মৃত্যু এক অমোঘ সত্য। জীবন মানেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। প্রকৃতির এ নিয়মের বাঁধনে জীবন চক্র আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। চাইলেও কোন উপায় নেই এ নিয়ম ভাঙ্গার বা এড়িয়ে যাবার। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণে বহু রকম চেতনা, বিশ্বাস । প্রত্যেকেই তার বিশ্বাসে অটল অবিচল! কখনো কবর, তো কখনো দাহ, কখনো বিচিত্র অদ্ভুত সব উপায়ে সৎকার করে থাকে। যার পিছনের মূল কারণ সেই পরকাল। পরকালের কল্যান শুভ কামনা, মঙ্গল বা মুক্তির আশ্বাস।
আমরা্ও প্রত্যেকেই যার যার বিশ্বাস অনুসারে তেমনি বিশ্বাস দৃঢ়তর অনুভবে তা লালন করি অন্তরে। তা অতি স্বাভাবিকও বটে। জ্ঞাতে, অজ্ঞাতে, চেতনে-অবচেতনে মৃত্যু বা মৃত্যু ভাবনা ক্ষনিকের জন্যে হলেও আমাদের তাড়িত করে। কখনো আপনজনের মৃত্যু দেখে বা ঘটনা অবহিত হয়ে- অজানিতেই মন কেমন হয়ে যায়! কি আছে ওপারে?
কেমন সেই জীবন? আদৌ কি কোন জীবন আছে?
নাকি সবই ভ্রম! নানান ভাবনারা জ্ঞানানুপাতে ভীর করে।
এ প্রশ্ন শুধু আজকের নয়। সৃষ্টির পর থেকেই বোধ করি সবচে প্রাসংগিক এই ভাবনাই মানুষকে বেশি ভাবিয়েছে। তাই দেখা যায়
মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। এবং বিশ্বজুড়ে প্রচুর মতবাদ, বিশ্বাস চর্চিত হচ্ছে যুগে যুগে।
১ম পর্বে -মৃত্যু পরবর্তী জীবন -১ বিভিন্ন অধিবিদ্যা অনুযায়ী বিভিন্ন ভাবনার সারসংক্ষেপ আলোচিত হয়েছিল। এ পর্বে থাকছে প্রাচীন ধর্মমত সমূহে এ বিষয়টিকে কোন দৃষ্টিতে অনুভব করা হয়েছে। প্রকাশ করা হয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এ পর্বে
প্রাচীন ধর্মে পরকাল ভাবনা :
প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম
প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে পরকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, আর এই বিশ্বাস ব্যবস্থাটি পরকাল সম্পর্কিত লিখিত ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। মৃত্যুর পর আত্মার কা (দ্বিতীয় শরীর) এবং বা (ব্যক্তিত্ব) মৃতদের রাজ্যে চলে যায়। সেখানে আত্মা ফিল্ড অব অরু নামক একটি স্থানে অবস্থান করে। মৃতদের বিকল্প হিসেবে সমাধির উপর একটি মূর্তি তৈরি করার রীতি ছিল প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে।
মৃত্যুর পর পরকালে পুরষ্কৃত হবার জন্য একটি পাপমুক্ত হৃদয় এবং বুক অব দ্য ডেড এর মন্ত্র, পাসওয়ার্ড ও সূত্রের উচ্চারণ করার সামর্থের প্রয়োজন হয়। মৃতদের হৃদয়কে শু পালক এর বপরীতে দাড়িপাল্লায় ওজন করা হয়। যদি হৃদয় এই পালকের চেয়ে হালকা হয় তাহলে সে ফিল্ড অব অরুতে যেতে পারে। যদি ভারি হয় তাহলে তাকে আম্মিত নামক দৈত্যের খাদ্যে পরিণত হতে হয়।
