-----------'সুদ' নামক বস্তুটির ভয়াবহ তান্ডবলীলা-৪ এর পরঃ
১০.৪ বহুমাত্রিক ক্ষতির চতুর্থ স্তরঃ
SSC পরীক্ষায় বাংলা ২য় পত্রে প্রায় যেন ফেল করে বসেছিলাম। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই বাংলা ২য় পত্রের একটি বাগধারাঃ শাখের করাত যার অর্থ পড়তাম 'উভয় সংকট' (যদি ভুল না করি) । বুঝতাম না কি জিনিস! এখন বুঝি। শাখের করাতের দুই দিকেই ধার থাকে। এটি দিয়ে দুই বার করে কাটা যায়। আর এখন নতুন এক ‘শাখের করাতের’ সন্ধান পেলামঃ পূঁজিবাদ।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সুদী-পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ‘দ্বৈত সমস্যার’ সৃষ্টি করে। বহুমাত্রিক ক্ষতির এই স্তরে এসে চলুন দেখা যাক আমাদের সরকার এবং তার নিয়ন্ত্রানাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিভাবে ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির’ চেষ্টা করে আর নিজেদের সকল জ্ঞানের সমারোহ করেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে মাথা ঠুকরে মরে। একটা কথা আমরা এখানে বার বার বলার চেষ্ট করছি আর তা হলঃ এই সুদী-পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মানবতার মুক্তির জন্য, তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য নেয়া কোন উদ্যোগই পরিপূর্ণ নয় এবং সময়ের স্রোতে তা বার বার ব্যর্থতার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হবে।
লক্ষ্য করুন, আমরা উপরে ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির’ কথা বলেছি। একটি দেশের সরকারকে আপামর জনসাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য সেই সব জনসাধারণের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে সদা তৎপর থাকতে হয়। আর এই কাজটিই সরকারের জন্য সবচেয়ে ‘চ্যালেঞ্জ’। ‘চ্যালেঞ্জ’ কথাটি এই কারনেই বল্লাম, কেননা; আমরা এতক্ষন পর্যন্ত যা দেখলাম তাতে এতটুকু দিবালোকের মত পরিস্কার যে এই নষ্ট অর্থব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব জীবনেও হবেনা। বরং এগুলো নিজেই এক একটি সমস্যা আর নতুন নতুন সমস্যার পরম মায়াবতী মাতা!! আর তাই সরকারকেও এতসব জঞ্জাল পরিস্কারের চেষ্টা করতে গিয়ে দারুন রকমে হিমশীম খেতে হয়। সেই কারনেই এই কাজগুলো সরকারের জন্য বড় ‘চ্যালেঞ্জ’।
চোখ ছানাবড়া করে লক্ষ্য করুন, আজ বলে দিলাম, আমৃত্যু মনে থাকবে আপনারঃ ‘গনতন্ত্র’ আর ‘ধনতন্ত্র’ দ্বারা আপনার কোন শান্তি আসবেনা।
আপনি শুধু বড় বড় নেতাদের বড় বড় কথাই শুনবেন। তাদের বড় বড় কথা শুনে আপানার মনে বড় বড় স্বপ্নই দানা বাঁধবে। বড় বড় সেই সব স্বপ্ন আপনাকে আবার সেই সব অদূরদর্শী বড় বড় নেতাকে ভোট দিতে উৎসাহিত করবে। বড় বড় নেতারা আপনার ভোটে বিজয়ী হয়ে আপনার বড় বড় সমস্যাগুলোর কোন সমাধানই করবেনা। কারন এই অর্থব্যবস্থায় তা সম্ভব নয়। তারা যা করবে তা হল-আপনার ভোটে বিজয়ী হয়ে তারা লোক দেখানো বড় বড় প্রকল্প হাতে নিবে। এই সব বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত বড় বড় স্বপ্নগুলো পূরণ হবে। তাদের বড় বড় কারখানা হবে, ছেলেমেয়েরা বিশ্বের নামিদামী বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়বে।
মনে রাখেন, ‘গনতন্ত্রে’র দোহাই দিয়ে প্রতিদিন এরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে আপনার স্বপ্ন। প্রতিদিন ‘ধনতন্ত্র’ বোপন করে দিচ্ছে ‘স্বার্থপরতা’ নামক ‘বিষফোড়া’ মানবতার কোমল আত্মায়। মনে রাখেন, যদি প্রতিবাদী না হন, যদি এখনও মানুষের মুক্তির জন্য বিচলিত না হন, যদি এখনো বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকেন, তবে ক্ষতি এই আপনারই। এই আপনিই প্রতিদিন বাজারে যাবেন, আর জিনিসপত্রের দাম শুনে মাথায় হাত দিবেন। রিক্সাওয়ালার সাথে দুই এক টাকা নিয়ে খেচখেচ করবেন। স্ত্রীর কোন প্রয়োজনের কথা শুনলে এই আপনারই মেজাজ আরেক দফা গরম হবে। ছেলেমেয়েকে মানুষ করা নিয়ে প্রতিনিয়ত সঙ্কিত হবেন। জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে ভুগবেন মানসিক যন্ত্রনায়। এই সবকিছু থেকে মুক্তির একমাত্র পথ নিয়েই আমাদের এই লেখা। একটু জানতে চেষ্টা করুন!!!
