ঢাকার একটি স্কুলের একজন শিক্ষক তার এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন। আজকের পত্রিকায় দেখলাম এই যৌন নিপীড়ক তার কৃতকর্মের দায়স্বীকার করেছে। এই ঘটনা নিয়ে গত কয়েকদিন ব্লগ এবং ফেসবুকে অনেক মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখলাম। এক ধরনের প্রতিক্রিয়ায় এই ধর্ষকের ধর্ম-পরিচয় নিয়ে টানাটানি করা হয়েছে। এই ধর্ষক শিক্ষকের ধর্ম-পরিচয়টাকে বড় করে দেখছেন এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। বলা হচ্ছে, সরকারের শক্তিশালী মানুষদের সঙ্গে এই শিক্ষকের খাতির আছে। তার পৈতৃক নিবাস প্রধানমন্ত্রীর জেলায়। এটা তাকে অনেক সুবিধা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, শক্তিধর মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে খাতির-অলা, গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা কোনো মুসলমান শিক্ষক যদি এই একই অপরাধ করতো, তখন প্রতিক্রিয়াটা কেমন হতো? আমার ধারণা, প্রতিক্রিয়া তখনও হতো। সেটা ধর্ষণের ভয়াবহতার কারণেই হতো। মানববন্ধন, ক্লাস-বর্জনও হতো। এখন যারা 'হিন্দু' ধর্ষককে গালি দিচ্ছেন, তারা একজন 'ধর্ষক'কে গালি দিতেন। ধর্ষণ ধর্ষণই। এবং ধর্ষক ধর্ষকই। ধর্ষণকে ঘৃণা করার জন্য ধর্ষকের জাতিভেদ জানা লাগে না। কিন্তু তারপরও পরিমলের হিন্দুত্ব সামনে আসছে কেন? আমার মনে হয়, হিন্দুত্ব নিয়ে যারা টানাহ্যঁাচড়া করছেন, তারা একটা সুযোগ পেয়েছেন। '**উন' শব্দটাকে যায়েজ করার মতো এত ভালো সুযোগ তারা আর কীভাবে পাবেন?
এবং আমরা এ-ও দেখলাম, অপরাধেরও জাতপাত থাকে। সবল দর্ুবলকে অপরাধী হিসাবে আবিষ্কার করলে দুইদফা ঘৃণা করে। একবার সে ঘৃণা করে অপরাধকে, আরেকবার অপরাধীর আত্মপরিচয়কে। এবং অনেকসময় দ্বিতীয় ঘৃণাটা প্রথম ঘৃণাটাকে ঢেকে ফেলে।
এই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের অনলাইন এবং অফলাইন পত্রিকাগুলোর ট্রিটমেন্ট নিয়েও কিছু কথা বলা দরকার। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো এ ধরনের সংবেদনশীল ঘটনাকে খুব বাজেভাবে ট্রিট করে। ঘটনাগুলোকে খবর বানিয়ে বিক্রি করাই থাকে অন্যতম উদ্দেশ্য। ঘটনার বর্ণনায় তাই ডিটেইলের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। অর্থাৎ পত্রিকা পাঠককে (ধরে নেওয়া হয় পাঠক পুরুষ) ঘটনার মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করিয়ে আনার ব্যবস্থা করে দিতে চায়। ফলে একবার ধর্ষিত মেয়েটিকে অগণিত পাঠক মানসিকভাবে ধষর্ণ করে। আমাদের অনেক সংবাদপত্রই এই সুবিধাটা করে দেয়। আমি পরিমল সংক্রান্ত যুগান্তরের একটা রিপোর্ট পড়েছি। ‘আমাদের সময়', ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পড়ার সাহস করে উঠতে পারিনি।
...অধ্যক্ষ হোসনে আরা অর্বাচীনের মতো কথা বলেছেন। অথবা পদ অঁাকড়ে থাকার জন্য অপরাধীর পাশে দঁাড়াতে চেয়েছেন। এটা নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে। তঁার পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত প্রধানের নিজ থেকেই পদত্যাগ করা উচিত। বাংলাদেশে অবশ্য তেমন দৃষ্টান্ত বিরল। হোসনে আরাকে নিয়েও অনেক অনলাইন কর্মকাণ্ড হচ্ছে। এই কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য এই মহিলার পদত্যাগের জন্য চাপ তৈরি করা। কিন্তু এটা করতে গিয়ে এমন কিছু করা হচ্ছে যা বিস্ময়কর। তাকে সম্বোধন করা হচ্ছে ‘নষ্টা’ প্রিন্সিপাল হিসাবে। একজন তাকে কাজের বুয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেউ কেউ করছেন বেশ্যার সঙ্গে তুলনা। তুলনা করার সময় তুলনাকারীর সামাজিক শ্রেণীবোধের নিদারুণ প্রকাশ ঘটছে। আজকে আমি একটা পোস্ট দেখেছি যেখানে হোসনে আরার পরিবারের সবার ছবি ফেসবুকে প্রচার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। হোসনে আরার যৌনতা নিয়ে মন্তব্য করা হচ্ছে। তাকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায়—সম্মিলতভাবে তা ভাবতে ভাবেত কল্পনাশক্তির বিবিধ প্রকাশ ঘটানো হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, এটা কি একটা ধর্ষণকে উপলক্ষ করে আরেকটা ভার্চুয়াল গ্যাংরেপ নয়?