somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাষ্টমস্‌ নামা, পড়িলে পাশ, না পড়িলে সর্বনাশ! লেখক: নজরুল ইসলাম টিপু

১০ ই জুলাই, ২০১০ দুপুর ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[সোনার বাংলাদেশ] ওয়েব পোর্টাল থেকে নেওয়া


বিদেশে থাকিয়া যাহারা কাষ্টমস্ এর মাধ্যমে নির্বিঘ্নে মালামাল দেশে আনিতে চাহেন, তাহাদের জন্য এই কাষ্টমস্ নামা বহু উপকারে এবং যাহারা দেশে আছেন তাহাদের জন্য দরকারে আসিবে। তাঁহাকে আর কাহারো কাছে বিস্তারিত জানিবার জন্য ধর্ণা ধরিতে হইবে না। প্রবাসী হিসেবে আপনি যে দেশেই থাকুন, সেখানকার বাংলাদেশ বিমানের কার্গো এজেন্সীতে আপনার মালামাল হাজির করুন। এজেন্সী ম্যান আপনার সমুদয় মালামাল আলাদা আলাদা করিয়া ওজন করিবেন এবং প্রতিটি বাক্স নিখুঁত করিয়া, ফিতা দিয়া মাপিয়া লইবেন। তিনি বাক্সের ওজন ও আয়তন কত দেখিয়া লইবেন। আপনি আলবৎ বেকুবের মত তাকাইয়া দেখিবেন, এজেন্সী ম্যান কিছু বাক্স ওজন হিসেবে, কিছু বাক্স আয়তন হিসেবে চার্জ ধার্য্য করিলেন। মোটামুটি আপনার পকেট থেকে দুটি পয়সা যেভাবে বেশী খরছ হয়, সেভাবেই তিনি কাজটি সারিয়া লইবেন। তিনি প্রশ্ন করিবেন কি মালামাল পাঠাইতেছেন? আপনি বলিবেন একটি টিভি, একটি কম্পিউটার, একটি ওভেন একটি ওয়াশিং মেশিন। তিনি পরামর্শ দিয়া বলিবেন, গৃহস্থালীর ব্যবহৃহ সামগ্রী লিখিবেন, কেননা দামী মালামাল লিখিলে দেশে চুরি হইয়া যাইতে পারে। আপনি তাহাকে আপনার বড় শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করিয়া তাহাই কাগজে লিখিয়া দিবেন এবং প্রতিটি বাক্সের বিনিময়ে দুইটি করিয়া কাগজ বুঝিয়া লইবেন। আপনি নিশ্চিন্ত হইলেন, আপনার মালামাল ছহি ছালামতে দেশে পৌঁছিয়া যাইবে।

দেশের পথে যখন বিমানে থাকিবেন, দেশের কাছাকাছি পৌঁছিলে, আপনি শুনিতে পাইবেন, বিমানে বলা হইতেছে, “আপনার মালামাল নিজ নিজ দায়িত্বে রাখিবেন, যাহাদের লাগেজ সর্ম্পকে ঘোষণা করিতে হইবে, তাহারা বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট নির্দিষ্ট ‘এ’ ফরম পূরণ পূর্বক ঘোষণা দিবেন”। আপনার জটিল ইমিগ্রেশেন পর্ব শেষ হইবার, হাত ব্যাগ পাইবেন। আপনাকে ঘোষণা করিতে হইবে কি পরিমাণ মালামাল আপনার পাসপোর্টের বিপরীতে কার্গো বিমানে পাঠাইয়াছেন। যখন কোথায় ফরম পাওয়া যাইবে? কোথায় তাহা ঘোষণা করিতে হইবে? ইত্যাদি জানিতে চেষ্টা করিবেন; তখন আপনার প্রতি সদয় হইয়া কেহ বলিবেন, যেদিন বিমান বন্দরে কাজ-কর্ম কম থাকিবে, সেদিন আসিবেন। আপনাকে বুঝাইয়া বলা হইবে, এখন অনেক যাত্রী আসিতেছেন, অনেকে যাত্রী যাইতেছেন, তাই সবাই ব্যস্থ। কাল সকালে আসুন, কেননা সকালে কোন বিমান আসিবেনা, তাই তাড়াতাড়ি আপনার কাজ শেষ হইয়া যাইবে।

