবতীয় আলোচনার দাবী রাখে। তা না হলে ভাসা ভাসা জ্ঞান দিয়ে তাকে বুঝার চেষ্টা পুরো বিষয়টিকে ভুল দিকে প্রবাহিত করে। আর তাই সব কিছুই জানতে হবে। আমার এই প্রবন্ধে সুদের আদ্যোপ্রান্ত আলোচনার চেষ্টা করা হবে। মনে রাখেন আল্লাহ আর তাঁর রাসূল যদি কোন কিছু নিষেধ করেন তবে তা আপনার আমার কল্যাণের নিমিত্তেই করেন। অনেক প্রজ্ঞা এর পেছনে কাজ করে। হয়ত সাময়িক ভাবে আপনি ব্যাপারটি বুঝবেন না কারন মানুষের জ্ঞানের পরিধি সীমিত। মানুষ এক সাথে অনেক কিছু ভাবতে পারেনা। কিন্তু আল্লাহর জ্ঞান তাঁর স্বত্তার মতই নূরালোকে ভাস্বর। তাঁর জ্ঞান তাঁর স্বত্তার মতই অসীম।
একটু ভাল করে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো যে আল্লাহপাক এখানে সুদের সাথে 'অত্যাচারের' একটি সর্ম্পক করে দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় আমি যেখানে সুদের উপকার দেখতে পাই সেখানে অত্যাচার আসলো কোথা থেকে? কিভাবে তা অত্যাচার হয়? কেন সুদকে ইসলামে এত ঘৃণার বস্তু হিসাবে ভাবা হয়? চলুন দেখি এসব প্রশ্নের জবাব মিলে কিনা।
বাকি অংশঃ-----'সুদ' নামক বস্তুটির ভয়াবহ তান্ডবলীলা-২ এ দেখুন
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১১ সকাল ১১:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



