একুশের বই মেলা মার্চ ১৮ থেকে শুরু হয়েছে। চলবে এইপ্রল(April) ১৬ পর্যন্ত।
বাংলা একাডেমি পরিবেশিত তথ্যানুযায়ী, ২০২০ এর বই মেলায় প্রায় পাঁচ হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়েছিল এর মধ্যে রাজনীতি নিয়ে ১৩, ধর্মীয় বিষয়ে ২০, নাটক ৩৪, স্বাস্থ্য বিষয়ক ৩৬, রম্য রচনা ৪০, অনুবাদ সাহিত্য ৫৭, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ৬৭, ভ্রমণ কাহিনি ৮২, বিজ্ঞান বিষয়ে ৮৩, ইতিহাস নিয়ে ৯৬, ছড়ার বই ১১১, গবেষণামূলক ১১২, এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৪৪টি বই ছিল। এর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা, 'আমার দেখা নয়া চীন' বইটি ৫০ হাজারেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে বলে শুনেছি।
পৃথিবীর কোনও রাস্ট্রে ঠিক এই সময়ে, মার্চ ২০২১, দিনব্যাপী জনসমাবেশের নজির নেই। মাসব্যাপী আয়োজন তো আলোকবর্ষ দুরের কথা। বাংলাদেশ কেন এই সুদুরের পেছনে ছুটছে তার কোনও ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনও কেউ মনে করেননি। জবাবদিহিতার মুখোমুখি না হওয়ার সম্ভাবনা ও ক্ষমতা থাকলে প্রজাতন্ত্রের কুশীলবরা এমনই দুর্দমনীয় হন।
আমি নিজেই তাই এর কিছু ব্যাখ্যা খুঁজতে চেয়েছি।তার আগে কয়েকটি চলতি খবর জেনে নেই।
'বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের হার আবারো উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে'।
-- স্বাস্থ্য বিভাগ
‘গত ১৫ দিনে অন্তত ২০ লাখ লোক কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটিতে ঘুরেছে। কেউ মাস্ক পরেনি। মাস্ক ছাড়া বিয়ে–শাদিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে'।
-- স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক
'করোনার সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষাপটে দেশের সব হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে'।
-- স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক
'চলমান পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ খুলে না দেবার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা'।
-- একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল(নাম মনে পড়ছেনা), মার্চ ১৬
'করোনার কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে'।
-- ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক
'এই মুহূর্তে লকডাউন ঘোষণার কোন সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা'।
-- একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল(নাম মনে পড়ছেনা), মার্চ ১৬
এত সব সাবধানবাণীর মধ্যেও আমাদের সব উদোম করে দেয়ার এই বেদম ইচ্ছে কেন হলো?
মেলার পক্ষের কেউ বলছেন, (১) বইমেলা যে হবেই তা অনেক আগের প্ল্যান। এত যোগাড় যন্ত্রের পর তো সেখান থেকে এখন পিছু হটে আসা যায় না। (২) কোটি টাকার আয়োজন, বিশাল ক্ষতির সম্ভাবনা, আত্মহত্যাও করে বসতে পারেন সংশ্লিষ্টদের কেউ। (৩) এই সময়েই যে আবার করোনার প্রকোপ বেড়ে যাবে সেটাই বা কে বুঝেছিল?
এগুলো কোনও যুক্তি হলো না। বিপদ সম্পর্কে যখনই জানা যায় তখনই সাবধান হতে হয়। তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে হয় catastrophe থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
২০২০ এর মার্চের কথা কি আমরা ভুলে গিয়েছি? জন্মশতবার্ষিকীর জন্য কী খেলাটিই না খেলা হলো! তরতর করে জীবাণু ঢুকছে আর আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বালিতে মুখ ডুবিয়ে পশ্চাৎদেশ উঁচিয়ে করোনার আক্রমণ ঠেকাচ্ছেন। করোনা নামের একটি জিনিসের যে অস্তিত্ব আছে, তা ই স্বীকার করতে চাননি। জোরপূর্বক হ্যাপি বার্থডে উপভোগ করাতে চেয়েছেন সমস্ত বাংলাদেশকে একটি বৈশ্বিক আনহ্যাপি সময়ে।
এই খেলার পরিনাম আমরা পরবর্তীতে ভালোভাবেই টের পেয়েছি। তথ্য লুকোচুরির সান্ধ্যকালীন লাইভ দেখেছি। অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির চুড়ান্ত দেখেছি। মন্ত্রী, ডিজিদের মোটা মাথা ও পাতলা ঠোঁট দেখেছি। ভেজাল মাস্কের ব্যবসা দেখেছি। পিপিই নামের 'ওয়ান টাইম ইউজ' রেইনকৌটের বাঁদরামী দেখেছি। হাসপাতালে, ক্লিনিকে চিকিৎসা না পেয়ে সাধারণ রোগীও মরতে দেখেছি। ভুয়া চিকিৎসা, সার্টিফিকেটের সাহেদ ও সাবরিনাদের দৌরাত্ম্যে মানুষকে হাঁসফাঁস করতে দেখেছি। চিকিৎসক, নার্স, পুলিশকে সাক্ষাৎ যমদূত এর সামনে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে দেখেছি। অমূল্য, অসংখ্য প্রাণ ঝরে যেতে দেখেছি।
আপনি আমার লেখাকে ঘৃণা করুন বা যে রাজনীতিই করুন, এক বারের জন্য দলাবদ্ধতা থেকে বের হয়ে এসে বুকে হাত রেখে বলুন, আপনি দেখেননি। বলুন, আপনার স্বজন, বন্ধু, বা পরিচিত কেউ এই সরকারি হঠকারিতার শিকার হননি।
একটি প্রয়াত প্রাণ হয়তো আপনাদের কাছে কেবলই একটি মৃত্যু, কিন্তু এই একটি মৃত্যুতে একটি পরিবারের প্রাণ হারিয়ে যেতে পারে।
এর দায় কি শুধুই কোভিড ১৯ এর?