পরদিন আপনি বিমান বন্দরে পৌঁছিবেন, তখন দেখিবেন বিমান বন্দরে সুমসাম নিরবতা। কোন বিমান যাইবার নাই, কোন বিমান আসিবার নাই। আপনিও খুশিতে গদগদ হইয়া, কাজটিও সহসা হইবে মনে করিয়া, ‘এ’ ফরম তালাশ করিবেন, তবে কাহারো সাহায্য পাইবেন না। অবশেষে সিকিউরিটি পুলিশকে আপনার সমস্যা বলিলে তিনি আপনাকে, কাঙ্ক্ষিত অফিসে পৌঁছাইয়া দিবেন। ইংরেজী ইউ আকৃতির লম্বা করিডোর পার হইয়া, এস আকৃতির গলিতে ঢুকিয়া দীর্ঘক্ষণ হাঁটিবার পরে, সে অফিসে পৌঁছিতে পারিবেন। তথায় একজন কারণিক ভদ্রলোককে বসিয়া থাকিতে দেখিবেন। আপনার আগমনের হেতু তাঁহাকে বর্ণনা করিলে; কয়টি বাক্সে মালামাল আনিয়াছেন তাহা তিনি উৎসাহ সহকারে জানিতে চাহিবেন। আপনি তাহাকে চারটি বাক্সের কথা বলিলে, মনো-ভারাক্রান্ত হইয়া তিনি আপনাকে অন্য দিন আসিতে পরামর্শ দিবেন। আপনি তাহাকে আজই কাজটি করিয়া দেওয়ার অনুরোধ করিলে, তিনি জানাইবেন আজ সাহেবের মেজাজ খারাপ, ফলে আপনার কাজ হইবে না, তাই আগামীকাল আসিবেন। ফলে আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে হইবে, কিভাবে সাহেবের মেজাজ ঠান্ডা হইবে? এই প্রশ্নে তিনি খুশী হইবেন। তিনি উপদেশ দিবেন প্রতিটি বাক্স পিছনে ৫০০ টাকা, তার সাথে আরো ২০০ টাকা ওনার নিজের জন্য দিলে, তিনি সাহেবের মেজাজ ঠান্ডা করিতে চেষ্টা করিবেন। অগত্যা দরদার করিয়া সাহেবের ‘মেজাজ ঠান্ডা চার্জ’ ১২০০ টাকায় নির্ধারণ করিবেন।

