somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন : আতঙ্কের রাজত্ব ও এক ব্যক্তির শাসন কায়েম করা হয়েছে : খালেদা জিয়া

১০ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন : আতঙ্কের রাজত্ব ও এক ব্যক্তির শাসন কায়েম করা হয়েছে : খালেদা জিয়া
স্টাফ রিপোর্টার
বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশের সাধারণ মানুষ আজ ভালো নেই। অল্প কিছু লোক ভালো আছে। তারা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। দেশজুড়ে কায়েম করেছে ভীতি ও আতঙ্কের রাজত্ব। একব্যক্তির শাসনে চলছে দেশ। শাসক আর শাসিত এই দু’ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে বাংলাদেশকে। একদলীয় বাকশালী দুঃশাসনের প্রবক্তারা আবার এক-ব্যক্তির শাসন কায়েম করেছে। গত দু’বছরে সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জাতিকে অসত্য তথ্য ও কল্পকাহিনী শুনিয়েছেন। তার ডিজিটাল স্টোরি এখন ভয়ঙ্কর দুর্নীতি ও পরিহাসে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেটে জড়িত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। শাসক দলের উত্পীড়নে মনে হয় ভিনদেশী শত্রুকবলিত দেশ। এ পরিস্থিতিতে সর্বাত্মক গণঐক্য গড়ে তুলতে তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
বর্তমান সরকারের দুই বছরের শাসনের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া দেশবাসীর প্রতি এ আহ্বান জানান। গতকাল বিকালে তার গুলশান কার্যালয়ে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী ভাষণে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ভুল, অসত্য, ভিত্তিহীন ও বিকৃত তথ্যে ভরা বলে উল্লেখ করেন।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, একাংশ মানুষ এখন দেশের মালিক-মোক্তার সেজে বসেছে। তারা দেশের সর্বনাশ করে নিজেদের ভাগ্য গড়ছে। দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। কেউ যাতে এর প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য তারা দেশজুড়ে কায়েম করেছে ভীতি ও আতঙ্কের রাজত্ব। তাদের ভয়ে কেউ টুঁ-শব্দটিও করতে পারছে না।
তিনি বলেন, জনগণের কণ্ঠ হিসেবে যাতে সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরতে না পারে সেজন্য তাদের গলাটিপে ধরা হয়েছে। হত্যা, গ্রেফতার-নির্যাতনের মাধ্যমে গণমাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করায় দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
বেগম জিয়া বলেন, সবখানেই আজ বিপজ্জনক পরিস্থিতি। হামলা, হুমকি, মামলা, গ্রেফতার, খুন, জখম, জুলুম, নির্যাতন, সন্ত্রাসের মাধ্যমে গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু কথা বলে যাচ্ছে একদল স্তাবক। শাসক আর শাসিত এই দু’ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে বাংলাদেশকে। একদলীয় বাকশালী দুঃশাসনের প্রবক্তারা আবার এক-ব্যক্তির শাসন কায়েম করেছে। এক-ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়েছে বাকি সবাইকে।
খালেদা জিয়া বলেন, মানবতা আজ লাঞ্ছিত। শাসক দলের বাইরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে অধঃপতিত করা হয়েছে। তাদের কারও মর্যাদা নেই। সামান্যতম নিরাপত্তাবোধও অবশিষ্ট নেই। শাসক দলের উত্পীড়ন ও ঘৃণা-বিদ্বেষের মাত্রা দেখে সবার মনে হচ্ছে, এ যেন ভিনদেশী শত্রুকবলিত এক অচেনা স্বদেশ।
এই ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে বর্তমান শাসক দল তাদের ক্ষমতা আরোহণের তৃতীয় বছরে পা রেখেছে।
দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রঙচঙে প্রকাশনা ও বর্ণিল প্রচারণা দেশবাসী অবাক হয়ে দেখেছে ও শুনেছে। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিয়েছেন। তার অনুগত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ আনন্দ-মিছিল করেছে।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগ যখন আনন্দ-মিছিল করে তখন ছাত্র কিংবা শিক্ষক-সমাজ কেবল নয়, সারাদেশের সব পর্যায়ের মানুষই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেননা, ছাত্রলীগ আজ মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নারী-নির্যাতন, বন্দুক-বোমা-চাপাতি-কুড়াল নিয়ে হামলা, দখল, শিক্ষক লাঞ্ছনা, চোরাচালান, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে এহেন অপকর্ম নেই যার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। একই রকম ঘৃণিত অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ শাসক দলের অন্যান্য সহযোগী সংগঠন। সন্ত্রাস চালিয়ে প্রতিবাদী সব কণ্ঠ তারা স্তব্ধ করে দিয়েছে। লিপ্ত হয়েছে নিজেদের মধ্যে মারামারি, হানাহানি, সশস্ত্র সন্ত্রাস এবং ভাগাভাগি ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে। তিনি বলেন, এখন কোথাও কোনো হাঙ্গামা হলেই মানুষ জানতে চায়—কোন লীগ কোন লীগের ওপরে হামলা করেছে। দুই বছরপূর্তি উপলক্ষে এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের আনন্দ-মিছিল প্রমাণ করে, গত দুই বছরে দেশজুড়ে চলেছে সন্ত্রাস, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দুষ্কর্মের উত্সব। আর তাদের উল্লাস দেখে শোষিত, বঞ্চিত, উত্পীড়িত মানুষ হয়ে পড়েছে আরও আতঙ্কিত। তাদের ভাবনা, আগামীতে এই লুটেরা, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা হয়তো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। দেশবাসী হয়ে পড়বে আরও বেশি অসহায়।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, যে কোনো তথ্য-উপাত্তের চেয়ে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনেক বেশি মূল্যবান। কারও বক্তৃতা থেকে কিছু শোনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের দেখা ও জানা বিষয়। কাজেই আমি কী বক্তৃতা করব আজ? দেশের অবস্থা কী সাধারণ মানুষ আমার চেয়ে কম জানেন না?
তিনি বলেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের ম্যানেজিং কমিটির ইলেকশন হয়ে গেল সম্প্রতি। সব ভয়ভীতি, শাসক দলের চোখরাঙানি, অর্থের ছড়াছড়ি ও লোভনীয় হাতছানিকে ঘৃণাভরে উপেক্ষা করে আপনারাই শাসক দলের বিরোধীদের সেখানে নির্বাচিত করেছেন। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, উত্সবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে সুচিন্তিত রায় দেয়ার জন্য আমি আপনাদের এবং আপনাদের মাধ্যমে বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজকে অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, এই নির্বাচনের ফলাফলকে গুণ্ডামির মাধ্যমে বানচালের অপচেষ্টা হয়েছিল। হামলা চালিয়ে ফল পাল্টাতে না পেরে এখন শাসকদলের মদতে মামলার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কেবল জাতীয় প্রেস ক্লাবে নয়, মানুষ যেখানেই সুযোগ ও পরিবেশ পাচ্ছে সেখানেই শাসকদলের বিরুদ্ধে ব্যালট বিপ্লব ঘটাচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটির মানুষ সেই প্রমাণ দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে প্রেস ক্লাব, বার ও পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে এর প্রমাণ মিলছে। বেগম জিয়া বলেন, আসন্ন পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সেখানেও ভোটাররা একই রকম রায় দেবেন বলে আমরা দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল। তার আভাস বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আপনাদের করা জনমত জরিপেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
