somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কল্প-গল্প : যান্ত্রিক ভালোবাসা

২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
থেমে থেমে মেঘের ঘর্ষণে চারদিক কেপে উঠছে। আলোর ঝলকানিতে ভোরের আকাশটা আলোকিত হয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। ফিলিপ ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ঘুম থেকে, হাত ইশারা করতেই জানালার উপর থেকে পর্দাটা সরে গিয়ে বাহিরের আকাশ উন্মুক্ত হয়ে উঠল। কৃত্রিম আকাশ, এই মেঘ এবং বৃষ্টির চমৎকার মিথস্ক্রিয়া সব কিছুই কম্পিউটারের সিমুলেশনে তৈরি ভেবেই বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ফিলিপের।

' কি হল ?' পিছন থেকে কাঁধে আলতো করে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে ক্যাথরিন।

ফিলিপ থেমে বলল 'আমাদের এই আলফা গ্রহের সব কিছুই কৃত্রিম বুঝলে। এখানে কোন আকাশ নেই, ত্রি-ডি প্রজেকশনের মাধ্যমে কৃত্রিম আকাশ তৈরি করা হয়েছে। বৃষ্টি, জ্যোৎস্না, সমুদ্র সব কিছুই কম্পিউটারের সিমিউলেশনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে।' ক্যাথরিনের ঝরঝরে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে হেসে বলল ফিলিপ।

' আজ তোমার আবার কি হল ?' ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল ক্যাথরিন।

' কিছু না।' ঠোট জোরা প্রশস্ত করে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলে ফিলিপ।

ক্যাথরিন ফিলিপের দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। ক্যাথরিন মাঝে মাঝে চিনতে পারে না ফিলিপকে, প্রায় ভাবুক হয়ে যায় মানুষটা, কেমন জানি এক ধরনের অস্থিরতায় ভুগে সারাক্ষণ। মানুষ-টাকি তাকে সত্যিই ভালবাসে ব্যাপারটা ভেবেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে ক্যাথরিন, বুকের ভিতরটা ভারি হয়ে আসে তার, ভিতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পরিবেশটা থমথমে করে তোলে খুব।

' স্যার ব্যাপারটি শুনেছেন ?' ঘরের কথা থেকে শব্দ ভেসে আসে

শব্দের উৎস খুঁজতে চোখ ঘুরাতেই ঘরের মাঝখানে হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিতে একটি তরুণের ছবি ভেসে উঠে।ফিলিপ ভ্রু কুচকে তরুণের দিকে তাকায়।

'স্যার আমি আপনার প্রিয় কমিউনিকেটর পোগ্রাম বলছি। আমাকে আপডেট করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমি এখন খবরা-খবর জানাতে পারি আরো দূত সময়ে, যে কোন জটিল হিসেব নিকেশ করতে এখন আমার সময় লাগে শূন্য দশমিক তিন পিকো সেকেন্ড, তাছাড়া নতুন বিনোদন ফিচারও যোগ হয়ে এই ভার্সনে, এই যেমন হালকা কৌতুক বলা এবং নাচ... ' আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কমিউনিকেটর পোগ্রামটি

ফিলিপ মাঝপথে থামিয়ে বলল ' কি বলতে জানাতে এসেছ বল ?'

'স্যার চার দিকে হইচই পড়ে গেছে। আমাদের এই ছায়াপথের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানব বসতির সমস্ত টিভি চ্যানেলে আপনাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আপনি এই ছায়াপথের সেলিব্রেটি বনে গেছেন স্যার।' বলেই তরুণটি ফিলিপের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করে।

ফিলিপ আজকাল লক্ষ্য করেছে তার নতুন এই কমিউনিকেটর পোগ্রামটি নাটকীয়তা করতে পছন্দ করে। কোন কথাই সোজা করে বলে না।

'হারামজাদা তোকে না বলেছি আমার সাথে নাটকীয়তা করবি না। পশ্চাৎ দেশে লাথি মেরে তোকে সোজা করে ফেলব!'

