টুলির শ্বশুর এসেছে । টুলির বাবা কাঁধের গামছা
নামিয়ে হাত কচলাতে লাগল । মুখ ও ঠোটের রগগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছিলো । কিছু বলতে
যাচ্ছিলো কিন্তু ভেতর থেকে বের হচ্ছে না ।
টুলির শ্বশুর বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিমায় রাহাতের সাথে টুলির দুর্ব্যবহারের নমুনা ফিস ফিস করে বলতেই থাকলো । টুলির সাথে রাহাতের বিয়ে হয়েছে সাত মাস । দাবিদাওয়া ছিলনা । টুলির চেহারা মিষ্টি , সেসব কথা উঠেনি ।
'বেয়ায় এবার যা হয় একটা কিছু করেন । ভাবলাম
মুবায়েলেই বলি ,আবার ভাবলাম মুখ দিইয়া কথা
বুলি ,মুখের দর্শণ না দিই তবে কথার স্বাদ
পাল্টাইয়া যায় । আর আপনারাও কি চিন্তা
করেন না করেন !'
'ঘটনা কিছু না , সকালে রাহাত মিয়া বলল , নাকের
মইদ্দে মুনে হয় বরণ হয়ছে দেখোতো টুলি ।
টুলি মা নাকি হাত দিয়া নাক সরায়া দিতে গেছে আর নাকের ডগাই লাগছে ঠাপ , কেমুন !
আমি আর কি বুইলবো বুলেন । এসব সমইস্যার
আমি কয়দিন সমাধান দিব ?'কথা বলতে বলতে
ঘেমে উঠেছিল টুলির শ্বশুর । টুলির মা তাল পাখা দিয়ে বাতাস করতেছিলো আপত্তি জানিয়ে ছিনিয়ে নিল সে । ততক্ষনে টুলির দাদাকে
উপস্থিত করা হয়েছে ।
তিনি ঘটনার অর্ধেক শুনে রায় দিলেন 'মাইয়ারে ভূতে পাইছে ।
তা না হইলে এমুন .........।'চিন্তাজড়িত কন্ঠে বলেন তিনি ।
"স্বামী বড় স্বজন
স্বামীরে ভজ মন ,
তবেই পাইবা তুমি খোদা দরশন "
বলেই মাথা দুলাতে লাগলেন । টুলির দাদা দবির
শেখ মেট্রিকুলেশন পাশ । বাংলা - ইংরেজী সব
বিষয়ের পন্ডিত বলেই মনে হয় । তবু অসংস্কার -
কুসংস্কার তার প্রিয় বিষয় ।তছাড়া ,যে সংস্কার পুর্বপুরুষ দিয়ে যায় তা ভোলা যায় না ।
দবির শেখ কে চেয়ার দেয়া হয়েছিল ,টুলির বাবা
তার পাশে মাটিতেই বসে পড়ল ।
আলোচনা শেষ করতে করতে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকা
শুরু করেছে । উতসুক প্রতিবেশীরা কয়েকজন
এসেছিল । টুলির শ্বশুর ততক্ষনাত আলোচনা
থামিয়ে দিয়েছে । বিনয় আর মিষ্টি কথায় বিদায়
করেছে ।' পারিবারিক 'অতি গোপনীয় ।
'শেষ- মেষ সিদ্ধান্ত এই যে ,আপনার বাড়িতেই
ভাসান গানের আসর । ১৩ বৈশাখ '।
'যুগ যামানা বড় পালটাইছে বুঝলেন , বাচ্চারা
পর্যন্ত মুবায়েলে ন্যংটো নাচ দেখে । ভাসান
গানের শোরাতা পাইবেন কিনা সেইডা আগে দেখেন' ।
বলল টুলির শ্বশুর ।
টুলির মা মুখে কাপড় দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করতে
চলে গেল । দবির শেখের অবশ্য খুব উতসাহ
দেখা গেল । বৃদ্ধ মানুষ একটা উপলক্ষ পেলে
বড় ভাল সময় কাটে । গল্প গুজবের দুটো লোক
পাওয়া যায় । টুলির বাবাকে নির্ভয় দিয়ে বলল
'শোন বড়ব্যটা তোর টুলির এবার বুদ্ধি হবেই ।
ভাসান গানের তিন নম্বর পালায় বেহুলা বালির যে
কান্দন তা দেখে গাছের পাতা ঝইরা পড়ে আর এ
ত তোর টুলির মন । গলিবেই গলিবে । বড়
সউয়ামী ভক্ত হবে তর টুলি । দেখিস না হয় , আমার কথা ফলে কি না ফলে '। আরও কিছু
বলার ইচ্ছা ছিল কিন্তু কেও হুঁ -না সাড়াও দিচ্ছে না দেখে থেমে গেলেন তিনি ।
বাঙ্গালী মুসলমান হয়েছে সাত-আট পুরুষ আগে
কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতি ভুলতে পারেনি | মুসলিম
সংস্কৃতিও যোগ হয়েছে । সব বড় বড় সংস্কৃতির চাপ সমাল
দিয়ে এ থাকে কিনা তাই এখন শঙ্কা ।
(১) সাপে কাটা রোগীর বিষ নামছে না ,