খালেদা জিয়া বলেন, আপনারা নিজেরাই দেখেছেন, গত দুই বছর ধরে ক্ষমতাসীনরা কীভাবে অসত্য কথার তুবড়ি ছুটিয়ে চলেছে। কিন্তু তাদের ব্যর্থতা এত সর্বব্যাপী এবং তাদের অপকর্ম এতটাই পর্বতপ্রমাণ যে, মিথ্যা দিয়ে আজ আর সত্যকে ঢাকা দেয়া যাচ্ছে না। একজন মহান ব্যক্তি বলে গেছেন, তুমি কিছু লোককে সব সময়ের জন্য এবং সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানাতে পার, কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছেন, তাদের ধোঁকা দিয়ে কিছুদিনের জন্য বোকা বানানো হয়েছিল। এখন তাদের চোখ খুলে গেছে। ধোঁকাবাজদের তারা চিনতে পেরেছেন। এখন অসত্য বলে, ধোঁকা দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই ক্ষমতাসীনরা এখন সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। দেশের মানুষ বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে দেখে ক্ষমতাসীনরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে দেখে শাসকদল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের কথাবার্তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেই বেসামাল অবস্থার চিত্র।
ক্ষমতার দুই বছর পূর্তিতে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ভুল, অসত্য, ভিত্তিহীন ও বিকৃত তথ্যে ভরা উল্লেখ করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, এই ভাষণের কী প্রতিক্রিয়া আমি দেব? তিনি বলতে চেয়েছেন, দেশে তেমন কোনো সমস্যাই নেই। দু’বছরে সব ফয়সালা করে ফেলেছেন। যা কিছু বাকি আছে, সেগুলোরও সুরাহা করে দেবেন ২০২১ সালে। আসলে দেশের বাস্তব ছবি কি তাই বলে? বেগম জিয়া বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) এখন এক তথাকথিত ‘রূপকল্প’র গল্প শোনাচ্ছেন। ভোটের আগে শুনিয়েছিলেন ডিজিটাল গল্প। ওয়াদা করেছিলেন, দশ টাকা কেজি দরে চাল, ফ্রি সার ও ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন। তার ডিজিটাল স্টোরি এখন ভয়ঙ্কর দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে। ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে মোটা চাল কেনার সামর্থ্য হারিয়ে এদেশের গরিব মানুষেরা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। সারাদেশে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ। ফ্রি সার ও চাকরি এখন সোনার হরিণ হয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তাই এখন আর কোনো কল্পকাহিনী কিংবা রূপকথা শুনতে চান না। তারা ক্ষুধার অন্ন চান, শীত নিবারণের বস্ত্র চান। তারা গ্যাস চান, বিদ্যুত্ চান, তৃষ্ণা নিবারণের বিশুদ্ধ পানি চান, চাকরি চান, সুস্থ ও নিরাপদ জীবন চান। ক্ষমতাসীন সরকার গত দু’বছরে এসব চাওয়ার কতটা পূরণ করতে পেরেছে, দেশের মানুষ সে কথাই জানতে চান।
দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে : খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে দ্রব্যমূল্যের যে চিত্র দিয়েছেন তা সত্য নাকি বিকৃত, সেটা বাজার করতে গিয়ে প্রতিটি নাগরিকই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আমরা সরকারে থাকা সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য জিনিসের দাম সাংঘাতিক বেড়ে গিয়েছিল। আমরা ভর্তুকি দিয়ে এবং সুষ্ঠু বাজার-ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু সে সময়কার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পথ বেছে নিয়েছিল। আর এখন তারা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির ধুয়া তুলছেন। তিনি বলেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বিএনপি আমলের তুলনায় অনেক কম আছে। তারপরও জিনিসপত্রের দাম জনগণের নাগালের বাইরে চলে গেল কেন? এ প্রসঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির একটা তুলনামূলক মূল্যতালিকা তুলে ধরে বেগম জিয়া বলেন, আমাদের বিগত সরকারের প্রথম চার বছর জিনিসপত্রের দাম অনেক কম ছিল। ২০০৬ সালে আমরা দায়িত্ব ছাড়ার বছরে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেই দাম একটু বেড়েছিল।
কিন্তু ২০০৬ সালের তুলনায় জিনিসপত্রের দাম এখন বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার ‘আন্দোলনের ফসল’ মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের জরুরি সরকার জিনিসপত্রের দাম ভয়ঙ্কর বাড়িয়ে ফেলে। আজকের ক্ষমতাসীনরা তাদের পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলেছেন। এরই নাম ডিজিটাল সরকারের সাফল্য!