'আমি দুঃখিত স্যার' মলিন গলায় বলল কমিউনিকেটর তরুণটি।

একটু থেমে আবার বলে 'স্যার কিছু মনে করবেন না আমি একটি নির্বোধ পোগ্রাম। মেঝেটাকে ভূমি ধরলে, আমি ভূমি থেকে নব্বই ডিগ্রি এঙ্গেলে লম্বালম্বি-ভাবি দাড়িয়ে আছি, জিয়োমেট্রি হিসেব অনুসারে সোজা অবস্থায় আছি। আপনি আমাকে আর কিভাবে সোজা করতে চান ?' হাত কচলাতে কচলাতে বলে কমিউনিকেটর তরুণটি।

রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে ফিলিপের। নিজেকে কোনমতে সামলে গরম দৃষ্টিতে তাকান ।

দ্বিতীয় প্রশ্ন না করে তরুণ সরাসরি বলে 'স্যার আজ লটারি ড্র হয়েছে। আপনি এন্ডেলিন ছায়াপথের আবিষ্কৃত নতুন গ্রহে যাবার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই ছায়াপথের ভিতর আপনিই হলেন সেই ভাগ্যবান যে এই গ্রহে যাবার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।'

সংবাদটি শুনে চমকে উঠে ক্যাথরিন। এন্ডেলিন ছায়াপথের সে গ্রহটার খবর সে আগে জেনেছে, এই ভ্রমণটা হবে একমুখী ভ্রমণ।সফর সঙ্গী হিসেবে থাকবে শুধু একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত একটি পোগ্রাম।

'তুমি কবে আবেদন করলে সেখানে যাবার জন্য ? তুমি কি জানো সেখানে গেলে আমরা আর এই জন্মভূমি আলফা গ্রহে ফিরে আসতে পারব না! তাছাড়া কয়েক হাজার আলোক বর্ষের দুরের সেই গ্রহতে যাবার জন্য হাইপার জাম্প করতে হবে।' বেশ বিস্ময়ের সাথে বলে ক্যাথরিন।

'হুম জানি, তবে জানতো সেই গ্রহতে নাকি সত্যিকারে সমুদ্র আছে, গাছ পালা, নদী নালা আছে, মানুষের আদিবাস পৃথিবীর মতই অনেকটা। আমি ছোটবেলা থেকে জেনেছি আমাদের আদিবাসে নাকি সমুদ্র ছিল, সেখানে পালতোলা জাহাজ ছিল, মানুষ সমুদ্রে ভেসে বেড়াতো, মাছ ধরত, চিন্তা করে দেখ তুমি হাঁটছ অথচ কাঁধে ভারি কোন বস্তুর সাহায্য ছাড়াই, গ্রাভিটির কি অসাধারণ ভারসাম্য।চাঁদ নামক একটি সত্যিকারের এক উপগ্রহ ছিল সেখানে, রূপ কথার মত একটি সবুজ গ্রহ, কোন কৃত্রিমতা নেই' বলতে বলতে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে ফিলিপের।

'আমরা কিন্তু আর ফিরে আসতে পারব না এই গ্রহে ।'

'আমি একাই যাচ্ছি, তুমি যাচ্ছ না সেখানে ডার্লিং।' হেসে বলে ফিলিপ।

বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠে ক্যাথরিনের, প্রবল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ফিলিপের দিকে।

২.
'সত্যিই কি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ?' আহত গলায় বলে ক্যাথরিন। তার চেহারায় লেপটে থাকা কৃত্রিম সিনথেটিকের চামড়ায় বেদনার চিত্র ফুটে উঠে, কৃত্রিম রেডিয়ামের চোখ ছল ছল করে উঠে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফিলিপের দিকে।

বড় করুণ সেই চাহনি, ফিলিপের বুকের ভিতরটা কেমন জানি ধক করে উঠে। সে যেন এক মূহুত্যের জন্য ভুলেই গিয়েছিল ক্যাথরিন একজন সপ্তম মাত্রার মানবিক আবেগ সম্পূর্ণ রোবট। কৃত্রিম সিল্কের চুলে হাত বুলিয়ে বৃথা সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে ফিলিপ।

হাত ঝামটা মেরে ফেলে দেয় ক্যাথরিন। স্পর্ধা ভরে জোর গলায় বলে 'উঠে তুমি যেতে পারবে না, আর যদি যেতে চাও তাহলে আমাকেও নিতে হবে। আমি তোমার স্ত্রী, আমিও তোমার সাথে যাব।'

'পাগলামি করো না। এই জার্নি শুধু একজনের জন্য। তোমাকে নেয়া সম্ভব নয়।' জীব দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলল ফিলিপ।

