somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরের স্মৃতির ছিন্নপত্র

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবনের বয়স যত বাড়ছে, বাড়ছে তত আমাদের মহান স্বাধীনতার ব্যাপ্তিকাল, তারই সাথে পাল্লা দিয়ে ঝাপসা হয়ে আসছে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ ৭১-এর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা ও গৌরবোদ্দীপ্ত স্মৃতিগুলো। তবুও ‘স্মৃতি সততই মধুর’- এই সিদ্ধ প্রবাদ, আর প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের আবির্ভাবে গভীর নস্টালজিয়ায় মগ্ন হবার কারণে স্মৃতিগুলো চাউর হয়ে ওঠে বারবার মানসপটে। তা না হলে নিজের কাছে নিজেকেই যে বড় অপরাধী মনে হয়। বাঙ্গালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন- যার সাথে স্বল্প পরিসরে হলেও আমার সম্পৃক্ততা রয়েছে- তা কি জীবনের শেষ প্রাণবায়ু নির্গত না হওয়া পর্যন্ত ভোলা যায়? বরঞ্চ ইচ্ছা করে বেশি বেশি, আরো বেশি আকড়ে ধরি ঔ সব স্মৃতি হৃদয়জুড়ে, প্রাণভরে, আর মস্তিষ্কের সমস্ত কোষ পুরে। আমার কাছে ঔসব স্মৃতি ছাড়া অন্য সবকিছুই মূল্যহীন। কারণ ওখানেই প্রোথিত বাঙ্গালির অস্তিত্ব, সকল সত্তা, আত্মপরিচয়, সৌর্য-বীর্য, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের অবিনাশী কৃতিত্ব আর আমাদের আদি-আনাদিকালের সর্বোত্তম আত্মগরিমা। তাই বড় সাধ, স্মৃতির পাতাগুলো সযতনে পুঁথিবদ্ধ করে রাখি চির অমোচনীয় কালির আচরে অক্ষয় পত্রপুঞ্জে। কিন্তু সবার সব সাধ কি পূরণ হয়? তবুও ৪৮ বছরের স্মৃতির অতল গহ্বর থেকে টেনে নিবেদন করবার চেষ্টা করছি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে কিছুটা শৈশব-স্মৃতিচারণ করা প্রাসঙ্গিক। কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে- যা ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। তবে ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ১৯৬২ সালে গোপালগঞ্জ অঞ্চলে এমনই একটি দাঙ্গা সংঘটিত হয়- যা আমার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক স্মৃতি। তখন আমি পাঠশালায় দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। মনে পড়ে পাশের বাড়ির পাঠশালা থেকে বাড়ি ফেরার পথে বৈশাখী ঝড়ের পাল্লায় পড়েছিলাম। পরের দিন শুনতে পেলাম ঝড়ের কারণে হিন্দু-মুসলমান উভয় পক্ষ রণে ভঙ্গ দেয়- যার ফলে দাঙ্গা প্রশমিত হয়। তবে লোকমুখে একটি খবর চাউর হয়ে যায়- টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান এই দাঙ্গারোধে নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। এরপর ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তৎকালীন ফরিদপুর জেলাধীন এবং বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলাধীন কোটালীপাড়া থানার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত রাজাপুর প্রাইমারী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমি খাতায় লিখে রাখি “পাকিস্তান ধ্বংস হবে”। তা দেখে আমাদের সুরেন স্যার আমাকে বকাঝকা করেন এবং উক্ত লেখার পাতাটা খাতা থেকে ছিড়ে ফেলেন। ১৯৬৬ সালে বরিশাল-ফরিদপুর সীমান্তবর্তী গৌরনদী থানার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পয়সা হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। সে সময় কাসেম ভাই, আউয়াল ভাই, আবুল ভাই প্রমুখ স্থানীয় প্রগতিশীল ছাত্র নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ৬-দফার সমর্থনে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ এবং সরকারবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন- যেমন হরতাল, জনসভা, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে স্বল্প-বিস্তর অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়। ১৯৬৮ সালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় বন্ধুরা মিলে উক্ত স্কুল-ঘরের একটি কক্ষে স্থাপিত পোস্ট অফিসে আসা দৈনিক প্রত্রিকায় আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণ মনযোগসহকারে নিয়মিত পাঠ করি। মামলার প্রধান আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ বাড়ি টুঙ্গিপাড়া আমাদের এলাকা থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। বড়দের কাছ থেকে জানতে পারি তিনি বিভিন্ন সময় আমাদের এলাকায় এসেছেন এবং প্রতিটি গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে ৬-দফা কী এবং কেন, তা বুঝিয়েছেন। এমনও শুনতে পেয়েছি, তিনি সারারাত রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার পর ক্লান্ত শরীরে পয়সারহাট নদীর তীরে সুন্দরী কাঠের গোলাঘরে ঘুমিয়েছেন, বিশ্রাম নিয়েছেন। আমাদেরই প্রতিবেশি শেখ মুজিবকে শিশুকালে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে জেনেছি, আর কৈশোরে এসে তাঁকে স্বাধীকার আন্দোলনের প্রধান নেতা হিসেবে জানতে পারছি। তাই সংবাদপত্র পড়ার সময় সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের জেরা এবং বিচারে তাঁর সম্ভাব্য সাজা কী হতে পারে- তা আমাদের সবার জানার মুখ্য বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। আমরা সবাই উদ্বেগ নিয়ে পরের দিনের সংবাদপত্রের অপেক্ষায় থাকতাম, আর পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতাম। এভাবেই শেখ মুজিব আমাদের আপনজন ও প্রিয় নেতা হিসেবে মনের মনিকোঠায় স্থান করে নেন।

১৯৬৯ সালে মাদারীপুরের কালকিনি থানাধীন শশিকর হাই স্কুলে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েই গণআন্দোলনের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। ঢাকা থেকে গৃহীত কর্মসূচি মাদারীপুর হয়ে আমাদের স্কুলে এসে পৌঁছানোমাত্রই সে মোতাবেক হাট-বাজারে লিফলেট বিতরণ ও পোস্টার লাগানোসহ টিনের চোঙ্গা ফুঁকিয়ে জনগণকে জানান দেয়া এবং অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করতে থাকি। শুধু আমাদের স্কুল এলাকায়ই নয়, কর্মসূচি বাস্তায়নে পাশ্ববর্তী এলাকাতেও আমরা তৎপর থেকেছি। একদিন হরতাল পালনের সময় আমরা জানতে পারি কোটালীপাড়া থানাধীন নারিকেল বাড়ি মিশনারীজ হাই স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রদেরকে হরতাল পালন করতে দিচ্ছে না। খরব জানামাত্র আমরা দৌঁড়াতে শুরু করি এবং স্কুল ছুটি হবার পূর্বেই নারিকেল বাড়ি পৌঁছে সেখানকার ছাত্রদেরকে ক্লাশরুম থেকে বেড় করে আনি। এভাবে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ রাতে মাদারীপুর থেকে খবর আসে গণআভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খান আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং শেখ মুজিবসহ অন্যান্য আসামীদেরকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। কয়েক দিন পর পত্রিকার খবরে জানতে পারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার জন্য আইয়ুব খান আহুত গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে তিনি পদত্যাতগ করে সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

এরপর নিয়মিত পত্রিকা পাঠ করে আমরা ঢাকার খবরাখবর রাখায় সচেষ্ট থাকি। একদিন পত্রিকায় দেথতে পাই ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করে এভাবে ঘোষণা প্রদান করেন- “একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে ‘বাংলা’ শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ‘বাংলা’ শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই দেশকে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে ‘বাংলাদেশ’ ডাকা হবে”। তাঁর এই ঘোষণার ফলে আমরা দারুণভাবে শিহরিত হই এবং তাতে আমাদের মনে স্বাধীনতার বীজ উপ্ত হতে থাকে।

ইয়াহিয়া খান এক ইউনিট পদ্ধতিতে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃ্ত্বে আওয়ামী লীগ তাতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। দলীয় ইশতেহারে অন্যান্য বিষয়াবলীর মধ্যে ৬-দফা হুবহু সংযুক্ত করা হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তকে বামপন্থীরা তীব্র সমালোচনা করেন। তবে মূলত ৬-দফাকে প্রধান উপজীব্য করে ঝড়ের বেগে বঙ্গবন্ধুর সারা দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচারণায় সেসব সমালোচনা হাওয়ায় উবে যায়।

নির্বাচনী ডামাডোলের মাঝে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলজুড়ে মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক লক্ষ মানুষ ও অগণিত গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটাসহ লক্ষ-লক্ষ উপকূলবাসী সর্বশান্ত হয়ে যান। দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়া উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করা থাক দূরের কথা, দুর্গত মানুষের সহায়তায় পাকিস্তান সরকারের যারপর নাই অবহেলা এ অঞ্চলের প্রতি তাদের চরম বৈষম্য আরেকবার প্রকাশিত হয়। নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু বিষয়টি মোক্ষমভাবে কাজে লাগান। এতে করে নির্বাচনে নৌকার পালে হাওয়া তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

উপকূল থেকে বেশ খানিকটা দূরে হবার কারণে ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড় আমাদের এলাকার তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি করতে না পারলেও বিশেষ দু’টি কারণে আমার জীবনে সেটি অম্লান স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। প্রথমত, আমি সে সময় দশম শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে মাদারীপুরের শশিকর হাই স্কুলের হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছিলাম। আগের দিন গভীর রাতে শুরু হওয়া ঝড় ১২ নভেম্বর সারাদিন এবং সারারাত একটানা চলল। এতে টিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে নির্মিত হোস্টেলঘর বারবার হেলে পড়ছিল, আর বৃষ্টির জলে আমাদের বিছানাপত্র ভিজে যাচ্ছিল। অনেকটা ভয় পেয়ে রাতেই আমরা বিছানাপত্র নিয়ে স্কুলের ল্যাবরেটরি দালানে সাময়িক থাকার স্থান করে নেই। দিনের বেলা দালানের জালানা খুলে ঝড়ের গতি, বৃষ্টিতে নাস্তানাবুদ গাছপালা আর ভরা ফসলের মাঠ টৈটুম্বুর জলে সয়লাব হওয়া দেখে অন্যরকম এক অনুভূতিতে পেয়ে বসেছিল আমাকে। ঝড় থামলে পরের দিন বড়দা এসছিলেন বাড়ি থেকে দেখতে কেমন আছি আমি। তখনতো আর মোবাইল ফোন ছিলনা যে তাৎক্ষণিক খবর নেয়া যেত! দাদাকে বললাম, মা যেন আমার জন্য চিন্তা না করেন। তাঁকে বলবে আমি ভালো আছি, সামনে টেস্ট পরীক্ষা, তাই বাড়ি যেতে সপ্তা দু’তিন দেরি হবে। দ্বিতীয়ত, ঘূর্ণিঝড়েরর পরপরই বাবা জমিজমার রেকর্ডাদি ঠিকঠাক করার জন্য বরিশাল শহরে যান। ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে শহরের গোটা পানীয় জল দূষিত হয়ে যাবার কারণে তা পান করলে বাবাকে ভীষণ পেটের পীড়ায় পেয়ে বসে। বাড়ি ফিরে তিনি যে শয্যাগত হলেন আর সেরে উঠলেন না।

