ধরুন পৃথিবীতে কেবলমাত্র একটি মেয়ে বেঁচে আছে। পুরো পৃথিবীতে কেবলমাত্র একটিমাত্র মেয়ে। সে মেয়ে দেখতে খুবই কুতসিত। মাথায় চুলের পরিমান খুবই কম। উচ্চতা হয়তোবা টেনেটুনে চার ফুটের বেশী হবেনা । দাতগুলোও খুব বিশ্রী।গায়ের রঙ একেবারেই কালো। আর খুবই স্থুলাকার তার শারিরীক গঠন। সব মিলিয়ে সে একেবারেই সুন্দরের ধারেকাছ দিয়েও যায় না।
এরকম যদি পরিস্থিতি হয়, তবে দেখবেন সে মেয়েটিকে পাবার জন্যে পৃথিবীর বড় বড় বাদশাহ পর্যায়ের মানুষেরা রাজপ্রাসাদ বিক্রি করতে রাজি থাকবে। নিজের চোখ খুলে হাতে তুলে দিতে বললেও হাজার হাজার যুবক নিজের চোখদুটো খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। সে মেয়ের যখন কোন রাজপ্রাসাদ বিক্রি করা বাদশাহ এর সাথে বিয়ে হবে, তখন দেখবেন সেদিন লক্ষ লক্ষ যুবক একযোগে আত্মহত্যা করবে।
আবার ধরুন আপনি পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলে। আপনিও দেখতে ভাল না একদমই। মাথায় কোন চুল নেই আপনার। আপনি দেখতেও খুবই কালো। স্থুলাকার শরীর আপনার। আপনি যখন কথা বলেন, তখন আপনার দাতগুলোও হলুদ দেখতে পায় মানুষ। আপনার একটি পা নেই। ক্রাচের উপড় ভর করে আপনাকে হাটতে হয়। আপনার গায়ের রক্তও দূষিত। ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে আপনাকে ঘুরে বেড়াতে হয়।
সেরকমটি হলেও দেখবেন পৃথিবীর আগুন ঝলসানো সব সুন্দর মেয়েগুলো আপনাকে নিয়ে লিখা অজস্র কথা দিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ রাত জেগে জেগে ডায়রীর পাতা শেষ করবে। আপনি বিশ্রীভাবে দুপুরবেলায় ডাল দিয়ে ভাত ভিজিয়ে প্লেটশুদ্ধ চেটেপুটে খেলেও তারা পরম মুগ্ধতায় সে দৃশ্য দেখে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে পারবে। আপনি শরীরে ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে ঘোরেন এটি জানামাত্রই হাজার হাজার মেয়ে আপনাকে পাবার জন্য নিজের শরীরের পুরো রক্তটুকু আপনার গায়ের রক্তের সাথে অদল বদল করতে চাইবে। আপনার দূষিত রক্ত নিজের শরীরে নিয়ে মরে হলেও সে আপনাকে বাঁচিয়ে যাবার একটি চেষ্টা করবে। অজস্র অজস্র মেয়ের মাঝ থেকে যেদিন আপনি পছন্দের কোন হাত ধরবেন, সেটি জানামাত্রই লক্ষ লক্ষ মেয়ে একযোগে মূর্ছা যাবে। অজস্র মেয়ের আত্মহত্যার লাশ দিয়ে পৃথিবী ছেয়ে যাবে।
এবার ধরুন, পৃথিবীতে শুধুমাত্র দুজন মানুষ।একজন হচ্ছেন আপনি, আর অন্যজন হচ্ছে সেই বিশ্রী মেয়েটা। পুরো পৃথিবী জুড়ে আর কেউ নেই।কোথাও আর কেউ নেই... কি ঘটবে তখন ? তখন আপনি তাই করতে রাজি থাকবেন, যেটি পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ যুবক এই বিশ্রী মেয়েটিকে পাবার জন্য করেছিলো। আপনার নিকট একটি মহাদেশ পরিমান বড় রাজপ্রাসাদ থাকলে তার বিনিময়ে হলেও আপনি ওই বিশ্রী মেয়েটির হাত কখনোই ছেড়ে দেবেন না।
আর ওই বিশ্রী মেয়েটিও আপনার কুতসিত হাত থেকে নিজের হাতটি ছাড়িয়ে নেয়ার দুঃসাহস দুঃস্বপ্নেও দেখাবেনা। কারন সে ভালকরেই জানে, আর কোন হাত নেই এই পৃথিবীটায়।একবার হাত ছাড়িয়ে নিলে একা হাটতে হবে। পুরোটা জীবন একা হাটতে হবে, যেখানে কোথাও কেউ নেই। একেবারেই কেউ নেই... আপনার কুতসিত হাতটি ধরে রাখার জন্যে সে এবার ওই মেয়েগুলোর মতই আচরন করবে।গায়ের পুরো রক্ত বদল করে হলেও সে আপনার হাতটি জীবন্ত রেখে যাবে।
মোটকথা আপনারা দুজনকে এতটা ভালবাসবেন, এত্তটাই ভালবাসবেন, যে মুগ্ধতার ঘোরে দিনরাত কখন পাড় হয়ে যাচ্ছে সেটি আপনাদের খেয়ালে ধরা পড়বেনা.. হয়তোবা আদম হাওয়ার ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিলো..