এই নিয়ে তাদের মাঝে প্রায় অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি হল, অনেক বুঝিয়েও মানাতে পারে না ফিলিপ।

'আমি যাব বলছি মানে যাবই।' সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে জোর গলায় বলে ক্যাথরিন।

রাগে খ্যাঁক করে উঠে, 'ভুলে যেওনা তুমি একটি যন্ত্র, মানুষ নও। স্কুপ-ড্রাইভার, টিভি, ফ্রিজ যেমন যন্ত্র ঠিক তেমনি তুমিও একটি যন্ত্র, তুমিও কৃত্রিম !' মুখ শক্ত হয়ে আসে ফিলিপের।

থেমে আবার বলে 'যাইহোক তোমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। আমারই ভুল হয়েছে তোমার মত যন্ত্রের সাথে কথা বলে।'

বেশ ধাক্কা খায় ক্যাথরিন। ফিলিপ মাঝে মাঝেই বেশ পাগলামি করে, হুট-হাট দায়িত্ব জ্ঞানহীনের মত আচরণ করে, তবে এতটা আশা করেই ক্যাথরিন। তার কৃত্রিম চোখ দিয়ে পানি চলে আসে।

'তুমি কি আমাকে ভালবাস না ?'

'তোমার প্রতি আমার ভালবাসা নেই বড়জোর সহানুভূতি আছে। আমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাব তাতে তোমার কি, মানুষ যখন কোথাও যায় তখন কি স্ক্রুপ- ড্রাইভার, ওয়াশিং মেশিন, হেয়ার ড্রায়ারের কাছে কৈফিয়ত দেয় !' ঝাঁঝ মিশানো গলায় বলল ফিলিপ।

৩.
মুখে একটি পাউরুটি গুজে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ফিলিপ। একশত ষাট তলা ভবন থেকে সুড়ুত করে ক্যাপসুলে করে নেমে আসে নীচে, আজ তাকে স্পেস ষ্টেশনে যেতে হবে, বেশ কিছু ফর্মালিটি বাকি আছে ভ্রমণের আগে। বৃত্তাকার একটি যান এসে থামল তার কাছে, কিছু ইউনিট খরচ করে ঢুকে পড়ল যানটিতে। তার পিছন পিছন একের পর লোকজন গাদাগাদি করে ঢুকে পড়ল।

প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলল যানটি একটি টানেলের ভিতর দিয়ে। ক্যাথরিনের সাথে ঝগড়া করে মনটা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে, তাই চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে নিলো টিভি চ্যানেল দেখার জন্য। এই সানগ্লাস লাগালে তার চোখের সামনে টিভি দেখতে পারবে কিন্তু অন্য কেউ তা দেখবে না। হাতে সংযুক্ত কমিউনিকেটর বাটনে চাপ দিতেই, একের পর এক চ্যানেল আসতে লাগল। ছায়াপথের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রহের সকল চ্যানেলেই প্রায় এই একমুখী যাত্রা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, এক গ্রহের সাথে আরেক গ্রহের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে টকশো হচ্ছে আরেক চ্যানেলে, আন্ত গ্রহের ভয়ানক রকেট রেইস প্রতিযোগীতে, ফিলিপ একের পর এক চ্যানেল পাল্টাতে থাকে, কোনটাতেই তার মন বসছে না।

বৃত্তাকার যানটির ভিতর একটি আট-দশ বছরের একটি মেয়ে, গায়ের রঙ্গ দেখতে সাধা, লম্বাটে মুখমণ্ডল, রঙ্গিন চুল এবং নাক সাংঘাতিক রকমের লম্বা। দেখতে ভারি মিষ্টি কিন্তু মেয়েটি যানের ভিতর সবাইকে বিরক্ত করে চলেছে। একটি ছোট ছেলে আইসক্রিম খাচ্ছিল মেয়েটি আইসক্রিম ফেলে দেয়, পাশে বসে থাকা আরেকটি বাচ্চাকে টিপ-কিনি কাটে, সবাই ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মেয়েটির সাথে থাকা মহিলাটি সম্ভবত তার মা, ভদ্রমহিলা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলেও প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে।