রামেসিস ৩ এর মমি ছিল এখানে। পাহাড়ে প্রায় দেড়শ মিটার গভীরে। দেয়ালে নানা কারুকাজ।
ছবি কৃতজ্ঞতা: ব্লগার আখেনাটেন
মিশরীয়গণ এও বিশ্বাস করতেন যে যদি মৃতের শরীরকে সারকোফেগাসে (বিভিন্ন জটিল চিহ্ন, ছবি ও হায়ারোগ্লিফিক লেখা সম্বলিত প্রাচীন মিশরীয়দের কফিন) রাখা হয়, সঠিকভাবে পচনরোধক মৃতের শরীরে মাখানো হয় এবং মন্দীরে সমাধিস্ত করা হয় তাহলেই তাদের পরোলোক প্রাপ্তি ঘটবে এবং সূর্যের সাথে ফিল্ড অব অরুতে প্রতিদিনের ভ্রমণে যোগ দিতে পারবেন। পরকালের বিভিন্ন বিপদের সম্ভাবনার জন্য সমাধিতে খাদ্য, অলংকারের সাথে "বুক অব দ্য ডেড"ও দিয়ে দেয়া হত। সমাধী ক্ষেত্রে গুলো হতো তেমনি বিশ্বাসের সাথে মিল রেখে দারুন রাজকীয় ঐশ্বর্যে ভরপুর ।
এভাবেই সিঁড়ি বেয়ে গভীরে নেমে যেতে হত। একেবারে শেষ মাথায় পাথরের ভিতরে সারকোফেগাসে মমিগুলো থাকত।
ছবি কৃতজ্ঞতা: ব্লগার আখেনাটেন
প্রাচীন মিশরীয়দের সভ্যতা ধর্মের উপর ভিত্ত করে গড়ে উঠেছিল। মৃত্যুর পর পরকালের বিশ্বাস ছিল তাদের মৃতের অন্তেষ্টিক্রিয়া পালনের প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের কাছে মৃত্যু ছিল কেবল মাত্র একটি অস্থায়ী বাঁধা, পূর্ণাঙ্গ সমাপ্তি নয়। আর চিরকাল ব্যাপী জীবন কেবল দেবদেবীদের করুণা লাভ, মমিকরণের মাধ্যমে দেহের সংরক্ষণ এবং মূর্তি তৈরি ও অন্তেষ্টিক্রিয়ার আচার যথাযথভাবে পালনের উপর নির্ভর করে। তাদের বিশ্বাস অনুসারে প্রত্যেক মানুষ কা, বা, এবং আখ এর সমন্ব্যে গঠিন। নাম এবং ছায়াও জীবিত সত্তা। পরকালকে উপভোগ করতে হলে তাই এই সবগুলো অংশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমান ধর্ম
গ্রিক পুরাণ অনুসারে আন্ডারওয়ার্ল্ডের রাজা হলেন গ্রীক দেবতা হেডিস। আন্ডারওয়ার্ল্ড হল একটি স্থান যেখানে মৃতরা মৃত্যুর পর অবস্থান করে। দেবতাদের বার্তাবাহক, গ্রীক দেব হার্মিস মৃতদের আত্মাকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিয়ে যান (কখনও হেডিসকে ডেকেও নিয়ে আসেন)। হার্মিস আত্মাকে স্টিক্স নদীর তীরে রেখে আসেন। গ্রীক পুরাণ মতে স্টিক্স নদী হল জীবন ও মৃত্যুর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী।
এরপর যদি আত্মার কাছে সোনা থাকে (সমাধিস্থ করার সময় মৃতের পরিবার মৃতের জিভের নিচে একটি মুদ্রা রেখে দেয়) মাঝি ক্যারন এই আত্মাদেরকে নদী পাড় করে হেডিসের কাছে নিয়ে আসে। এরপর আত্মাকে একাস, রাডামেন্থাস এবং রাজা মিনোস বিচার করেন। সেই বিচারের উপর ভিত্তি করে আত্মাকে এলিসিয়াম, টারটারাস, এসফোডেল ক্ষেত্র ও ফিল্ড অব পানিশমেন্টে পাঠানো হয়। এলিসিয়াম হল তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে পরিত্র জীবন যাপন করেছিলেন। এখানে সবুজ মাঠ, উপত্যকা এবং পর্বতমালা রয়েছে। সকলে এখানে সুখে শান্তিতে থাকে এবং সূর্য সবসময় এখানে কীরণ দেয়। টারটারাস হল সেইসব লোকের জন্য যারা দেবতাদের নিন্দা করেন, বিদ্রোহ করেন ও জেনে বুঝে খারাপ কাজ করেন।