নেতাদের হতে হয় স্মার্ট ও দুরদর্শি। স্মার্ট মানে কলপ দেয়া গোঁফের সাথে কড়া মেইকআপ ও আনকোরা ভাঁজের কালো কৌট বা সাফারি পড়া চকচকে জুতার রোবট না। স্মার্ট নেতাকে জানতে ও বুঝতে হবে চারপাশে কী ঘটছে। কী ঘটতে পারে তা ধারণা করতে হবে, সেই অনুযায়ী ভবিষ্যত উপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। নিদেনপক্ষে সততার সাথে ভুলটি স্বীকার করতে হবে। আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। একটি ব্যর্থতায় সব শেষ হয়ে যায়না।
কিন্তু আমাদের নেতারা মুজিব কৌট স্মার্ট। উনারা জেনে গিয়েছেন যে মুখে যত মুজিব, পকেটে তত মানি(money)। উনারা শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি পণ্যে রূপ দিয়েছেন। মুজিব কৌট সেই পণ্যের লাইসেন্স। যত অন্যায়ই কর, মুজিব কৌট জড়িয়ে নিলেই সব অদৃশ্য। কী তেলেসমাতি! তাই করজোড়ে মাফ চেয়ে, 'একটিবারের জন্য সুযোগ' চেয়ে ক্ষমতায় এসে কোনও দিন প্রাণ থাকতে ক্ষমতা থেকে সরবেন না বলে এই নেতারা প্রতিজ্ঞা করেন। 'চিনা গনতন্ত্রের' যে টেক্সটবুক প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি তাতে আপনাদের সহসাই সরাতে পারে ক্ষমতা থেকে, তেমন কোমর, পেশী, বা মস্তিষ্ক আছে এমন কারোই আর অস্তিত্বও দেখি না। তাহলে, আর একটি বছর পরে এই শতবার্ষিকী পালন করলে কী সমস্যা হতো? কেন জোর করে সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে হবে? নাকি দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে চাইছেন। বই মেলাও কি আরেকটি ডাইভারশন প্রজেক্ট?
কত কোটি মানুষ মাসব্যাপী বইমেলা থেকে উপকৃত হয়? বইমেলার সাথে সরাসরি যুক্ত কত লক্ষ মানুষ? একটি একুশের বই মেলায় বই বিক্রি করে সারাবছর সংসার চালানোর সক্ষমতা আছে কত হাজার লেখক বা প্রকাশকের? তাদের সংখ্যা কি গার্মেন্টস কর্মীদের চাইতে বেশি?
আপনারা সবল গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের ৫০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দিতে পারেন অথচ 'গরীব', 'ভুখা নাঙ্গা' ৫২২টি (মেলায় স্টলের সংখ্যা) প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন না? আপনাদের ভবিষ্যতের জন্যই তো এটা একটা ইনভেস্টমেন্ট হতে পারতো। নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেও মিথ্যাচার করা লাগতো না।
এই ২০২১, ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ধিত আকারের সংক্রমণ মোকাবিলায় আবার নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দেশে সীমিত আকারে এবং প্রকারে(১০-১০০ জন) সমাবেশের অনুমতি দেয়া হচ্ছে এবং এর যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে তারপরও নতুন সংক্রমণের ঢেউ আটকে রাখা যাচ্ছে না। এই ঢেউয়ের সকল লক্ষণ এবং উদাহরণ বর্তমান থাকা সত্বেও আমাদের সরকার দেশি-বিদেশি অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়েছে।
অনেকেই মত দিচ্ছেন যে, দলবেঁধে ভ্রমণ চলছে, বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে, সভা চলছে, জন্মদিনের অনুষ্ঠান হচ্ছে, বিসিএস পরীক্ষা হচ্ছে, স্টেডিয়ামে দিনব্যাপী জনসমাবেশের আয়োজনও করা হচ্ছে, তবে বইমেলায় সমস্যা কেন?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে কিছু তাত্বিক বিষয় জানা দরকার।
প্রথম কথা হচ্ছে, যা হচ্ছে, পরিস্থিতির বিচারে সবই অনৈতিক ও অন্যায় আচরণ। অন্যায়কে অনুসরণ করার খায়েশে দেখাটাও অন্যায়। ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধ। একটি অন্যায়কে উদাহরণ মেনে আরেকটি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। একটি অনৈতিকতার ঘটনা সামনে এনে আরেকটি অনৈতিকতায় সম্মতি দেয়া যায় না। যদি কেউ দেয় তবে অন্য কৃত অন্যায় ও অনৈতিকতাকে বৈধতা দেয়া হয়।
দ্বিতীয়ত, মানুষ তার ভুল থেকেই শিখে। ভুল স্বীকারে অস্বস্তি থাকা উচিত নয়।
তৃতীয়ত, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বুক ফুলিয়ে অন্যায় করতে পারার নাম ফ্যাসিবাদ। এতে যারা অন্যায় দেখেন না তারা নিঃসন্দেহে ফ্যাসিস্ট সিম্প্যাথাইযার(fascist sympathiser).
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০২১ সকাল ৮:০১