ওঝার নির্দেশে দিতে হবে "পদ্মপুরাণ " গানের মানসা |
(২) গোয়ালের গরু অসুখে দমাদম মরছে , "মানিক পীরের গান " |
(৩) খুব বড় বটের গাছটা কাটতে হবে জ্বীনের বাদশাকে খুশী রাখতে "মাদার গান " |
(৪) নতুন বিয়ে দেয়া ছেলে - মেয়ের মিল হচ্ছে না " ভাসান গান "(পদ্মপুরাণের অন্য রূপ ) |
ইত্যাদি ।
বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তি রাবনের মত গ্রাস করে চলেছে এগুলোকে ।
তবু গ্রাম্য দু -একজন মূর্খ যুবকের মুখে এখোনো শোনা যায় -
" আগে জদি জানতাম আমি তুমি মানিক পীর '
আগে দিতাম দুগ্ধ কলা পাছে দিতাম ক্ষির ।।
ওও হ ।।রে ওহরে ..."।।
টুলিদের বাড়িতে ১৩ই বৈশাখ এসেছে যথা
নিয়মে । বাড়ির বাইরে ঝলমলে সামিয়ানা টঙিয়ে চকির অবকাঠামোয় মাটির সিঁড়ি দিয়ে
মঞ্চ বানানো হয়েছে । ভাসান শিল্পী সবাইকে
পাওয়া যায়নি । যারা এসেছে তাদের নতুন গামছা
, নগদ তিনশ করে টাকা ও নেভী সিগারেট দিতে
হয়েছে ।
সস্তা মেকাপে পুরুষ ছোকরারা মেয়ে সেজে
"ভেংটি সাপের লেজটা কাটা , ভেংটি সাপের
লেজটা কাটা "টাইপ তালে নাচতে লাগল । মঞ্চের
চারিদিকে খই -মুড়ির ডালায় নাড়ু ,সন্দেশ ,
বাতাসা ,কলা ,দুর্বা ঘাস ,প্রভৃতি শোভা পেতে
লাগল ।
সাথে ধূপের ধোয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উঠল । ঢোলের তালে হ্যাচাক বাতির কেরসিন পোড়ার শব্দও শোনা গেল না ।কিন্তু শ্রোতাদের ভীড় গানের চেয়ে বাদাম ,জিলাপীর
দোকানে বেশি জমে উঠল । টুলি আর রাহাতের
পাশাপাশি দুটি চেয়ার পাতা হয়েছে মঞ্চের খুব কাছাকাছি ।
কালো পাড়ের টকটকে গোলাপী শাড়ী ও ছোট্ট
কালো টিপের সরল সাজে আপুর্ব এক কিশরী
রাহাতের পাশে গিয়ে বসল ।
এশার আজানের জন্য গান কিছুক্ষন বন্ধ রাখা
হয়েছিল , এ সময় মেয়ে সাজা ছোকরাদের
সিগারেট ফুকতে দেখে টুলি অবাক হল,রাহাতের
দিকে ঝুকে এসে কি যেন জিজ্ঞেস করল |
রাহাত শব্দ করে হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে
নিল ।
মেয়ে সাজা এই ছোকরারা যে ,ছেলে তুমি জান না?
কি? পাল্টা প্রশ্ন করল টুলি ।
আবার ঢোল কাঁশির তালে শুরু হল তৃতীয়
পালার গান |
ইস, এই মেয়ে-সাজা ছোকরারা যে , ছেলে এটাই
জানে না টুলি |
সে গ্রামের মেয়ে বটে, রঙ্গিন ঝালরের এতো কাছে
এসে দেখার সুযোগ ত তার হয়নি ।
আর কতই বা বয়স তার ।
রাহাত প্রতিজ্ঞা করে ,টুলির উপর সে আর রাগ করবে না ।
ভাসান গানের এ পর্যায়ে লক্ষিন্দরকে সাপে কাটবে । মনসা (পদ্মা) সাজা ছোকরাটি
ঝমক ঝমক ,ঝম ঝম তালে নাগিন নৃত্য করে চলেছে ।
পোড়া মাটির সরায় ধূপ ছিটিয়ে , বাতাস দিয়ে ধোয়া বাড়ানো হয়েছে |
সুরভিত ধোয়া ।
শ্রোতারা এবার জিলাপীর দোকানওয়ালা ছেড়ে
মঞ্চ ঘিরে ধরেছে । সবার আগ্রহ এই
বিশেষ পর্বে ।
অনেকক্ষন নাগিন নৃত্য হয় |
উপস্থিত সবাইকে টুলি চিনেনা ঠিকই , কিন্তু
সকলেই তার গাঁয়ের কিংবা পাশের গাঁয়ের |
শ্রোতারা নাগিন নৃত্য শুধু দেখছে না । মায়া মায়া
চোখে টুলির দিকেও তাকাচ্ছে । সে চোখের ভাষা বলছে - তুমি ভূতে পাওয়া,
তুমি আমাদের দলে নও । তুমি ভূতের দলে ।
নাগিন নৃত্যকারিনী ' মনসা 'এবার মঞ্চ ছেড়ে এসে
টুলিকে ঘিরে ধরল । সাপের মত দেহ বাঁকিয়ে
নাচতে লাগল |
টুলি লজ্জায় লাল হয়ে গেল । দেহের সব রক্ত কান
ফুটে বের হতে চাইছে । কান্নার ঢেউ চেপে
আসছে । সে কাঁদবে না , কিছুতেই না |
কিন্তু এ অপমান আর কতক্ষন !