অতঃপর তিনি আপনার হাতের কাগজ দেখিয়া জানিতে চাহিবেন, কি মালামাল আনিয়াছেন? আপনি সকল তথ্য জানাইবার পর কহিবেন, সকল কিছুর বৈধ কাষ্টমস্‌ দিবেন, তবে চুরির ভয়ে, অন্যের পরামর্শে; কাগজে ব্যবহারিক মাল লিখেয়াছেন। তিনি আচানক আশ্চর্য্য হইয়া বলিবেন, আরে মিয়া করিলেন টা কি?! এখন আপনার বাক্সে গৃহস্থালীর মাল হিসেবে থালা-বাটি, বালিশ-কাপড়-ঢুকাইয়া; টিভি-কম্পিউটার সব তো গায়েব করিয়া ফালাইব। আপনি মামলা করিতে পারিবেন না, কেননা আপনি দাবী করিয়াছেন গৃহস্থালীর মাল আনিয়াছেন। এই কথা শুনিয়া আপনার মাথায় প্রথম আসমান ভাঙ্গিয়া পড়িবে। আপনি এসি রুমের ঠান্ডার মধ্যে বসিয়া শরীরের তাপমাত্রা মাপিয়া লইবেন, দেখিবেন তাহা ১০৫ ডিগ্রী পার হইয়া গিয়াছে। যাক, তিনি খুবই সহসা আপনার সম্মুখেই সব কাগজে সিল, সই করিয়া আপনাকে পরবর্তী করণীয় বলিয়া বিদায় করিবেন। আপনি চোখে চশমা লাগানোর পরে বুঝিবেন, ইনি সেই অফিসার, যাহার মাথার মেজাজ খারাপ ছিল! দরজা দিয়া বাহির হইবা মাত্রই আপনাকে সাহায্য করা সেই সিকিউরিটিকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিবেন। তিনি আপনাকে পথ দেখাইয়া এখানে নিয়ে আসার জন্য মোটা দাগে ভিক্ষা চাহিবেন। ইতিমধ্যে আপনি আসিবার রাস্তাটি ভুলিয়া গিয়াছেন কিংবা বন্ধ দেখিতে পাইবেন। আপনি সিকিউরিটিকে সম্মান জনক ভিক্ষা দিয়া দিলেই। তিনি আপনার পাশের দেওয়ালের তক্তাটি ধাক্ষা দিবেন, দেখিবেন সেটাই বাহির হইবার দরজা। আপনি বাহির হইয়া চিন্তা করিবেন এত কাছে ঢোকার পথ থাকিতে, কেন তখন লম্বা পথ ঘুরাইলেন! বাহিরে ভিক্ষুক, টেক্সিওয়ালা, সাহায্যকারী ব্যক্তিগণ ইতিমধ্যেই বিমান বন্দরে আসিবেন, তাহাদের সাথে মোলাকাত সারিয়া পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে, বিমানের কার্গো অফিস কোথায় তাহার সন্ধানে বাহির হইবেন।

বিমান বন্দর থেকে বিমান অফিস কমপক্ষে ১০ মাইল দুরে থাকিতে হয়। তাই আপনাকে বিমানের কার্গো অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইতে হইবে। আপনি অনেক হন্ত-দন্ত হইয়া বিমানের কার্গো অফিসে পৌঁছিবেন। দেখিবেন অফিসে পিনপতন নীরবতা, এক চাপরাশীকে জি, এম মার্কা, ভাবখানা নিয়া ঘুরিতে দেখিবেন। আপনিই তাহাকে বলুন কিভাবে আপনার কাজটি সহজে সমাধা হইবে? তিনি কার্গোর বালাম দেখিবেন মাল দেশে আসিয়াছে কিনা, প্রতি বাক্সে ২৫০ টাকা করিয়া ‘বালাম চেক ফি’ দাবী করিবেন, আপনি তাহাকে ১০০০ টাকা হাতে গুঁজিয়া দিবেন। কাগজে আপনার টাকা পিন মারিয়া অফিসারের ডান পাশের নীচের ড্রয়ারে তিনি যত্ন করিয়া রাখিবেন। তিনি আরো বলিবেন অফিসার না আসা পর্যন্ত বসিয়া থাকিতে হইবে। প্রশ্ন করিবেন অফিসার কোথায়? তিনি বিরক্ত হইয়া বলিবেন; তিনি আপনাদের মতো মানুষ নাকি? তার অনেক কাজ, বসুন ১০ মিনিট পরেই আসিবেন। ২ ঘন্টা অতিবাহিত হইলেও অফিসারের ১০ মিনিট তখনও শেষ হইবে না। তাই আপনার আরো পীড়াপীড়িতে তিনি অফিসারকে খোঁজ করিবেন।