ফিলিপের এতক্ষণ মেয়ের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছিল, মেয়েটি ফিলিপের কাছে এসে দুষ্টামি করলে সে একটি চড় বসিয়ে দেয় মেয়েটির গালে। কথায় আছে মাইরের উপর কোন ঔষধ নেই, কথাটি সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে মেয়েটি গালে হাত দিয়ে মুখ ভার করে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।

ততক্ষণে মেয়েটির মা এগিয়ে আসলে কিছু বলতে চাইলে ফিলিপ থামিয়ে দিয়ে গর্জন করে বলে 'মেয়েকে সামলাতে পারেন না নিয়ে বের হন কেন ? '

'কিছু মনে করবেন না, আমার মেয়েটির আজ মন ভাল নেই। ওর বাবাকে আজ শীতল ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।' মহিলাটির চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে।

ফিলিপ বেশ বিব্রত হয়ে পরে। সাধারণত বৃদ্ধ মানুষ মরার সময় হলে স্বেচ্ছায় শীতল চলে যায় যাতে ঘুমের মধ্যেই মারা যায় এক সময়, অথবা যারা খুব অসুস্থ বাচার কোন আশা নেই তাদের শীতল ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করবে তখনই পরের ষ্টেশনে নেমে যায় মহিলাটি মেয়েটিকে নিয়ে।

৪.
'আপনি কি স্বেচ্ছায় এন্ডেলিন ছায়াপথের যেতে চাচ্ছেন ?' হাতা ধরে থাকা ডিভাইসে কিছু একটি চেক করতে করতে বলল একজন মহিলা কর্মকর্তা।

'জ্বি'

'আপনাকে কি কেউ এখানে যেতে প্রলুব্ধ করেছে বা বাধ্য করেছে ?'

'না'

'আপনি কি জানেন এখানে এই প্রথম আমরা কোন মানুষ পাঠাচ্ছি এবং আপনার সফর সঙ্গী শুধু একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ পোগ্রাম হবে ?'

'জ্বি' ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বলল ফিলিপ।

'এটা একটি একমুখী যাত্রা, আপনি আর এই গ্রহে ফিরে আসতে পারবেন না, আপনি কি অবগত আছেন ?'

'জ্বি'

'আমরা লটারির মাধ্যমে এই গ্রহে যাবার জন্য আবেদন আহ্বান করেছি ঠিকই, কিন্তু যত খরচ হবে তা যাত্রিকে বহন করতে হবে। এই বিপুল পরিমাণ ইউনিট ব্যয় করতে স্বেচ্ছায় রাজি আছেন ?'

'হ্যাঁ, আমি সব জেনেই রাজি হয়েছি। আমার টাকা পয়সার অভাব নেই, আলফা গ্রহের অন্যতম একজন ধনী লোক আমি তাই ইউনিট নিয়ে কোন সমস্যা নেই।' বেশ অহংকারী কণ্ঠে বলল ফিলিপ

'দুইশত নব্বই আলোক বর্ষ দূরের পথ। এই দূরত্ব যাবার জন্য হাইপার জাম্প করতে হবে।এই হাইপার জাম্প প্রযুক্তি এখনও পরীক্ষিত কোন প্রযুক্তি নয়। আমাদের বিজ্ঞানীরা পরিক্ষামূলকভাবে এটা করতে চাইছে। এতে আপনার প্রাণহানি হবার সম্ভাবনা আছে। আপনি অবগত আছে সেটা ?'

'হ্যাঁ'

'সর্বশেষ প্রশ্ন, সাধারণত আমরা ভেবেছিলাম নিঃসঙ্গ মানুষেরাই শুধু হয়ত আবেদন করবে, যাদের জীবনের প্রতি কোন মায়া মমতা নেই। আপনার যথেষ্ট ইয়ং, তাছাড়া আপনার স্ত্রী আছে! আপনি কেন যেতে চাচ্ছেন ? আপনি কি সংসার জীবনে সুখী নন ?'

