বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী লেখক হিসেবে সমাধৃত, তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক। আমার প্রিয় তার অসাধারণ একটি উক্তি আছে "“আমরা সবাই পাপী; আপন পাপের বাটখারা দিয়ে; অন্যের পাপ মাপি।”"।
কবির আরো কিছু বিখ্যাত উক্তি “হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান।তুমি মোরে দিয়াছো খ্রিস্টের সম্মান।” তাছাড়া “অভাবের দিনে প্রিয় অতিথি আসার মতো পীড়াদায়ক বুঝি আর কিছু নেই। শুধু হৃদয় দিয়ে দেবতার পূজা হয়তো করা যায়, কিন্তু শুধু হাতে অতিথিকে বরণ করা চলে না।” কবিতায় বুঝা যায় কবি যথেষ্ট অর্থকষ্টে ছিলেন, শুধু শুধু-তো আর পেট থেকে এমন কবিতা বের হয় না! তবে অর্থকষ্ট তাকে প্রেম প্রীতি থেকে আটকাতে পারেনি, যেমন “তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন, সে জানে তোমারে ভোলা কি কঠিন।” এবং “প্রেম হল ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন।” প্রেম নিয়ে কবির বানী প্রমাণ করে কবি একজন পোড়-খাওয়া প্রেমিক।
কবি নজরুল যে শুধু প্রেম প্রতি নিয়েই থাকতেন তা নয়, অনেক অনুপ্রেরণামূলক কবিতাও প্রসব করেছেন তিনি, আমরা অনেকেই ছোট বেলায় এই কবিতাটি পড়েছি, “আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে।” কবি নজরুলের আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কেও ভাল ধারনা ছিল বা খোজ খবর রাখতেন নিশ্চয়ই তাইতো লিখেছেন “বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।” তবে কবি নজরুল সবচেয়ে বেশী পরিচিত বিদ্রোহী এবং সাম্যের কবি হিসেবে, তার সেই বিখ্যাত উক্তি “মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত। যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।”
মৃত্যু নিয়েও কবি ভেবেছে তাইতো পেট থেকেই বেড়িয়েছি এমন কবিতা, “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।”
যাইহোক আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু কবি নজরুল নয়, তাকে নিয়ে লেখার জন্য অনেক পণ্ডিত এবং হেভি-ওয়েট লেখক আছেন। আমার লেখার বিষয়বস্তু যে কি নিজেও খেই হারিয়ে ফেললাম দেখি, আমার অবস্থা হচ্ছে "তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেন কি?, বসন্ত কালে তোমায় বলতে পারিনি" । গানটি আণ্ডা-বাচ্চা যুবা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই বেশ লুফে নিয়েছে, হয়ত অনেকে জীবনের সাথে কিছুটা মিল পেয়েছেন তাই। আসলে গান বাজনা হোক বা অন্য কিছু যদি তা জীবনের কথা বলে, নিজেকে কো-রিলেট করতে পারে মানুষ সেটা অনেকদিন বেচে থাকে!