এসফোডেল ক্ষেত্র হল তাদের জন্য যারা সমানভাবে ভাল কাজ ও পাপ কাজ করেছেন বা জীবনে যারা অমীমাংসিত ছিলেন এবং যাদের বিচার করা হয় নি। ফিল্ড অব পানিশমেন্ট বা শাস্তির ক্ষেত্র তাদের জন্য যারা প্রায়ই পাপ করেন কিন্তু টারটারাস আশা করেন না। টারটারাসে আত্মাকে লাভায় পুড়িয়ে অথাবা র্যাকে টেনে কষ্ট দেয়া হয়। গ্রীক কিংবদন্তীর কিছু বীরকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে ভ্রমণ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। পরকাল বিষয়ে রোমানদের বিশ্বাসও একইরকম। তাদের পুরাণে হেডিস প্লুটো নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রীক পুরাণের লেবরস অব হেরাক্লেস অনুসারে, বীর হারকিউলিস তাকে দেয়া কাজ তিন মাথাওয়ালা কুকুর সারবেরাসকে বন্দী করতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে গিয়েছিলেন। ড্রিম অব সিপিও তে সিসারো শরীরের বাইরে বের হবার পর আত্মার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন যেখানে সেই আত্মা পৃথিবী থেকে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে দূর থেকে ক্ষুদ্র পৃথিবীকে দেখে।
ভারজিলের এনিয়াড এ বীর এনিয়াস তার পিতাকে দেখতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে ভ্রমণ করেছিলেন। সেখানে গিয়ে স্টিক্স নদীর তীরে তিনি অনেক আত্মাকে দেখতে পান যাদেরকে সঠিকভাবে সমাধিস্থ করা হয় নি। তাদেরকে যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ ঠিকভাবে সমাধিস্থ করছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে এখানে অপেক্ষা করে কাটাতে হবে। তারপর তাকে একটি প্রাসাদ দেখানো হয় যেখানে ভুলভাবে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিরা বাস করেন, তাকে ফিল্ড অব সরো দেখানো হয় যেখানে আত্মহত্যা করা ব্যক্তিগণ অনুশোচনা করেন যেখানে এনিয়াসের প্রাক্তন প্রেমিকাও ছিল। তাকে টারটারাস দেখানো হয় যেখানে টাইটান এবং অলিম্পিয়ানদের শক্তিশালী অমর শত্রুরা বসবাস করে। টারটারাসে তিনি বন্দীদের চিৎকার ও গোঙ্গানি শুনতে পান। তিনি বিস্মৃতির নদি লেথকে দেখেন যা পান করে একজন মৃৎ পূর্বের সব ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে যায়। তিনি ফিল্ড অব এলিসিয়ামে যান যেখানে সাহসী বীরগণ বাস করেন। তার পিতা তাকে রোমের সকল ভবিষ্যৎ বীরদেরকে দেখান। এনিয়াস যদি তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী নগর প্রতিষ্ঠা করে তাহলে এই বীরগণ জন্ম লাভ করবে।
আব্রাহামিক ধর্ম
ইহুদি ধর্ম
