কিষাণীর স্মৃতি থেকে- ৭
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি মফস্বলে হওয়াতে এখানকার পরিবেশও ছিল বেশ রক্ষণশীল। আমাদের শিক্ষকরা ছেলে মেয়েরা একসাথে আড্ডা দিচ্ছে, জুটিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব দেখলে খুবই অখুশী হতেন। সন্ধ্যার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হলে ফিরতে না পারলে হলের হাউজ টিউটরদের হাতে কি পরিমান যে নাকাল হতে হত! হলে থাকা মেয়েদের নিয়ে তাদের ধারনাও ছিল আপত্তিকর রকম খারাপ। অথচ এই সব শিক্ষকদের সন্তানরাই হয়তো অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে; একই রকম পরিবেশে জীবন যাপন করছে। জুটিবদ্ধ ছাত্রছাত্রীদের ভাল রেজাল্ট করা কঠিন ছিল, যদিবা রেজাল্ট আটকানো সম্ভব না হত, তবু ভাল রেজাল্ট করা সত্বেও শিক্ষকতা নামক চাকরীটি পাওয়া দুস্কর ছিল যাদের গায়ে প্রেমিক প্রেমিকা গন্ধ আছে তাদের। এরকম একটা পরিবেশে আমরা কোন কিছুর পরোয়া না করে দিব্বি নামকরা জুটি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চষে ফেলতে লাগলাম।
আমি বরাবর ঢাকা শহরে জন্মানো এবং বেড়ে ওঠা একটি মেয়ে। ইট, কাঠের দালানের মধ্যে বড় হয়েও প্রকৃতির প্রতি আমার এত মমতা তৈরী হয়েছিল বোধহয় বই এবং পত্রিকা পড়তে পড়তে। আমি এর আগে কাশ ফুল দেখেছি টিভিতে অথবা ক্যালেন্ডারের পাতায়, বাস্তবে এর দেখা আমি আগে পাইনি। প্রথম যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসি, আমার পিঠাপিঠি বড় ভাই এবং আমি খুব ভোরে ঢাকা থেকে বাসে করে আসি। আসবার পথে ক্যাম্পাসে ঢোকার আগে দেখি নদীর বিস্তির্ন চর জুরে সাদা কাশের বন, আমি তো মুগ্ধ বিস্ময়ে শুভ্র কাশবন দেখছি, পরীক্ষার পড়া টড়া মাথা থেকে উধাও। ক্যাম্পাস দেখে আমি আরো মুগ্ধ, এত শান্ত, এত সুন্দর! যেন ছবির মত সাজানো। এখনো যখন যাই আমার এক অদ্ভুদ প্রশান্তি আসে মনে। মনে মনে তখন বলেছিলাম এখানে পড়তে হবে। এই প্রিয় ক্যাম্পাস, যেখানে প্রকৃতির রূপ রঙ চারিদিকে ছড়ানো, সেখানে চুপ করে ঘরে বসে থাকা যায়! আমার পক্ষে তো তা অসম্ভব। আমি যখন ই সময় পাই, ঘুরে বেড়াই। প্রিয় প্রকৃতি আর প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য আমার জীবনকে আরো ভরিয়ে তোলে।
শরৎকালে নদীর তীরে যেমন কাশফুল ফোটে, তেমনি ঘাসেদের বুক চিরে ফোটে ঘাসফুল। এই ফুলগুলোকে আমি বলি ঘাসফুল, আসলে কি নাম কে জানে! এগুলো পরে চোরকাঁটা বা প্রেমকাঁটা হয়। আমরা দু'জন যখন পড়া শেষে বিকেল বেলা, অথবা ছুটির দিনে নিঝুম দুপুরবেলা টি এস সির পিছনে বসে বসে কত কত কথার ফুলঝুরি ফোটাই; তখন যেদিকে দুচোখ যায় মাঠজুড়ে শুধু ঘাসফুল, কি যে অপূর্ব দেখতে! সারা মাঠ সাদা গালিচায় মোড়ানো, আমার ইচ্ছে হত ঐ সাদা মখমলের মত ফুলের ওপর গড়িয়ে আসি। কত যে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম; অকারনে চোরকাঁটার ওপর দিয়ে হাঁটতাম। আর বসে বসে গপ্প করার ফাঁকে ফাঁকে চোরকাঁটা বাছতাম।
আরো এক বিস্ময় ছিল জোনাকী। একটু গ্রাম গ্রাম হওয়াতে রাস্তার বাতিগুলো তে খুব আলো হত না। যেখানে একটু আলো কম, ঝোপের মধ্যে দেখতাম ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকী। সে যে কি অসম্ভব সুন্দর। মনে হত বিয়ে বাড়ীর আলোক সজ্জা, আমি খুশীতে আত্মহারা হয়ে যেতাম, ওর হাত ধরে বলতাম দেখো দেখো কি সুন্দর। আমার সব আনন্দ সব উল্লাসে তার ছিল নিঃশব্দ সমর্থন। আমার সব ছেলেমানুষী শখকে বিনা প্রশ্নে পূরন করতে তার কোন ক্লান্তি ছিল না।
অন্য সবার মত আমারো পূর্ণিমা ভীষণ পছন্দ। আমার মত ছন্নছাড়া, ভাবুক টাইপের মেয়ের ফুল, পাখি, কবিতা, চাঁদ ভালো লাগবে এ আর এমন কি! তবে এতদিন শহরের দালান কোঠার মাঝে পূর্ণিমার চাঁদকে দেখেছি। ক্যাম্পাসের পূর্ণিমা না দেখলে চাঁদের সাথে এত প্রেম আমার হত কিনা সন্দেহ!