১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের শেষ নাগাদ আমার এসএসসি টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়। তবে পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে সোৎসাহে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করা অনেকটা নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়, সে এক অন্যরকম অনুভূতি। স্পষ্ট মনে আছে, জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ফরিদপুরের কালকিনি আসনের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আদেল উদ্দিন নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে আমাদের হোস্টেলের সামনের মাঠে জনসভা করেছিলেন। তিনিসহ বড়রা সভাস্থলে পৌঁছানোর আগে আমরা বন্ধুরা মিলে মাইকে নানান স্লোগান দিয়ে মাঠ মাতিয়ে রেখেছিলাম। আমার সহপাঠী সুকান্ত নিজে বঙ্গবন্ধুর উপর গান রচনা করে খালি গলায় গেয়ে সবার নজর কেড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। টেস্ট পরীক্ষার পর এপাড়া-ওপাড়া, এগ্রাম-ওগ্রাম, হাট-বাজার ও শহর-গঞ্জে নির্বাচনী প্রচারণা ও জনসভায় অংশগ্রহণ করে দিনে কেটেছে। এসবের মধ্যে দু’টি বিশাল জনসভার কথা এখনো মনে পড়ে। প্রথমটি ডিসেম্বরের ১ বা ২ তারিখ মাদারীপুর নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগ দেওয়া। জনসভায় যাবার জন্য বরিশাল-ফরিদপুর, বরিশাল-মাদারীপুর, বরিশাল-ভুরঘাটা, মাদারীপুর-ভুরঘাটা প্রভৃতি রুটের সকল বাস সার্ভিস বিনাভাড়ায় যাত্রীবহন করে। মনে আছে- ভুরঘাটার পরে ভাঙ্গাব্রিজ ও তাঁতিবাড়ি থেকে আমরা বাসের দরজায় ঝুলে মাদারীপুর গিয়েছিলাম। সেই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে দেখা এবং তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ শোনা। মুহুর্মুহু করতালি এবং গনণবিদারী স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে নিজেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হলেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে শিহরিত হয়ে ওঠাটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া মনে হচ্ছিল বারবার। দ্বিতীয়টি কোটালীপাড়ার ভাঙ্গারহাট স্কুল মাঠে মোল্লা জালাল উদ্দিনের জনসভা। এই জনসভায় কোটালীপাড়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সতীশ চন্দ্র হালদার তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, “আপনারা জালাল ভাইকে ভোট না দিলে আমি আমার জন্য আপনাদের ভোট চাই না”। তাঁর এ উক্তি করার পিছনে কারণ ছিল- গোপালগঞ্জ অঞ্চলের জনপ্রিয় শিক্ষক বীরেন বিশ্বাস গণমুক্তি পার্টি গঠন করে তার প্রধান হিসেবে নির্বাচনে ঔ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোল্লা জালালের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। এতে তিনি মোটামুটি একটা সাড়া জাগাতেও সক্ষম হয়েছিলেন। তবে মোল্লা জালাল ও অন্যান্যদের কৌশল এবং সর্বোপরি নৌকার পালে তীব্র হাওয়া লাগা ও গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান হবার কারণে বীরেন বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত ভোটের দৌঁড়ে কুলিয়ে উঠতে পারেননি।

’৭০-এর নির্বাচী প্রচারণার যে বিষয়টি আমার মনে আরও তীব্র রেখাপাত করে আছে তা হচ্ছে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা। নির্বাচনে অংশগহণেকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবশেষে আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ ভাষণ নির্বাচনের ৪ দিন আগে রেডিওতে প্রচারিত হয়।

এভাবে একদিন চলে আসে ৭ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। এ নির্বাচনেই নির্ধারিত হয় বাঙালির ভবিষ্যত। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের সব ক’টিতে মনোনয়ন দেয়। আমার নিজস্ব এলাকা বরিশালের গৌরনদীতে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ প্রার্থী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, পাশে ফরিদপুরের কোটালীপাড়ায় মোল্লা জালাল উদ্দিন, আর কালকিনিতে অ্যাডভোকেট আদেল উদ্দিন। উল্লেখ্য, বরিশাল ও ফরিদপুর জেলা দু’টির সীমান্তজুড়ে নিজ গ্রামের অবস্থান হওয়াতে তিনটি এলাকার নানা প্রকার নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার বিরল সৌভাগ্য হয় আমার। নির্বাচনের আগের রাতে বাড়ি ফিরে জানতে পারি পরের দিন কোদালধোয়া স্কুলকেন্দ্রে আমাকে অন্যতম স্বেচ্ছাসেবক মনোনীত করা হয়েছে। আমি আনন্দে আত্মহারা। বয়স কম হবার কারণে ভোটার না হতে পারলেও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ভোটারদেকে- বিশেষ করে বয়স্ক, অশিক্ষিত এবং মহিলাদেরকে ভোট দিতে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারব- এর চেয়ে বড় আর কী সৌভাগ্যের হতে পারে? আমি খুব ভোরে বাড়ির সবার আগে ভোটকেন্দ্রে চলে গেলাম। যাবার আগে অসুস্থ বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি ভোট দিতে যাবেন কিনা। উত্তরে তিনি অনেকটা রাগতস্বরে বললেন, “কেন যাব না, অবশ্যই মজিবরকে (গ্রামের বড়রা বঙ্গবন্ধুকে এ নামেই ডাকতেন) ভোট দিতে যাব, জীবনে আর ভোট দেই বা না দেই- এই ভোটটা দিতে আমি যাবই, তাতে বাঁচি আর মরি”। আর মাকেও দেখলাম ভোটকেন্দ্রে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। ভোটকেন্দ্রে গেলে বড়রা আমাকে করণীয় বুঝিয়ে দিলেন। পরে দেখলাম বড়দা গ্রামের সব ভোটারদেরকে কেন্দ্রে আনা-নেওয়া এবং তাদের আপ্যায়ন করার খবরদারি করছেন, মা মহিলাদেরকে নিয়ে আসছেন আর বাবাকে তার নাতিরা (আমার বড় জেঠার নাতিরা) সযত্নে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসছে। মা-বাবার জীবনে সেই শেষ ভোট দেওয়া, তবে তা অবশ্যই স্বার্থক। সে যাহোক, কোথায় কেমন করে ভোট দিতে হবে এবং ভোট দেয়া হয়ে গেলে কী করতে হবে সে সব ভোটকেন্দ্রের বাইরে বসে ভোটারদেরকে বুঝিয়ে দেওয়াটাই মুখ্য কাজ ছিল আমার ও আরো কয়েক বন্ধুর। আমরা খুব সফলভাবে আমাদের কর্তব্য সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম বলে আজও গর্ব অনুভব করি।

কোদালধোয়া ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনা শেষ হতে রাত ১০টার বেশি বেজে যায়। কোন প্রার্থী কত ভোট পেয়েছিলেন তা আজ আর মনে নেই। বাড়ি ফিরে নির্ঘুম প্রায় সারা রাত পাশের বাড়ির তীর্থ কাকুর রেডিওতে ভোটের ফলাফল শুনতে থাকি। বলা বাহুল্য, একের পর এক কেন্দ্রের ফল ষোষিত হচ্ছিল, আর পতপতিয়ে নৌকার বিজয়কেতন উড়ছিল। সব এলাকার নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হতে পরের দিন কাটিয়ে রাত হয়ে গেলেও সারাদিন ধরে গ্রামে-গ্রামে, পাড়া-মহল্লায়, বাজার-গঞ্জ, শহর-বন্দর সর্বত্র নির্বাচনে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বিজয়ের আনন্দ মিছিলে গোটা দেশ মুখরিত হয়ে ওঠে। সবগুলো আসনের ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা যায় জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টির মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়লাভ এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ গোটা পাকিস্তানের ৩১০ আসনের মধ্যে এককভাবে ১৬৭ আসন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

কয়েক দিনের মধ্যে স্কুলের ছুটি শেষ হয়ে গেলে আমি হোস্টেলে ফিরে যাই। টেস্ট পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। আমি এতে প্রথম স্থান অধিকার করি। কয়েক দিন পর ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাদারীপুরের শশিকর স্কুল কেন্দ্রে আমি আবার স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করি। তবে এতে ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মত উত্তাপ পরিলক্ষিত হয় না। কারণ মূল (জাতীয় পরিষদ) নির্বাচনে বাঙালিরা ইতোমধ্যে বিজয়ী হয়ে গেছে, এখন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনেকটা নিয়ম রক্ষা মাত্র। সে যাহোক, প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০টির মধ্যে ২৮৮টি আসনে বিজয়ী হয়।

মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর, হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর সর্বত্র সর্বদাই আলোচনার মুখ্য বিষয় কবে কখন পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সরকার গঠনের আহ্বান জানাবেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার গরিমসি দেখে সমগ্র পূর্ব বাংলাজুড়ে গুঞ্জন ওঠা শুরু করে। আমাদের এলাকার কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের মাধ্যমে জানতে পারি ঢাকায় স্বাধীনতার জন্য ছাত্রদের মধ্য থেকে ক্রমশঃ বঙ্গবন্ধুর প্রতি চাপ সৃষ্টি হতে থাকে। এরই মধ্যে ৩ জানুয়ারি রাতে রেডিওতে এবং পরে সংবাদপত্রে জানতে পারি ৬-দফা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু অনড় অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং এ ব্যাপারে তিনি রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। এর জের সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমরাও যে যার মত করে আর স্বাধীকার নয়, স্বাধীনতার জন্য স্বোচ্চার হতে থাকি। শহরের জনসভা ও মিছিল ছাড়াও গ্রাম-গঞ্জের হাটে-বাজারে, যাত্রাপালায়, কবিগান আসরে, এমন কি বিয়ে বাড়িতেও, অর্থাৎ সর্বত্র তখন শুধু স্বাধীনতার দাবিই উত্থাপিত হতে থাকে। এ সময় একদিন আমাদের স্কুলের লাইব্রেরি রুমে বসে দেখতে পাই আমার মেজদার সহপাঠী সহদেবদা একটি খামের উপর ঠিকানার সর্বশেষে ‘পূর্ব বাংলা’ লিখছেন। দেশের নাম ‘পূর্ব বাংলা’ লিখলেন কেন জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বললেন, “কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আছে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে পূর্ব বাংলা লিখতে হবে। এখন এটা লিখছি, কয়েক দিন পর সোজা ‘বাংলাদেশ’ লিখব”। এ কথা বলে সহদেবদা মুচকি হাসলেন। এতে স্বাধীনতার স্বপ্নে আমাদের মনে শিহরণ জাগে।

রেডিও এবং পত্রিকার খবরে আরমা জানতে পারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালির ৬-দফা ও স্বায়ত্ত্বশাসন নীতির প্রবল বিরোধীতা করছেন এবং অ্যাসেমব্লি বয়কটের হুমকি দিচ্ছেন। ভুট্টো এমনও ঘোষণা দেন- ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তা তিনি মানাবেন না। এমনই রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া মার্চ মাসের প্রথম সপ্তায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। এবার ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে এই বলে হুমকি ছুড়ে দেন, “পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত সব কিছু বন্ধ করে দেয়া হবে, অ্যাসেমব্লিতে কেউ যাবেন না, গেলে সবাইকে মেরে ফেলা হবে এবং কসাইখানা হবে অ্যাসেমব্লি”। এ ছাড়াও ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানজুড়ে বিভিন্ন জনসভায় বাঙালি, আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় গালাগাল করে বক্তৃতা দিতে থাকেন।

হঠাৎ করে ১ মার্চ আমরা রেডিওতে শুনতে পাই মার্চের প্রথম সপ্তায় ডাকা অ্যাসেম্বলি অধিবেশন ইয়াহিয়া বন্ধ ঘোষণা করেছেন। এতে গোটা পূর্ব বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমন কি পরের দিন আরমা জানতে পারি বাঙালি দর্শকদের প্রতিবাদের তোড়ে ঐ সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান-এমসিসি ক্রিকেট ম্যাচ খেলা পণ্ড হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ১-৭ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এখনকারমতো সে সময় তথ্য আদান-প্রদানের আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মাধ্যম না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক বিদ্যুৎ বেগে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থনের কারণে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আমি হোস্টেল থেকে বাড়ি চলে আসি। বাড়ি এসেও আমাদের এলাকার সর্ববৃহৎ বাজার পয়সারহাট থেকে পরিচালিত আন্দোলন-সংগ্রামে শামিল হতে থাকি।

বঙ্গবন্ধুর অহসযোগ আন্দোলনে অভূতপূর্ব সাড়া মিলে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মিছিল, জনসভা, পথসভা আর স্লোগানে-স্লোগানে গোটা দেশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ সময় আমরা আর ৬-দফার নয়, ১-দফার পক্ষে পোস্টার ও প্রচারপত্র বিলি এবং স্লোগান দিতে থাকি। মনে আছে, পয়সারহাটে আমার বন্ধু ছাত্তারদের বইয়ের দোকানের পিছনে বসে আমরা সারা রাত পোস্টার লিখে দিনের বেলা গোটা এলাকাজুড়ে টানিয়ে দেই। প্রতি সন্ধ্যায় কলেজ পড়ুয়া আইয়ুব ভাই, কাসেম ভাই, লতিফ ভাই, আউয়াল ভাই প্রমুখ এসে এলাকার সবাইকে নিয়ে মিটিং করে ঢাকার সর্বশেষ অবস্থা এবং আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির উপর আমাদেরকে বিবৃত করতেন, আর বলতেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। আমরা ৭ মার্চের অপেক্ষায় থাকি।

৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা প্রদান করেন তা শোনার জন্য আমরা দুপুর থেকে পাড়ার রাইস মিলের ঘরে রেডিও অন করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি। বেলা ১২টা থেকে রেডিওতে বার বার ঘোষণা আসতে থাকে বেলা দুইটায় রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার করা হবে। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমরা শুনতে না পেয়ে অনেকটা হতাশ ও মনকষ্ট নিয়ে বসে থাকি ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন আর ওয়াশিংটন থেকে প্রচারিত বাংলা সংবাদগুলো শোনার জন্য। প্রতিটা খবরে জানতে পারি লাখ লাখ জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন। তিনি কী কী বলেছেন তাও খবরে সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করা হয়। পরের দিন ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে প্রচারিত হলে তা শুনে আমরা উদ্বেলিত হয়ে উঠি। “ভায়েরা আমার…..” এই বলে শুরু করা এবং “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা” এই বলে শেষ করা তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে আমাদের মনে স্বাধীনতার আশায় শিহরণ জাগে। পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, স্কুল মাঠে শুরু হয়ে যায় শারিরীক কসরত আর বিনাঅস্ত্রেই অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং।

মিছিল, মিটিং, আর যুদ্ধের প্রস্তুতিতে অতি দ্রুত দিন চলে যাচ্ছিল। সেইসব দিনের জনপ্রিয় এবং শিহরণ জাগানিয়া স্লোগানগুলো আজও স্মৃতিতে ভাস্বর, যেমন- ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি, বাঙালি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘শেখ মুজিবের পিছে, বাঙালি আছে’, ‘শেখ মুজিবের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি।

স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত গোটা বাঙালি জাতি, উত্তাল গোটা বাংলাদেশ। সেসব প্রশমনে পাকিস্তানীরা নানান কূটকৌশল অবলম্বন করতে থাকে। স্থগিত করা অ্যাসেমব্লি অধিবেশন ইয়াহিয়া আবার ২৫ মার্চ বসার ঘোষণা দেন, আর রাজনৈতিক অচল অবস্থা নিরসনের নামে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ ঢাকা আগমন করেন। একটানা ১০ দিন আলোচনার নামে প্রহসন ও সামরিক প্রস্তুতিগ্রহণ শেষে রাতের আঁধারে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করার আগে তিনি ‘পোড়া মাটি’র নীতি বাস্তবায়নে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে যান। এ নির্দেশ তালিম করতে ২৫ মার্চ গভীর রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জনতার উপর বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী হামলা ও গণহত্যা চালায়। বাঙালিরা যথাসাধ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর সহকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশদান করেন।

পাকিস্তনীদের হাতে গ্রেফতার হবার পূর্বে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু এভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন- “এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক---”। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা কোন রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে প্রাচরিত না হওয়ায় আমরা এর খবর দিন তিনেক পর জানতে পারি। অন্যদিকে ২৬ মার্চ দিনের বেলা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাদামতলী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম, এ, হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। পরের দিন, অর্থাৎ ২৭ মার্চ পর পর দুই বার চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। প্রথম ঘোষণাটি তিনি নিজের নামে এবং পরে সেটি সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করেন। এই দু’টি ঘোষণাই আমরা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে সরাসরি শুনতে পাই। উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধারা ২৮ মার্চ পর্যন্ত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখলে রেখে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ এবং ৩০ মার্চ পর্যন্ত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হিসেবে পরিচালনা করেন। ৩০ মার্চ প্রভাতী অধিবেশনে এই কেন্দ্র থেকে প্রচারিত প্রথম বারের মত আমরা ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি প্রথম শুনতে পাই। ৩০ মার্চের পর চার দিন আমরা রেডিও’র নব ঘুরিয়ে কোথাও ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ট্রেস করতে ব্যর্থ হই। ০৪ এপ্রিল আবার ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনতে পাই।

এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে আবিষ্ট হয়ে পড়ি। আমরা এলাকার যুবক ও কিশোররা প্রতিনিয়ত নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে যাবার পথ খুঁজতে থাকি। কে কোথায় কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম এখানে তার বর্ণনা দেবার চেষ্টা করছি। কারণ ৪৮ বছর আগের সে সময়ের রণাঙ্গনের বন্ধুদেরকে নিয়ে এ পর্যায়ে স্মৃতিচারণ না করলে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।

প্রণতি জানাচ্ছি রণাঙ্গনের সকল সহযোদ্ধা বন্ধু-সাথীদেরকে। তোমরা কেমন আছো? কে কোথায় আছো? কত দিন দেখি না, হয় না কথা। নান্নু, দেশের এক কনিষ্ঠতম মুক্তিযোদ্ধা তুমি। বয়স, আকার-আকৃতি আর স্বভাব-চরিত্রে আমাদের ১১০ জনের দলের সবার ছোট বলে প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল মালেক তোমাকে আদর করে ডাকতেন ‘লুল্লু’ । ’৭১-এ অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তুমি মায়ের চোখ ফাঁকি দেবার দুর্দান্ত সাহস দেখিয়েছিলে কী করে তা ভেবে আজও স্তম্ভিত হয়ে যাই । এখানেই দেশমাতৃকার কাছে জন্মদাত্রী মা পরাজিত, আর তা কেবল বাঙ্গালির জীবনে একবারই ঘটেছিল। আমাদের দেশে এমনি হাজার হাজার ত্যাগী মা এবং তাদের সন্তান নান্নুরা কে কোথায় কেমন আছেন তা কি আমরা কেউ খবর রাখি? তবে এখানে উল্লিখিত নান্নুর খবর আমি কিছুটা হলেও রাখার চেষ্টা করি, তার সাথে মাঝে-মধ্যে যোগাযোগ হয়। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলাধীন আমবৌলা গ্রামের নান্নু বিমানে ছোট একটা চাকরি করে কোন রকমে সংসার চালিয়েছেন, এখন অবসরে চলে গেছেন। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, নাতি-নাতনি হয়েছে। মেয়ের জামাই যে খুব একটা ভালো স্বচ্ছল তাও নয়। ছেলেকেও তেমন লেখাপড়া শিখাতে পারেননি। তার জন্য এখন নান্নুর যতসব চিন্তা। কোন রকমে তার কর্মস্থল বিমানে একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেই তদ্বির করতেও কুণ্ঠা বোধ করছে। যদিও তিনি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল বিমান ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নান্নুর চাচা আইয়ুব আলী ভাই আমাকে বছর কয়েক আগে একদিন বলেছিলেন নান্নুর ছেলের একটা চাকরি দরকার, চলো তুমি আর আমি এক সঙ্গে বিমান অফিসে গিয়ে একটু তদ্বির করে আসি। আমি বল্লাম, কি বললেন? নান্নুতো আমাকে একদিনও বলেনি এ কথা। আইয়ুব ভাই বললেন, এটাইতো মুক্তিযোদ্ধাদের মহত্ম, দেশের জন্য ভাববে, লড়বে, জীবন দেবে, কিন্তু নিজের জন্য কখনো ভাববার অবকাশ নেই তাদের। আমি তাকিয়ে থাকি আইয়ুব ভাইয়ের মুখের দিকে। কারণ উনি নিজেই যে ঔ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কি পেয়েছেন আইয়ুব ভাই? তার সম্পর্কে একটু বলা দরকার। বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলের ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব ভাই। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মার্চ ’৭১ সালে স্নাকত প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন বরিশাল-ফরিদপুর অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দুধর্ষ গেরিলা, আদর্শবান রাজনৈকিত কর্মী, সমাজসেবী ও মানবদরদী আইয়ুব ভাই গোটা অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সবার কাছে ‘নেতা’ নামে পরিচিত। খর্বাকৃতির বিশেষ শারিরীক গঠনের জন্য এই ‘নেতা’কে যে একবার দেখেছে সে ভুলতে পারবে না। তাই তিনি গোটা দেশের নিজ দলের ওপর-নীচ প্রায় সবারই পরিচিত। অথচ অতি সাধারণ তার জীবনধারণ। বরিশালের বাগধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন একাধিবার। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আগৈলঝাড়া থানা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও ছিলেন। ঢাকায় আসতেন প্রায় প্রতি সপ্তায়, নিজের কোন তদ্বিরের কারণে নয়, রণাঙ্গনের বন্ধু-সাথীদের জন্য সমন্বিতভাবে কিছু একটা করার জন্য। ঢাকায় আসলে ইস্টার্ন প্লাজায় এক উকিল বন্ধুর দেয়া একটা ছোট্ট অফিসে বসে সবার সাথে যোগাযোগ করেন। সেদিন ওখানে তার সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করলাম, এমপি বা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করলেন না কেন? সোজা উত্তর তার- আগের দিন নেই, এখন টাকা ছাড়া নির্বাচন করা যায় না, আমার টাকা নেই, তাই নির্বাচন করতে সাহস পাই না। জানালেন ২০০১-২০০৬ সময়কাল এবং ১/১১’র পর ছোট-বড় অনেক নেতাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে গিয়ে অনেক ধারদেনা করতে হয়েছে। জিজ্ঞেস করি, তার সহপাঠী মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী লতিফ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ আছে কিনা। জানালেন, লতিফ বছর কয়েক আগে একবার দেশে এসেছিলেন, কিন্তু বড় ভাই বিচারপতি আব্দুল আজিজ বিতর্কিত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার কারণে অনেকটা কুণ্ঠিত, তাই লতিফ সবার সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রেখেছেন। শুনে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলাম। লতিফ ভাই দেশত্যাগ করলেও আদর্শ ত্যাগ করেন নাই। আদর্শবাদীতার কারণে পিতৃতুল্য অগ্রজের প্রতি বিরাগভাজন। লতিফ ভাই বরাবরই একরোখা, যা বলতেন তা করেই ছাড়তেন। মনে পড়ে ২৮ মার্চ ’৭১-এ এলাকার ছাত্র-যুবক সবাইকে জড়ো করে ঘোষণা দিলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশে চট্টগ্রাম রওয়ানা দিচ্ছেন ঐ দিনই। জানতে চাইলেন কে কে যাবে তার সাথে। আমরা কেউই তখন অতোটা সাহসী হয়ে ওঠতে পারিনি বিধায় উনি একাই একটা হাফ প্যান্ট ও টি-শার্ট গায়ে যোদ্ধার বেশে হন হন করে আমাদের সামনে দিয়ে চট্টগ্রাম উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন, যুদ্ধে যোগ দিলেন। নায়কোচিত চেহারার লতিফ ভাইয়ের বীরবেশে দুরন্ত নাটকীয় ভঙ্গিমায় যুদ্ধে যাওয়াটা আমাদের সকলের মনে দারুণ রেখাপাত করেছিল, দেশমাতৃকার মুক্তির সোপানে আত্মাহুতি দিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম সবাই। এরপরই আমাদের মধ্যে অনেকটা হিড়িক পড়ে যায় কে কবে কীভাকে কোথায় ট্রেনিং নেবো, যুদ্ধে যাবো।

আগেই বলেছি, আইয়ুব ভাইয়ের রাজনৈতিক কানেকশন খুব শক্ত, শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং নুরুল ইসলাম মঞ্জু- বরিশালের এই দুই জাদরেল নেতার সাথেই তার অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক এবং দু’জনেরই সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছিলেন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পশ্চিম বঙ্গের টাকি এবং হাসনাবাদে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপনের প্রায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর সেখানে ডাক পড়ল আইয়ুব ভাইয়ের। কারণ দপ্তর ও প্রশাসন দেখাশোনার জন্য বিশ্বস্ত ও যোগ্য আর কাউকেই তাঁরা পছন্দ করতে পারছিলেন না। পয়সারহাটে সাময়িকভাবে স্থাপিত আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা যোগাযোগ অফিসে একদিন সন্ধ্যায় আমাদের সকলকে ডেকে তার উপর হুকুম নাজেল হয়েছে জানিয়ে ঔ রাতেই রওয়ানা দিলেন গন্তব্যে। বললেন, আর দেখা হবে কিনা জানিনা, তবে তোমরা একে একে সবাই অবশ্যই যুদ্ধে যেতে ভুল করবে না। আমাদেরকে শপথও পাঠ করালেন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে যাবার। সেদিন সেখানে আমরা যারা ছিলাম তাদের প্রায় সবাই পর্যায়ক্রমে যুদ্ধে গিয়েছিলাম।

ভারতে ট্রেনিং এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণের কাহিনী মনে পড়লে আজো শিহরিত হয়ে উঠি, উদ্দীপ্ত হই নতুন কোন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার। জীবনের শ্রেষ্ঠ সেই অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে তুলে ধরছি।
====
মু্ক্তিযুদ্ধচলাকালীন আমার বাবা চণ্ডি চরণ অধিকারী পেটের পীড়ায় বহুদিন শয্যাগত থেকে ’৭১ এর ২৫ এপ্রিল পরলোকগমন করেন। বাবার মৃত্যু’র তারিখ ছাড়াও দিনটি অন্য দু’টি বিশেষ কারণে বিশেষভাবে আমার স্মৃতিপটে দাগ কেটে আছে। প্রথমত, বাবার মারা যাবার ক্ষণ (সময়) আমরা ঠিক করে কেউ জানতে পারিনি। কারণ, বেলা বাড়ন্ত হলেও বাবা ঘুম থেকে উঠছেন না দেখে আমার মেঝদি বাবাকে উঠানোর জন্য প্রথমে ডাকতে থাকেন, সাড়া না পেয়ে তাঁর গায়ে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠেন, বলেন বাবা নেই। আমি সে সময় বাড়িতে ছিলাম না, পাশের বাড়ির তীর্থ কাকুদের বারান্দায় বসে অন্য সবার সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথাবার্তা শুনছিলাম ও বলছিলাম। রাজেন নামে আমার এক ভাইপো সেখানে গিয়ে মৃত্যুখবর জানিয়ে বলে “কাকু, ছোটভাই মারা গেছে”। উল্লেখ্য, আমাদের বাড়িতে সে সময় পনেরটিও বেশি পরিবার বাস করত। বিশাল এই বাড়িতে আমার আপন ঠাকুর দাদা ও তাঁর অন্য ভাইদের সকল ছেলে-মেয়েদেরে মধ্যে আমার বাবা ছিলেন সকলের ছোট। তাই বাড়িতে নাতি-নাতনিদের ‘ছোট ঠাকুর দাদা’কে তারা আদর করে ‘ছোট ভাই বলে’ সম্বোধন করতো। যাহোক, বাবার মৃত্যু অনেকটা অপ্রত্যাশিত ছিল, যদিও মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। আমিও পরিবার এবং বাড়ির ভাইবোনদের মধ্যে সকলের ছোট বলে বাবার মৃত্যুপরবর্তী আমার জন্য সকলের আলাদা একটি সহানুভূতি ছিল। উল্লেখ্য, ৭১-এ আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম, বয়স ছিল ১৫ বছর। দ্বিতীয়ত, ঐ একই দিন (২৫ এপ্রিল ১৯৭১) পাকিস্তানী বাহিনী স্থল, বিমান ও নৌ হামলা চালিয়ে বরিশাল শহর মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে দখল করে নেয়। উল্লেখ্য, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল শহরেই মেজর জলিলের মুক্তিযুদ্ধকালীন হেডকোয়ার্টার ছিল। পাকিস্তানীরা তা দখল করে নেয়ার পর তিনি তার বাহিনী নিয়ে উজিরপুর ও গৌরনদী এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচলনা করেন। এ সময়ে তিনি একাধিকবার পয়সার হাট এবং আমাদের গ্রাম রাজাপুরে আসেন।

আমার জন্মস্থান রাজাপুর গ্রামের অর্ধেক অংশ তৎকালীন ফরিদপুর আর বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানায়, আর অর্ধেক বরিশালের গৌরনদীতে, বর্তমানে আগৈলঝাড়ায়। আমাদের গ্রাম থেকে শুরু করে উত্তর দিকে গ্রামের পর গ্রাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো নয় মাস মুক্তাঞ্চল ছিল। তবে মাঝেমধ্যেই পাকিস্তানী বাহিনী বিপুল সমরাস্ত্র নিয়ে এসব অঞ্চলে হামলা চালাতো। এমনই জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে একদিন। সে দিন আমাদের ঘুম ভাঙ্গে পাকিস্তানীদের গুলির শব্দে। ওরা আমাদের গ্রামে হামলা চালিয়েছে। কারণ আগের রাতে দুর্ধর্ষ দুই মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত ও কমলেশ কোটালীপাড়া থেকে ২০-২৫ জনের একদল রাজাকার ধরে এনে এখানে তাদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করেন। এরই প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানীদের এ হামলা। হেমায়েত ও কমলেশের মূল ক্যাম্প ছিলো আমাদের গ্রামে। তাই তারাও প্রস্তুত ছিলেন। পাল্টা হামলা চালান। টানা দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানীরা পিছু হটে যায়। কিন্তু আমরা খবর পেতে থাকি পাকিস্তানীরা বরিশাল ও গোপালগঞ্জ থেকে শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের গ্রামে যে কোন সময় হামলা চালাবে। তাই ঐ দিনই গ্রাম প্রায় শূন্য হয়ে যায়।

জুন মাসের ঐ হামলার পর আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে আর বাড়িতে থাকার সাহস পাইনি। শৈলদহ বিল এলাকার বড় ঠাকুর দাদা যে-বাড়ি করে গিয়েছেন, সেখানে পরিবার স্থানান্তর করি। দিনের বেলা রাজাপুরের বাড়ি, আর সন্ধ্যা হলেই বিলের বাড়ি, এই ছিল সে সময়ের নিত্যনৈমিত্তিক পালা। জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পাকিস্তানীরা আবার রাজাপুর এবং রামশীল গ্রামে হামলা চালায়। তবে ঐ দিন আমরা আর রাজাপুর গ্রামে যাইনি বিধায় প্রাণে বেঁচে যাই। ঐ দিন বড়দা’র উপর আমরা পরিবারের সকলে ক্ষেপে যাই, কারণ কেনো তিনি আমাদেরকে নিয়ে ভারত রওয়ানা হচ্ছেন না। বড়দা সে দিন ভারত যেতে রাজী হলেন।

অন্যদের সাথে আমাদের পরিবারেরও অনেক কষ্টক্লেশ শেষে জুনের শেষ নাগাদ কলকাতার উপকণ্ঠে লবনহ্রদ স্মরণার্থী শিবিরে ঠাই মেলে। কিন্তু কৈশোর পেড়িয়ে সবে যৌবনে পা দেয়া মন টানে বারবার যুদ্ধের ময়দানে। সুযোগ পাব কেমন করে? শুনেছি এই বয়সের ছেলেদের জন্য ট্রেনিং না হলে যুদ্ধে যাওয়া যাবে না। জানতে পারলাম যুবকদেরকে ট্রেনিং-এ নিয়ে যাবার জন্য মাধে মাঝেই লবনহ্রদে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রাক আসে। পরিবারের সকলের অগোচরে এই সুযোগ নিলাম এক দিন আমি আর ভাইপো উপেন। সম্ভবত সেটি ছিল আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহের কোন এক দিন। লবনহ্রদ থেকে কলকাতার শিয়ালদা স্টেশন সেনা ক্যাম্পে। সেখান থেকে সারা রাত ট্রেনে করে বাংলা-বিহারের সীমান্ত শহর রামপুরহাট ট্রেনিং ক্যাম্প।

হানিফ বক্তিয়ার আমাদের ক্লাসের সকলের চেয়ে বয়সে বড়, আমার চেয়ে বছর তিনেকের । তাই সহপাঠী হলেও আমরা সবাই তাকে হানিফ ভাই বলেই ডাকি। হানিফ ভাইসহ আমাদের সাথে আরো যারা পড়তো তাদের মধ্যে ছাত্তার, ফরহাদ এবং আরো কয়েকজন জুলাই-আগস্ট মাসে ভারতে ট্রেনিং নিয়ে সেপ্টেম্বরে দেশে ঢুকে যুদ্ধ শুরু করে দেয় । এ খবর জানতে পারি তাদের এক মাস পর আমিও যখন ভারতের ঔ একই ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। ঔ সময় জগদীশ, লিয়াকত ও নিরঞ্জন সরাসরি বাংলাদেশ থেকে রামপুরহাট ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে হাজির, আর আমি কলকাতার লবনহ্রদ থেকে। অনেকটা কাকতালীয়। এখানে ট্রেনিং-এ পরিচিতদের মধ্যে আরো যোগ দেয় আমার সমবয়সী ভাইপো উপেন, পাশের গ্রামের পরেশ, হরলাল, খালেকসহ আরো আনেকে। দূরের অপরিচিতদের মধ্যে ছিলো রাজশাহীর পুটিয়া থানার হুদা ও হাদি, দিনাজপুরের বিরল থানার নিজাম ও আব্দুল হাকিম, এক সময়ের খুলনার ছেলে- পরে ভারতের মধ্যপ্রদেশবাসী ক্ষিতিশ প্রমুখ, সবার নাম আজ আর মনে করতে পারছি না।

অনেক কিছু স্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলেও ট্রেনিং ক্যাম্পের অনেক অম্ল-মধুর স্মৃতিই আজো মনের মনিকোঠায় জ্বাজ্জোল্যমান । যেমন, হরলালের চেহারা নাদুসনুদুস গোলগাল ও ফর্সা এবং ট্রেনিং-এ সে তেমন পারদর্শি না হবার কারণে আমাদের ট্রেইনার মেজর মণ্ডল ওর নাম দিয়েছিলেন ‘কদ্দু’। আমরা সবাই ওকে নিয়ে খুব মজা করতাম, সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করতো। পুটিয়ার হুদার প্রেমিকার বাবা ছিলো রাজাকার, যার কারণে হুদা ট্রেনিং নিতে যায়, উদ্দেশ্য ঔ রাজাকারকে খতম করে প্রেমিকাকে ঘরনী করবে, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশে সে ঘর-সংসার করবে। একাজে প্রেমিকাই ছিলো তার প্রেরণার সবচেয়ে প্রধান উৎস। প্রতি রাতে হুদা আমাদেরকে প্রেমের গান গেয়ে শোনাতো। মান্না দে আর মোহম্মদ রফি’র গান গেয়ে শোনাতো ক্ষিতিশ । আগেই বলেছি ক্ষিতিশদের পরিবার খুলনার বাসিন্দা ছিলো, ৬০-এর দশকে তারা ভারতের মধ্য প্রদেশ চলে যায় । মাতৃভূমির টানে ক্ষিতিশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। দিনাজপুরের আব্দুল হাকিম আমাদের মধ্যে ছিলো সবচেয়ে ভালো শুটার। ট্রেনিং চলাকালীন তার বন্দুকের অব্যর্থ গুলির নিশানা আমাদের সবাইকে তাক লাগাতো।

রামপুর হাট ট্রেনিং সেন্টার মূলত বিহারের চাকুলিয়া ক্যান্টমেন্টের ঠিক দক্ষিণাংশজুরে অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশরা সেনা ও বিমান বাহিনী’র জন্য যুতসই করে এই ক্যান্টমেন্ট স্থাপন করে। কাজেই এখানে ট্রেনিং-এর সকল সুব্যবস্থা রয়েছে। ’৭১ সালে ভারত সরকার এটি গেরিলা ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়। এই ট্রেনিং সেন্টারে একেকটি দলে ১০জন করে গেরিলা স্কড এবং ১০টি স্কড, অর্থাৎ ১০০ জনের একটি কোম্পানি গঠন করে ট্রেনিং দেয়া হয়। প্রতিটি স্কডের একজন স্কড লীডার করা হয়। আমার সৌভাগ্য যে আমাকের স্কড লীডার করা হয়। ট্রেনিং সেন্টারে আমার গেরিলা নম্বর ছিল এফএফ-১০১। ট্রেনিং-এর সময়কাল ছিল ২১ দিন। ২১ দিন ট্রেনিং-এর পর প্রতিটি স্কড থেকে বাছাই করে একটি কোম্পানি থেকে ১০ জনকে আরো ২১ দিন স্পেশাল ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আমিও এই স্পেশাল ট্রেনিং নেয়ার সৌভাগ্যবানদের একজন। প্রাথমিক ও স্পেশাল ট্রেনিং-এর মধ্যে মূল পার্থক্য ছিলো ভারী অস্ত্র চালনা এবং রাজনৈতিক ট্রেনিং দেয়া। আমাদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষক ছিলেন মাদারীপুর নাজিম উদ্দিন কলেজের তৎকালীন ভিপি শাহজাহান খান (পরবর্তীতে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী)। তিনি দেরাদুনে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে গেরিলাদের ট্রেনিং দেয়ার প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন।