আমরা আগেই দেখেছি কিভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চিত হয়ে পূঁজিপতির হাতে চলে যায়। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের কাছ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে এই সঞ্চয়ন প্রক্রিয়াকে অর্থনীতির ভাষায় ‘পূঁজির আদিম সঞ্চয়ন’ বা ‘capital accumulation’ বলে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝা যাক। খেয়াল করুন, ব্যাংক মধ্যবর্তী একটি প্রতিষ্ঠান রুপে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের তাদের জমার বিপরীতে সুদ (ধরুন ৮%) দিয়ে সব অর্থ জমা করে আর তার চেয়েও বেশী সুদে (ধরুন ১৫%) পূঁজিপতির কাছে ঋণ সরবারহ করে। এতে দুই দিকের সুদের পার্থক্যই হচ্ছে ব্যাংকের লাভ (১৫%-৮%=৭%)। মজার ব্যাপারটি লক্ষ্য করুনঃ ব্যাংক বেশী ঋণ দিয়ে বেশী লাভ করতে হলে তাকে ঋণের উপর বেশী চার্জ করতে হবে। তখন ঋণের বিপরীতে সুদের হার ১৫% থেকে বেড়ে ২০% হয়ে যাবে। আবার বেশী ঋণ দিতে হলে তো ব্যাংকের কোষাগারে বেশী অর্থ জমা থাকতে হবে! তা আসবে কোথা থেকে? ক্ষুদ্র আমানতকারীদের কাছ থেকে। তাই না? তখন ক্ষুদ্র আমানতকারীরাও সেই ব্যাংকে অর্থ জমা করবে যে ব্যাংক তাদের জমার বিপরীতে বেশী সুদ দিবে। আর তাই ধরেন তা ৮% থেকে বেড়ে হয়ে যাবে ১০%। আগের তুলনায় এতে করে ব্যাংকের লাভ বেড়ে হবে ২০%-১০%=১০% যা পূর্বের তুলনায় ৩% বেশী।
পূঁজিপতির এই সুদের অর্থ পরিশোধ করে মূলত সাধারণ জনগন। কিভাবে? পূঁজিপতি ঋণকৃত অর্থ দিয়ে যে কারখানা দেয় কিংবা যে পণ্যদ্রব্য তৈরী করে, তার উপর সে ‘অতিরিক্ত’ সুদের অর্থ (১৫% হিসেবে যেই পরিমান সুদ আসে) যোগ করেই একক প্রতি পণ্যের দাম নির্ধারন করে এবং তা বাজারজাত করে। খেয়াল করুন, পূঁজিপতি আগে তার প্রদেয় ঋণের বিপরীতে ১৫% সুদ প্রদান করত। এখন ব্যাংক অতিরিক্ত ৩% লাভ করার জন্য ঋণের বিপরীতে সুদের হার বেড়ে হয় ২০%। অর্থ্যাৎ, সর্বসাধারণের উপর পূঁজিপতি আগে তার নিজের ১৫% সুদের যে ভার বর্তে দিত, তা বেড়ে হয়ে গেল ২০%। বাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম আরেক দফায় বাড়বে! ক্ষুদ্র আমানতকারীদের জন্য সুদের হার বাড়বে মাত্র ২%। সবচেয়ে খারাপ দিক হল ক্ষুদ্র আমানতকারীদের এই ২% বৃদ্ধি নিয়েই ‘মানসিক শান্তি’র মধ্যে থাকতে হয় যে তার জমার বিপরীতে মুনাফা (সুদ) বেড়েছে। কিন্তু সে বুঝতেই পারেনা যে এই ২% বৃদ্ধি মূলত ব্যাংকের জন্য ৩% বেশী মুনাফার (সুদের) ব্যবস্থা করেছে আর পণ্যদ্রবের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে তার নিজের জীবনে বয়ে এনেছে চরম অনিশ্চয়তার অশান্তি।
অন্যদিকে যদি আমরা একটু বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা করি তা সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু বিষয় চলে আসে। একটু লক্ষ্য করুন, পণ্যদ্রব্যের দাম যদি বৃদ্ধি পায় মানুষ বেঁচে থাকার জন্য আর ‘সঞ্চয়’ না করে ‘অর্জিত আয়’ দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ক্রয় করবে। এতে করে দেশের ‘মোট সঞ্চয়’ কমে যাবে। মোট সঞ্চয় কমার অর্থ হল ব্যাংকে ক্ষুদ্র আমানতকারী কর্তৃক জমা কমে যাওয়া। ফলাফল হিসেবে পূঁজিপতিও নতুন বিনিয়োগের জন্য অর্থ পাবেনা। আর এ কারনে দেশের ‘মোট বিনিয়োগ’ও কমে যাবে। মোট বিনিয়োগ কমে গেলে নতুন কর্মসংস্থান হবেনা। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। তাহলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে কি করতে হবে?? সুদের হার কমাতে হবে। সুদের হার কমালে পূঁজিপতি কম সুদে ঋণ নিয়ে বেশী বিনিয়োগ করতে পারবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সুদের হার কমালে আবার ক্ষুদ্র আমানতকারীরা ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ব্যাংকে কম পরিমানে অর্থ জমা হবে আবার পূঁজিপতি অর্থ সংকটে পড়বে। আবার বিনিয়োগ কম হবে। বেকারত্বের সৃষ্টি হবে। লক্ষ্য করুন, সর্বাবস্থায়ই পূঁজিপতি কর্তৃক নেয়া ঋণের বিপরীতে সুদের কারনে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। কোন সমাধান আছে কি??? এ এক গোলকধাঁধাঁ!!! আরও অনেক আছে। বেশী বলে আপনার মাথা নষ্ট করতে চাইনা। আপাতত যদি পারেন এই সমস্যারই সমাধান খুঁজে বের করুন।
-----বাকি অংশঃ 'সুদ' নামক বস্তুটির ভয়াবহ তান্ডবলীলা-৬ এ দেখুন