অফিসারের বাসায় ভাবীর কাছে ফোন করা হইবে, স্যার সেখানে নাই। কেন্টিনে ফোন করিবেন, খবর আসিবে তিনি সেখানেও নাই। রাস্তার পাশে মদিনা হোটেলেও কদাচিত যাইতেন, খবর আসিবে তাঁহার পদার্পন সেখানেও ঘটেনাই। অবশেষে পাশের রুমের বন্ধ দরজা ধাক্ষা দিলেই তাহা খুলিয়া যাইবে, সেখানে অফিসারকে আরেকজনের সাথে গল্পরত অবস্থায় দেখিতে পাইবেন। তিনি দেখিতে ২২ বছরের যুবকের ন্যায় হইবেন, কাঁধে বিমান বাহিনীর নাম না জানা বিভিন্ন ধাতব ফুল লটকিতে দেখিবেন। গম্ভীর চেহারায় থাকিবেন ও সাধারনের সাথে কোন কথা কহিবেন না। চেয়ারে বসিয়াই ড্রয়ার খুলিবেন ও প্রতিটি কাগজের সমপরিমান টাকা লাগানো আছে কিনা ক্যশিয়ারের মত গুনিয়া দেখিবেন। সবকিছু ঠিকঠাক মতো হইলে, তিনি সই করিবেন। জি, এম সাহেব পরবর্তী করণীয় জানাইয়া, চায়ের টাকা দাবী করিবেন, আপনার জন্য কষ্ট করিবার কারণে।

অতঃপর কোন কাষ্টমস অফিসে মাল আসিয়াছে, তাহা উদ্ধার করিতে নিজে আরো কিছু টাকা খরছ করুন এবং কিছুদিন শহরের রাস্তায় রাস্তায় ‘চলাচল ব্যায়াম’ করুন। অবশেষে আপনি জানিতে পারিবেন কাষ্টমস এর মেইন অফিসে মালামাল গিয়াছে। আপনার মালামাল সে অফিসের ষ্টোরে গিয়াছে কিনা তাহা জানিতে, বড়ুয়া বাবুর শরনাপন্ন হইতে হইবে। তিনি মালের ঢুকানো ও বাহির করার হিসাব, সামনে রক্ষিত বালামে লিপিবদ্ধ করেন। তিনি বলিবেন, বালামের পাতা খুলিলেই ৫০ টাকা দিতে হবে। বালামে মাল পাওয়া গেলে প্রতি কাগজের বিপরীতে ৫০ টাকা সম্মানী দিতে হইবে। রাজী থাকিলে বলা হইবে, এই ব্যক্তিকে নিয়ে ষ্টোরে যান, দেখেন আপনার মালামাল ছহি ছালামতে আছে কিনা, নাকি পরিবর্তন হইল! তথায় আপনার পাঠানো বাক্সগুলো বেহাল অবস্থায় দেখিবেন। আপনার মালের উপর চার জন কুলি বসিয়া গপ্প জুড়িয়াছেন এবং নিবিষ্ট মনে সিগারেট ফুঁকিতেছেন; দেখিয়া আপনার মাথায় দ্বিতীয় আসমান ভাঙ্গিয়া পড়িবে, কান্না আসিতে চাহিবে, খবরদার সেখানে কান্না করিয়া লজ্জা আনিবেন না। যাক, মনের দুঃখ বুকে নিয়া বড়ুয়া বাবুকে সম্মানী দেওয়া পূর্বক একটি সই ও সিল নিয়া বাহির হইবেন। তিনি ইনেসপেক্টর মতিনের সাথে দেখা করিতে বলিবেন। এই নিরাপদ জোনে ভয় নেই, কারন চারিদিকে সাদা পোশাকের পুলিশ গিজগিজ করছে।

মতিনের সন্ধানে ইনেসপেক্টরের অফিসে গেলে, কক্ষের প্রথম জনকে দেখিবেন তিনি টেবিলে রক্ষিত ক্যালেন্ডারে গভীরভাবে দৃষ্টি বুলাইতেছেন! অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে ১০ বার প্রশ্ন পূর্বক জানিতে পারিবেন তিনিই মতিন। সমস্যার কথা জানাইলে তিনি বলিবেন ইনসপেক্টর বাতেনের কাছে যান। বাতেন কোথায় জানতে চাইলে বিরক্ত হইয়া জানাইবেন খুঁজিয়া দেখেন। বহু খোঁজাখুঁজির পর জানিতে পারিবেন মতিনের পাশে বসা অফিসারই ‘বাতেন’। বাতেন সাহেবকে বহুদিনের পুরানো তেলাপোকার পায়খানায় ক্ষতিগ্রস্থ একখানা পঁচা কাগজ নাড়ানাড়িতে ব্যস্থ অবস্থায় পাইবেন। বহু চেষ্টায় তাঁহার দৃষ্টি লাভে সক্ষম হইলে পর জানিতে পারিবেন ইহা ইনসপেক্টর সমর বিশ্বাসের কাজ। বহু জায়গায় ঘুরিয়া ফিরিয়া তাঁহাকে বাতেনের সামনের টেবিলে আবিষ্কার করিবেন। অগত্যা তিনি তাহা নাসরিন বানুর কাজ বলিয়া সিদ্ধান্ত দিবেন। সেখানে চেয়ারে বসা একমাত্র মহিলাকে নাসরিন বানু মনে করিয়া, প্রশ্ন করিলে তিনি চটিয়া গিয়া আপনার বেআকলীর জন্য দুঃখ ও টিটকারী প্রকাশ করিবেন।