দলে দলে ট্রেনিং শেষে রণাঙ্গনে যাত্রার পালা। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তায় একদিন ভোরবেলা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ট্রাকে উঠে রাত ১০টা নাগাদ কল্যাণী বিশ্রাম ক্যাম্পে আশ্রয় মেলে । পর দিন ভোর বেলা নির্দেশ আসে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শরণার্থী শিবিরে যাদের পরিবার অবস্থান করছে তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করার জন্য তিন দিন সময় পাবে। আর চার দিনের মধ্যে পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তবর্তী বাগুন্ডি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হবে । বাগুন্ডি যাবার রাস্তাও জানিয়ে দেয়া হয় আমাদেরকে যে যার মত করে। আমার ও ভাইপো উপেনদের পরিবার কলকাতার উপকণ্ঠ লবনহ্রদ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় জুন মাসের শেষ নাগাদ। আমার মা, বড় দুই ভাই ও বৌদি ওখানে (বাবা ২৫ এপ্রিল যে দিন পকিস্তানীরা বরিশাল দখল করে সে দিন মারা যান)। লবনহ্রদ শরণার্থী শিবিরে আমরা দু’জনে ফিরে বাগুন্ডি ক্যাম্পে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এতে যার যার পরিবার, বিশেষত মায়েদের নিকট থেকে প্রচণ্ড বাধা আসে। সাত দিন আমি মায়ের আঁচলে-আঁচলে থেকে চেষ্টা ও ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে অনুমতি আদায় করতে সমর্থ হলেও উপেন ব্যর্থ হয়। অগত্যা অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তায় একদিন দুপুর দুইটা নাগাদ একাই লবনহ্রদ থেকে পদব্রজে শিয়ালদাহ স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চেপে বারাসত, সেখান থেকে ট্রেন বদল করে রাত আটটা নাগাদ হাসনাবাদ পৌঁছি। ঔ রাতের কয়েকটি মজার স্মৃতি উল্লেখ না করে পারছি না। বারাসাত স্টেশনে একটা বোর্ডে লেখা ছিলো, সম্ভবত এখনো রয়েছে, “হাসনাবাদ জানেকে লিয়ে গাড়ী বদলি কী জিয়ে”। বাংলা ও ইংরেজিতে অনুরূপ লেখা থাকলেও হিন্দি লেখাটা এখানে উদ্ধৃত করছি এ কারণে যে, আমি অদ্যাবধি হিন্দি তেমন রপ্ত করতে না পারলেও ঔ লাইনা আজো মনের কোণে স্পষ্ট গেঁথে আছে, কি কারণে জানি না। হাসনাবাদ যেতে যেতে ট্রেন প্রায় যাত্রী শূন্য হয়ে যায় । আমি একা এক কামরায় বসে আছি, এমন সময় টিকেট চেকার এসে তাড়া করল। আমি টিকেট দেখাতে ব্যর্থ হলে সে আমাকে স্টেশন মাস্টারের রুমে ধরে নিয়ে যায় । ট্রেন থেকে নেমে তার পেছন পেছন হাটতে হাটতে অতি সন্তর্পণে যে কাজটি করি তা হচ্ছে বড়দার দেয়া ২০ রুপির নোটটা যদ্দূর সম্ভব ছোট ভাঁজ করে গালের ভেতর ঢুকাই, সঙ্গে একটা চকোলেট, আর মায়ের দেয়া দশ রুপির নোটটা জামার কলারের পকেটে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ওদেরকে, তাই এ সাবধানতা । যা হোক, স্টেশন মাস্টার কিছু বলার আগে আমিই শুরু করলাম, আমি একজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, সকাল বেলা বfগুন্ডি যাব, কিভাবে যাব বলে দিন। স্টেশন মাস্টার আমার সাথে থাকা কাজগপত্র দেথে ট্রেনে গিয়ে আমাকে ঘুমাতে বললেন, আর কর্তব্যরত গার্ডকে হুকুম করলেন, সকাল বেলা যেন আমাকে বাগুন্ডি যাবার বাস ধরিয়ে দেয়। আমি বললাম, হাসনাবাদের সন্নিকটে টাকিতে মুক্তিযোদ্ধাদের যে ক্যাম্প আছে সেখানে থাকলে ভাল হয় কিনা। স্টেশন মাস্টার বললেন, এখন অনেক রাত হয়ে গেছে, ওখানে ওরা কাউকে ঢুকতে দেবে না, আর তাছাড়া প্রতিদিন সকাল বেলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বাগুন্ডি নেবার জন্য ট্রেন স্টেশনের কাছেই বাস আসে । বললাম, টাকি ক্যাম্পের দাপ্তরিক কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত আইয়ুব ভাইকে স্টেশন মাস্টার চিনেন কিনা। আমার মনে হচ্ছিল, আইয়ুব ভাইয়ের বিশেষ শারিরীক গঠন এবং তার গণসংযোগের পারঙ্গমতার কারণে স্টেশন মাস্টার তাকে চিনবেন। ঠিক তাই। স্টেশন মাস্টার বলল, কেনো চিনবো না তাকে, কিন্তু সে এখানে নেই, কয়েক দিন আগে ট্রেনিং নিতে দেরাদুন চলে গেছে।

ট্রেনের কামরার চেয়ার বিছানা হলেও, ঘুমটা খুব গভীর হল । সকাল বেলা গার্ডের ডাকে ঘুম ভাংলো। সে বলল তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই বাগুন্ডি যাবার বাস আসবে । সত্যি তাই, কয়েক মিনিটের মধ্যে বাস আসলো, আর ইতোমধ্যে টাকি থেকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাও এসে গেছে। আমাদেরকে একে একে কাগজপত্র দেখে বাসে উঠিয়ে বাগুন্ডি নিয়ে যাওয়া হ’ল। ওখানে যাওয়ামাত্র ফল-ইন করে আবার কাগজপত্র চেক করে আমার ক্যাম্পে যোগদানে বিলম্ব হয়েছে দেখামাত্রই হবিলদার (নাম ভুলে গেছি) শাস্তির বয়ান করলেন। যথা হুকুম, দু’পায়ের নীচ দিয়ে হাত ঘুরিয়ে কান ধরে ১০ মিনিট বসে থাকা, তারপর মুক্তি। একটু দূরে দেখি জগদীশ, লিয়াকত, খালেক ও নিরঞ্জন আমাকে দেখে হাসছে। ওরা সময়মত এসে ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে বলে কোন শাস্তি পেতে হয়নি। বলল, ঠিক সময় এসে গেছো, আজ রাতেই আমরা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে দেশে রওয়ানা হব। বললাম, ভাগ্যিস তোমাদেরকে পেয়ে গেছি, এক সঙ্গে যাওয়া যাবে, মজা হবে। ওদের মুখেই শুনলাম, তিন দিন আগে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি এখান থেকে পদব্রজে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলো, তারা যশোর পার হয়ে খুলনা যাওয়ামাত্র পাকিস্তানীদের অ্যাম্বুসে পড়ে, দলের প্রায় সকলেই শহীদ হয়। এদের মধ্যে ইতিপূর্বে বর্ণিত ক্ষিতিশও ছিলো, প্রাণ হারিয়েছে। শুনে দারুণ কষ্ট হ’ল সহযোদ্ধা বন্ধুদের জন্য, বিশেষ করে ক্ষিতিশের জন্য। ভারতে অভিবাসী পুরো পরিবার ফেলে দেশপ্রেমের অদম্য স্পৃহা নিয়ে যুদ্ধে যোগদান করছিলো ক্ষিতিশ, সে কিনা বেঘাটে প্রাণ হারালো। তোমাকে লাল সালাম ক্ষিতিশ, তোমার ঋণ শোধ হবার নয়, কোনও দিন ভুলতে পারবো না তোমাকে। মূলত ঔ দলের সাথেই আমারও যাবার কথা ছিলো। মায়ের বিলম্ব অনুমতির কারণে বেঁচে গেছি। মায়ের কথা মনে হতে চোখ দিয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল, মা তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছো, শাস্তি হিসেবে মাত্র দশ মিনিট কান ধরে বসে থাকাটা তোমার আশীর্বাদ বৈ কিছুই নয়। মনোবল বেড়ে গেলো, যুদ্ধ করবই, জিতবোই আমরা।

ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রারে নাম এন্ট্রি করা হয়ে গেছে, দুপুরের খাওয়াদাওয়াও শেষ। আবার ফল-ইন করার ডাক পড়ল। প্রথমে সম্ভবত ক্যাপ্টেন মেহেদি কিছু নিদের্শনামূলক বক্তব্য দিলেন, তারপর মেজর জলিল এসে সহাস্য একে একে সবার সাথে হাত মিলালেন, হিম্মত রাখতে বললেন। আমাকে দেখে মুচকি হেসে কাঁধ চাপড়ে বললেন, নাছোড়বান্দা, যুদ্ধে যোগদান করেই ছাড়লে। মেজর জলিলের স্মরণে ছিলো এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ আমাদের রাইস মিলে পজিশন নেবার কথা। সে সময় আমাদের গ্রামের তুখোর লাঠিয়াল সিদ্ধেশ্বরদা আর আমি তাকে মেশিনগানের গুলির বস্তা টানতে সাহায্য করেছিলাম। পজিশন নেবার পর বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে কাটিয়েছিলাম, আর যুদ্ধ করার সুপ্ত বাসনা ব্যক্ত করেছিলাম। উল্লেখ্য, পাকিস্তানিরা ২৫ এপ্রিল বরিশাল শহর দখল করার পর মেজর জলিল আমাদের গ্রামে এসে দিন দুয়েকের জন্য ঘাঁটি গেড়েছিলেন। ঘন ঘন স্থান বদল করা ছিলো তার যুদ্ধের কৌশল।

এভাবে মেজর জলিলের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আমরা ফের বাসে উঠলাম, গন্তব্য আবার হাসনাবাদ। বেলা ডুবতে ডুবতে হাসনাবাদ এসে বাস থামলো। মিনিট পাঁচেক পায়ে হেটে নদীর পাড়ে গিয়ে সওদাগরী নৌকায় ওঠলাম। চারটা বড় নৌকায় জনা পঞ্চাশের মত আমরা, সঙ্গে অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ, খাবার রসদ ও পানি। আগের দিনও আমাদের দলের অন্য পঞ্চাশ জন রওয়ানা হয়ে গেছে। এভাবে প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ঢুকছে দেশমাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে। এবার আর পদব্রজে নয়, নদী ও সমুদ্রপথে দেশে ঢোকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুলনায় পাকিস্তানিদের অ্যাম্বুসে পড়ে বহু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার আত্মাহুতির কারণেই আপতত নৌপথের এই আয়োজন।

আমাদের প্রতি নৌকায় একজন করে সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধাকে দায়িত্ব দেয়া হয়, দুইজন করে পেশাদার মাঝি, তাদের সঙ্গে আমরা পালাক্রমে দাঁড় টানছি। নৌকা চলছে ভারতীয় ভূখণ্ডের সুন্দরবনের আঁকাবাঁকা নদীনালা পেড়িয়ে, কখনোবা সমুদ্রের তীর দিয়ে। বড় মাটির হাড়িতে রাখা মিঠা পানিতে ভেজা চিড়া ও গুড়ই ছিলো আমাদের মূল খাবার। মাঝেমধ্যে মগ ভরে সমুদ্রের পানি তুলে চেখে দেখছি, তীব্র লবনাক্ত ও তেঁতো।

