somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কর্তৃপক্ষ কোনও রেকর্ড খুঁজে পায়নি - একটি অশরীরী অভিজ্ঞতা

১৭ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র কারিকুলাম ডিভালাপারদের তিনদিনের সম্মেলনে যোগ দেয়ার ইনভিটেয়শ্যন(invitation) যখন পাই তখন হাতে দু সপ্তাহ সময় আছে। প্ল্যান করার জন্য সময়টা একটু টাইট। তবে চিঠিতে বলে দিয়েছে যাওয়া আসার এবং থাকা খাওয়ার খরচ কর্তৃপক্ষ বহন করবে এবং টিকিট কনফার্ম করার জন্য নির্দেশিত agent এর সাথে যেন সত্বর যোগাযোগ করি। ভেরি গুড। কাজটা একটু সহজ হয়ে এলো।

লম্বা দুরত্বে ট্রেইন জার্নি আমার খুব পছন্দের। হাত পা মেলে, হেঁটে, ফিরে প্রকৃতি দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। অবশ্য ক্যানাডায় ট্রেইন ভ্রমণ বেশ ব্যায়বহুল। ইয়োরোপে বা এশিয়ারই অনেক দেশে ট্রেইনে ভ্রমণ যেমন সময় সাশ্রয়ী ও পকেটের জন্য স্বস্তিকর ক্যানাডায় সেরকম না। আগে থেকে ট্রাভেল প্ল্যান না করলে বা কোনও ডিল(deal) না পেলে টিকিটের দামটা অযৌক্তিক মনে হতে পারে। তাই আমরা অগ্রীম প্ল্যানকে খুব গুরুত্ব দেই।

টরন্টো টু ওইনিপেগ। খবর নিয়ে দেখলাম ২০০০ কিলোমিটার দুরত্ব ট্রেইনে যেতে লাগবে ৩৭ ঘন্টা, স্লিপার ক্যাবিনে(sleeper cabin) টিকিটের দাম প্রায় ৫০০ ডলার(এখন $৭০০)। হুম।

চিঠিতে কর্তৃপক্ষ দুইরাত তাঁদের খরচে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছে, তার সাথে আমি আরও একরাত যোগ করে agent মারফত ঝটপট প্লেইনের টিকিট কেটে নিলাম। হোটেল বুক করলাম। দুই দিনের জন্য একটা রেন্ট এ কারও কনফার্ম করলাম।

এটাই আমার প্রথম ওইনিপেগ, ম্যানিটোবা যাত্রা।

সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ওয়ার্কশপ। সকালে ১০ মিনিটের চা বিরতি, দুপুরে ৪৫ মিনিটের লাঞ্চন(luncheon), বিকেলে আবার ১০ মিনিটের বিরতি। বাকি সময়টা খুব ব্যস্ত। একের পর এক টপিক নিয়ে আলোচনা, ব্রেইনস্টর্মিং, রিভিউ, প্রেজেন্টেয়শ্যন, ডিসপ্লে, আবার নতুন টিম, আবার নতুন আইডিয়াজ। দম ফেলার সময় ওই চা বিরতিতে। দম নিতে চাইলেও তাই।

দিন শেষে কেউ হোটেলে ফেরে। রিল্যাক্স করে। কেউ ঘুরতে যায়। ডিনারে দেখা হয়ে যায় কারো সাথে আবার। রাতে লাউঞ্জ বা বারে সময় কাটায় কেউ।

আমার তখন প্রতিদিন জগিংয়ের অভ্যাস। রোদ, বৃষ্টি, ঝর, স্নৌ, বা ভ্রমণ, দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। সপ্তাহে তিনদিন পার্কে জগিং করি। পার্কও দেখা হয়। ঘামও ঝরে।

ওইনিপেগে এসে প্রথম বিকেলেই অ্যাসিনিবয়েন পার্কে গেলাম। চমৎকার করে সাজানো পার্ক। সুন্দর একটা ক্যাফে ভেতরে, চিড়িয়াখানা আছে, স্কাল্পচার গার্ডেন, ওপেন গ্রিন স্পেইস, বাচ্চাদের খেলার জন্য নানারকম ব্যবস্থা। কোলাহলমুখর জনপ্রিয় পার্ক।

ঠিক করলাম শেষদিনে আমাদের কাজ একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলে আমি লা ব্যারিয়ের পার্কে যাব। শুনেছি, পার্কটা বিশাল, বড় একটা ট্রেইল আছে আর পার্কের ভেতরেই লা স্যাল(La Salle) লেইকে ফিশিং বা কায়াকিং(kayak) করা যায়।

শেষ দিনেও সাড়ে তিনটায়ই শেষ হলো আমাদের সম্মেলন। দেরি না করে সেখানেই ড্রেস বদলে গাড়িতে সাড়ে চারটার দিকে পার্কে পৌঁছে গেলাম। জায়গাটা মূল শহর থেকে খানিকটা দুরে। পার্কের একটা অংশে ঘন জঙ্গল। এই সময়েও পার্কিংয়ে মাত্র সাত আটটা গাড়ি দেখেই বুঝলাম শান্তশিষ্ট পার্কই হবে।