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে ক্ষমতাসীনদের লাগামহীন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, অব্যবস্থাপনা এবং আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে। নানা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে সরকারের লোকরা ফায়দা লুটছেন আর কাফ্ফারা দিতে হচ্ছে ক্রেতাসাধারণকে। এইসব দুষ্কর্মের কথা সারাদেশের ভুক্তভোগী মানুষ জানলেও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সেসব বেমালুম চেপে গেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত সে কথা দেশবাসী সরকার সমর্থক পত্রিকার মাধ্যমে অনেক আগেই জানতে পেরেছে। টিসিবির জন্য দেশের ভেতর থেকেই চড়া দামে পেঁয়াজ কেনার বাণিজ্য তিনি তার এক নিকটাত্মীয়কে দিয়েছিলেন।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি উত্তরাঞ্চল থেকে নাকি মঙ্গা ও অভাব বিতাড়িত করেছেন। মূলত তিনি সারাদেশে মঙ্গা ছড়িয়ে দিয়েছেন। ওএমএসের নিম্নমানের চাল কেনার জন্য গরিব-দুঃখী, অভাবী মানুষের দীর্ঘ সারি, তাদের অপুষ্টি-জর্জর দেহ, বেদনাক্লিষ্ট মুখ, হতাশ শূন্যদৃষ্টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চোখে কি কখনও পড়ে না? সেই অসহায় মানুষগুলোর ক্ষুধার অন্ন নিয়েও চলছে তেলেসমাতি ও দুর্নীতি। শাসকদলের সাঙ্গোপাঙ্গরা ওএমএসের চাল নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি করায় দীর্ঘ লাইনে সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেও অনেক ক্ষুধার্ত মানুষকে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৭৪ সালে মুজিব আমলের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় অনাহারে যখন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, সে সময় উপোসী মানুষের লঙ্গরখানার খাদ্য নিয়েও আওয়ামী লীগের লোকেরা চরম দুর্নীতিতে মেতেছিল। তাদের সেই চুরির স্বভাব আজও যে রয়ে গেছে, সেটা দেশবাসী চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ক্ষুধিত মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়ার এই ধারাটা অন্তত বন্ধ করুন। নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী দশ টাকায় চাল দেয়ার সাধ্য আপনার নেই, আমরা জানি। বিএনপি সরকারের আমলের প্রথম চার বছরের কথা বলছি না। আমাদের দায়িত্ব ছাড়ার বছরে জিনিসপত্রের যে দাম ছিল, অন্তত সেই পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য নামিয়ে আনুন—দেশবাসী কৃতজ্ঞ থাকবে।
গত দু’বছরের কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন ধারাবাহিক সরকারের প্রক্রিয়া উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, অতীতের কিছু উন্নয়ন প্রকল্প চালু রাখা এবং রুটিন কাজকর্মকে উন্নয়ন বলে জাহির করার চেষ্টা সত্যি হাস্যকর। জোট সরকারের প্রথম দুই বছরের সঙ্গে বর্তমান সরকারের দু’বছরের তুলনাকে স্বাগত জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ২০০১ থেকে ২০০৩ সালে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পের উল্লেখ করেন।
র্যাট এবং পরে র্যাব গঠনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, পলিথিন ও থ্রি-স্ট্রোক ইঞ্জিন নিষিদ্ধ করা, নগরীতে সিএনজিচালিত মোটরযান ও উন্নতমানের বাস চালু, যানজট নিরসনে মহাখালী ও খিলগাঁও ফ্লাইওভার তৈরি, ভৈরবে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু, শিকারপুর-দোয়ারিকা সেতুসহ বেশ কটি বড় সেতু এবং নলকা-হাটিকামরুল-বনপাড়া সড়কসহ বেশ কটি সড়ক চালু করা, যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে রাজশাহী ও খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেল চালু করা, নকলমুক্ত পরীক্ষা নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো পাঠ্যবই তুলে দেয়া, মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখাপড়া ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে নতুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, কৃষিতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ৩ গুণ করা, কৃষিতে সেচ সহায়তার জন্য কম মূল্যে বিদ্যুত্ সরবরাহ, পল্লীবিদ্যুত্ কর্মসূচির আওতায় ৩৫টি উপকেন্দ্র স্থাপন, কয়েক হাজার কিলোমিটার বিদ্যুত্ বিতরণ লাইন নির্মাণ, ৫ হাজার গ্রামে নতুন বিদ্যুতায়ন এবং প্রায় সাড়ে ১০ লাখ নতুন বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া, দেশের উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ, বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাস লাইন নির্মাণ ও ২ লাখ নতুন গ্রাহককে গ্যাস সংযোগ দেয়া, বড়পুকুরিয়ায় বার্ষিক ১০ লাখ টন উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাখনির বাণিজ্যিক উত্তোলন শুরু হয় এবং সে কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র নির্মাণ, বিদেশে জনশক্তি প্রেরণের বন্ধ দরজা খোলা, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক নতুন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, স্কুল-কলেজে কম্পিউটার পৌঁছানো হয়। শিক্ষকদের দেয়া হয় কম্পিউটার ট্রেনিং, প্রত্যেক জেলায় ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন উদ্যোগের বর্ণনা তুলে ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এ বিবরণীও আমাদের বিগত সরকারের প্রথম ২ বছরের উন্নয়ন-সাফল্যের এক খণ্ডচিত্র মাত্র। এগুলো আপনারা জানেন। দেশবাসী এসব উন্নয়নের সুফল ভোগ করছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় জানেন না কেবল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।বর্তমান সরকারের দুই বছরপূর্তিতে দু’টি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের হেডলাইন পড়ে শোনান বেগম খালেদা জিয়া। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ‘মহাজোট সরকারের দু’বছর পূর্তি আজ নির্বাচনী ইশতেহার উপেক্ষিত’। একই পত্রিকার আরেক শিরোনাম : ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা ঠিক হয়নি দুই বছরে’। সাপ্তাহিক বুধবার পত্রিকার শীর্ষ শিরোনাম : ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দুই বছর’। ওই পত্রিকায় চিন্তাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা, ‘দিনবদলের দুই বছর : উন্নতির নিচে আর্তনাদ’ এবং কমিউনিস্ট নেতা হায়দার আকবর খান রনোর ‘দিনবদলের স্লোগান এখন হাস্যকর বুলি’ শীর্ষক নিবন্ধের শিরোনাম তুলে ধরেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, পত্রিকাগুলোর লেখক-সাংবাদিকরা বিএনপি করেন না। তারাই যা লিখেছেন, আমার আর বেশিকিছু বলার প্রয়োজন নেই। তারা যেসব তথ্য দিয়েছেন ও প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দয়া করে অন্তত সেসবের জবাব দেবেন কী?
