সেনেগাল। আফ্রিকার ছোট্ট দেশ। ১৯৬০এ স্বাধীনতার আগে ছিল ফ্রান্সের কলোনী। এ অঞ্চলে ইসলাম ঢোকে নিুবর্গের মধ্যে জনপ্রিয়তার সূত্রে চতুর্দশ শতকে। অষ্টদশ শতকে সেনেগাল সংস্পর্শে আসে ইউরোপের - প্রধানত দাস ব্যবসা সূত্রে। এই সেনেগালেরই সিনেমা পরিচালক ওসমান সেনবেন।
জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালে দক্ষিণ সেনেগালের কাসামান্সে। পারিবারিক পেশা ছিল মৎস্যজীবীতা। তার সমুদ্রভীতির কারণে মাছ ধরা পেশায়ও জড়িত হতে পারলেন না। স্কুলের গ-ী পেরোবার আগেই তাকে নিয়ম শৃঙ্খলা ভাঙার জন্য স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আর ও মুখো হন নি। এটা তার জন্য শাপেবর হয়েছিল কারণ ঐ সময়ের কলোনীয়াল শিক্ষা ব্যবস্থার মূলে ছিল সাম্প্রদায়িকতা - কালোদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম; সর্বোপরি কলোনীয়াল শাসনকে বৈধতা দেওয়ার প্রধান বাহন। পরে সেনবেন তৎকালীন পশ্চিম আফ্রিকার প্রশাসনিক কেন্দ্র ডাকার চলে আসেন-মেকানিক, রাজমিস্ত্রী (ফিল্মমেকিং ছিল তার ৪৫তম পেশা) এসব পেশার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকেন। ১৯৪৪ সালে তার সময়ের অনেক আফ্রিকান যুবকের মতোই ইউরোপীয়ানদের পক্ষে বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন - ফ্রান্সকে জার্মানীমুক্ত করতে। ১৯৪৬এ যুদ্ধফেরত সেমবেন আবার ডাকারে ফেরত আসেন-রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। তিনি নির্মাণ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৪৭ এর দিকে ভালো সুযোগের জন্য ফ্রান্সে চলে যান, থাকেন মার্সেইর মেডিটেরিনিয়ান সিটিতে, ১৯৬০ পর্যন্ত। ফ্রান্সে থাকাকালে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হন এবং মার্ক্সিস্ট পাঠচক্রগুলিতে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৪৮ সালে ব্ল্যাক ওয়ার্কার্স অর্গানাইজেশন ইন ফ্রান্স এর সাধারণ সম্পাদক নিযুুক্ত হন এবং ১৯৫০ এ ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ইন্দো-চায়না যুদ্ধ এবং কোরিয়ান যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। প্রকাশ্যে সমর্থন জ্ঞাপন করেন আলজেরিয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এফএনএল)-কে। তখনো কমিউনিস্ট মতাদর্শের আলোকে পৃথিবীময় মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। ততদিনে সেমবেন-এর পরিচয় উপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। ১৯৬২ সালে তিনি গোর্কি ফিল্ম ইন্সটিটিউটে ফিল্মের উপর পড়াশুনা করতে যান। সেখানে তিনি কাজ শেখেন বিখ্যাত পরিচালক মার্ক ডনস্কয় এবং সের্গেই গেরাসিমভ-এর কাছে। সেমবেন ফিরে এসে ফিল্ম করার কাজে