ভালবাসা সম্পর্কে কোথায় যেন হুমায়ূন আহমেদ এর একটি থিওরী পড়েছিলাম। আমার মতে সেটিই সবচাইতে উপযুক্ত থিওরী।
সৃষ্টিকর্তা যখন একজোড়া মানুষ সৃষ্টি করেন , তখন তিনি একটি ডিজাইন তৈরী করেন। সে ডিজাইনটি হয় অসম্ভব রকমের সুন্দর। যে সৌন্দর্য যেকোন মানুষকে মোহিত করতে যথেষ্ট। এরপর তিনি ওই ডিজাইনটিকে ছিড়ে দু খন্ড করে ফেলেন। ছেড়া ডিজাইনটির একখন্ড দেন ছেলেটির হাতে, আর অপর খন্ডটি দেন মেয়েটির হাতে। এরকম অসংখ্য অসংখ্য ডিজাইন তিনি অসংখ্য অসংখ্য ছেলে মেয়েদের মাঝে দুখন্ড করে করে দিয়ে দেন। এরপর তাদের সবাইকে দুনিয়ায় ছেড়ে দেন।
ছেলেটি জীবনের অনেকটুকু সময় খরচ করে সে মেয়েটিকেই খোঁজে যার কাছে ডিজাইনটির অপর অংশটি আছে। মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কেউই সে মানুষটিকে পায়না। পায় অন্য কারো ডিজাইনের খন্ডিত অংশ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে। পরে উপায় না দেখে তারা খুঁজে দেখে তাদের হাতের ডিজাইনটির সাথে অন্য কার ডিজাইনের খুব মিল। কারো সাথে মিল খুঁজে যদি খুঁজে পায়, তবে তার সাথেই জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। যেটুকু মেলেনা সেটুকুতে দুজন মিলে আঁকিঝুকি করে মিলিয়ে নেয়।
আপনি যদি পৃথিবীর একমাত্র কুতসিত ছেলেটি হন, আর আপনার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি যদি একমাত্র কুতসিত মেয়েটি হয়, তাহলে আপনাদের দুজনের সাথেই দুজনের হাতের খন্ডিত ডিজাইন খুব ভালভাবে মিলে যাবে, আঁকাঝুকির কোন প্রয়োজন হবেনা।কারন কোথাও কেউ নেই। শুধু আপনারা দুজনই।ডিজাইনের খন্ডিত টুকরোও দুটোই থাকবে।
কিন্তু পৃথিবীটি সেরকম নয়। অজস্র মানুষ অজস্র খন্ডিত ডিজাইনের টুকরো নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনাকে তাই আঁকাঝুকির কাজটুকু ভালকরে শিখতে হবে। ডিজাইন মিললে ভাল, যদি না মেলে তবুও যেন মিলিয়ে ফেলা যায়...
পৃথিবীতে এমন অজস্র মানুষ রয়েছে, যারা এই আঁকিঝুকির কাজটুকু করতে না পারার জন্যে অন্য খন্ডিত অংশটি না পাবার আফসোস নিয়ে পুরোটা জীবন কাটিয়ে দেয়। সে আফসোসে খুব একটা লাভ হয়না। এত এত কোটি কোটি খন্ড খন্ড ডিজাইনের ভীড়ে আপনার কাঙ্খিত ডিজাইনটি কিভাবে বের করবেন! লটারীর আশায় কখনো জীবন চলেনা।
আঁকাঝুকি করে ডিজাইন মিলানোর কাজ শেখাটাই তাই নিরাপদ... সে কাজটি যদি না পারেন, তবে কোন একদিন একই ছাদের নিচে দুজন ঘুমাবেন, কিন্তু দুপাশে মুখ করে। দুজনের মাঝে মাত্র এক ফুটের মত দুরত্ব থাকলেও দুজন দুই মহাবিশ্ব সমান দুরত্বে থেকে যাবেন... এরকম মানুষের সংখ্যাও প্রচুর..
হয়তো তাদের মধ্যেই অনেকে অন্যপাশে মুখ করে ফোনটা হাতে নিয়ে আমার এই কথাগুলো পড়ছে.. এই কথাগুলো পড়তে হতনা, যদি তারা আঁকাঝুকির কাজটি জানতো। তখন আর এই মাঝরাতে ফোন হাতে নিয়ে জেগে থাকা হত না, পাশের মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা হত...
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৫৭