কি লিখতে চাইলাম আর কি লেখছি, আমার চোখে এখন "সাধা সাধা কালা কালা রং জমেছে সাধা কালা"! যাইহোক কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মেয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন হল এতে আমি আনন্দিত এবং খুশি। মেয়ে মানুষ দেখতে আমার ভাল লাগা, পাঠকরা আমাকে ভুল বুঝবেন না, অনেক নারীবাদীরা তেড়ে আসতে আরে আমার এই বাক্য পড়ে, তাই আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলছি, সব দোষ কবির, কবি বলেছেন "তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, একি মোর অপরাধ?"! ইয়ে মানে আমি শুধু কবির সাথে সহমত বললাম আরকি।
যাইহোক মূল প্রসঙ্গে আসা যাক, মেয়েদের এই সাফ জয়ে জনতা দুই ভাগে বিভক্ত, কেউ প্রাণ খুলে অভিবাদন জানাচ্ছে, আবার অনেকেই কমেন্টে তুমুল প্রতিবাদ করছে, যারা এর বিরুদ্ধাচরণ করছে তাদের যুক্তি হল ইসলামিক হুকুমত মতে ঠ্যাং দেখানো নাজায়েজ। আমি একজনকে চিনি সে গান বাজনা করে, কভার ফটোতেও গিটারের ছবি, মাঝে মাঝে নিজের গান বাজনা ফেইসবুকে আপলোড দেয়। গায়ক সাহেব অত্যন্ত নাখোশ হয়েছেন মেয়েদের এই জয়ে, তিনি তীব্র ভাষায় কমেন্ট করলেন মেয়েদের খেলাধুলার বিপক্ষে। তার ভাষায় মেয়েদের ঠ্যাং দেখানো ঠিক না, কেয়ামতের দিনে সব থেকে বেশী জাহান্নামী হবে মেয়েরাই, শুধু তাই না তার ভাষায় আমরা ছিলাম জান্নাতের অধিবাসী, এই নারীদের জন্যই এই পৃথিবীতে এখন আমরা। অর্থাৎ এই গায়ক সাহেবের ভাষায় "মেয়েদের ঠ্যাং দেখানো নাজায়েজ তবে গানবাজনা ঠিক আছে।"
জৈনিক এক বক্তা দেখলাম তীব্র বয়ান দিচ্ছে, "গান বাজনা হারাম, হারাম এবং হারাম"। শুধু এই বক্তাই না মোটামুটি এমন কোন বক্তা পাওয়া যাবে না যারা গান বাজনার পক্ষে বলবে। যাইহোক কোনটা হারাম আর কোন হালাল সেটাও আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়, আমি বললাম না আমার অবস্থা হচ্ছে "তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেন কি?"। এই বক্তার ভাষায় গানবাজনা হারাম তবে ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করা ঠিক আছে। এরা ফিকাহর এবং কিতাবের ফাঁক ফোকর দিয়ে যুক্তি দিয়ে বলে ইসলামিক হুকুমত প্রচারের জন্য এগুলো জায়েজ। এই বিষয়ে সময় নিউজের রিপোর্টে দেখলাম, দেওবন্দের ফতোয়া বলে ভিডিও নয় অডিও প্রচার করা যাবে, তবে বক্তারা সেই পথে হাঁটবে না কারণ তাতে ভিউ কম আসবে!
অনেক বক্তাদের ইউটিউব চ্যানেল আছে, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারে একাউন্ট আছে। তারা বেশির ভাগই চড়া মূল্য নিয়ে ওয়াজ করেন। নিজের ভিডিওর নিদিষ্ট কিছু অংশ নিজের ফেইসবুক এবং ইউটিউবে ছাড়েন, এতে ভিউ বেশী হয়, বিজ্ঞাপন থেকেও ভাল টাকা আসে। অনেক সময় ওয়াজের মাঝে মদ-তারির এবং আজে বাজে বিজ্ঞাপনও চলে আসে, তবে এতে সমস্যা নেই! পবিত্র কোরানের সূরা নূরে আছে, "মুমিনদের মাঝে যারা অশ্লীলতা প্রচার করে তাদের দুনিয়াতে এবং আখেরাতে আছে কঠিন শাস্তি "। যাইহোক হোক মুল বক্তব্য হচ্ছে এই বক্তা মেনে নিচ্ছেন "গানবাজনা করা যাবে না তবে ভিডিও করা যাবে, নিজের ছবি আপলোড করা যাবে তাতে মদ-তারির বিজ্ঞাপন আসলেও করার কিছু নেই।"
আমার পরিচিত একজন বলল, জৈনিক এক ব্যক্তি নাকি মেটাতে মানে ফেইসবুকে চাকরী পেয়েও চাকরিতে জয়েন করেন নাই কারণ মেটাতে বা ফেইসবুকে মদ-তারির বিজ্ঞাপন দেখা যায়। ফেইসবুকে শতশত ইসলামিক ভিডিও, অডিও আছে ইসলামিক হুকুমত প্রচারের জন্য। অনেক সমাজ কল্যাণমূলক কাজ, দেশের দুর্দিনে এবং বড় কোন দুর্যোগের খবর আমরা ফেইসবুকের মাধম্যেই পাই বেশীর ভাগ। অনেক দরিদ্র মানুষের জন্য সরাসরি ফেইসবুকের মাধ্যমে দিনার দিয়ে সাহায্য করা যায়। যেই মাধ্যমে ব্যাবহার করে ইসলামিক প্রচার হয় সেই মাধ্যমে চাকরী করে সেটাকে উন্নত করা যাবে না কারণ এখানে মদ-তারির বিজ্ঞাপনও দেখানো হয়! ভদ্রলোক আমি যতদূর জানি পশ্চিমা দেশে থাকে। তার সমালোচনা আমার উদ্দেশ্য নয় শুধু মাত্র এটা যার যার ব্যাক্তি স্বাধীনতার বিষয়, আমি কে হে বাধা দেবার!