নেমেন পড়েন। লক্ষ্য করার বিষয় সেনেগালের স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরেই সেমবেনের ফিল্ম ক্যারিয়ার শুরু হয়। ঔপনিবেশিক ইউরোপ আফ্রিকার এত অবমাননাকর ইমেজ তৈরি করে রেখেছে যে সেখানে নিজেকে উপস্থাপন করা মানেই শেষের ইমেজটিকে, প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইমেজের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা। তাই অনায়াসে সেমবেনের কথা প্রবাদের মতো হয়ে দাঁড়ায় - আফ্রিকায় ক্যামেরা ধরাটাই রাজনৈতিক কাজ। প্রথম দিকে তার কাজে নিউরিয়ালিষ্ট ধারার কাজের ছাপ পাওয়া যায় পরে ছবির গঠনে এবং গল্প বর্ণনায় এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসেন। তার ছবি সাদা-কালোর দ্বন্দ্বেই শেষ হয়ে যায় না, যা অনেক মাঝারি মানের আফ্রিকান ফিল্মমেকারের বৈশিষ্ট্য। তার ছবিতে (মানিঅর্ডার) দেখা পাই ইব্রাহীম দিয়েঙ-এর, যার ভাতিজা ফ্রান্স থেকে মানিঅর্ডার পাঠায়, অশিক্ষিত সরল ইব্রাহীম দিয়েঙ উত্তর কলোনী যুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে মানিঅর্ডার ভাঙাতে গিয়ে এমন ভাবে প্রতারিত হয় যে সে হয়ে দাঁড়ায় মার্ক্সকথিত সেই লম্বা সারির সর্বহারার একজন যাদের না হলে পুঁজিবাদ সিস্টেম হিসেবে অকার্যকর। এটাই ছিল আফ্রিকার প্রথম রঙিন ছবি। এখানে কোন রহস্যই গড়ে ওঠে না, পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে উন্মোচন- উত্তর কলোনীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আফ্রিকান কালচার, চক্ষু-কর্ণের বিবাদে (শিক্ষিত-অশিক্ষিত দ্বন্দ্ব) আকীর্ণ সমাজের ক্ষমতাকাঠামো, ক্ষমতাহীন মানুষের বেঁচে থাকার বিড়ম্বনা..। দেখা পাই (ইষধপশ মরৎষ) সেই কালো মেয়েটির যে কিনা মেইড সার্ভেন্ট হয়ে প্যারী যায়। বিশাল স্বপ্ন-নিজেকে গড়ে নেয়ার, গড়ে তোলার- কিন্তু কিছুতেই প্যারীর পণ্যায়িত বুর্জোয়া সমাজের ভেতর ঢুকতে পারে না। আস্তে আস্তে মেয়েটি ঘবমধঃরড়হ এর মানসিক চৈতন্যে পৌঁছে। এ যেন পাল্টা পদক্ষেপ টারজান সিনড্রোমের। যে টারজানকে কেন্দ্র করে ইউরোপের ‘সাদা ক্যামেরা’ ঢুকে যেত আফ্রিকার অন্দরে-দেখাত কালোরা কত বর্বর! আর ব্ল্যাকগার্ল ছবিতে ঐ কালো মেয়েটিকে কেন্দ্র করে ‘কালো ক্যামেরা’ যেন ঢুকে যায় ইউরোপের বুর্জোয়া মানবতাবাদী অন্দরমহলে- সেখানে দেখা যায় বাথটাবে পড়ে আছে কালো মেয়েটার লাশ- যে কিয়ৎক্ষণ আগে নিজেকে খুন করেছে! এ ছবি ছিলো আফ্রিকার প্রথম ফিচার ফিল্ম। কলোনীয়াল প্রপঞ্চের এক নিমর্ম সমালোচনা থাকে সেমবেনের ছবিতে। আধুনিক শিক্ষিত সেনেগালিজ সমাজ কিভাবে অশিক্ষিত মানুষদের ঠকায় তার প্রথম ছবিতেই তা দেখান (ইড়ৎড়স ঝধৎবঃ) । ক্ষালা ছবিতে দেশীয় বুর্জোয়াদের উপর তীব্র