-----------'সুদ' নামক বস্তুটির ভয়াবহ তান্ডবলীলা-২ এর পরঃ
১০.২ বহুমাত্রিক ক্ষতির দ্বিতীয় স্তরঃ
‘সুদ’ নামক ঘৃণ্য বস্তুটির অস্তিত্ব বহু আগে থেকেই ছিল। কিন্তু তা ছিল বিক্ষিপ্ত ভাবে হয়তো কোন এক জনপদে অথবা একটি দেশের মধ্যে আবদ্ধ। পুরাতন জনপদগুলোর ইতিহাস আলোচনা করলে তা বেরিয়ে আসে। সুদূর অতীতের ‘মহাজনী কারবার’ আর নিকট অতীতের ‘কাবুলীওয়ালাদের’ অত্যাচারের কথা কারো-ই অজানা থাকার কথা নয়। মজার ব্যাপার হল এই সুদী ব্যবস্থা প্রাত্ষ্ঠিানিক রুপ লাভ করে পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায়ঃ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। এর অন্যতম প্রধান কারন হল, পূঁজিবাদী ব্যবস্থা যে স্বর্থপরতার ধারনা (পূর্বে-ই আলোচনা করা হয়েছে) লালন করে তা কেবল সুদী ব্যবস্থার সাথেই খাপ খায়। আর এর পরিনত ফলাফল হিসেবে পাওয়া যায় আরও বেশী স্বার্থপরতা, আরও বেশী সেচ্চাচারিতা!
চলুন দেখে নেয়া যাক, এই অর্থব্যবস্থায় অর্থের চাহিদা এবং যোগানের সমন্বয় কিভাবে হয়। অর্থনীতিবিদরা একে একটি Theory (তত্ত্ব; এই সব তত্ত্ব আবার জীবনের সাথে সাংঘর্ষিক) দিয়ে ব্যাখা করেন। তাঁদের মতে অর্থনীতিতে মোটামুটি ভাবে দু’টি পক্ষ থাকেঃ এক পক্ষের কাছে থাকে ‘অর্থ’ আর অন্য পক্ষের কাছে থাকে ‘তথ্য’, ‘প্রচষ্টা’ বা ‘উদ্যোগ। যাদের কাছে ‘অর্থ’ থাকে তারা ‘উদ্যোক্তাদের’ অর্থ সরবারহ করে আর উদ্যোক্তারা নিজেদের মত করে ব্যবসায় স্থাপন ও পরিচালনা করে। যেহেতু, উদ্যোক্তাদের পূঁজির সরবারহ প্রথম পক্ষ করে থাকে, তাই তাদেরকে সরবারহকৃত অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ (সুদ) প্রদান করতে হয়। যুক্তি হল, যেহেতু, ঐ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (যত দিনের জন্য উদ্যোক্তা অর্থ ধার করেছেন) অর্থ প্রদানকারী অর্থের ব্যবহার করতে পারেননি, তাই তিনি ঐ পরিমান অর্থ পাওয়ার অধিকার রাখেন যে পরিমান অর্থ তিনি এই উদ্যোক্তাকে যদি ধার না দিয়ে অন্য কোন কাজে বিনিয়োগ করে পেতেন। একে অর্থনীতিবিদরা আদর করে ‘Opportunity Cost’ বা ‘সুযোগ ব্যয়’ বলে ডাকেন। অর্থাৎ কোন কিছুই মানবিক দিক বিবেচনা করে হয় না। রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বার্থপরতা। প্রশ্ন করতে পারেন, “আরে ভাই যে ভাবে বলা হল তা তো যৌক্তিক। তাহলে সমস্যা কোথায়?” ভাই আপনাকে বলি, কাককে দেখতে অনেকটা কোকিলের মতই লাগে। তাই বলে কাক তো আর কোকিল হয়ে যায় না! সমস্যা অনেক ব্যাপক। সুদের এই প্রাতিষ্ঠানিক রুপের (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহ) কারনে বিশ্ব মানবতার যে মানবেতর জীবন রচিত হয়, তা জানতে আপনাকে তার পুরো চিত্র সম্পর্কে জানতে হবে। দেখা যাক তা জানা যায় কিনা!