এবার ফিলিপ কিছুটা রেগে গেল, গলায় যথাসম্ভব ঝাঁঝ মিশিয়ে বলল 'আপনি আমাকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছে, আলফা গ্রহের আঠারো নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোন নাগরিকের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কোন সংস্থার নাগ গলানোর অধিকার নেই।'

এবার তরুণীটি বেশ নমনীয় হয়ে বলল 'স্যার কিছু মনে করবেন না। শেষের প্রশ্নটি আমাদের লিস্টে ছিল না, এই প্রশ্নটি আমার ব্যক্তিগত ভাবে জানার ইচ্ছে ছিল। আপনি বলতে না চাইলে বলতে হবে না! '

'হুম' একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফিলিপ।

মহাকাশ ভ্রমণ খুব একটা নতুন নয় ফিলিপের কাছে, এর আগেও আশেপাশের কয়েকটি গ্রহে অবকাশ যাপন করতে গিয়েছিল। তবে এই ভ্রমণটি একেবারেই ভিন্ন, গত কয়েক মাস ধরে অদ্ভুত এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে নিজের মাঝে, জীবনটাকে একঘেয়ে লাগছে খুব।ক্যাথরিন ইতিমধ্যেই অনেকগুলো ফোন দিয়েছে, ধরতে ইচ্ছে করছে না ফিলিপের।

হঠাৎ তার মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল, অন্যমনস্ক হয়ে মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখে। একটি ছোট মেয়ে ছুটাছুটি করছে বাইরে, এখনকার কর্মিরা সবাই মেয়েটার সাথে খেলাধুলা করছে। ফিলিপের হঠাৎ মনে পড়ে মেয়েটাকে সে আজ সকালে এখানে আসার সময় দেখেছে।

'এই মেয়েটি কে ? এখানে কি করে ?' জিজ্ঞেস করল ফিলিপ।

'মেয়েটির নাম এলিনা, মেয়েটি এতিম। এলিনার যাবার কোন জায়গা নেই তাই আপাতত আমাদের এখানে এনে রেখেছি। ওর বাবা আগে আমাদের যাত্রীবাহী রকেটের ক্রু ছিল, গতকাল শীতল ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।' বলেই একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মহিলাটি।

'কেন ?'

'এলিনার বাবার মস্তিষ্কে নিউরনের রোগে ভুগছিল, সমস্ত নিউরন অকেজো হয়ে গেছে। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছে' বলেই থেমে যায় মহিলাটি

একটু সময় নিয়ে বলে 'জানেন সবাই পৈত্তিক সূত্রে সম্পত্তি পায়, দামি জিনিষ ব্যবসা পায় কিন্তু এলিনা অদ্ভুত একটি জিনিষ পেয়েছে!' মহিলাটির কণ্ঠে আবেগ ঝরে পড়ে। কণ্ঠ কেপে উঠে অদ্ভুত এক ছন্দে।

ফিলিপ অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ করল।

'ওর বাবার রোগটি ওর মাঝে ফিরে এসেছে ।'

৫.
যানের ভিতরের গ্র্যাভিটির পরিবর্তনের ফলে শরীরের মাঝে অদ্ভুত এক ধরনের পরিবর্তন টের পায় ফিলিপ। কর্ক-পিটের বসে সামনের মনিটরে তাকিয়ে আছে সে, মনিটরে ডিসপ্লেতে মহাশূন্য দেখাচ্ছে, দূরে যতদূর চোখ যায় গ্রহগুলোকে ছোট ছোট বিন্দু কণার মত পিছনে চলে যাচ্ছ দূত। যানটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ পোগ্রামের নির্দেশ অনুসারে এলোপাথাড়ি ভাবে বেশ কিছু বাটনে চাপতে থাকে ফিলিপ। ইঞ্জিনের গমগম শব্দ কানে এসে বাড়ি খায় প্রচন্ডভাবে।

' আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাইপার-জাম্প করব ' গমগমে গলায় জানান দেয় কৃত্রিম পোগ্রামটি।

ফিলিপের বুকের ভিতর কেপে উঠে, শরীরটা যথা সম্বব শক্ত করে ফেলে সে। বুকের ভিতর ধুক ধুক শব্দ করতে থাকে, নির্দেশ অনুসারে এই মুহূর্তে যা করার কথা উত্তেজনায় ভুলে যায় ফিলিপ। সামনে থাকা লাল বাটনটি টিপ মারে। কর্ক-পিটে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ পাল্টে লাইট জ্বলে উঠে।

'আপনি বার বার একই ভুল করছেন চারজন ক্রু দাড়িয়ে বলে উঠে। আর কয়েক ঘণ্টা পড়ে আপনি যাত্রা করবেন, সিমুলেশনে বার বার ভুল করছেন। ট্রেনিং এ আপনার খুব একটা মন নেই মনে হচ্ছে।'

