
১.
মহাকাশ যানের কন্ট্রোল রুমের কুর্সিতে হেলান দিয়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দ করে কফি খাচ্ছে নীও। ছোট একটি দল নিয়ে বিশেষ একটি অভিযানে যাচ্ছে সে, নীও এই অভিযানের দলনেতা। এই তরুণ বয়সে এরকম একটি অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া বিরল ঘটনা। তবে যেই ছেলে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে নিজের সমীকরণ দিয়ে ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি ব্যাখ্যা করেছে, যার সমীকরণ বিজ্ঞানের চেনা-জানা সকল হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়েছে, তার উপর বিজ্ঞান পরিষদই-বা কেন আস্থা রাখতে কার্পণ্য করবে!সম্মান সরূপ তিন তারকা পেয়েছে নীও যেটা তার কোর্টের উপর সোভা পাচ্ছে।
‘ভিতরে আসতে পারি?’ কন্ট্রোল রুমের দরজায় কড়া নেড়ে বলল নীসা। তবে অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঢুকে পরল সে। নীসা একজন পঞ্চম প্রজন্মের মেডিকেল রোবট, পঞ্চম প্রজন্মের রোবটদের মানুষের সম-মর্যাদা দেয়া হয়েছে অবশ্য এর জন্য সব পঞ্চম প্রজন্মের রোবট মিলে আন্দোলন করেছিল!
মহাকাশ-যানের ভিতর মাইক্রো-গ্রাভিটির ফলে নভোচারীদের শরীরের প্রতিটি কোষ এবং পেশী দুর্বল হয়ে পরে। নীসার দায়িত্ব নিয়ম করে সবার রক্ত, ব্লাড প্রেশার, রক্তে হিমোগ্লোবিন, মস্তিষ্কের তরঙ্গ ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা।
‘নীও কেমন আছ? তোমার মেডিকেল চেকআপে করতে হবে।’
নীও আপন মনে কফিতে চুমুক দিয়ে চলছে। কোন কথাতেই যেন ভ্রূক্ষেপ নেই তার।
নীসা আরও কয়েকবার ডাকল আসতে করে কিন্তু কোন সাড়া পেল না। কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে আছে সে, প্রায় সময় নীও মন বিষণ্ণ করে বসে থাকে, তবে যেদিন খুব মন মেজাজ ভাল থাকে সেদিন নীসার সাথে দারুণ ফুরফুরা মেজাজে কথা বলে, তাকে ডার্লিং বলে সম্বোধন করে। নীও এর কাছ থেকে ডার্লিং শুনলে নীসার মস্তিষ্কের সার্কিটে কেমন যেন ইলেকট্রনের প্রবাহ হঠাৎ বেড়ে যায়, মস্তিষ্কের কৃত্রিম নিউরনে এক ধরনের কম্পন অনুভূত হয়। আবার নীও এর মন খারাপ দেখলে তার সার্কিটে অস্বাভাবিক একটা কম্পন অনুভব করে। এর মানে কি ভালবাসা ? নীসা নীও সম্বন্ধে যতটুকু জানে সে আগে এরকম ছিল না, সবসময়ই হাসিখুশি থাকত তবে সে যতটুকু জেনেছে তা হল কয়েক বছর আগে তার স্ত্রী খুন হয় এবং কি কারণে যেন তার বাবা-মার সাথে দুরুত্ব তৈরি হয়, তারপর থেকেই এরকম হয়ে গেছে। নীসার মাঝে মাঝে মনে হয় তাকে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু পারে না, কারণ সে একজন রোবট। রোবটদের মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাগ গলাতে নেই, তাদের সাথে বন্ধুত্বের বেশী কিছু হওয়া নিষেধ, এটা প্রটোকলের পরিপন্থী, কি অদ্ভুত সব কানুন, নীসা মনে মনে এগুলো ভেবে একটা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
‘নীও, তুমি শুনছ?’ এবার একটু জোরে বলল নীসা।
নীও এর চিন্তার ছেদ পরল, নীসার দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে আরেকটা কুর্সি দেখিয়ে চোখ দিয়ে বসার ইশারা করল।
এবার চোখে মুখে যথাসম্ভব ভাবগাম্ভীর্য এবং থমথমে ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল ‘আমরা একটা চক্র-ভিউয়ের ভিতর ফেঁসে গেছি !’
