পবিত্র শবে মেরাজ রজনীতে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে দর্শন দিয়েছিলেন। দর্শন করিয়েছিলেন সৃষ্টির গুপ্ত রহস্য সমূহ। এই পবিত্র রজনীতে অনেকেই যারা বিস্তারিত অবহিত নন, তাদের জন্য সংকলিত পোষ্ট শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই জ্ঞান সমুদ্রে অবগাহনের সুয়োগ দিন।
প্রথম পর্বের লিংক
প্রর্তাবর্তন ও পুনঃগমন
অনেক রাজ ও নেয়াজের কথার পর আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ৫০ ওয়াক্ত নামাজ দিনে রাতে ফরজ করলেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিদায় দিলেন। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ষষ্ঠ আকাশে এলেন তখন মুসা আলাইহিস সালাম এর সাথে দেখা হল।… হযরত মুসা আলাইহিস সালাম আরজ করলেন — কত ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হল আপনার উম্মতের উপর?
হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন — পঞ্চাশ ওয়াক্ত।
হযরত মুসা আলাইহিস সলাম বললেন — আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আপনার উম্মত তা আদায় করতে পারবে না। কেননা আমার উম্মতের উপর আরও কম হওয়া সত্ত্বেও তারা তা আদায় করতে পারে নি। সুতরাং আপনি আপনার রবের কাছে আবার ফিরে যান এবং কম করানোর প্রার্থনা করুন।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন — অতঃপর আমি ফিরে গেলাম। আল্লাহ তাআলা এবার পাঁচ ওয়াক্ত কমালেন। আমি ষষ্ঠ আকাশে ফিরে এলাম। আবারও মুসা আলাইহিস সালাম আমার রবের কাছে ফিরে যেতে আরজ করলেন।
এভাবে নয় বার ষষ্ঠ আকাশ থেকে খোদার দরবারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাওয়া আসা করলেন। আল্লাহ তাআলা প্রতিবার পাঁচ ওয়াক্ত কমাতে থাকলেন এবং পয়তাল্লিশ ওয়াক্ত কমিয়ে কেবল পাঁচ ওয়াক্ত বহাল রাখলেন।
এবারও হযরত মুসা আলাইহিস সালাম পুনরায় খেদার দরবারে ফিরে যাওয়ার আরজ পেশ করলেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন — আমি পাঁচ ওয়াক্তেই রাজী হলাম। পুনরায় ফিরে যেতে লজ্জা লাগে।
আল্লাহ সাথে সাথে ওহী নাজিল করলেন —
আল্লাহর কালামের বা তাঁর চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের আর কোন পরিবর্তন করা হবে না।
তবে আল্লাহ তাআলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনার উম্মত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে আমার এখানে পঞ্চাশ ওয়াক্তই লেখা হবে। সুতরাং আপনার উম্মতকে পাঁচ ওয়াক্ত দেয়া যেমন ঠিক, তেমনি আমার পঞ্চাশ ওয়াক্তের নির্দেশও ঠিক। পার্থক্য শুধু সংখ্যার — গুণের নহে।
পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার হেকমত রুহুল বয়ান, ইতকান, বেদায়া ওয়া নেহায়া, প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফজর নামাজ হযরত আদম আলাইহিস সালাম আদায় করেছেন।
জোহর নামাজ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আদায় করেছেন।
আসর নামাজ হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম আদায় করেছেন।
মাগরিবের নামাজ হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আদায় করেছেন।
এশার নামাজ হযরত মুসা আলাইহিস সালাম আদায় করেছেন।
আল্লাহ তাআলা পছন্দ করে পাঁচজন পয়গম্বরের নামাজ একত্র করে উম্মতে মুহাম্মদীকে দান করেছেন। সুতরাং নামাজের ইবাদতটি নবীদের স্মৃতিবাহীও বটে।… নামাজের মধ্যে রুকু, সেজদা, কিয়াম, তসবিহ ইত্যাদি ফেরেশতাদের ইবাদতের নমুনা যা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজে প্রত্যক্ষ করে এসেছেন।
প্রশ্ন জাগে মেরাজ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে শুধু হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর সাথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাক্ষাৎ এবং তাঁর অনুরোধে নবীজির বার বার খোদার দরবারে যাতায়াত কি খোদার ইচ্ছায় হয়েছিল এবং খোদার পরিকল্পনা মত হয়েছিল? নাকি দুই নবীর ইচ্ছায় হয়েছিল?
