somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন ইসমাইল

২২ শে জুন, ২০১৪ সকাল ১১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মোহাম্মদ ইসমাইল, বয়স মাত্র ৩৫ বছর। আমাদের সদাহাসয প্রিয় এই সহকর্মী বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন রাত ৮টা নাগাদ বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অকস্মাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার অকাল প্রয়াণে আমরা গোটা অফিসএক্সট্র্যাক্টস্ পরিবার মুহ্যমান হয়ে পড়েছি। বৃহস্পতিবার রাতে অন্যান্য সহকর্মীদেরকে সাথে নিয়ে তার নিঃথর দেহ শেষবারের মত দেখে এসে তাকে নিয়ে বারবার ‍কিছু একটা লিখতে বসেও লিখতে পারছি না। কী লিখব, কেনইবা লিখতে হবে? কারণ ইসমাইলকে নিয়েতো এই সময়ে কিছু লেখার কথা ছিল না! কথা ছিল- ইসমাইল সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে, উচ্চতর নতুন দায়িত্ব বুঝে নিয়ে আগের চেয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে কাজ শুরু করবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর ঘটে আরেক। এটাই বুঝি ‘বিধাতার বিধান’!

৮ জুন বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম ক্যাসপারস্কি ইন্টারনেট সিকিউরিটি এবং অ্যান্টি-ভাইরাসের ২০১৫ সংস্করণ অবমুক্ত করা হয়। এ উপলক্ষ্যে এক মাস আগে থেকেই এ দেশে ক্যাসপারস্কি ল্যাবের ডিস্ট্রিবিউটর- অফিসএক্সট্র্যাক্টসের গোটা টীমকে রাতদিন কাজ করতে হয়। টীমের অন্যতম কোর সদস্য হিসেবে ইসমাইলের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব সে সুচারুরূপে পালন করে। অনুষ্ঠানস্থলেও ছিল ওর সর্বত্র উৎফুল্ল বিচরণ। ৯ জুন থেকে নতুন সংস্করণ ইন্টারনেট সিকিউরিটি এবং অ্যান্টি-ভাইরাসের বিশেষ স্কীম ঘোষণা করা হয়। মূলত ৮ জুনের আগেই ইসমাইল স্কীমসংক্রান্ত যাবতীয় সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখে। ৯, ১০ ও ১১ জুন- এই তিনদিনও সে যথারীতি স্কীমের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। স্কীম শেষ হয় ১৮ তারিখ। কিন্তু তার পূর্বেই ১২ তারিখ থেকে ইসমাইল অসুস্থ হওয়ার কারণে কর্মস্থলে আসতে পারে না। অন্য সহকর্মীরা ফোন এবং ই-মেইলে তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে থাকে। সবাই আশা করছিল রোববার (১৫ জুন) সে সুস্থ হয়ে কাজে যোগদান করবে। কিন্তু তার পক্ষে তা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তারপরও আমরা ভেবেছিলাম ইসমাইলের সুচিকিৎসা চলছে, খুব শীঘ্রই ওর অসুখ সেড়ে যাবে, কাজে যোগদান করবে। কিন্তু সপ্তাহান্তে বৃহস্পতিবার রাত ৮টার কিছু পর আমাদের মাথায় বাজ পড়ে। আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি, এখনো পারছি না- ইসমাইলের সেই সদাহাস্য চেহারাটি আর দেখা যাবে না। ভেতরে-ভেতরে ইসমাইল যে এতোটা রোগপীড়িত ছিল তা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি, বা তা সে নিজেও বিন্দুমাত্র প্রকাশ করেনি। কী কারণে প্রকাশ করেনি তা আমাদের কাছে রহস্যাবৃত হয়েই থাকবে।

২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি সহকর্মী হিসেবে সে আমাদের সাথে যোগদান করে। প্রথম দিন তাকে আমার কেমন লেগেছিল তা ঠিক মনে করতে পারছি না। সম্ভবত তার ইন্টারভিউ নেয়ার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। তাকে কী প্রশ্ন করেছিলাম তাও মনে করতে পারছি না। তবে একটা বিষয় আমি খুব স্পষ্ট করে মনে করতে পারছি- ইসমাইলকে প্রথম যে-কাজটা অ্যাসাইন করা হয়েছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খ সম্পন্ন করে দিনের মধ্যে কম্পোজ করে ইমেইলে পাঠিয়ে দিতে একদিনের জন্যও সে ভুল করেনি। এভাবে ঢাকা শহরের অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় অ্যান্টি-ভাইরাস সফ্টওয়্যারের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি সে মাত্র সাত দিনের মধ্যে শেষ করে ফেলে। ইংরেজিতে কম্পোজ করা তার দক্ষতার সাক্ষ্য বহনকারী রিপোর্টগুলো আজও আমার কাছে ব্যাকআপ স্টোরেজ এবং ই-মেইলের ইনবক্সে সংরক্ষিত রয়েছে।