‘কি বললে আমি ঠিক বুঝলাম না।’ কুর্সিতে বসতে বসতে বলল নীসা।
কফির মগটা টেবিলের রেখে আবারো বলল ‘আমরা একটা চক্র-ভিউয়ের ভিতর ফেঁসে গেছি নীসা!’
নীসার চোখের সামনের ডিসপ্লেতে চোখ যেতেই কিছুটা ধাক্কা খেল। এতক্ষণ সে লক্ষ করেনি নীও মহাকাশ যানের গতিপথ পাল্টে পুনরায় পৃথিবী-মুখী করেছে।
চোখ জোরা বড় বড় করে বলল ‘নীও আমরা টাও সেতু নক্ষত্রের অধীনে এসেছি মাত্র, তুমি আবার পৃথিবীর দিকে যাচ্ছ কেন ? তাছাড়া কিসের চক্র-ভিউ এর কথা বলছ তুমি ?' নীসাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে কত বড় একটা আতঙ্ক নিজের ভিতর লুকিয়ে রেখেছে।
‘নীসা আমাদের মহাকাশ যানের গড় গতি কত?’
‘এক লক্ষ্য সতের হাজার পার কিমি!'
‘আমরা এই মিশনে আসছি কত দিন?’ নীসার দিকে তাকিয়ে খুবই সিরিয়াস-ভাবে জিজ্ঞেস করল নীও।
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি এই ধরনের প্রশ্ন করছ কেন?’ কিছুটা দ্বিধান্বিত গলায় নীসা বলল।
‘সব কিছু বলছি, আগে উওর দাও?’
‘প্রায় ছয় মাস, তের দিন, আট ঘণ্টা বার সেকেন্ড' আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল নীসা।
নিও তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল ‘তোমাকে এত বিস্তারিত বলতে হবে না, তুমি কি লক্ষ্য করেছ আমরা এখন আমাদের সৌর জগতের নিকটবর্তী নক্ষত্র টাও সেতুর সৌর জগতে ঢুকে পরেছি যা বর্তমানে পৃথিবী থেকে কমপক্ষে বার আলোক বর্ষ দূরে, তুমি বুঝতে পারছ ব্যাপারটা?’
‘তুমি কি বলতে চাইছ একটু পরিষ্কার করে বলবে নীও?’
কথা বলার সময় নীও এর বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করছে, সে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলল ‘আমাদের যানের গড় গতি ঘণ্টায় এক লক্ষ্য সতের হাজার কিমি। আমরা এই ছয় মাসে প্রায় ২৪x৩০x৬ মানে ৪,৩২০ ঘণ্টা ভ্রমণ করেছি। ৪,৩২০ কে যদি ১,১৭০০০ দিয়ে গুন কর তাহলে যা পাবে আমরা ততটা দূরত্ব অতিক্রম করেছি।’
নীও একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার বলল ‘গুণফল হয় ৫০৫.৪৪ মিলিয়ন মানে এই পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করার কথা অথচ আমরা এখন পৃথিবী থেকে আছি প্রায় ১২ আলোক বর্ষ দূরে, এটা কিভাবে সম্ভব?’
নীও এর কথা শুনে নীসা কিছুটা নড়েচড়ে বসল। সে মোটামুটি একটা ধাক্কা খেল, আশ্চর্য সে একজন আধুনিক রোবট, সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব নিমিষেই করতে পারে অথচ এই সহজ ব্যাপারটা তার মাথাতেই আসে নি! সত্যিই হিসেব মত তাদের বড়জোর ৫০৫ থেকে ৫০৬ মিলিয়ন কিমি পথ অতিক্রম করার কথা, তারা বারো আলোক বর্ষ কিভাবে আসল ?