আরেকটি প্রশ্ন হল — নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দরবারে বার বার কোন বাহনে করে গিয়েছিলেন এবং দুনিয়াতে ফেরত এলেন কেমন করে? আরও একটি প্রশ্ন জাগে — হযরত মুসা আলাইহিস সালাম কি কেবল উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য সুপারিশ করেছিলেন নাকি অন্য উদ্দেশ্য নিহিত ছিল?
বিভিন্ন কিতাবে প্রশ্নগুলোর যেসব জবাব মেলে তা নিচে দেয়া হল —
প্রথম প্রশ্নের জবাব : আল্লাহতাআলার পরিকল্পনা মোতাবেক মুসা আলাইহিস সালাম ষষ্ঠ আকাশে অপেক্ষমান ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তাঁর প্রিয় হাবীব তাঁর দরবারে বার বার ফিরে যান এবং দশবার তাঁর সাথে হাবীবের দিদার নসিব হোক।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব : ষষ্ঠ আকাশ থেকে খোদার দরবারে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এবং ফিরে আসার ক্ষেত্রে রফরফ বা বোরাক ব্যবহারের উল্লেখ হাদিসের কিতাবে সরাসরি পাওয়া যায় না। তফসিরে রুহুল মাআনীতে বলা হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি যেভাবে মেরাজে গমন করেছেন সেভাবেই ফেরত এসেছেন। কিন্তু তফসিরে রুহুল বয়ান তফসিরে রুহুল মাআনীরও পূর্বে রচিত, কাজেই এর মতামত অধিক শক্তিশালী।
তফসিরে রুহুলবয়ানে সুরা নজম এর তিনটি আয়াত এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে -
“নিম্নগামী তারকার শপথ, তোমাদের সাথী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পথ ভোলেননি বা পথভ্রষ্টও হননি এবং টেরা বাঁকাও হননি।”
উক্ত আয়াত মেরাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকার কথা বলা হলেও ইমাম জাফর সাদিক রাদ্বিআল্লাহু আনহু বলেছেন :
“নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই বোঝানো হয়েছে। কেননা, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এক হাজার নামের মধ্যে আন-নাজম একটি নাম।”
আর هَوَى অর্থ নিম্নগামী। এই আয়াতের অর্থ তাহলে দাঁড়ায় আল্লাহর দরবার থেকে নিম্নগামী তারকা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শপথ। আর, “পথ ভোলেননি বা টেরা বাঁকা হননি” দ্বারা বোঝা যায় — যে পথে তিনি গিয়েছেন সেপথেই ফেরৎ এসেছেন। বোরাক বা রফরফ এর মাধ্যমে ফেরৎ এলে একথার প্রয়োজন হত না। কেননা তখন বোরাক বা রফরফই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত। সুতরাং মেরাজ থেকে আসার পথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কুদরতে একাই ফিরেছেন। কেননা তিনি নূর। নূর বা আলো সব ভেদ করে সোজা ধাবিত হয়।
তৃতীয় প্রশ্নের জবাব : হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর মত একজন নবী ইন্তিকালের আড়াই হাজার বছর পরও আমাদের উপকার করতে পারেন। যেমন করেছিলেন মুসা আলাইহিস সালাম উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য। এছাড়াও হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। তিনি তুর পর্বতে আল্লাহর দর্শন চেয়ে ব্যার্থ হয়েছিলেন। এমনকি আল্লাহর যে তাজাল্লী তুর পর্বতে আপতিত হয়েছিল তা তিনি বেহঁশ হবার কারণে দেখতে পারেননি। কিন্তু মেরাজের রাত্রিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর সান্নিধ্যে ফানা হয়ে যে তাজাল্লী নিয়ে এসেছেন সেই দৃশ্য দেখে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর মনে তুর পর্বতের সেই সাধ জেগে উঠল। তিনি বারবার আল্লাহর তাজাল্লী দেখার জন্যই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বারবার আল্লাহর দরবারে যেতে অনুরোধ করেছিলেন।