সেইতো শুরু, ইসমাইলকে কোনও দিনও কোনও কাজে নেতিবাচক হতে দেখিনি। যখন যা প্রয়োজন পড়েছে করতে বলেছি, যথাসম্ভব দ্রুত সম্পন্ন করে একখানা স্বভাবজাত নিষ্পাপ হাসিমুখে কিছু একটা আশা করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। কী সেই আশা- আমি বুঝতে পারতাম। তাই আমিও একটা মুচকি হাসি দিয়ে ‘ভ্যারি গুড, থ্যাংক ইউ স্যো মাচ’ বলার সাথে-সাথে সে আরেকটু বেশি হেসে, মানে খুশি হয়ে দ্রুত প্রস্থান করত। দু’এক দিন ঠিক চাহিদমাফিক কাজটা সম্পন্ন করতে না পারলে তা বলার সাথে-সাথে সে বুঝে নিয়ে পুনরায় নিমিষেই কাজটা করে দিত। আবার কোনও কারণে কখনও একটু নাখোশ হয়েছি, ইসমাইল তা বুঝতে পেরেও খুব স্বাভাবিক থেকেই কজাটা ঠিকভাবে সম্পন্ন করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, অফিসের মধ্যে ইসমাইলের বসার ডেস্কই আমার রুমের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত। এই অবস্থানগত কারণে না চাইলেও ওর সাথে আমার যোগাযোগটা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই ঘটে যেত বৈকি। তা সত্ত্বেও ইসমাইলের সাথে আমার খুব বেশি কাজের প্রয়োজন পড়তো না। প্রতিদিনতো নয়ই, সপ্তাহে, আবার কখনো দু’সপ্তাহ বা মাসে দু’একবার। বিশেষ করে বাংলায় প্রমোশন্যাল স্কীমের প্রচারপত্র ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিগুলো কম্পোজ এবং প্রুফ রিডিং-এর কাজেই ওর সহায়তা নিতে হত। তবে বিগত কয়েক মাস যাবত প্রমোশন্যাল স্কীমের প্রচারপত্রগুলো অন্যদের সাথে আলোচনা করে সে নিজেই নির্ভুল প্রস্তুত করে ফেলত। আবার এরই মধ্যে ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলে ঐ প্রচারপত্র ই-মেইল এবং বাহক মারফত প্রেরণসহ এ সংক্রান্ত বাল্ক এসএমএস করার দায়িত্বও তার উাপরই বর্তিয়েছিল। তাছাড়া, অতিসম্প্রতি জনবলের একটু ঘাটতি থাকায় মার্কেট ভিজিট এবং প্রডাক্ট (সফ্টওয়্যার) ডেলিভারিসংক্রান্ত কিছু কাজও ইসমাইলকে করতে হয়েছে। অন্যদিকে অফিসের অন্যান্য সহকর্মীরা বাংলা বা ইংরেজিতে ছোটখাটো কিছু কম্পোজ করার কাজও তাকে দিয়েই করিয়েছেন। সবকিছুই ইসমাইল সানন্দচিত্তে করে দিয়েছে। কোনও কাজেই ওর না ছিল না। অফিসের প্রত্যেকটি ই-মেইলে সাড়া একমাত্র ইসমাইলের কাছ থেকেই পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে ও ছিল কাজপাগল মানুষ। এ হেন দক্ষ কাজপাগল মানুষটাকে আমরা চিনতে পারিনি, বুঝতে পারিনি, হয়তো যথাসময়ে যথাযথভাবে মূল্যায়নও করিনি। ভাল মানুষ বলে কথা! বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।

১৯ জুন রাত ১০টা নাগাদ যখন ইসমাইলদের উত্তর পীড়েরবাগের বাসায় যাই, তখন ওদের নবনির্মিত ভবনের নীচতলায় একটি খাটিয়ার ওপর ইসমাইলের শবদেহ শায়িত। ওর পুরো শরীর চাদর দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। ওকে শেষ গোসলের প্রস্তুতি চলছিল। আমরা অনেকটা উদ্ভ্রান্তের মত ওর মুখমণ্ডল খুলে দিতে বললে- ওর আত্মীয়-স্বজনরা সযত্নে চাদরটা সরিয়ে নেন। আমরা দেখেতো অবাক! এইতো আমাদের প্রিয় সহকর্মী ইসমাইল। মনে হচ্ছিল ওর কিছুই হয়নি, যেন প্রশান্তির নিদ্রাযাপন করছে, মুখে লেগে রয়েছে চিরচেনা সেই মধুর হাসি । চিরহাস্যোজ্জ্বল ইসমাইল আমাদের কাছে চিরঞ্জীব, হয়ে থাকবে কর্মপ্রেরণার উৎস। ইসমাইলের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:১২
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×