প্রথমেই জেনে নেয়া যাক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহ কিভাবে এই স্বার্থপর ব্যবস্থার মূল নিয়ামক কাজ করে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের (চলতি আমানত, স্থায়ী আমানত, পেনসন স্কিম ইত্যাদি; বীমা কোম্পানীগুলোরও অনেক ধরনের প্রকল্প থাকে) মাধ্যমে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে। আমানতকারী থেকে যে হারে তারা ঋণ নেয়, তার চেয়ে বেশী হারে তারা যাদের বিনিয়োগের জন্য অর্থের প্রয়োজন, তাদের কাছে ধার দেয়। মাঝখানের পার্থক্যটাই তাদের লাভ (সুদ)।
ধরুন, ৪ জন ক্ষুদ্র আমানতকারীর প্রত্যেকের কাছে ১০০ টাকা করে মোট ৪০০ টাকা আছে যা তারা ব্যাংকে জমা করতে পারেন। ব্যাংক ১০০ টাকার বিপরীতে ৬% করে সুদ প্রদান করে তাদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা বিধিনিষেধের কারনে মনে করুন ৩০০ টাকার বেশী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে পারে না। ১০০ টাকার ঋণের বিপরীতে ব্যাংক ধরুন ১৫% করে সুদ উদ্যোক্তার নিকট হতে গ্রহন করে। তাহলে প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে ব্যাংকের সুদ লাভ হল ১৫% - ৬% = ৯%। আরেকটি চরম স্বার্থপরতার (আমি বলবো অমানবিকতা!) নজির দেখুন। ধরুন, ব্যাংক ঐ ৩০০ টাকা উদ্যোক্তাকে ধার দিল এতটুকু নিশ্চিত হয়ে যে সে সময়মত তার দেনা পরিশোধে সক্ষম। ব্যাংক কখনোই কিন্তু ধার পরিশোধে অক্ষম কিংবা ক্ষমতা কম এমন কাউকে টাকা ধার দেয় না।
অর্থাৎ, ব্যাংক থেকে ধার পাবার পূর্ব শর্তই হল আপনার আগে থেকে যথেষ্ট পরিমানে টাকা থাকতে হবে। এতে ধনী নতুন বিনিয়োগ করতে পারে, তার ধন আরও বাড়তে থাকে। গরিবদের সন্তুষ্ট থাকতে হয় অল্প কয়েকটা ‘চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে’- এর উপর সন্তুষ্ট থেকে। ফলাফল? ধনী দরিদ্রের আকাশ পাতাল ব্যবধান আর অতি দ্রুত সেই ব্যবধানের গতি (‘ত্বরণ’ সবচেয়ে উপযুক্ত শব্দ। কিন্তু অনেকেই এর অর্থ বুঝবেন না) বৃদ্ধি পাওয়া। আর পূঁজিবাদী এই অর্থব্যবস্থায় যেহেতু ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই হল এর কার্যক্রমের চালিকা শক্তি এবং ক্ষুদ্র আমানতকারীদের তিলে তিলে সঞ্চিত অর্থ অনেক বড় অংকে রুপ নেয় বিধায় সরকার কখনো চায় না যে কোন একটি ব্যাংক ব্যবসায় বন্ধ করে ফেলুক। কারন এতে করে বিশাল অংকের টাকা নিয়ে বাজারে তারল্যের সংকট দেখা দেয়; অর্থনীতিতে সংকট ঘনীভূত হয়। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়, জীবন আরও বিষিয়ে উঠে। আর তাই, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয় তার জন্য হস্তক্ষেপ করে যা আবার পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক মতাদর্শের বিরোধী। অর্থাৎ, স্ববিরোধী যত কাজ আছে, এ ব্যবস্থা তার একটিও বাদ দেয় না। এরাই নাকি আবার নিজেদের মতাদর্শ দেশে দেশে ফেরী করে বেড়ায় আর গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষের রক্তের লালে হোলি উৎসবে মাতে।
এখন, এই উদ্যোক্তা যে কিনা ৩০০ টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিল, ধরুন ঐ সময়ে তার ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে এবং সে ঋণের টাকা সময়মত পরিশোধ করতে পারেনি। ব্যাংক তার থেকে টাকা অর্জনের চেষ্টা করবে। ধরুন, ঐ ব্যক্তি দেউলিয়া হয়ে গেল। এতে ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দেবে। ব্যাংকের এই করুন দশা দেখে ঐ ৪ জন অসহায় ও সংক্ষুদ্ধ ক্ষুদ্র আমানতকারী নিজেদের টাকা তুলবার জন্য ব্যাংকের সামনে লাইন দেবে। কারন, তাদের টাকাই তো ব্যাংক ঐ উদ্যোক্তাকে ধার হিসেবে দিয়েছিল! কিন্তু, বিপত্তি এখানেইঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা সরকারের হস্তক্ষেপের কারনে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেয়া হবে না। ফেরত দিবে কিভাবে? ঐ টাকা তো উদ্যোক্তার মাধ্যমে জলে চলে গেছে! এত কথা বলার পেছনে মোদ্দা কথা হলঃ এই সুদী ব্যবস্থায় অতি সাধারন মানুষেরা নিজেদের সারা জীবনের তিলে তিলে জমা করা টাকা ব্যাংকে রাখেন, ব্যাংক যে ইতিমধ্যেই ধনী তাকে টাকা প্রদান করা হয়, সে আরও বিনিয়োগ করে আরও ধনী হয়; তার নিজের গাফিলতির কারনে দেউলিয়া হলে সাধারণ মানুষ আর টাকা ফেরত পায় না (এর চেয়ে বড় অমানিবিকতা আর কি হতে পারে?)। উদাহরন? বিশ্ব পন্ডিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বার ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সময়ের ‘Financial Crisis’ বা ‘অর্থনৈতিক সংকট’ যার মাধ্যমে হাজার অতি সাধারন মানুষ পথে বসে গেছেন। বেশী দেরী নাই যে আমাদের দেশেও এমন একটা পতন হবে না! শেয়ার বাজার সেই পতনকে আরও গতিশীল করে। শেয়ার বাজারের ভাওতাবাজি সম্পর্কে জানতে ‘শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ কেন হারাম’ লেখাটি পড়ে দেখতে পারেনঃ Click This Link
-বাকি অংশঃ 'সুদ' নামক বস্তুটির ভয়াবহ তান্ডবলীলা-৪ এ দেখুন
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১১ সকাল ১০:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