দুই ঘন্টা ব্যাপী আপনার এই চরম দুরাবস্থা দেখিতে পাইয়া প্রথমোক্ত ইনসপেক্টর মতিন আগাইয়া আসিবেন। তাঁহার চেহারায় আগের বিরক্তির পরিবর্তে সহযোগীতার নুরানী আলো ভাসিতে দেখিবেন। তিনি প্রশ্ন করিবেন কি কি মাল আনিয়াছেন? আপনি বিস্তারিত বলিবার পর। তিনি একটি কাগজে চোখ বুলাইয়া বলিবেন ২২ হাজার টাকা সরকারী ঘরে যাইবে, আমাকে ৬ হাজার দিলে, আপনাকে মেহেরবানী করিতে পারি। আপনি টাকার পরিমানু শুনিয়া, আমতা আমতা করিলে তিনি বলিবেন তাহলে নাসরিন বানুর নিকট যান। আপনি নাসরিন বানুর ভেটকীর কথা মনে করিয়া পূনরায় সেখানে যাইতে চাহিবেন না। তথাপিও নাসরিন বানুকে আপনার প্রতি সদয় হইলেন বলিয়া মনে করিবেন। তিনি গায়ে পড়িয়া মতিনকে বলিবেন যাক, বেচারা অনেক কষ্ট করিয়াছে সরকারী টাকার ২৫% নিয়েই কাজটি সমাধা করিয়া দিন। আপনি নাছোড় বান্দার মতো লাগিয়া থাকিবেন, তাহা হইলে ১৫% মেহনতি খরছে অর্থাৎ ৩৩০০ টাকায় তাহাদের রাজি করাইতে পারিবেন। অবশেষে আপনিও হাঁফ ছাড়িতে পারিবেন। এখান টাকার মার নাই কারন, সেখানে সাদা পোশাকের পুলিশ-গোয়েন্দা সর্বত্র গিজগিজ করিতেছে।

দেখিবেন কুলিরা সহসা আপনার মালামাল টানিয়া, ঠেলিয়া, হেঁছড়াইয়া, ছেঁড়াইয়া, হালকা আছাড় মারিয়া ইনসপেক্টর মতিনের সামনে হাজির করিবেন। আপনাকে আবারো বলিতে হইবে, কোন বাক্সে কি আছে, তাছাড়া বাক্সগুলো ফুটোই দেখিতে পাইবেন। কেউ লম্বা পেরেক ঢুকাইয়া ইতিমধ্যেই বুঝিতে চাহিয়াছেন কি আছে সেখানে! ইনসপেক্টর আপনাকে দুঃখ করিয়া বলিবেন এখানে গোয়েন্দারা ঘুরঘুর করিতেছে, আপনার সব বাক্স খুলিবনা একটিমাত্র বাক্সই খুলিব। অন্যগুলোর বন্ধনগুলো কাটিয়া দিব; যাহাতে বেকুপ গোয়েন্দা বুঝিতে পারে ইনসপেক্টর সকল বাক্স তল্লাশী করিয়াছেন। ইনসপেক্টর আপনার বাক্সে কি কি পাইয়াছেন তাহার ফিরিস্তি লিখিবেন। ১টি ২০” টিভি, ১টি গ্যাস ওভেন, ১টি ওয়াশিং মেশিন, ১টি মনিটর, ১টি পি,সি, ১টি মাউস, ১টি মাউস প্যাড, ১টি প্লাষ্টিক কভার, ২টি স্পীকার, ৪টি কানেকশন তার, ৪০ হাত লম্বা আধা ইঞ্চি পুরু ১টি রসি, ৪টুকরা শোলা, ৪টি স্পঞ্জ, ৩টি পলিথীন ব্যাগ, ২টি বই, ১টি গামছা, ১টি তসবিহ, ১টি টুপি ১টি.......। অতঃপর ইনসপেক্টর মন্তব্য লিখিবেন, “টিভি, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন ও কম্পিউটার বাবদ ২২ হাজার টাকা কাস্টমস হার ধার্য্য হইল। বাকী জিনিসগুলো ব্যবহার্য হওয়ায়, বাহকের অনুরোধে, সিনিয়র কাষ্টমস্ কর্মকর্তার অনুমোদন ক্রমে, বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে, প্রবাসী বিবেচনায় মাফ করা যায়”।