জাকির নায়েকের একটি ভিডিও দেখলাম তিনি হাদিস কোরান দিয়ে সরাসরি সূরা নিসার ৯৭ এবং ৯৮ আয়াত দেখিয়ে বললেন পড়াশুনার এবং দাওয়ার কাজ ছাড়া বিদেশ থাকা যাবে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তানের ইত্যাদি দেশের নাম নিয়ে সরাসরি বললেন এসব দেশ থেকে মানুষ বেটার লাইফের আসায় পশ্চিমে সেটেল হওয়া জন্য যায়, এগুলো সম্পূর্ণ নিষেধ। যাইহোক আমি পশ্চিমা দেশে থাকার ব্যাপারে আরও কিছু পড়াশুনা করলাম, ইসলামিক ভিত্তিক এক সাইটে দেখলাম, তারা বিভিন্ন প্রমাণ করল পশ্চিমা দেশে থাকা যাবে তবে কিছু শর্ত আছে, নিজের বিশ্বাসে অটল থাকতে হবে, ঈমান হারা হওয়া যাবে না ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। সেই ভদ্রলোকের কাছে "পশ্চিমা দেশে থাকা যাবে তবে এই মেটাতে চাকরী করা যাবে না কারণ সেখানে হারাম বিজ্ঞাপন দেখানো হয়।"
কিছুদিন আগে এক ভিডিও দেখলাম, একজন সরকারী অফিসার ঘুষ নিচ্ছে প্রকাশ্যে। সেই অফিসার বয়সে পোঢ, মুখে দাড়ি , কপালে নামাজে কালো দাগ! দেখলে মনে হয় দরবেশ। এই লোকের কাছে হয়ত নামাজ পড়তে হবে, দাড়ি রাখতে হবে তবে ঘুষ নেয়া যায়! সেদিন চিত্র নায়িকা বর্ষার ইন্টারভিউ দেখলাম, সে বলছে আমি মুসলিম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। বর্ষার কাছে হয়ত নামাজ পড়তে হবে তবে সিনেমাতে বেলি-ড্যান্স দিলে সমস্যা নাই!