হিব্রু বাইবেলে শেওলকে মৃতদের স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বুক অব স্যামুয়েলের প্রথমটি ২৯:৩-১৯ (এলিয়াহু কোরেন বাইবেল): "এখন স্যামুয়েল মৃত... এরপর সাউল তার দাসদের বললেন, "আমাকে একজন মহিলাকে খুঁজে এনে দাও যিনি একজন মাধ্যম... এবং তিনি বললেন... স্যামুয়েলকে নিয়ে আসো আমার কাছে... এবং সাউল জানতেন যে এটাই স্যামুয়েল... এবং স্যামুয়েল সাউলকে বললেন, আমাকে এখানে আবার ফিরিয়ে এনে তুমি কেন আমাকে অশান্তিতে ফেললে? সাউল উত্তর দিল, আমি প্রচণ্ড মর্মপীড়ায় আছি... ঈশ্বর তোমার থেকে প্রস্থান করেছেন এবং তোমার শত্রু হয়েছেন বলে তুমি আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করো?... কাল তুমি এবং তোমার পুত্ররা আমার সাথে থাকবে।"
একলেসিয়াসতেস: "যা মানবপুত্রদের সাথে ঘটে তা পশুদের সাথেও ঘটে; তাদের সকলের বেলায় একই ব্যাপার ঘটে: এদের একটি যেমন মারা যায়, অন্যটিও মারা যায়, তাদের সকলের একই শ্বাস-প্রশ্বাস; মানুষের পশুদের থেকে বেশি কোন সুবিধা নেই, সবই অসার, সবাই একটি জায়গাতেই যাবে: সকলের উৎপত্তি ধুলা থেকে, এবং সকলে ধুলায় ফিরে যাবে। কে বলতে পারে যে মানুষের আত্মা উপরের দিকে যাবে আর পশুর আত্মা মাটির নিচে যাবে?" (একলেসিয়াসতেস ৩:১৯-২১ )
"কিন্তু যিনি জীবিতদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন তার আশা আছে, একট জীবিত কুকুর একটি মৃত সিংহের থেকে ভাল। জীবিতরা জানেন যে তিনি একদিন মারা যাবেন; কিন্তু মৃতরা কিছুই জানেন না, আর তাদের কাছে আর কোন পুরস্কার নেই। তাদের কোন স্মৃতি নেই। ভালবাসা, ঘৃণা, হিংসা সব বিনষ্ট হয়ে যাবে; সূর্যের নিচে তারা যা যা করেছেন তারা তা আর কিছুই করতে পারবেন না।" (একলেসিয়াসতেস ৯:4-6 )
বুক অব জবে বলা হয়েছে: "কিন্তু মানুষ মারা যায় এবং শায়িত হয়; যদি সে শ্বাস-প্রশ্বাস না নেয় তাহলে সে কোথায়?... সুতরাং মানুষ শায়িত হয় এবং আর কখনও ওঠে না। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বর্গ থাকবে না তারা জাগবেও না, ঘুম থেকেও উঠবে না... যদি একজন মানুষ মারা যায়, সে কি আবার জীবিত হবে?" (জব ১৪:১০,১২,১৪)
তালমুদে পরকাল সংক্রান্ত কিছু কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। তালমুদীয় কর্তৃপক্ষগণ স্বীকার করেন যে মৃত্যুর পর ধার্মিকগণ একটি পরকাল ভোগ করবেন। মৃত্যুর পর আত্মাকে বিচারের কাঠগড়ায় আনা হবে। যারা পাপমুক্ত জীবন যাপন করেছেন তারা তৎক্ষণাৎ ওলাম হাবা বা ওয়ার্ল্ড টু কাম এ প্রবেশ করবেন। বেশিরভাগই এই ওলাম হাবায় প্রবেশ করতে পারেন না, বরং তারা তাদের পার্থিব জীবন পর্যালোচনা করার জন্য একটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যান। এই সময় তারা পৃথিবীতে কী কী ভুল কাজ করেছেন সে সম্পর্কে অবগত হন। কারও মতে এই সময়টা হল "পুনঃশিক্ষন" যেখানে আত্মা তার ভুলের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে জ্ঞান লাভ করে। অন্যদের মতে এই সময়ে পূর্বের ভুলগুলোর জন্য এক ধরণের আধ্যাত্মিক অস্বস্তি কাজ করে। এই সময়কালের শেষে, যা এক বছরের বেশি নয়, আত্মা ওলাম হাবায় প্রবেশ করে। যদিও কিছু ইহুদি ধারণায় মৃত্যুর পর পূর্বের ভুলের কারণে পাওয়া অস্বস্তির কথার উল্লেখ আছে, কিন্তু অন্যান্য ধর্মগুলোর মধ্যে উপস্থিত চিরস্থায়ী নরকভোগের মত বিষয় ইহুদিদের পরকালের মতবাদে নেই। তালমুদ অনুসারে আত্মার বিলুপ্তির বিষয়টি খুওই বিদ্বেষ্পরায়ণ এবং অসৎ দলনেতাদের জন্য বরাদ্দ। এদের কুকর্ম হয় নিয়মের ঊর্ধ্বে চলে গেছে, না হয় মানুষের একটি বড় অংশকে তারা প্রচণ্ড অশুভ কাজের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
মাইমোনিডিস ওলাম হাবাকে আধ্যাত্মিক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে পরকাল প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই হয়, এটা হল আত্মার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া যেই দেহে এটি তার পার্থিব অস্তিত্বের সময় অবস্থান করেছিল। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ জোহর অনুসারে গেহেনা (ইহুদিদের নরক) পাপাত্মাদের শাস্তির জায়গা নয়, বরং এটা তাদের আত্মার শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার একটি স্থান।
ইহুদিধর্মে জন্মান্তরবাদ
যদিও ইহুদের তালমুদ বা এর পূর্বের ধর্মগ্রন্থগুলোতে জন্মান্তরবাদের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না, আব্রাহাম আরিয়েহ ট্রাগম্যানের মত র্যাবাইদের মতে জন্মান্তরবাদকে ইহুদি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরা হয়। ট্রাগম্যান ব্যাখ্যা করেন এটা মৌখিক ঐতিহ্য হিসেবে এসেছে। ইহুদি রহস্যবাদের প্রাচীন গ্রন্থ জোহারে বারবার পুনর্জনের কথা বলা হয়েছে। ট্রাগম্যান বলেন বিগত পাঁচটি শতকে ইহুদিদের মাঝে পুনর্জন্মের কথা প্রকাশ করা হয়। এর পূর্বে পূনর্জন্মের ব্যাপারটি লুক্কায়িত ছিল। শ্রাগা সিমোনস বলেন, বাইবেলেও ডিউটোরমি ২৫:৫-১০, ডিউটোরমি ৩৩:৬ এবং ইসাইয়াহ ২২:১৪,৬৫:৬ এ পুনর্জন্মের ধারণা দেয়া আছে।
ইরমিয়াহু আলম্যন লিখেছেন, পুনর্জন্ম ইহুদিধর্মে একটি প্রাচীন ও মূলধারার বিশ্বাস। জোহারে পুনর্জন্মের ব্যাপারে বারবার এবং বড় আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সময়ে ইহুদিধর্মে ধর্মান্তরিত, ধার্মিক ও নির্ভরযোগ্য ভাষ্যকার অনকেলস ডিউটোরনমি ৩৩:৬ স্তবকটি ("রিউবেনকে মরতে দিও না, বাঁচতে দাও...") ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে যে, রিওবেনকে সরাসরিভাবে পৃথিবীতে বাঁচতে দেয়া উচিৎ, এবং পুনর্জন্মের ফল হিসেবে তাকে পুনরায় মরে যেতে দেয়া উচিৎ নয়। তোরাহ পণ্ডিত, ভাষ্যকার এবং কাব্বালিস্ট ন্যাকম্যানিডিজ (রাম্বান ১১৯৫-১২৭০) জবের কষ্টভোগকে পুনর্জন্ম বলে মত দিয়েছিলেন। কারণ জবের কথায়, "ঈশ্বর একজন মানুষের সাথে এসব দুইবার বা তিনবার করে করেন যাতে তার আত্মা অন্ধকূপ থেকে ... জীবনের আলোয় ফিরে আসে" (জব ৩৩:২৯,৩০)।