আপনি সততার সহিত ইনসপেক্টরকে তাঁহার মেহনতি শুল্ক বাবদ ১৫% টাকা বুঝাইয়া দিবেন, মনে করিলেন ঝামেলা বুঝি শেষ হইল! তিনি বলিবেন আরো ৩টি সই লাগিবে, প্রতি সইয়ে ২০০ শত করিয়া টাকা বের করুন। আপনি বিশিষ্ট উদার ব্যক্তি হিসেবে ৬০০ শত টাকা টেবিলে রাখিবেন। ভয় নাই টাকাটা মার যাবেনা কেননা, সাদা পোশাকের পুলিশ সর্বত্র গিজগিজ করছে। কিছুক্ষন পর আপনাকে সই করা কাগজ ফেরত দেওয়া হইবে, আপনি কাষ্টমস অফিসে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের নগদ গ্রহণ কাউন্টারে কাস্টমস ফি বাবদ ২২ হাজার টাকা লইয়া দাঁড়াইবেন। কাউন্টারে নগদ গ্রহনকারী ক্যাশিয়ার আপনার টাকা কোনক্রমেই লইবেন না বরং আপনাকে সরিয়া দাঁড়াইতে অনুরোধ করিবেন, যাহাতে পিছনে যাহারা দাঁড়াইয়া আছে, তাহাদের টাকা প্রদান করিতে সুবিধা হয়। আপনার অনুরোধ, গোস্বা, উত্তেজনা যখন কোন কাজেই আসিবেনা, তখন পাশের ব্যক্তিকে প্রশ্ন করিবেন, কি ব্যাপার ভাই? তিনি আদবের সহিত বলিবেন, আপনি মনে হয় এ লাইনে নতুন? আপনি নতুন বলিয়া স্বীকার করিবেন এবং তাহার সহযোগীতা চাইবেন, প্লিজ আমাকে এই পুল সিরাত পার হইতে সহযোগীতা করুন এবং আরো কত ঘাট বাকী আছে বলুন?

সাহায্যকারী বলিবেন ২২ হাজার টাকার ১% মানে ২২০০ টাকা কাগজের নিচে রেখে ক্লিপ মারুন, কাগজ উপরে ধরুন নীচের টকাটা প্রদর্শন করুন। অমনি ছোঁ মারিয়া আপনার টাকাটা নগদ গ্রহণ করিয়া তিনি আপনাকে উপকৃত করিবেন। অতঃপর ব্যাংকের নগদ গ্রহনের চারটি রশিদে ‘এমবোশ’ করিতে হইবে। এমবোস হইল কাগজের উপরে লোহার হাতুড়ী মেরে, সেটাকে ছিন্নভিন্ন করা। প্রতিটি আঘাতের জন্য ২০ টাকা করিয়া অবশ্যই হাতুড়ী চার্জ দিয়া দিবেন। তারপর আপনাকে কাগজ লইয়া কর বিভাগে যাইতে হইবে, প্রতি কাগজে মেহনতি ফি তারা নিতে ভূল করিবেন না। তারপর আপনাকে রাজস্ব বিভাগে যাইতে হইবে, যথারিতী মেহনতী ফি দিয়ে দিলেই আপনার অফিসীয়াল কাজ শেষ হইল বলিয়া ধরিতে পারিবেন। টাকা পয়সা খোলা মেলা লেন-দেন করিতে ভয় পাইবেন না, কেননা সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা নিরাপত্তা রক্ষায় চারিদিকে গিজ গিজ করছে।