'একটু বিরতি দিয়ে আবার করি' বলেই সিমুলেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় ফিলিপ। তার আজ সত্যিই মনটা বিক্ষিপ্ত, বারবার ক্যাথরিনের চিন্তাটা মাথায় এসে আঘাত হানছে, কিছুতেই এই রবোটিনির চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে পারছে না। মেয়েটি একের পর এক ফোন এবং মেসেজ দিচ্ছে, ফিলিপ কিছুক্ষন আগে জানিয়ে কিছুক্ষণ পর সে চলে যাবে ভ্রমণে।

সন্ধ্যা ছয়টার পর এসে হাজির হয় ক্যাথরিন ততক্ষণে এন্ডেলিন ছায়াপথের উদ্দেশ্য ছেড়ে চলে যায় মহাকাশ যানটি। ক্যাথরিনের বুকের মাঝে এক ধরনের চাপ অনুভব করে, ভিতর থেকে এক ধরনের বোবা কান্না দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে ভারি করে তোলে চারিপাশটা। হঠাৎ পিছন থেকে এক পরিচিত হাতের ছোঁয়া পায় কাঁধে, ঘুরে যা দেখে তাতে আবেগাপ্লুত হয়ে অয়ে, তার হৃদয় আর্দ্র হয়, কৃত্রিম রেডিয়ামের চোখ অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে উঠে।

ফিলিপের সেদিন আর যাওয়া হয়নি, ক্যাথরিনে ভালবাসা তাকে আটকে দিয়েছিল, ঘণ্টা দুয়েক আগে মত পরিবর্তন করলে তার বদলে আরেক জনকে নিদিষ্ট সময়ে তড়িঘড়ি করে পাঠিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় মহাকাশ সংস্থা।

'তুমি কি মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছো ? কখনও আপসোস হবে নাত এর জন্য ? আমিতো কৃত্রিম, আমার সবকিছুই কৃত্রিম !' কোমল গলায় বলে ক্যাথরিন।

না সুলভ মাথা নারায়। ক্যাথরিনের মাথায় পরম মমতায় হাত রাখে ফিলিপ। সে বুঝতে পারে ক্যাথরিনের এটা কৃত্রিম মাথা, এর ভিতর অসংখ্য ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতিতে ভরপুর, তবে ফিলিপের প্রতি তার যেই ভালবাসা সেটা কৃত্রিম নয় বরং প্রাকৃতিক এবং নিখুঁত।

এলিনা নামক মেয়েটিকে দত্তক নেয় ফিলিপ-ক্যাথরিন দম্পতি, তার সমস্ত চিকিৎসার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয় ফিলিপ। এই ছায়াপথের সমস্ত গ্রহের ডাক্তারদের নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়ে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রয়োজনে মস্তিষ্কে সমস্ত নিউরন ফেলে সেখানে কৃত্রিম নিউরন জুড়ে দিয়ে বাঁচিয়ে তোলে এলিনাকে। কৃত্রিমতা সব সময় খারাপ নয় বুঝতে পারে ফিলিপ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৮ ভোর ৬:০৭
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় প্রতারক চক্রের সন্ধানঃ সতর্ক হোন!

লিখেছেন মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৪

একটি নতুন ভারতীয় প্রতারক দল সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য এই পোস্টের অবতারণা। সবাই পড়বেন দয়া করে।

গত ২৬ মার্চ ২০২৪ তারিখে এক ভারতীয় দাদা 01677119057 নাম্বার থেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি কি কারো অবিশ্বাস নষ্ট করি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:০১




আমার কাজ হলো বিশ্বাস সুদৃঢ় করা, তাতে অবিশ্বাসী মাইন্ড খেয়ে বসে কেন? বিশ্বাসেই আমি পেয়েছি সরল সঠিক পথ। সেটাই আমি বিশ্বাসীগণকে বলছি। অবিশ্বাসী তাতে ক্ষেপে যায় কেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনের মসজিদ

লিখেছেন সাদা মনের মানুষ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:০৩


প্রচলিত রূপকথা অনুযায়ী কোন এক অমাবস্যার রাতে জ্বীন-পরীরা এই এলাকা উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এলাকাটি পছন্দ করে । তারপর তারা মাটিতে নেমে এসে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

×