গিলগুল নামে পরিচিত পুনর্জন্মের ধারণায় ইহুদি লোক-বিশ্বাসে জনপ্রিয়, এবং আশকেনাজি ইহুদিদের ইদ্দিশ সাহিত্যেও এটা পাওয়া যায়। কিছু কাব্বালিস্টদের মতে, এটা বলা হয়েছে যে কিছু মানব আত্মা অ-মানব শরীরে জন্ম লাভ করবে। এই ধারণা ১৩শ শতক থেকে কাব্বালিস্টদের গ্রন্থে পাওয়া যায়। ১৬শ শতকের শেষের দিক থেকে অনেক রহস্যবাদীদের মাঝেও এই ধারণা পাওয়া যায়। মারটিন বুবারের বাল শেম তভ এর জীবনের গল্পের প্রথম সংগ্রহগুলোতে দেখা যায় মানুষ পরপর ক্রমানুযায়ী পুনর্জন্ম হয়।
অনেক সুপরিচিত র্যাবাই (সাধারণত নন-কাব্বালিস্ট বা এন্টি-কাব্বালিস্ট) যারা জন্মান্তরবাদের ধারণাকে পরিত্যাগ করেছেন তাদের মধ্যে আছেন সাদিয়া গাওন, ডেভিড কিমহি, হাসদাই ক্রেসকাস, ইয়েদেয়াহ বেডেরশি (১৪শ শতকের প্রথম দিকের), জোসেফ আলবো, আব্রাহাম ইবনে দাউদ, রশ এবং লিও ডে মোডেনা। সাদিয়া গাওন তার এমুনথ ভে ডেওথ (হিব্রু: বিশ্বাস এবং মতামত) গ্রন্থের সেকশন ৬ এ মেটেমসাইকোসিস (পুনর্জন্ম) এর নীতিকে খণ্ডন করেছেন। তিনি আরও বলেন, "যেসকল ইহুদিগণ পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন তারা অ-ইহুদীয় বিশ্বাস ধারণ করেন।" অবশ্যই সকল ইহুদি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না, কিন্তু ইহুদিদের মধ্যে পুনর্জন্মে বিশ্বাস অপ্রচলিত নয়, এমনকি অর্থোডক্স ইহুদিদের মধ্যেও পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদ অপ্রচলিত নয়।
সুপরিচিত জন্মান্তরবাদী র্যাবাইদের মধ্যে আছেন ইয়োনোসান গেরশম, আব্রাহাম আইসাক কুক, তালমুদ পণ্ডিত এডিন স্টাইনসাল্টজ, ডভবার পিনসন, ডেভিড এম. ওয়েক্সেলম্যান, জালমান শাখতার এবং আরও অনেকে। রামবান (ন্যাকম্যানিডিজ), মেনাকেম রেকান্তি এবং রাবেনুউ বাখিয়ার মত নির্ভরযোগ্য বাইবেল ভাষ্যকারও জন্মান্তরবাদের কথা বলেছেন।
ইয়েৎশাক লুরিয়ার অনেকগুলো সংখ্যায় (যার বেশিরভাগই ইয়েৎশাকের শিষ্য চেইম ভিটালের দ্বারা লিখিত) জন্মান্তরবাদ সংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। তার শার হাগিলগুলিম (পুনর্জন্মের দ্বার) নামক গ্রন্থে ইহুদিধর্মে জন্মান্তরবাদের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।
রোর জিউইশ লার্নিং ইনস্টিটিউটের র্যাবাই নাফতালি সিলবেরবার্গ বলেন, "অন্য ধর্ম ও বিশ্বাসব্যাবস্থা থেকে উৎপন্ন যেসব ধারণাগুলো জনপ্রিয় হয়েছে, সাদাসিধে ইহুদিরা সেগুলোকেই মেনে নিয়েছে।"
চলবে - - -
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা: উইকি সমূহ, অন্তর্জাল
ছবি কৃতজ্ঞতা: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:১৯