আক্রমণ করেন- যে বুর্জোয়ার জন্ম হয়েছে কলোনীয়াল শাসনের গর্ভে। নপুংসক বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি এল হাজি। এরা যেন হয়ে ওঠে ফ্রাঞ্জ ফ্যানন কথিত ইষধপশ চবড়ঢ়ষব ডযরঃব গধংশং-এর প্রতীক। তৃতীয় বিয়ের সময় বাসর রাতে সে হারায় তার পৌরুষ - ছুটতে থাকে আধুনিক এল হাজি তান্ত্রিকের কাছে - রোগমুক্তির আশায়। বোরোম সারের সেই সহজ সরল ভ্যানচালক বা ইব্রাহীম দেয়েঙ যারা সব খুঁইয়েছিল তাদের একটাই রাস্তা বাকি-ভিখারী হওয়া; তারাই যেন প্রতিশোধ মঞ্চ তৈরি করে-হাজিকে থু থু দিতে দিতে ধিক্কারে শাপমোচন করে। এইরকম ঘটনা/চরিত্রের (ইব্রাহীম দিয়েঙ, ভ্যানচালক) পুনরাবৃত্তির এক ছক থাকে সেমবেনের এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে। তার প্রথমদিককার ছবিতে থাকে বিশ্লেষাণাত্মক মনোভঙ্গী, শেষের দিকে এই মনোভাব কিছুটা পাল্টে যায়। পুরোনো মূলবোধের পুনর্উৎপাদন, ইতিহাস চেতনা এসবে জোড় দেন। মোদ্দাকথা ঐ যে এই সাক্ষাতকারেই সেমবেন যেমন বলেছেন ‘কালো গোলাপ আকা’ সেই চেষ্টাই যেন করে যান। ভাষার ক্ষেত্রে তার ছবিতে দ্বন্দ্ব সবসময় দেখতে পাই। আর এটা আফ্রিকার এক জটিল পটভূমিকে স্মরণ করায়। আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্য এখনো ইউরোপীয় ভাষায় রচিত হয়। ফলত তারা ইউরোপে যত বড় সাহিত্যিক আফ্রিকায় তাদের তত পরিচিতি নেই। তা তিনি চিনুয়া আচেবেই হোন বা হোন ওলে সোয়িঙ্কা! সেমবেন নিজেও ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখালেখি করেছেন। সেমবেনের সিনেমা প্রথম দিকে ফ্রেঞ্চ ভাষায়ই ছিল। মানডাবি (গড়হবু ঙৎফবৎ) গ্রামে প্রদর্শন করতে গিয়ে কৃষকদের বলেন-দেখ তোমাদের নিয়ে ছবি করেছি। উত্তরে কৃষকেরা বলেছিল-আমাদের ভাষাতে তা কেন নয়? সেমবেন তারপরেই আলাদা সাউন্ডট্রেক যুক্ত করে ঐ ছবির প্রদর্শনীর বন্দোবস্ত করেন। সেমবেন এরপর থেকে ওলোফ ভাষায়ই সিনেমা বানানো শুরু করেন। এটাই সিনেমার ক্ষমতা যে অশিক্ষিত মানুষের কাছেও পৌঁছে যেতে পারে যা আধুনিক সাহিত্য পারে না। সেমবেন ১৯৭২ সালে বের করেন ওলোফ ভাষার প্রথম সংবাদপত্র কাদ্দু।
ওসমান সেমবেন মারা যান ২০০৭ সলে। মুলাদে তার শেষ ছবি। এই ছবি নিয়েই তার এই সাক্ষাতকার। এখানে যে ট্রিলজির শেষ অংশ ঞযব ইৎড়ঃযবৎ ঐড়ড়ফ ড়ভ জধঃং- এর কথা বলেছেন তা তিনি শেষ করে যেতে পারেন নি। এ সাক্ষাতকার নিয়েছেন সাম্বা গাজিগো। ঙংসধহ ঝবসনবহ : ঞযব খরভব ড়ভ ধ ৎবাড়ষঁঃরড়হধৎু অৎঃরংঃ নামে সেমবেন অনুমোদিত জীবনীগ্রন্থের লেখক। তিনি সেমবেনের উপর একটি ডক্যুমেন্টারী ফিল্মও নির্মাণ করেছেন।
ভূমিকা ও অনুবাদ : হাসান জাফরুল বিপুল
বাকী অংশ পড়তে

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


