অঞ্জন দত্তের একটা গান শুনতেসিলাম, বাসে আসতে আসতে। গানটাতে বারবার ঘুরেফিরে কলকাতা আর ঢাকার প্রতিতুলনা। ঢাকার বেইলি রোডের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে কলকাতার বউবাজারকে কত সাবলীলভাবে তিনি বলতেছেন, ‘আমার বউবাজার’। আমি এইভাবে বলতে পারব মনে হয় এখন। ‘আমার পলাশী, আমার টিএসসি, আমার শাহবাগ...।’ হয়তো শিকাগোর শনের সঙ্গে টেবিলটেনিস খেলতে খেলতে তারে বলে বসব, তোমার ডাউনটাউন আর আমার ফার্মগেট। এমনভাবে বলা, যেন আমি পুরা ফার্মগেটের মালিক! অথচ ফার্মগেট দিয়া যতবার আমি হাঁটসি বারবার মনে হইসে জায়গাটার মালিক বিবিধ ব্যবসায়ীবৃন্দ। টিএসসিরেও আপন ভাবার মতো সাহসী হইতে পারি নাই। পলাশিকেও উঠান উঠান লাগে নাই তেমন। মনে হইসে, এইসব অন্য মানুষদের জায়গা। নিজেকে কোথায় দাঁড়া করানো যায় সেটা ভাইবা বিব্রত হইসি। এই ইতস্তত ভাব থিকা অতি আত্মবিশ্বাস উৎসারিত হইসে মাঝে সাঝে। কারে আমি ‘আমার’ বলব? রংপুরের কাচারিবাজাররে? চেনাজানা মানুষ, প্রিয় সব মানুষ আড্ডা দেয় সেখানে। তাদের সঙ্গে আমারও ঘণ্টা ঘণ্টা মুখর সময় কাটসে। কিন্তু তারপরও, কেমনে বলি ‘আমার কাচারিবাজার’? কাচারিবাজার আসলে বিশ-পঁচিশজন ফটোকপির দোকানদারদের, উকিলদের, শক্ত পেশীর রিকশাঅলাদের, একজন ট্রাফিক পুলিশের। আমি যখন প্রতি বছর এক-দুইবার গিয়া তাদের সঙ্গে মিশে যাবার চেষ্টা চালাতাম, তারা আসলে আমারে নিল কি নিল না--এই সন্দেহ আমার যাইত না। ক্যামনে বলি--‘আমার কাচারিবাজার’? অথচ এখন আমি অবলীলায় নিজেরে পুরা দেশটারই মালিকের জায়গায় বসায়া দেই--‘আমার দেশ’। মাই কান্ট্রি। আমার ল্যাবে দুইজন ইন্ডিয়ান আছে। তাদের একজন আবার বাঙালিও। তবে সে উড়িষ্যার দিকে বড় হইসে। বাংলা বলতে পারলেও লিখতে জানে না। এরা আমারে বলে, ওই যে একটা বোলার আছে না তোমাদের, খুব রাগী আর খুব তেজ? দাদারে বোল্ড কইরা দিসিল? আমি বলি, হ, মাশরাফি। তো চেনে না। বলে, না, কী জানি নামটা। আমি বুঝি, সে খেলা খুব একটা দেখে না। বিশ্বকাপের ম্যাচটাই খালি দেখসে। বলি, মাশরাফি বিন মুর্তজা। সে লাফায়--ইয়া ইয়া মুর্তাজা...কী তেজ রে বাবা! আমি বুঝি, এদের কাছে আমি মাশরাফির খালাতো ভাই-ই! বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ককে কোনোদিন এত নিজের লোক-নিজের লোক লাগে নাই!
শিকাগোতে এখন তুমুল স্নো পড়তেসে। রাস্তা-ফুটপাত-গাড়ি সব সাদায় সাদা। এত সাদা যে মনে হয় এই রঙটা এইভাবে আগে চেনা হয় নাই। এর আগে কোথায় দেখসিলাম এই রঙটা? প্রজেক্টরের মধ্যে খটখট খটখট করে ছবি পাল্টায়। দাদাবাড়ির কথা মনে আসে। হলুদ পোয়ালের পুন্জ। আমাদের ওখানে ‘পুন্জ’ই বলে। শব্দটা ‘পুঞ্জ’ থেকে অপভ্রংশ হইসে। তো হলুদ পোয়ালের পুন্জের পাশে মফিজলের ছোটভাই আজিজল গাইয়ের দুধ দোয়াইত। একটা অ্যালুমিনিয়ামের ছোট্ট বালতিতে সাদা সাদা ফ্যানা আর ফটফট শব্দ করতে থাকা গরম দুধ। একটু দূরে বান্ধা থাকত বাছুর। শোষকশ্রেণীর বঞ্ছনার কৌশল তার কিছুই শেখা হয় নাই তখনো। তো সেই সাদা দুধ দেখসিলাম, আর দেখলাম এই সাদা স্নো। সাদা এত সাদা হইতে পারে! আর কী তার চেষ্টা! সবকিছুর রঙ সে একরঙা কইরা দিতে চায়! মাইনাস টেম্পারেচারে কালো আর বাদামি মানুষদের ঠাণ্ডা লাগে বেশি। কালো আর বাদামি মানুষদের পিঠে-ঘাড়ে সাদা সাদা তুষার জমতে থাকে। কালো আর বাদামি মানুষদের কাছে এই প্রথম এই রঙটার অন্য মানে দাঁড়ায়া যায়...
শিকাগো
১৪ ডিসেম্বর, ২০০৯
(আরো লেখার ইচ্ছা আছে। এই লেখায় ক্রিয়াপদের বিকৃতি আলাপের সুবিধার জন্য ইচ্ছাকৃত।)