আপনার মালামাল এখন বাহির করিতে পারিবেন, আপনি আপনার ভাড়া করা কুলিকে মাল টানিবার জন্য নিতে চাহিলে, সেখানে অবস্থিত কুলিরা আপনার মালের উপর লাটির মৃদু আঘাত করিয়া প্রতিবাদ করিবে। আপনি অক্ষত মাল উদ্ধারের আশায় কুলিদের প্রশ্ন করিবেন, কত টাকা চাই? তাহারা বলিবে ২ হাজার টাকা। শুনিয়া আপনার মাথায় তৃতীয় আসমান ভাঙ্গিয়া পড়িবে। আপনার চোখ দুটো পকেটে ভরে ফেলুন তারপর প্রতিবাদ করুন। বলুন, দরজার বাহিরে আমার গাড়ি, দশ হাত জায়গা পার করিতে ২ হাজার টাকা? আপনি বলিবেন ৫ শত টাকা দেওয়া হইবে। ডিজিটাল যুগে আপনার মত বেআকল ব্যক্তি দেখিতে পাইয়া, কুলিরা অট্টহাসিতে ফাটিয়া পড়িবে। তাহারা অশিক্ষিত ভাষায়, তীর্যক দৃষ্টিতে কটুক্তি করিয়া বলিবে, হায়বে কৃপন বিদেশী! ৫ শত টাকা আমাদের ২ দিনের চা খরচও হইবেনা। আমাদের ১১ কুলিকে ১১ শত, দুই কুলি সর্দারকে ৪০০ টাকা সর্বমোট ১৫ শত টাকা দিন, নতুবা মালের বাক্সে মাল থাকিবেনা বরং মালের টুকরা যাইবে বলিয়া আপনার মালের বাক্সে হাতুরির আঘাত দিবেন।

কুলিদের টাকা প্রদানপূর্বক আপনি ঝামেলা শেষ হইয়াছে ভাবিয়া যেই রওয়ানা হইয়াছেন, সিকিউরিটি আসিয়া বাধা প্রদান করিবেন। বলিবেন সমুদয় মালামাল খুলিয়া দেখা হইবে, কাগজের সাথে বাক্সের মালের মিল আছে কিনা তাহা যাচাই বাচাই করা হইবে। অতএব, মাথায় নতুন করিয়া চতুর্থ আসমান ভাঙ্গিয়া পড়িবে। কুলি সর্দারের সহযোগীতায় সিকিউরিটিকে সম্মান করিলে, আপনার মালামাল খোলা থেকে নিস্তার পাইবেন। তবে সিকিউরিটিকে সম্মান স্যালুট দিয়ে করা যাবেনা তা করতে হবে, কচকচে টাকার চকচকে নোট দিয়ে। আপনার ভয় নাই সর্বদা সাদা পুলিশের লোকেরা গিজগিজ করছে সেখানে।