এভাবে দাঁড় টেনে দুই রাত একদিন পার করে একদিন ভোর বেলা বিশাল এক নদীর পার এসে হাজির আমরা। নদীর নাম রায়মংলা। এপারে ভারত, ওপার প্রিয় মাতৃভূমির বিশাল নয়নাভিরাম বনরাজি সুন্দরবন। এতো বড় নদী পাড়ি দেবার আগে সবাই আমরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে যদ্দূর দৃষ্টি যায় তন্ন তন্ন করে দেখে নিচ্ছিলাম। পাকিস্তানী বিশাল এক যুদ্ধ জাহাজ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। মাঝি মুহূর্তে নৌকা ঘুরিয়ে বনের মধ্যে লুকিয়ে নেয়। সে জানালো সন্ধ্যার আগে রায়মংলা পাড়ি দিলে নির্ঘাত পাকিস্তানীদের নিশানায় পড়তে হবে। অগত্যা গল্পগুজব করে আর রেডিও শুনে দিন কাটাতে হ’ল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই যতটা সম্ভব সমুদ্রের গভীরে গিয়ে রায়মংলার মোহনা বরাবর মাঝি নৌকা পাড়ি জমালো, আমাদেরকে বললো নৌকার ছৈ আর খোলের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে। বেশ দূরে হলেও মাঝে মাঝেই পাকিস্তানীদের যুদ্ধ জাহাজ থেকে সার্চলাইটের আলোয় রায়মংলার মোহনা জুড়ে আলোকিত হয়ে ওঠে। মাঝি অভয় বাণী শোনায়, অতো দূর থেকে রাতের বেলায় আমাদের নৌকা ঠাওর করা যাচ্ছে না। কি জানি, হবে হয়তো! মাঝির কথা বিশ্বাস করা ছাড়া আর কিইবা উপায়, আর তারা তো এ সমুদ্র অঞ্চলেই নৌকা চালাতে অভ্যস্ত, অভিজ্ঞ। ভরসা করাই যায়।

এমনি করে প্রায় সারা রাত নৌকা চলল। খুব ভোরে বাংলাদেশের সুন্দরবনে ঢুকতে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখছি জনা পাঁচ-ছয়েক লোক একটা ছিপ নৌকায়, হাতে রামদা নিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। বুঝতে বাকি রইল না এরা সুন্দরবনের জলদস্যু। আমরা নৌকার খোল থেকে এসএলআর ও এলএমজি বেড় করে ওদের দিকে তাক করতেই নৌকা ঘুরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে প্রাণ রক্ষা করল। আমরা ওদের পিছনে সময় ব্যয় না করে এগিয়ে চললাম। ক্রমান্বয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করছি আমরা। সুন্দরবন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ। সুন্দর, গরাণ, কেওয়া, গোলপাতা প্রভৃতি বৃক্ষরাজির মহাসমারোহ, নয়নাভিরাম। প্রাকৃতিকভাবে সাজানো-গোছানো। আক্ষেপ হচ্ছিল ছবি তুলতে পারিছিলাম না বলে, তখনতো আর আজকেরমত ক্যামেরা সহজলভ্য ছিলো না!

দিনরাত মিলে মোট চারবার জোয়ারভাটা। চাঁদের টানে সমুদ্রের এই লীলা খেলা এতোটা কাছ থেকে দেখা এর আগে আর হয়ে ওঠেনি। জোয়ারের সময় গোটা সুন্দরবনের নদীনালা ছাপিয়ে গাছপালা ডুবে যাচ্ছে, আবার ঘ্ন্টা ছয়েক পর নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। জোয়ারে আমাদের নৌকা চলে তিরতির দ্রুত গতিতে, আর ভাটার সময় শক্ত করে নৌকা বেঁধে না রাখলে নির্ঘাত সমুদ্র টেনে নিয়ে যাবে। তবে ভাটার সময় মাছ ধরা আর নদীর কিনারায় বনে ভ্রমণের মজা আজো হৃদয়ে দোলা জাগায়। সুন্দরবনের নদীর মাছ- না পুরোপুরি সামুদ্রিক, না মিঠা পানির, তবে অত্যন্ত সুস্বাদু, ধরে ধরে তাজা মাছ ভাঁজি খেতে সে কী মজা ভাবতে আজো জিহ্বে জল আসে। অন্যদিকে হরিণের মাংস? ছোটবেলা থেকেই বাপ-দাদার কাছে এ মাংসের গল্প শুনে আসছি, খাবার সৌভাগ্য হয়নি কখনও। মাঝি জানালো আমরা যে এলাকা অতিক্রম করছি সেখানে প্রচুর হরিণের বাস। তাই কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে তীরে নেমে পড়লাম চারজন এসএলআর নিয়ে। মাঝি সাবধান করে দিল বেশি গভীর অরণ্যে না যাবার জন্য। কারণ যে এলাকায় হরিণের বাস, তার আশেপাশে বাঘেরও বাস৷ বেশি ঘোরাফেরা করতে হ’ল না আমাদেরকে, দু’শ গজের মধ্যেই চার-পাঁচটা হরিণ দেখা গেল। গুলি চালালাম দু’জন এক সাথে। দু’টা হরিণ দাপাতে শুরু করল, দৌড়ে গিয়ে ধরে এনে সবাই মিলে মাংস তৈরির কাজে লেগে গেলাম। রান্না করার মসল্লা কেবল ভারতীয় খনিজ লবন আর গোলমরিচ। কিন্তু তাতে কি? কতদিন পর অমৃতের স্বাদ যেন লভেছি আমরা দুরন্ত যুব-কিশোর! তবে হরিণের মাংস খাওয়া ঔ প্রথম, ঔ শেষ, কারণ হরিণ বধ করা অবৈধ এবং অনৈতিকও বটে।

এভাবে আরো চার-পাঁচ দিন পর সুন্দরবনের শেষ প্রান্তে বলেশ্বর নদীর পারে পৌঁছালাম। জায়গার নাম বগী । সুন্দরবনের এ পারটা বাগেরহাটের শরণখোলা, আর ওপার পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া। মুক্তিযুদ্ধ চলাকলীন এই বগী এলাকা ছিলো গোটা দক্ষিণ বাংলার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কারণ, ক্যাপ্টেন জিয়া উদ্দিন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল) এক দুর্ভেদ্য ক্যাম্প স্থাপন করে শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে সেখানে ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করেন। তার গঠিত বাহিনী পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকলীন গোটা সুন্দরবন এলাকা শত্রুমুক্ত রাখে। তাছাড়া ভারত থেকে সমুদ্রপথে আসা মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করার পূর্বে তার ঔ ক্যাম্পে দু’এক দিন অবস্থান করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি যে এলাকায় প্রবেশ করবে সে এলাকায় যাবার রাস্তা রেকি করা এবং দীর্ঘ নৌ-সমুদ্র ও বনজঙ্গল পেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রাম নেবার প্রয়োজনে তারা সেখানে অবস্থান করতেন। বগী এলাকায় আমাদের অবস্থান ছিলো দু’দিন এক রাত।

যোদ্ধাতো যোদ্ধাই। তাই যারাই ক্যাপ্টেন জিয়ার ক্যাম্প হয়ে দেশে প্রবেশ করতেন তারা ওখান থেকেই যুদ্ধের প্রথম তালিমটা নিয়ে নিতেন। আমাদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেদিন নভেম্বরের ৪/৫ তারিখ হবে। আমরা সকালে নাস্তা সেরে একটু আশেপাশের বনেবাদারে ঘোরাফেরা করছিলাম। জগদীশ কোন সময়ই এসএমজিটা হাত ছাড়া করতো না, আমার হাতে এসএলআর। আমরা একটা কেওয়া গাছের ডালে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ বাঁশির শব্দ। বুঝতে পেলাম ফল-ইন করতে হবে, কিন্তু কেন? আমরাতো এখান থেকে রওয়ানা হয়ে যাবো সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর। তা একটু পরেই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গেলো। পাকিস্তানী গানবোট আসার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমাদেরকে নদীর তীর থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরে বিভিন্ন ট্রেন্সে পজিশন নিতে বলা হ’ল। ঔ ক্যাম্পের স্থায়ী মুক্তিযোদ্ধারা জানালেন বর্বর হানাদাররা প্রায় প্রতিদিন দু’একবার করে এ নদী দিয়ে গানবোট চালিয়ে যায় আর গোলাগুলি করে, আমাদেরকে তা প্রতিহত করতে হয়। এ কথা শোনায় মুহূর্তে প্রথমবারেরমত যুদ্ধে অংশগ্রহণের উত্তেজনায় আমরা টগবগিয়ে উঠি। আমাদের একদিন আগে এখানে আরো ৫০ জনের একটি দল ভারত থেকে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, আমাদের দলে ৫০ জন, তাছাড়া ওখানকার স্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা ১০০ জনেরও বেশি, সব মিলিয়ে ২০০ শতাধিক বাংলার অকুতোভয় দামাল ছেলে রণহুঙ্কার দিয়ে পজিশন নেবার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লাম। আমার চেয়ে বয়সে বড় আব্দুল হক এলএমজি, আমি এসএলআর, আর আমার চেয়ে শারিরীক গঠনে ছোট জগদীশ এসএমজি নিয়ে পাশাপাশি ট্রেন্সে পজিশন নিলাম। অন্যরাও পরপর পজিশন নিল। এভাবে প্রায় এক কিলোমিবার নদীর পার দিয়ে আমরা শক্তিশালী রক্ষাব্যুহ গড়ে তুলি। স্পষ্ট পাকিস্তানী গানবোট আসার শব্দ ক্রমান্বয়ে কাছে আসছে শুনতে পাচ্ছিলাম। এক সময় তাদের গানবোট দৃষ্টিগেচার হ’ল, আমাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে হানাদাররা শেলিং শুর করে দিল। বিকট আওয়াজে সুন্দরবন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। কানে তাক লেগে যাচ্ছিল। যাদের মাথায় হেলমেট ছিলোনা তারা যে যার মতো করে গামছা বা পকেটে থাকা রুমাল দিয়ে বা কান বেধে নিলাম। হানাদাররা গানবোট থেকে তীরে না নামলে কোন গুলি না চালানোর নির্দেশ ছিলো আমাদের প্রতি। কমান্ডারের আদেশ অমান্য করা যাবে না। কিন্তু আমাদের ত্বর সইছিলো না, নরখাদক, হানারাদ আমাদের সামনে দিয়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা নিশ্চুপ বসে থাকবো, তা কি করে হয়? কায়মনোবাক্যে চাচ্ছিলাম এক দু’টা জানোয়ার ডাঙ্গায় নামছে না কেন? আমরাতো কোন গুলি ছুরছি না, তা হ’লে আমরা যে দুর্বল এই ভেবেওতো ওরা আমাদের ক্যাম্প দখলে নেবার জন্য ধেয়ে আসতে পারেতো। অবশেষে আমাদের আশার আলো দেখা গেলো। দু’তিনটা খাকি পোষাক পড়া কুত্তা ডাঙ্গায় নামতেই হক বললো, চালাচ্ছি, তুইও চালা গুলি, জগদীশ তুই চালাবি না। একসাথে এলএমজি আর এসএলআর চললো, অন্যান্য ট্রেন্স থেকেও চললো সমান তালে, ডাঙ্গায় নামা জানোয়ার সব ক’টাই ধরাশায়ী। গানবোট নিয়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালো অন্য কয়টা। প্রথম যুদ্ধে বিজয়ী আমরা! “জয় বাংলা” ধ্বনি তুলে মহাউল্লাসে ট্রেন্স ছেড়ে একে একে সবাই উঠে আসি।

