আজ পহেলা মহররম।
আমি একজন বাঙালী। আমি একজন মুসলিম।
পহেলা বৈশাখ আমাকে যেভাবে আলোড়িত করে, একই ভাবে আলড়িত করে মহররম।
শোক, ত্যাগ আর মহান অনেক ঘটনার মাস মহররম। সবচে বেশি যাতনা ছড়ায় কারবালার মর্মন্তুদ ইতিহাস।
তাইতো কবি বলে উঠেন
মহররমের চাঁদ এলো ঐ
কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়
ইয়া হোসেনা ইয়া হোসেনা
তারই মাতম শোনা যায়!
সবাইকে আরবীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।এ নতুন বছর মুসলমানদের জন্য এবং বিশ্ববাসীর জন্য নিয়ে আসুক মুক্তির বারতা।
সকল অকল্যান দূর হোক। মঙ্গল, শান্তি আর কল্যানে ভরে উঠুক সকলের গৃহ।
জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার চর্চায় জাগ্রত হোক মুসলিম মানস।
মুহররম হলো ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্রতম মাসের মধ্যে এটি একটি। মুহররম শব্দটি আরবী যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মুহররম মাস পবিত্র হিসাবে গন্য। মহররমের ১০ তারিখ বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন দিন, যাকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
এই দিনটি নানা কারণে স্মরনীয় বলে গণ্য। বিশেষ করে মুহররম মাসের দশম দিন ইসলামে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন একটি দিন। প্রচলিত আছে যে, এই দিনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। যে কারণে মহহরম মাসটিও বিশেষায়িত হিসেবে গণ্য। ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
এই দিনে প্রথম মানব আদি পিতা আদম আ: কে সৃষ্টি করেন;
আদম-কে এদিনেই স্বর্গ বা জান্নাতে স্থান দেয়া হয়
এবং পরবর্তীতে এই দিনেই পৃথিবীতে পাঠিয়ে আল্লাহ তাকে প্রতিনিধি মনোনীত করেছেন।
নূহ-এর সময়কালে এই দিনে মহাপ্লাবন হয়।
ইব্রাহীম জন্ম নেন এই দিনে এবং মূসা ও তার সাথীরা ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার পানও এই দিনে।
মূসার সমসাময়িক ফেরাউন ও তার সৈন্যদেরকে আল্লাহ এই দিনে নীল নদের পানিতে ডুবিয়ে মারেন।
ইউনুছ মাছের পেট থেকে মুক্তি পান এই দিনে।
আইয়ূব রোগ মুক্তি পান এই দিনে।
ঈসা (খ্রিস্টধর্মমতে যিশু) এই দিনে জন্ম নেন এবং পরবর্তিতে তাকে সশরীরে ঊর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নেয়া হয় এই দিনে।
নবী মুহাম্মদ-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন এই দিন কারবালার ময়দানে ইয়েজিদের সৈন্যদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন।
মহররম নিয়ে সাহিত্যের মাঝে অমর সৃষ্টি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মহররম কবিতা।
এ যেন শুধু কবিতা নয়। পুরো কারবালার বাস্তব চিত্রায়ন। পাঠে প্রতিটা ছত্রে ছত্রে যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে
কারবালার সেই যাতনাভরা মুহুর্তগুলো।
আজ মহররমের নতুন দিনে আসুন পাঠ করি সেই অমর কাব্য।
মহররম
-কবি কাজী নজরুল ইসলাম
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া –
আম্মা লাল তেরী খুন কিয়া খুনিয়া,
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?
সে কাদনে আসু আনে সিমারের ও ছোরাতে।
রূদ্ধ মাতাম ওঠে দুনিয়া দামেস্কে –
জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?