আপনি আপনার মালামাল গাড়িতে তুলার পর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিবেন; এই মুছিবত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। আপনি মনে মনে ওয়াদা করিবেন আর কোনদিন এই অফিসের দারস্থ হইবেন না, প্রয়োজনে গরীব থাকিবেন। মোনাজাতের হাত কপালে ঘষে ড্রাইভারকে বলিবেন চল এবার যাই। দেখিবেন কি আশ্চর্য্য! মেইন গেটের দারোয়ান গেট বন্ধ করে, আরেক দিকে তাকিয়ে আছেন। হর্ণের আওয়াজ যেন তার কানেই যাচ্ছেনা! অথছ গাড়ী ঢুকার সময় হরহর করিয়া ঢুকিয়াছিলেন। দারোয়ান বলিবেন গেইট ক্লিয়ারেন্স আনুন, আপনি বলিবেন সেটাতো আমাকে দেয় নাই। দারোয়ানের সোজাসাপ্টা উত্তর পাইবেন, তাহলে মালামাল রেখে যান, কালকে আসুন। কারন ইতিমধ্যেই সকল কর্মকর্তার ছুটির ঘন্টা বাজিয়া গিয়াছে, কাউকে আর তাহাদের চেয়ারে পাইবেন না। এই কথা শুনিয়া আপনার মাথায় চতুর্থ আসমান ভাঙ্গিয়া পড়িবে। আপনি পদে পদে দেখিতে পাইবেন অফিসার যত ছোট মুসিবত তত বড়। ভাগ্যভাল আপনি কুলি সর্দারকে আবারো পাইয়া যাইবেন, তাঁহার সহযোগীতায় যথারিতী দারোয়ানকে স্যালুট করে এ যাত্রায় নিস্তার পাইবেন। গেট থেকে বের হবেন? মাশায়াল্লাহ পেয়ে যাবেন এক দল ভিক্ষুক। তাহাদের আচরণে আপনি ভয় পাইয়া ভাবিবেন এরা ভিক্ষকু নাকি ভিমরুল? তাই পকেট খালি করিয়া দ্রুত সেখান থেকে ইজ্জত নিয়া পালাইবেন।

গাড়ীতে প্রশান্তির হেলান দিয়া ভাবিতে থাকুন, বৈধ জিনিস লইয়া বিগত ১ সপ্তাহে যে ধকল গেল। অবৈধ সম্পদ লইয়া কেয়ামতের কাষ্টমস কিভাবে পারি দিবেন? হিসাব করুন নিজের কর্মের, নিজের কর্তব্য এবং দায়িত্বের। শরীর ক্লান্ত লাগিবে, তদ্রামগ্ন হইবেন! আচানক গাড়ীতে জোড়ে ব্রেক পড়িবে। হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্নতা হারিয়ে দেখিবেন, সামনে পুলিশ দাঁড়াইয়া আছেন। তাহাদের ধারনা হইবে সমুদয় জিসিষ চুরির মাল, রসিদ কই? আপনার টিভির লাইসেন্স কই? আপনি বলিবেন রশীদ নাই, কাষ্টমস পেপার আছে, তাছাড়া এগুলো বিদেশ হইতে আসিয়াছে। পুলিশ জানাইবে আমরা বিদেশী জিনিষই খুঁজিতেছি, যেটা চুরি হইয়াছে এবং সেটা আপনাদের গাড়ীতেই আছে! আর কাষ্টমস পেপার যে কেউ বানাইতে পারে। আপনাদেরকে গাড়ীসহ থানায় যাইতে হইবে, কারন আপনাদের মালামাল ‘সিজ’ করা হইয়াছে। এই কথা শুনিয়া অবশিষ্ট আসমান একযোগে আপনার মাথায় ধ্বসিয়া পড়িবে..। ভয় নাই দেশের সর্বত্র নিরাপত্তা রহিয়াছে!

পুনশ: ২০০২ সালে আমার কম্পিউটারের সাথে দুই বন্ধুর পরিবারের জন্য তাদের জিনিসগুলো এনেছিলাম। শুধু জানা, দেখা ও অবলোকন করার জন্য এই দায়িত্ব নিয়েছিলাম। ঘুষ দিতে হবে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকার পরও এই বেহাল অবস্থা। শুনেছি বর্তমানে অনেক নিয়ম কানুন বদলিয়েছে, তারপরও হয়রানী বন্ধ হয়নি, কারণ নিয়ম বদলাইলেও মানুষতো আর বদলায়নি!

লেখকঃ আমীরাত প্রবাসী
Click This Link
১০টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×