আমরা দ'জন এক পড়ন্ত বিকেলে নদীর ধারে গিয়ে বসলাম। ঝিরঝির বাতাস বইছে, কি যে ভাল লাগছে। আমাদের নদীটার পুবদিকে বিস্তীর্ণ চর, অনেক দুরে গ্রামের ক্ষীণ রেখা দেখা যায়।পশ্চিমাকাশে সূর্য তখন ঢলে পড়ো পড়ো। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি পুবাকাশে বিশাল চাঁদ ধীরে ধীরে উঠছে। এরপর আমি লক্ষ্য করেছি পূর্ণিমাতে একদিকে সূর্য ডোবে আর একদিকে চাঁদ ওঠে।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে, বিশাল সোনালী চাঁদ পুবের আকাশ বেয়ে উপরে উঠে আসছে। সোনালী আলোয় ঝলমল করে ইঠছে চারপাশ। নদীর টলটলে পানিতে সোনালী আলোর ঝিলমিল খেলা। যেন কালো মসলিন শাড়ীতে সোনালী সুতোর কারুকাজ। আমি হতবিহ্বল, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমরা সব সময় বলি রূপালী চাঁদ, কিন্তু একদম সন্ধ্যায় চাঁদ সোনালী থাকে, ধীরে ধীরে রাত বাড়ার সাথে রূপালী হয়। মুগ্ধ আবেশে আমরা দীর্ঘ সময় পাশাপাশি হাত ধরে বসে এই অপূর্ব প্রকৃতি দেখি। আমাদের হলে ফিরতে ইচ্ছে করেনা। তবু হলে ফিরে বকা খাবার ভয়ে হলে ফিরি। আমি হলে ফিরেও ছাদে বসে চাঁদকে দেখি, সোনালী চাঁদ রূপালী হয়, আমি জোৎস্নার সাগরে ভাসি। গভীর রাতেও আমি ঘুম ভেঙ্গে জোৎস্না দেখি। মাঝরাতে জোৎস্নাকে আমার কেমন অশরীরী মনে হয়। গা ছমছম করে ওঠে। জোৎস্নার সাথে আমার এক অলিখিত প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আমি পরে একদিন তাকে বলি, সেদিন নদীর জলে আমার জোৎস্নার খেলা দেখা হল না। আমি মেয়ে বলে আমাকে হলে ফিরতে হল। যদি আমি ছেলে হতাম, মাঝরাত পর্যন্ত নদীর ধারে শুয়ে থাকলেও কেই আমাকে কিচ্ছু বলতো না। সে বললো ঠিক কথা। আমি তাকে বললাম আমার খুব ইচ্ছে করছে পুরো একটি পূর্ণিমার রাত আমি আমি নদীর উপরে নৌকাতে থাকবো। সারারাত জোৎস্না দেখবো। তুমি আমার এই শখটা পূরণ করবে? আমি জানি আমার শখটা যতটাই রোমান্টিক ঠিক ততটাই অনিরাপদ। আমাদের দ'জনের কারোরই এতটা সাহস নেই এখনই এই এডভেঞ্চারটি করবার। তাই আমরা ঠিক করলাম আমাদের যখন বিয়ে হবে তখন কোন নিরাপদ পরিবেশে আমরা দু'জন সারারাত নদীর জলে জোৎস্না দেখবো।
আমার এ সাধের স্বপ্ন টা আজো পূরন হয়নি। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে অনেক ব্যবধান থাকে। সময় হয়নি, সুযোগ হয়নি। তবে স্বপ্নটা এখনো আছে। এখনো আমি ভাবি একদিন ছেলেপুলেরা বড় হবে, সংসারী হবে। তখন আমার দায়িত্ব ফুরাবে, মুক্ত হব আমি। হয়তো একদিন শুভ্রবসনে, কাশফুলের মত সাদাচুলের বুড়োবুড়ি জোৎস্নায় স্নাত হবে, নদীর জলের উপর, মুখোমুখি বসে। আমাদের কন্ঠে গুনগুন করবে প্রিয় গান, দ'জন মিলে আবৃত্তি করবো প্রিয় কবিতা। প্রিয় মানুষটির কানের কাছে চুপিচুপি আমি বলবো অনেক দিনের একটা শখ আজ আমার পূরণ হল, আজ আমার মরেও সুখ।
চলবে.....