যাইহোক এই লেখার বিষয়বস্তু ধর্মীয়-ভাবাবেগ নিয়ে নয়, এমনকি কাউকে সমালোচনা করাও নয়। আমরা আসলে ব্যক্তি পর্যায়ে নিজেদের জন্য নিজেরাই কিছু সীমানা দাড় করিয়েছি আমরা কতটুকু ধর্ম মানব এবং কতটুকু ছাড় দিব। অর্থাৎ আমাদের সবারই ব্যক্তি পর্যায়ে ধর্ম মানার ক্ষেত্রে কিছু স্কেল বা বাটখারা আছে। কেউ হয়ত পাচ-ওয়াক্ত নামাজ পরছে, তবে ব্যাংকে চাকরী করছে। ব্যাংকের উদাহরণ দিলাম এর জন্য যে ব্যাংক চাকরী করা নিয়ে ইসলামিক হুকুমতে বাধানিষেধ অথবা মতবেদ আছে। আবার অনেকে ব্যাংকে করছে না ধর্মীয় কারনে তবে শুক্রবারে বা মাঝে মধ্যে নামাজ পরছে।
আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু স্কেল বা বাটখারা আছে। আমাদের মূল দণ্ডটা হয় তখনই যখন আমরা নিজেদের স্কেলে দাঁড়িয়ে বা নিজেদের বাটখারা দিয়ে যখন অন্যের পাপ পূর্ণ মাপতে যাই। আসলে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয় সম্প্রদায় পর্যায়েও কিছু স্কেল আছে, আমি সেই বিষয়ে বিস্তারিত যেতে চাচ্ছি না। এক স্কেল দিয়ে আরেক স্কেল দিয়ে মাপতে গেলে মাঝে মাঝে সংঘাতও হতে পারে। যেমন পাকিস্তানের হাজেরা সম্প্রদায়ের লোকেরা যেমন হামলার লক্ষ বস্তুতে পরিণত হয়েছে সেটাও দেখা যাবে এক সম্প্রদায় নিজের স্কেল দিয়ে আরেক সম্প্রদায়কে মাপার ফলেই!
আমি অবশ্যই নিজেকে ধার্মিক হিসেবেই মানি তবে আমারও নিজস্ব কিছু স্কেল আছে! আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে আমরা নিজেরা নিজের স্কেল দিয়ে আরেকজনকে মাপছি নাতো!! প্রশ্ন উঠতে পারে আমরা কি তাহলে কেউ অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করতে পারব না? অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে তবে এখানে বিষয় বহির্ভূত একটি কথা বলি, আমি আর্টিফিসিয়াল ইইন্টেলিজেন্ট দিয়ে চোখের রোগ নির্ণয় বিষয়ে কাজ করছি বর্তমানে, আমি আর আমার সুপারভাইজার কিছু হাইপোথিসিস নিয়ে এগুচ্ছি, আমার সুপারভাইজার বলল যদি আমাদের হাইপোথিসিস মিলে তাহলে আমরা উচ্চস্বরে গলা উঁচিয়ে পেপারে নিজেদের আর্গুমেন্ট দিব আর যদি পুরোপুরি না মিলে তাহলে গলা নামিয়ে কথা বলব অর্থাৎ মিউ মিউ করব! যাইহোক নিজের আত্মজীবনী পাঠ বন্ধ করা যাক, আমরা প্রত্যেকে নিজেদের স্কেলে আছি, তাই অন্যকে সমালোচনা করতে হবে মার্জিত-ভাবে, শালীন-ভাবে।
আমাদের উপমহাদেশে সামগ্রিকভাবে এত সমস্যার কারণ হচ্ছে আমরা আসলে প্রত্যেকেই অনেক বেশী জাজমেন্টাল, কে কি করল, কেন করল ইত্যাদি আমরা চাই প্রত্যেকে আমাদের-মত হোক, নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর চাপাতে ভালবাসি মানে সবাইকে নিজের-বাটখারা দিয়ে মাপতে চাই বা নিজের স্কেলে নামিয়ে আনতে চাই।
বিভিন্ন মতের এবং ধরনের মানুষ নিয়েই আমাদের এই গ্রহ। আমরা সবাই ভিন্নমতের সহ-অবস্থান মেনে নিয়ে সহনশীল হলে এই গ্রহ আরও সুন্দর হয়। কি লেখতে কি লেখলাম কে জানে, আমার অবস্থা "তুমি বন্ধু কালা পাখি, আমি যেন কি? বসন্ত কালে তোমায় বলতে পারিনি।" সম্প্রতি এই গানটি আমার প্রিয় গানের তালিকায় আছে, মুগাম্বার খুশ হুয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০২২ সকাল ৯:৪৩