তখন দুপুর গেড়িয়েছে মাত্র। আমরা গোসলাদি ও খাওয়াদাওয়া সেরে বিশ্রাম নিলাম। দেশের ভেতর থেকে রেকিম্যান এসে খবর দেবার অপেক্ষা। চারটা-সাড়ে চারটা নাগাদ রেকিম্যান এসে আমাদেরকে যাত্রা করার গ্রীন সিগন্যাল দিল, সঙ্গে আরেকটি বিশেষ খবর। মঠবাড়িয়া থানা মুক্তিবাহিনী কমান্ডার আমাদেরকে অনুরোধ জানিয়েছেন আমরা যেন উক্ত থানা মুক্ত করতে তাদেরকে সহায়তা করি। এ অনুরোধের কারণ- ইতোমধ্যে ঔ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা জেনে গেছে এ যাবতকালের মধ্যে ভারত থেকে আসা সকল মুক্তিযোদ্ধা দলের মধ্যে আমাদের দলটাই ছিলো অস্ত্রেশস্ত্রে সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ। সরাসরি রেকিম্যানকে কিছুই জানালাম না বটে, কিন্তু আমরা সকলের জানা ছিল মূল গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে বড় কোন যুদ্ধে জড়ানো যাবে না- যদি না একান্ত চেপে বসে, যেমনটি ঘটেছিলো ঔ দিন কিছুক্ষণ পূর্বে গানবোটে আসা পাকিস্তানীদের সাথে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে পুরোপুরি রণসজ্জিত আমাদের ১১০ জনের একটা গেরিলা দলটি পর পর পাঁচ-ছয়টা বড় নৌকায় বলেশ্বর নদী পার হয়ে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করি। আমাদের দলের দায়িত্বে ছিলেন সর্ববয়োজেষ্ঠ্য আব্দুল মালেক। আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হ’ল রাতে কখনও পায়ে হেটে, আবার কখনওবা নৌকাযোগে গন্তব্যের পানে এগোতে হবে। দিনের বেলা হাইড-আউট করে থাকতে হবে। মঠবাড়িয়া থানা তখনও পাকিস্তানী মিলিশিয়া এবং রাজাকার বাহিনীর দখলে ছিল। সিদ্ধান্ত মোতাবেক উক্ত থানা পাশ কাটিয়ে আমরা হেটে চলতে থাকলাম। প্রায় সারারাত হেটে আমরা ক্লান্ত। খরস্রোতা গাবখান নদী পার হয়ে আগে থেকে নির্ধারিত আমাদের আশ্রয়স্থলে পৌঁছি। কিন্তু সকলকে এক সাথে বিশ্রাম নেয়া চলবে না। একদল বিশ্রাম নেবে, আরেক দল পাহাড়ায় থাকবে, অন্যথায় শত্রুর হামলা হলে নির্ঘাত সবাইকে মারা পড়তে হবে। এভাবে দিন কাটানোর পর সন্ধ্যায় আমাদের গাইড এবং রেকিম্যান এসে খরব জানালো নাজিরপুর, তুষখালি, কাউখালি প্রভৃতি এলাকায় কোন পাকিস্তানী সেনা বা মিলিশিয়া নেই, তবে এখনো কিছু আলবদর-রাজাকার সেসব এলাকায় লুটতরাজ ও অত্যাচার চালাচ্ছে। তারা ততোটা শক্তিশালী নয়। তাই ওসব এলাকা দিনের বেলায় অতিক্রম করতে আমাদের কোন অসুবিধা হবে না। আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিলাম, যাবার সময় আলবদর-রাজাকারগুলোকে সাবার করে দিতে হবে। তুষখালি বাজারে গিয়ে জানতে পারলাম, ঔ এলাকার আশে-পাশে কিছু চিহ্ণিতি রাজাকার সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, সুযোগ পেলেই সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। লোকজন আমাদের কাছে এসে একে এক নালিশ করতে থাকলে আমরা পাঁচ গ্রুপে ভাগ হয়ে তিন গ্রুপ চলে গেলাম রাজাকারদের সন্ধানে, আর দুই গ্রুপ থাকলাম বাজারে পজিশন নিয়ে ওদেরকে কভার দেবার জন্য। ঘণ্টা দুয়েক অপারেশন শেষে এলাকাটা রাজাকারশূন্য করে আবার আমরা বাজারে মিলিত হলাম। তবে কোন রাজাকারকে ধরা যায়নি, কারণ তারা আমাদের আসার খরব জেনে আগেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। সন্ধ্যায় আমাদের সাথে আসা তুষখালি, কাউখালি এবং আওড়াবুনিয়া এলাকার বেশ কিছু সহযোদ্ধাকে ওখানেই যার যার এলাকায় যাবার জন্য বিদায় জানালাম। আমাদরেকে কিছুদূর পায়ে হেটে কাউখালির পাশ থেকে আবার নৌকায় ওঠতে হ’ল। এবার এক রাতের মধ্যে স্বরূপকাঠি, বানারিপাড়া, হারতা, ধামুরা প্রভৃতি এলাকা পাড় হয়ে উজিরপুর এসে ক্ষান্ত হলাম। সারারাত ঔসব এলাকা অতিক্রম করার সময় আমাদেরকে অত্যন্ত সন্তর্পণে নৌকা চালাতে হয়েছে, ছৈয়ের আড়ালে এলএমজি, এসএলআর, আর থ্রি-নট-থ্রি নিয়ে পাহাড়া দিতে হয়েছে। এলাকাগুলো ভালো করে রেকি না করার ফলে আমাদের এ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। সে যাক, রাত পোহালেই পায়ে হেটে পাঁচ মাস পর আমাদের গৌরনদী থানার সরাইল গ্রামে পৌঁছালাম। এটি নভেম্বর মাসের ১০-১২ তারিখের কোন একদিন হবে।

আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য গৌরনদী থানা মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার। নলচিড়া বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়কের পূর্ব দিকে, আর সরাইল পশ্চিমে। দিনের বেলা উক্ত মহাসড়ক অতিক্রম করা নিরাপদ ছিল না। কারণ সে সময়-অবধি এ সড়ক ধরে পাকিস্তানী সৈন্যদের আনাগোনা ছিল। তাই দিনের বেলা সরিকল গ্রামের এক বাড়িতে বিশ্রাম, দুপুরের স্নানাহার এবং রাতের খাবার খেয়ে কাশেমাবাদ এলাকা হয়ে আমরা মহাসড়কটি অতিক্রম করি। রাতের বেলা পাঁচটি উপদলে ভাগ করে আমাদেরকে পিঙ্গলাকাঠি প্রাইমারী স্কুলসহ আশেপাশের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়। পরের দিন আমরা নলচিড়া হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করে আবার পিঙ্গলাকাঠি প্রাইমারী স্কুলেই ফিরে আসি। কারণ, আমাদের আগমনের পরপরই থানা মুক্তিবাহিনী প্রধান নিজামউদ্দিন দিন কয়েকের মধ্যেই গৌরনদী থানা আক্রমন করে দখলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উল্লেখ্য, অস্ত্রশস্ত্র সমৃদ্ধ আমাদের শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা দলের আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন এই কমান্ডার। এভাবে চতুর্দিকে মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলে চূড়ান্ত আক্রমন চালানোর পরিকল্পনা করার দু’ দিনের মাথায় আমাদের নিকট খবর আসে পাকিস্তানী মিলিশিয়া এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা থানা ছেড়ে গৌরনদী কলেজে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্থানীয় মূল ক্যাম্পে চলে গেছে। তাছাড়া বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়ক ধরে ওদের আনাগোনাও আর পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমাদের প্রস্তুতির খবর জেনে গিয়েছিল বলেই তারা থানা ছেড়ে মূল ঘাটিতে চলে গেছে, আর তারা রাস্তায় টহল দিতেও বেরুচ্ছে না। এই খবর যে দিন আমরা পাই সেটি ছিল ঈদের আগের দিন- যা বিশেষ কারণে এখনো আমার মানসপটে জ্বলজ্বল করছে।

আমাদের প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল মালেকের নিজ বাড়ি পিঙ্গলাকাঠি। তিনিসহ দলের অন্য চার সিনিয়র সদস্য সোবহান, শাহজাহান, শাহনেওয়াজ ও শামসু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণার্থে থানা কমান্ডারের সাথে আলাপ-আলোচনা করার জন্য নলচিড়া চলে গেলেন। পিঙ্গলাকাঠি প্রাইমারী স্কুলে অবস্থানরত উপদল কমান্ডার শাহজাহান। নলচিড়া থেকে তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে উপদলের দায়িত্ব দিয়ে যান। ঠিক সন্ধ্যার সময় হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে আমরা হতচকিত হয়ে উঠি। মুহূর্তে যে যার অস্ত্র নিয়ে স্কুলের চারদিক ঘিরে পজিশন নেই। গুলি ছুড়তে শুরু করি। পাল্টা কোন গুলি আসছে না দেখে ক্ষাণিকক্ষণ পর আমরা গোলাগুলি বন্ধ করে যে যার পজিশনে অস্ত্র তাক করে বসে থাকি। একটু পর আমাদের একজন বলে উঠল, আরে আগামীকালতো ঈদ, সে আনন্দে আশেপাশের বাড়িতে আতশবাঁজি করা হয়েছে, তারই শব্দ শুনেছি আমরা। আমাদের নিকট বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেলেও আরো কিছুক্ষণ অস্ত্র হাতে পজিশনে থাকলাম। এভাবেই ’৭১-এর ঈদ উদযাপন শুরু আমাদের।

পরের দিন, অর্থাৎ ঈদের দিন পিঙ্গলাকাঠি বাজার ও লঞ্চঘাটে পজিশন নেই। উদ্দেশ্য, ঢাকা থেকে আগত লঞ্চ তল্লাশি করা। লঞ্চ এলে তা তল্লাশি করে যথারীতি ছেড়ে দিলাম। পিঙ্গলাকাঠি লঞ্চঘাটে প্রত্যক্ষ করা দু’টি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন।

প্রথমত, লঞ্চঘাটে এক যুবক একটা মেয়ের নাম ধরে বারবার চিৎকার করে তাকে ফিরে পাবার আকুতি জানাচ্ছিল। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে আমরা জানতে পারি ছেলেটা ঔ মেয়েটাকে ভালোবাসত। মে মাসে মেয়েটাকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে যায়। তার আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। সে শোকে ছেলেটা পাগল হয়ে মেয়েটার নাম ধরে চিৎকার করছে।

দ্বিতীয়ত, মলিন বসনা উস্কখুস্ক চেহারার শান্তশিষ্ট এক যুবতী বিড়বিড় করে কী যেন বলছে আর নদীর পার দিয়ে হেটে চলছে। কাছে গিয়ে আমরা কিছু জিজ্ঞেস করলে সে যে ভাষায় উত্তর দিল তা আমাদের বোধগম্য হল না। আশেপাশের লোকজন জানালো, গত ক’দিন যাবত মেয়েটাকে এখানে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তার কোন ঠিকঠিকানা কেউ জানে না, তার কথাও কেউ বুঝতে পারে না। চেহারা দেখে মনে হয় সে উপজাতীয় কোন গোষ্ঠীভূত। সম্ভবত, পাকিস্তানীরা ধরে এনে লাঞ্ছিত করে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার সময় মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে গেছে।

ঘটনা দুটো পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার সামান্যতম বিবরণ মাত্র।

দুই তিন দিন পিঙ্গলাকাঠি ও নলচিড়া এলাকায় তল্লাশি করে আমরা নিশ্চিত হলাম গৌরনদী থানার পূর্বাঞ্চলে কোন পাকিস্তানী সৈন্য বা মিলিশিয়া বা রাজাকার-আলবদর নেই। আমাদের প্রতি নির্দেশ আসে গৌরনদী থানা হেডকোয়ার্টারে অবস্থান নেবার। উদ্দেশ্যে- গৌরনদী থানায় পাকিস্তানীদের সর্বশেষ অবস্থান গৌরনদী কলেজে সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে দখলে নিয়ে উক্ত থানাকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা। কথামত আমরা গৌরনদী থানা হেডকোয়ার্টারে অবস্থান নিলাম। সেখানে তখনো রান্না করার ব্যবস্থা হয়নি বিধায় পাশের গ্রামগুলোর একেক বাড়ি থেকে একেক দিন রান্না করে দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়, আর সকালের নাস্তার জন্য চিড়ামুড়ি, কলা, বিস্কুট, চা ইত্যাদি।