তারা দুজনই চুপচাপ হয়ে রইল, অবশেষে নীও এই অস্বস্থিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিয়ে আবার বলল ‘আমি মহাকাশ যানকে কেন পৃথিবী-মুখী যাচ্ছি বুঝতে পারছ ? আগে আমাদের এই রহস্যের সমাধান হওয়া দরকার। আমরা মাত্র ছয়মাসে এত দূর এলাম কিভাবে ?’
‘পৃথিবীতে ফিরে যাওয়াতো সম্ভব না কারণ এত দূরত্ব পারি দেয়া প্রায় অসম্ভব। যেখানে এক আলোক বর্ষ যেতেই আমাদের জীবনের আয়ু শেষ হয়ে যাবে সেখানে বারো আলোক বর্ষ কিভাবে যাব?’ উদ্বিগ্ন গলায় বলল নীসা। নীসার চোখে মুখে ভয়ে রেখা ফুটে উঠল।
নীও নীসার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ধাক্কা খেল, বুকের ভিতরটা কেমন জানি মোচর দিয়ে উঠল তার।নীও যেন ভুলেই গিয়েছিল নীসা একজন পঞ্চম প্রজন্মের রোবট, রোবট হয়েও মানুষের মতই কত সুন্দর ভয়ের অনুভূতি আছে তার।
নীও একটু নীবর থেকে বলল ‘সেটা জানি না, তবে এতটুকু বুঝতে পারছি, এই মুহুত্যে পৃথিবী-মুখী যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন ভাল বুদ্ধি নেই। তাছাড়া যোগাযোগ মডিউলের থেকে কোন সিগন্যাল আসছে না অনেকদিন ধরে, তাই যাই থাকুক কপালে আমাদের পৃথিবী-মুখী যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’
হঠাৎ নীসা মহাকাশ যানের যোগাযোগ মডিউলের দিকে তাকিয়ে বলল ‘সর্বনাশ।’
নীও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে যোগাযোগ মডিউলের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল।
‘আমাদের তিন দিক থেকে ট্রকাররা আক্রমণ করেছে।’ বলল নীসা ।
ট্রকার হচ্ছে এক ধরনের ক্ষুদ্র প্রাণী, এরা মহাকাশের সন্ত্রাসী গ্রুপ, তাদের জ্বালায় মহাকাশের কোথাও শান্তি নেই, তাদের বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে থাকায় মুহূর্তেই যে কোন জায়গায় যেতে পারে তারা।
‘যান হাতের ডানদিকে ঘুরাও!’ উত্তেজিত হয়ে বলল নীসা।
‘সে দিকে যাওয়া যাবে না, সেখানে এক ধরনের রেডিয়েশন দেখাচ্ছে যোগাযোগ মডিউলে।’ বলল নীও।
‘কি রেডিয়েশন?’
‘খুব সম্ভবত ব্ল্যাক হোল আছে, সেদিকে যাওয়াটা বিপজ্জনক।’
হাতে আর বেশী সময় নেই, ট্রকাররা খুবই দ্রুত ধেয়ে আসছে। তারা দুজনই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দম বদ্ধ করে যোগাযোগ মডিউলের দিকে তাকিয়ে আছে ।
২.
‘সব কিছু শুরু হয়েছে এপিসোড নাম্বার তেরো থেকে।’ বলল মধ্যবয়স্কা নারীটি।
‘ঠিক বুঝতে পারছিনা, কি বলছ তুমি ? কি শুরু হয়েছে তেরো নাম্বার এপিসোড থেকে ? নীও এবং নীসা চরিত্র-দুটিকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছ তুমি। এই ড্রামা সিরিয়ালটির টি,আর,পি(টার্গেট রেটিং পয়েন্ট) এখন পর্যন্ত আগের সবগুলো শোয়ের রেকর্ড ব্রেক করেছে, সবাই পছন্দ করছে এই ড্রামা সিরিয়ালটি । প্রথম দিকে রোমান্টিক প্রেমের কাহিনী ভেবেছিলাম, সেখান থেকে কল্প কাহিনীতে রূপ নীল, এখন আবার এই পর্বে দেখা যাচ্ছে ওরা আবার পৃথিবী নামক কাল্পনিক গ্রহে ফিরে যাচ্ছে, কোন দিকে মোর নিচ্ছে গল্প ? গল্পের প্লট-টাকি পরিবর্তন করলে?’ বলল লোকটি।
‘আমি কিছুই করিনি। আমি একজন তরুণ বিজ্ঞানী এবং রোবটের মাঝে প্রেমের একটা প্লট চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু বললাম না তেরো নাম্বার এপিসোডের পর থেকে চরিত্রগুলোর উপর আমার আর কোন হাত নেই। আমার লেখা প্লট অনুসারে আর চলছে না সিরিয়ালটি।’
‘লোকটি অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ করল, কিভাবে?’