মিরাজ থেকে ফিরে এসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন বিছানা এখনও গরম রয়েছে। ভোরে তিনি কাবাগৃহে তশরিফ নিয়ে সকলের কাছে এ ঘটনা বললেন। আবু জাহেল প্রমুখ কুরায়শ দলপতিরা পরীক্ষার ছলে বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজা জানালা ইত্যাদির বিবরণ জানতে চাইল। তারা জানত যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও বাইতুল মুকাদ্দাস দেখেননি। আল্লাহ পাক সাথে সাথে জিবরাইলের মারফতে বাইতুল মোকাদ্দাসের পূর্ণ ছবি নবীজির চোখের সামনে তুলে ধরলেন যেন বর্ণনা দিতে হুজুরের তকলিফ না হয়। হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখে দেখে সব বলে দিলেন। তবু প্রশ্নকারীরা ক্ষান্ত হল না।
তারা প্রশ্ন করল — আপনি কি আমাদের বানিজ্য কাফেলা দেখেছেন?
হুজুর আকরাম বললেন — হ্যাঁ। তারা মক্কার অতি নিকটে পৌঁছেছে এবং বুধবার সূর্য ওঠার পূর্বেই তারা মক্কায় প্রবেশ করবে।
আবু জাহেল প্রমুখ ঐদিন ঘরের ছাদে উঠে কাফেলার আগমন পরীক্ষা করতে লাগল। এদিকে সূর্য ওঠে ওঠে অবস্থা। আবু জাহেল বলতে লাগল, এবার প্রমাণ হয়ে গেল যে নবীর ভ্রমণ মিথ্যা। কেননা তিনি বলেছেন বুধবার সূর্য ওঠার পূর্বে কাফেলা মক্কায় প্রবেশ করবে। অথচ আমরা আমাদের দৃষ্টি পথে কাফেলার কোন চিহ্নই দেখছি না। আল্লাহ তাআলা নবীর কথাকে ঠিক রাখার জন্য সেদিন রাত্রিকে আরও দীর্ঘ করে দিলেন এবং সূর্যের গতি থামিয়ে দিলেন। পরে দেখা গেল সূর্য ওঠার পূর্বেই কাফেলা মক্কায় পৌঁছে গেছে।
আবু জাহেল হযরত আবু বকরকে বাড়ি আসতে দেখে মিরাজের ঘটনা বলে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করল। হযরত আবু বকর রাদ্বিআল্লাহু আনহু বললেন, কে বলেছে? আবু জাহেল বলল, তুমি যার পেছনে ঘুরেছ এমন অসম্ভব কথা তিনি ছাড়া আর কে বলবে?
হযরত আবু বকর বললেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে থাকলে সত্যই বলেছেন।
একথা শুনে আবু জাহেল দমে গেল। আবু বকর রাদ্বিআল্লাহু আনহু নবীজির খেদমতে যেয়ে এর সত্যতা জানতে চাইলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন — তুমি কেমন করে অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে?
আবু বকর রাদ্বিআল্লাবু আনহু বললেন — এটা বিশ্বাস করা তো খুবই সহজ। এর চেয়ে কঠিন বিষয় অর্থাৎ আল্লাহ যে আছেন তা না দেখে বিশ্বাস করেছি, তখন তাঁর কাছে যাওয়া তো অতি সহজ ব্যাপার।
হযরত আবু বকর এর জবাব শুনে নবীজি খুবই প্রীত হলেন এবং তাঁকে সিদ্দিকে আকবর খেতাব দিলেন।
(সমাপ্ত)
সংকলন সূত্র:
গ্রন্থ সূত্র : নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ।
রচনা : অধ্যক্ষ হাফেজ আবদুল জলীল।
পোস্ট : আনিসুল আরওয়াহ- انیس الارواح-রুহের বন্ধু
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:৫১