হায় হায় হোসেনা ওঠে রোল ঝন্ঝায়,
তলোয়ার কেপে ওঠে এজিদের পান্জায়
উন্মদ দুল দুল ছুটে ফেরে মদিনায়
আলী জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়।
মা ফাতিমা আসমানে কাদি খুলি কেশপাশ
বেটাদের লাশ নিয়ে বধুদের শ্বতবাস
রণে যায় কাশিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা
মেহেদির রং টুকু মুছে গেল সহসা –
হায় হায় কাদে বায় পূরবী ও দক্ষিনা
কন্কন পৌচী খুলে ফেল সকিনা
কাঁদে কেরে কোলে করে কাশেমের কাটা শীর
খান খান খুন হয়ে ক্ষরে বুক ফাটা নীর
কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্য ও রুদ্ধ
বিশ্বের ব্যাথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র
গড়া গড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা
আম্মাগো পানি দেও ফেটে গেল ছাতিমা
নিয়ে তৃষ্ষা সাহারার দুনিয়ার হাহাকার
কারবালা প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার
দুই হাত কাটা তবু শের নর আব্বাস
পানি আনে মুখে হাকে “দুশমন ও সাব্বাস” ।
দ্রিম দ্রিম বাজে ঘন দুন্দভী দামামা
হাকে বীর “শীর দেগা নেহী দেগা আমামা”
কলিজা কাবাব সম ভূনে মরু রোদ্দুর
খাঁ খাঁ করে কারবালা নাই পানি খজ্জুর
মার স্তনে দুধ নাই বাচ্চারা তড়পায়
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়টায়
দাও দাও জ্বলে শিরে কারবালা ভাষ্কর
কাঁদে বানু পানি দেও মরে যাদু আসগর
পেলনাতো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন
ডাকে মাতা পানি দেব ফিরে আয় বাছা শোন –
পুত্র হীনা আর বিধবার কাঁদনে
ছিড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাধনে
তাম্বুতে সজ্জায় কাদে একা জয়নাল
দাদা তেরী ঘর কিয়া বরবদ পয়মল
হায়দারী হাক হাকে দুল দুল আসওয়ার
শমশের চমকায় দুশমুনে ত্রাসবার
খসে পড়ে হাত হতে শত্রুর তরবার
ভাষে চোখে কেয়ামতে আল্রার দরবার।
নিঃশ্বেষ দুশমুন ওকে রণশ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আখি প্রান্ত।
কোথা বাবা আসগর শোকে বুক ঝাঝরা
পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাজরা
ধুকে মলো আহা তবু পানি এক কাতরা
দেয়নিরে বাছাদের মুখে কম জাতরা
অন্জলী হতে পানি পড়ে গেল ঝর ঝর
লূটে ভূমে মহাবাহু খন্জর জর্জর।
হলকুমে হানে তেগ ওকে বসে ছাতিতে
আফতাব ছেয়ে গেল নীল আধীয়ার রাতিতে
আসমান ভরে গেল গোধুলীতে দুপুরে
লাল নীল খুন ঝরে ফুরাতের উপরে
বেটাদের লহুরাঙ্গা পীরহান হাতে আহা
আশরের পায়া ধরে কাদে মাতা ফাতেমা
এয় খোদা বদলাতে বেটাদের রক্তের
মার্জনা কর গোনা পাপী কম বখতের
কত মহরম এল গেল, চলে গেল বহু কাল
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লহুলাল
মুসলিম তোরা আজ জয়নাল আবেদীন
ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা কেদে তাই যাবে দিন
ফিরে এল আজ সেই মহরম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।
উষ্ষীষ কোরআনের হাতে তেগ আরবীর
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শীর।
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা
শমশের হাতে নাও বাধ বুকে আমামা
বেজেছে নাকাড়া হাকে নাকিবের তুর্য
হুশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সুর্য্য
জাগো ওঠো মুসলিম হাকো হায়দারী হাক
শহীদের দিলে সব লালে লাল হয়ে যাক।
নওশার সাজ নাও খুন খচা অস্তিন
ময়দানে লুটাতেরে লাশ এই খাস দিন
হাসানের মত পিব পিয়ালা সে জহরের
হোসেনের মত নিব বুকে ছুরি কহরের
আসগর সম দেব বাচ্চাদের কুরবান
জালিমের দাদ নেব দেব আজ গোর জান
সখিনার শ্বেত বাস দেব মাতা কন্যায়
কাশিমের মত দেব জান রূধি অন্যায়
মহরম কারবালা কাদো হায় হোসেনা
দেখ মরূ সুর্য্য এ খুন যেন শোষেনা ।।
ছবি ঋণ: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২২