ছয় মিনিটের একটা কুইক স্ট্রেচিং সেরে হাঁটা ধরলাম। গা একটু গরম হয়ে আসতেই ট্রেইল ধরে দৌড়।ট্রেইলের দু-পাশে সবুজ ঘাস। ফ্রেশ কাটা ঘাসের গন্ধ নাকে লাগলেই মন ভালো হয়ে যায়। প্রাকৃতিক জঙ্গলের পাশাপাশি কিছু কৃত্রিম বনায়নও হয়েছে, ওক ট্রি, অ্যাশ ট্রি দিয়ে। ওয়েল মেইনটেইনড পার্ক। এই বিকেলেও প্রচুর পাখির আনাগোনা, যদিও প্রায় সবই আমার অজানা পাখি। কাক, কবুতর, চড়ুই, লুন, আর কার্ডিনাল ছাড়া আর কোনও পাখি ঠিক চিনিনা আমি। পাখিদের কিচিরমিচির বাদ দিলে চারদিক থেকেই নীরবতা ঘিরে রেখেছে পার্কটিকে। ভেতরে লোকজন তেমন কেউ নজরে এলো না এখনো পর্যন্ত। স্বচ্ছ, শান্ত লা স্যাল লেইক দেখে ফিশিং, কায়াকিং(kayak) এর জন্য দারুণই মনে হলো। দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছিলাম আরেকটা দিন থাকলে কায়াকিং করে যেতে পারতাম।

লেইকের উপর একটা ছোট্ট ফুটব্রিজ। ব্রিজে উঠতেই হুউস করে বাতাস ধাক্কা দিয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তাল হারালাম। অশুভ লক্ষ্মণ? খটকা লাগলেও না থেমেই পার হয়ে গেলাম ব্রিজটা। ব্রিজ থেকে আরো কিছুদুর যেতেই দিগন্ত ছড়ানো বিশাল এক ফসলি জমি এসে উদয় হলো। দু চার পাঁচ বিঘা না, একরের পর একর। সম্ভবত গম চাষ হচ্ছে। এক মিনিট থেমে ডুবন্ত সূর্যটাও দেখে নিলাম। নাম না জানা পাখিরা যার যার বাসায় থিতু হয়ে বসছে। আরো চুপচাপ হয়ে গেল পরিবেশটা।

আমি একা। এই অনুভূতিটা খুব শক্তিশালী ইন্দ্রিয় আবেশি অনুভূতি। স্টেডিয়ামে বসেও যদি কারো মনে হয় সে একা, তাহলে আর পরিত্রাণ নেই। জমাট বাঁধা পার্টিতেও অনিরাপদ মনে হবে নিজেকে।

আমাকে নিশ্চিন্ত করে দুর থেকে বাচ্চাদের খেলার শব্দ ভেসে এলো। ডাকাডাকি, চিৎকার, চেচামেচি হচ্ছে।মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় আজিমপুর কলোনিতে আমি, রুমি, টিপু, আফফান, গগি এমন চেঁচামেচি করেই ইটের উইকেটে ক্রিকেট খেলতাম। হেসে নিজে নিজেই বললাম, সন্ধ্যা হয়েছে, বাসায় যাও কচি কাঁচার দল।

দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। ট্রেইলটা একটা লুপের(loop) মতো, তাই লেইকের উপর দিয়ে ফিরতে হয়না। বুশ(bush) আর হালকা একটা জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ট্রেইল ধরে ফিরে আসার পথে আবারও বাচ্চাদের খিলখিল হাসি শুনতে পেলাম। কে যেন বলছে, 'লেট'স গৌ'। আনন্দ, খুশি, আর দুরন্তপনা ভরা শব্দ। বাচ্চাদের হাসির শব্দের চেয়ে বিশুদ্ধ শব্দের অস্তিত্ব আর কোথায় আছে!

পার্কের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। ভেতর থেকেই দেখা যাচ্ছে পার্কিং এ আমার ভাড়া করা টয়োটা ক্যামরি নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে দাঁড়িয়ে। লম্বা পথ যেতে হবে। ছোট্ট একটা বাথরুম ব্রেইক নিয়ে টি-শার্টটা বদলে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।

পরদিন সকালের ফার্স্ট ফ্লাইটে ব্যাক টু টরন্টো।

এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমার ডিপার্টমেন্টে। লাঞ্চের পর বাসায় ফিরে গোসল সেরেই দিলাম এক ঘুমে বিকেল পার করে। ঘুম থেকে উঠে ডিনারে বসে দ্য টরন্টো স্টার এ চোখ বুলাতে বুলাতে 'ট্যুরস অ্যান্ড ট্র‍্যাভেলস' পাতায় দেখলাম লা ব্যারিয়ের পার্ক নিয়ে প্রতিবেদন। মজা তো, আমি তো সেখান থেকেই ফিরলাম!

'লা ব্যারিয়ের পার্কে ভৌতিক অভিজ্ঞতা' শিরোনামে যা লিখেছে,- 'পার্কটি তৈরি করার পর থেকে ভ্রমণকারীদের কেউ কেউ সেখানে অসময়ে বাচ্চাদের খেলাধুলা ও হৈচৈ এর শব্দ শুনতে পেয়েছেন বলে কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানিয়েছেন। প্রতিটি অভিযোগের অধিকতর তদন্তে জানা গিয়েছে যে, অভিযোগে উল্লিখিত সময়ে পার্কে বাচ্চাদের খেলতে আসার বা অবস্থানের কোনও রেকর্ড কর্তৃপক্ষ খুঁজে পায়নি'।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ৯:৪৪
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×