‘তের নাম্বা এপিসোড পর্যন্ত চরিত্রগুলোর উপর আমার হাত ছিল। তেরো নাম্বার এপিসোডে চরিত্রগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করতে মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করেছিলাম।চরিত্রগুলোকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করেছিলাম যাতে গল্পে কোন নিদিষ্ট সিচুয়েশন দিলে চরিত্রগুলো যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই সিচুয়েশন অনুসারে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারে, চরিত্রগুলো যাতে আরও জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে।’
মহিলাটি একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার বলল ‘চরিত্রগুলোর মাঝে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ এমন একটি প্রোগ্রাম লিখেছিলাম যেই প্রোগ্রামটি নিজেও প্রয়োজন অনুসারে প্রোগ্রাম লিখতে পারত। ধর তাপমাত্রা কত জানতে হলে সে নিজেই তাপমাত্রা বের করার প্রোগ্রাম লিখতে পারবে, কোন হিসেবে দরকার হলে নিজের মাঝে ক্যালকুলেটরের প্রোগ্রাম লিখতে পারবে। তেরো নাম্বার এপিসোডের পরে দেখা গেল নীও এবং নীসা এর সেই মূল প্রোগ্রামটি নিজেদের মধ্যে এরকম কয়েক মিলিয়ন ছোটছোট প্রোগ্রাম লিখে ফেলেছে।’
মহিলাটি একটু ঢোক গিলে আবার বলল ‘তেরো নাম্বার এপিসোডের পর চরিত্রগুলো এতটাই স্বতন্ত্র হল যে এখন আমি প্লটে যেই সিচুয়েশনই ইনপুট দেই সেগুলো বাতিল করে দিয়ে নিজেরা নিজেদের মত চলতে থাকে।’
‘তাহলে প্রোগ্রামটি অফ করছ না কেন? ’ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল লোকটি।
‘এই ড্রামা সিরিয়ালের টি,আর,পি খুবই ভাল আসছে। সপ্তাহে তিনটি করে এপিসোড দেখানো হয়। তাই এই প্রোগ্রাম অফ করলে আমাকে আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হবে, অনেক সময়ের ব্যাপার, মিডিয়া, পযোজক সর্ব-পুরী দর্শক সবার কাছ থেকে একটা প্রেশার আসবে। আমার সংসার এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা চলে এই আয়ের উপর, এটা বন্ধ হলে সবাই আমাকে অপেশাদার ভাববে, কাজ দিবে না!’
লোকটি ঢোক গিলে জিব দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলল ‘হুম বুঝলাম, তবে একটা জিনিষ লক্ষণীয় তোমার চরিত্র দুটি মনে হয় ফেঁসে গেছে, তারা কি করতে চাইছে? পৃথিবী নামক কাল্পনিক গ্রহেতো ফিরতে পারবে না মনে হয়!!’
মধ্যবয়স্কা নারীটি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল ‘সেটা নিয়ে আমিও চিন্তিত !’
তারপর দুজনই সামনের মনিটরে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পরবর্তীতে কি ঘটে সেটা জানার জন্য। (শেষ)
বি দ্র – গল্পটাকে নতুন করে আপডেট করেছি। অনেক কিছু পরিবর্তন করেছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