মনসা আবার মঞ্চে ফিরে এসেছে । বেহুলা -লক্ষিন্দর রাজকীয় পোষাকে , সোনালী চাদরে ঢাকা ।
যেহেতু তারা মঞ্চে শুয়ে আছে , সুতরাং মঞ্চকেই
লোহার বাসর কল্পনা করতে কারোও অসুবিধা
হচ্ছে না ।
ধুপের ধোয়া বাড়িয়ে দেয়া হল । হিস হিসস শব্দ
করে মনসা লক্ষিন্দরের পায়ে ছোবল দিল । মনষা অদৃশ্য (প্রস্থান ) হয়ে গেছে |
আকস্মিকভাবে ঢোল কাঁশীর রাগ থেমে গেল |
লক্ষিন্দর এবার জেগে উঠে । মোটা বাঁশির দুখিনী
সুরের সাথে কন্ঠ মিলায় -,
"বিষে অঙ্গ আমার জর জর ,
উঠো বেওলা বালি আমায় ধর ধর |
কি নাগে দংশিল আমায় ,কালনাগিন হে .........।।"
বেহুলা জাগল না ।
বার বার সুরে টান দিতে দিতে এক সময়
বেহুঁস হয়ে পড়ে যায় ।
এবার বেহুলার পাট , বেহুলা উঠে দেখে স্বামীর
নিথর দেহ পড়ে আছে । সর্প দংশনে মুখমন্ডল
নীল ।
শুরু হয় বেহুলার লাঞ্ছনা -গঞ্জনার আর দুঃখের পালা।
প্রাণ রক্ষার জন্য মৃত স্বামীকে নিয়ে কলার ভেলায়
গঙ্গায় ভাসে । সর্গপুরী পর্যন্ত পৌছাতে , সিমাহীন
কষ্ট । আহ ! স্বামীর জন্য কি কষ্ট !
চাদ সওদাগর কোন সাহায্য দেয়নি । অসতী
অপবাদ দিয়েছে ।
বেহুলা তাই এবার দর্শকদের কাছ থেকে সাহায্য
(টাকা) আদায় করতে নেমেছে । এই পর্বটা
শিল্পীদের বানানো |
টুলি- রাহাতকে ঘিরে বেহুলা চরিত্রের ছোকরাটি নাচে ,গায় , টাকা
তুলে ।
বিরক্তে- লজ্জায় টুলির মরে যেতে ইচ্ছা করে ।
কাঁদতে ইচ্ছা হয় , প্রচন্ড । কিন্তু সে এত দুর্বল
নয় , কিছুতেই কাঁদবে না ।
বেহুলাবালির উপদ্রপ চলতেই থাকে । একসময়
অজান্তেই টুলি লজ্জার শেষ সীমায় পৌছায় । দু
চোখ বেয়ে জলধারা নামে । বৈশাখের গুমসি
রাতে চারিদিকে জয় হর্ষ উঠে ।
'জয় বেহুলা ,জয় বেহুলা ।'
কারণ উদ্দেশ্য সফল হয়েছে|
টুলির চোখে পানি এসেছে |
টুলির মন গলেছে । স্বামীভক্তি বুঝতে পেরেছে ।
টুলির বাবার ঠোটে বাঁকা হাসির রেখা দেখা যায় ।
লাল গনগনে শিখায় হ্যাচাক বাতির কাঁচ গলে পড়ে | একটা দমকা বয়ে যায় । দপ করে খসে পড়ে হ্যাচাক বাতির ছাইএর ফিলামেন্ট ।টর্চের আলো ফেলা হয় টুলির মুখে , ছোকরার মুখে । টুলি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠে ।
অনেক দুর থেকে সেই শব্দের সাথে আরেকটা
শব্দ পরিস্কার শোনা যায় ।
ও বেওলা , গোহ বালি গোওওও
..................।।