আমরা গৌরনদী কলেজে আটকে পড়া পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের দোসর ও পরিবার-পরিজনদেরকে চার দিক থেকে ঘিরে রেখেছি। সব মিলিয়ে সংখ্যায় ওরা দু’-আড়াইশ’র কম ছিল না। রয়ে রয়ে দু’ পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হচ্ছে। তবে আমরাই প্রথম শুরু করি, আর উপস্থিতি জানান দিতে ওরা কেবল পাল্টা গুলি ছোড়ে। ওরা বেশ কিছু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে কলেজ এলাকায় শক্তিশালী একটি রক্ষাব্যুহ তৈরি করে, কিন্তু বাইরে আসে না এবং বেশ চতুরতার সাথে রসদ জোগার করে ও অন্যান্য কাজ সারে- যেমন, কলেজ মাঠে চাপা কল থেকে পানি নেবার জন্য কোন পুরুষ না এসে মহিলাদেরকে পাঠায়। এমনি ছলচাতুরি ও লুকোচুরির মধ্যে একদিন কলেজের ৫০০ গজ দূরে পালরদি স্কুল ঘরের একটি বাঙ্কারে আমরা অবস্থান করছি। পাশের বাঙ্কারে রহিম, হারুন, মোস্তাফা প্রমুখ ৪-৫ জন সহযোদ্ধা। বিকেলের দিকে একটা মহিলাকে ধরে একটা পুরুষ লোক কলেজের ছাদের উপর হাটাচ্ছে দেখতে পেয়ে আমরা সতর্ক হয়ে যাই। আমাদের সঙ্গে থাকা বাইনোকুলার দিয়ে দেখা যায় মহিলাটা গর্ভবতী। আমরা ইতস্তত করতে থাকি গুলি চালানো ঠিক হবে কিনা। কিন্তু কিছু বলার আগেই পাশের বাঙ্কার থেকে সহযোদ্ধারা একযোগে গুলি চালালে পুরুষ ও মহিলা দুজনকেই ছাদের উপর পড়ে ছটফট করতে দেখা যায়। গর্ভধারিনীর প্রাণহানির জন্য আমাদের কিছুটা মন খারাপ হয়। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সবকিছুই মেনে নিতে হয় বলে একটু পরে আমরা যার যার দায়িত্ব পালনে মনোনিবেশ করি।

আমরা পুরোদমে শেষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি ওদেরকে উৎখাত করবার জন্য। এ কাজে পাশের এলাকার দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন ও কমলেশ বেদজ্ঞ’র সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়। তারা নির্দিষ্ট দিনে সদলবলে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আমাদের সংকেতমত একযোগে গৌরনদী কলেজে আক্রমন চালাবে। এরই মধ্যে আমরা যারা ভারত থেকে ফিরে বাড়ি যাইনি তাদেরকে কমান্ডার নিজাম উদ্দিন ৪ ডিসেম্বর হ‍ঠাৎ ডেকে বললেন, তোমরা বাড়ি যাও, সাত দিনের বিশ্রাম নিয়ে আসো। কারণ এরপর যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোন ছুটি পাবে না। এ আরেক বিপদ। কারণ, গৌরনদী থেকে বাড়ি গিয়ে যাবো কার কাছে, উঠবো কোথায়? কেউ যে নেই ওখানে! বাড়িতে কেউ না থাকার কারণে ওটাতো এখন সাপ-শেয়ালের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু কমান্ডারের নির্দেশতো অমান্য করা যাবে না। তাই বাড়ি গেলাম বটে, তবে নিজেদের বাড়ি নয়, পাশের গ্রামের বন্ধুদের বাড়ি। কিছুটা বিসন্নতা থাকলেও সময় কেটে যাচ্ছিল ভালোই। ৬ ডিসেম্বর আকাশবাণীর খবর শোনার জন্য সহযোদ্ধা তিন বন্ধু- খালেক, জগদীশ ও আমি মিলে গোপালগঞ্জ ও বরিশালের সীমান্তবর্তী মুক্ত অঞ্চলে রেডিও ধরে একটা লোহার পুলের উপর বসে আছি। খবরে শুনলাম ভূটান প্রথম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা আনন্দে মেতে ওঠলাম। কিন্তু আরো অধিক কিছু শোনার জন্য মন আনচান করছিল। এমন সময় ঘোষণা এলো- এখন লোকসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। আমরা চুপ হয়ে রেডিওতে কান পেতে বসে রইলাম। এ যেন স্বর্গলোক থেকে দেবি মহামায়া আমোঘ বাণী শোনাচ্ছেন। সেসবের অনেক কিছুই আজ আর মনে নেই, যদিও এটি ঐতিহাসিক ও কালজয়ী ভাষণ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তবে ঐ ভাষণের যে দু’টি বিষয় এখনো আমার স্মৃতিতে আম্লান হয়ে আছে তা হচ্ছে- (১) এ ভাষণের মাধ্যমেই ইন্দিরা গান্ধী ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং (২) তিনি হিন্দিতে যা বলেছিলেন তার অর্থ হচ্ছে, “আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতার মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে এনে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে চাই ভারত কী পারে”।

আমরা তিন বন্ধু উত্তেজনায় কোন রকমে সারা রাত কাটালাম, কখন ভোর হবে, আমরা ক্যাম্পে যাবো, যুদ্ধ করবো, দেশকে তাড়াতাড়ি মুক্ত করবো। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সে দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করার বিশ্ব জানান দিয়েছেন। এখন শুধু চূড়ান্তভাবে বিজয় কেতন ওড়াবার অপেক্ষা। তাই ৬ ডিসেম্বর আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল চির ভাস্বর একটি দিন।

৬ ডিসেম্বর নিশ্চিত হয়ে গেছি বিজয় অত্যাসন্ন। প্রায় গোটা বরিশাল ইতোমধ্যে মুক্তাঞ্চল বনে গেছে। ফরিদপুরের সর্বশেষ পাকিস্তানী ঘাটি মাদারীপুর শহর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করে ফেলেছে ৯ ডিসেম্বর। চারদিক থেকে একের পর এক শহর-বন্দর-নগর মুক্ত করার খবর পাচ্ছি। ১৪ তারিখ থেকে জেনারেল নিয়াজির উদ্দেশ্যে আত্মসর্মপণের জন্য জেনারেল ম্যানেকশ’র ঘোষণা বারবার শুনতে পচ্ছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং আকাশবাণী থেকে। ঢাকার একেবারে উপকণ্ঠ মিরপুর লোহার ব্রিজের অপর পার আমিন বাজার এসে ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরা মাইকে তার এককালের ব্যাচমেট পাকিস্তানী মেজর জেনারেল জামশেদকে আত্মসমর্পনের আহ্বান জানাচ্ছেন, চিরকুটও পাঠিয়েছেন। এসব খবর শুনে আমরা উত্তেজনায় টগবগ করছি কখন উত্তর বরিশালের শেষ পাকিস্তানী ঘাটি গৌরনদী কলেজ আমরা মুক্ত করব। চার দিক থেকে কলেজটি ঘিরে রেখেছি, থেমে থেমে গুলি চালাচ্ছি আমরা বটে, কিন্তু পাল্টা কোন গুলি আসছে না। বুঝতে বাকি রইলো না ওদের মনোবল একবোরেই নিঃশেষ। এভাবে ১৫ তারিখও কেটে গেলো, ১৬ তারিখ সকাল ৮টায় মিরপুর ব্রিজের উপর জেনারেল নাগরা আর কাদের সিদ্দিকীর নিকট ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর প্রথম দলটি আত্মসমর্পন করে, আমরা জানতে পারি এ দিন বিকেল বেলা যে কোন সময় পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার নিয়াজি আত্মসমর্পণ করবে। অবশেষে এ দিন বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে নিয়াজি তার পুরো ট্রুপসহ রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু আমরা ভেবে পাচ্ছিলাম না গৌরনদী কলেজে অবস্থানরত পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করছে না কেন? ১৭ তারিখ সকাল বেলা হঠাৎ কলেজের ভেতর থেকে এক রাজাকার হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বেড়িয়ে এসে আমাদেরকে জানালো পকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করতে চায়, তাই তারা অনুরোধ জানিয়েছে গোলাগুলি বন্ধ করতে। আমাদের সর্বকনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ইউনুসকে আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া সম্বলিত পত্র নিয়ে পাকিস্তানীদের নিকট পাঠানোর সিদ্ধান্ত হ’ল । আমাদের সন্দেহ ছিলো ইউনুস যেতে রাজি হবে কিনা। ওকে বলামাত্র সানন্দে রাজি হয়ে গেলো, চিঠি নিয়ে কলেজ মাঠ পেরিয়ে মূল ভবনে ঢুকে পড়ল। আমরা ওকে বাঙ্কার থেকে কভার দেবার সব ব্যবস্থা রেখেছি। পাকিস্তানীদের বিশ্বাস নেই। তাই ইউনুস ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা উৎকণ্ঠিত ছিলাম। তবে ওর কোন ক্ষতি করার সাহস যে ওরা পাবে না তা অনেকটা নিশ্চিত ছিলাম, কারণ ওদের সব কিছু আমরা বন্ধ করে দিয়েছি । পাকিস্তানী এক সৈন্য কলেজ মাঠের টিউবওয়েল থেকে পানি নিতে এসে আমাদের গুলি খেয়ে মারা পড়েছে । পরে পানি নেবার কাজে মহিলা, এমনকি গর্ভবতী কাউকে পাঠিয়েছে ওরা। আমাদের ধারনা সত্যি হ’ল, শ্বস্তি ফিরে পেলাম, ১৫ মিনিটের মধ্যে সদর্পে ইউনুস বেড়িয়ে এলো। তবে ও যা বললো তাতে আমাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হ’ল। পাকিস্তানীরা মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসর্মপণ করতে নারাজ, আমাদেরকে ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না, ওদেরকে আমরা মেরে ফেলব এই ভয়। তাই ওরা ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্মসর্মপণ করতে চায়। এতে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তখনই চার দিকে থেকে সাড়াসি আক্রমন চালিয়ে কলেজ দখল করার প্রস্তাব করল। আমরা আলোচনায় বসলাম। পাকিস্তানীদের এ মনোভাবের খবর বরিশাল ও ঢাকায় জানানো হলে ওখান থেকে আমাদেরকে আক্রমন করতে বারণ করা হ’ল। জানানো হ’ল ভারতীয় বাহিনী যাচ্ছে, ওদের নিকটই গৌরনদী কলেজে অবস্থানরত পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করবে। কারণ, কলেজে আক্রমন চালালে আশেপাশে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হবে। আমরা পালাক্রমে কলেজের চারদিক বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান বদলাচ্ছিলাম। পরের দিনই ভারতীয় বাহিনী এলো, পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করলো, আমরা বাঙ্কার ছেড়ে যে যার ক্যাম্পে চলে গেলাম। আমাদের মূল ক্যাম্প গৌরনদী থানায়। সেখানে আমরা ৫০ জন যোদ্ধা। মুক্ত রাজধানী ঢাকা শহর, মুক্ত জেলা শহর বরিশাল, মু্ক্ত আমাদের থানা গৌরনদী, মুক্ত গোটা দেশ। তা এখন গ্রেনেডগুলো দিয়ে করব কি? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো- থানার সামনের পুকুরটায় মাছ আছে, ওখানে গ্রেনেড হামলা চালাই না কেন? মাছ শিকারের অভিনব ফন্দি! যে কথা সে কাজ, একটা গ্রেনেড পানিতে ছুড়ে মারলাম। ফলাফল- কিছুক্ষণ পর একটা মাঝারি রুই, আকেরটা বড় কাতলা মাছ ভেসে ওঠল। আমাদের মজার ভুরিভোজ হ’ল। তখন সময় বেলা ৩-৪টা হবে। হঠাৎ বরিশাল থেকে খবর এলো ওখানে গিয়ে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ জমা দিতে হবে এবং ওখানেই আমাদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হবে। ১০ মিনিটের মধ্যে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে আমরা রওয়ানা হলাম। বোঝাই যাচ্ছে, কোন যান্ত্রিক যান নেই, আছে সৃষ্টিকর্তা আর মা-বাবার বদৌলতে পাওয়া ১১ নম্বর গাড়ি (দু’পা)। অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ ও ব্যাগ-বস্তা হাতে, কাঁধে, পিঠে ও মাথায় নিয়ে আমরা হাটতে শুরু করলাম। সুশৃংখলভাবে লেফ্ট-রাইট করতে করতে বিজয়ের উল্লাসে ২২ মাইল রাস্তা আমরা যে কখন পাড় করে দিলাম তা টেরই পেলাম না । নিমিষেই বরিশাল পুলিশ লাইনে পৌঁছে গেলাম। আহা কি আনন্দ!

(অসমাপ্ত)
পথম গ্রন্থনা: ১৪ ডিসেম্বর ২০১১
পুনঃলিখন: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯


সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৪০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×