বিদ্যুত্ প্রসঙ্গে : প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে দেয়া বিভিন্ন তথ্যকে ডাহা মিথ্যা অভিহিত করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের সরকারের আমলে নাকি দেশে এক মেগাওয়াট বিদ্যুত্ও উত্পাদন হয়নি। কিন্তু লুটপাট হয়েছে হাজার কোটি টাকা।’ একই মিথ্যা কথা বারবার বলাটা মনে হয় তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ২০১০ সালের ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বইটির ১১৮ পৃষ্ঠায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, আমাদের সরকারের ৫ বছরে নতুন ১২৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ জাতীয় গ্রিডে সংযোজন করা হয়েছে। ২০০১ সালে আমরা সরকারের দায়িত্ব নেয়ার সময় বিদ্যুতের মোট স্থাপিত উত্পাদন-ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৫ মেগাওয়াট। ২০০৬ সালে আমরা দায়িত্ব ছাড়ার সময় এ উত্পাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ৫ হাজার ২৭৫ মেগাওয়াটে উন্নীত করি। নিজেদের সরকারের এ তথ্য গোপন করে শীর্ষ পর্যায় থেকে যদি অবিরাম মিথ্যা বলা হয়, তাহলে মানুষ কার ওপর আস্থা রাখবে?
খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের সময়ে বিদ্যুত্ নিয়ে কিছু সমস্যা থাকলেও এখন তা সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুত্ উত্পাদনে সফলতার নানা মেগাওয়াট-কাহিনী শুনিয়েছেন। দেশবাসী এসব বানোয়াট গল্প আর শুনতে চায় না। তারা দেখছেন, সরকার বিদ্যুতের সব ধরনের নতুন সংযোগ দেয়া বন্ধ রেখেছে। তারা জানছেন, দীর্ঘদিন হাত গুটিয়ে বসে থেকে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির পর সরকার আত্মীয়স্বজন ও দলীয় লোকদের কাছ থেকে চড়া দামে বিদ্যুত্ কেনার উদ্দেশ্যে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বসানোর চুক্তি করছে বিনা টেন্ডারে। এসব কাজে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। বরং রয়েছে বিশাল দুর্নীতির অভিযোগ।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এ অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার জন্য আগামীতে যাতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয়, তার জন্য এগুলোকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। বিশিষ্টজন ও বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে একে ‘দুর্নীতি ও চুরির ইনডেমনিটি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এতো কিছু করার পরও বিদ্যুতের অভাবে কারখানা বন্ধ, উত্পাদন ব্যাহত এবং জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মানুষ মেগাওয়াটের হিসাব শুনতে চায় না, পেতে চায় বিদ্যুত্। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞদের হিসাবে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টওয়ালারা আগামী ৩ বছরে লুটে নেবে অতিরিক্ত ২০ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।
তার অর্থ হচ্ছে, দুর্নীতি করবেন তারা, আর ভুক্তভোগী হবে জনগণ। আর চলমান দুর্নীতি ঢাকতে অপপ্রচার করবেন, এ খাতে অতীতে দুর্নীতি হয়েছে—সেটা চলবে না।
শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে : সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজার লুট হয়ে যায়। তাদের আগের সরকারের আমলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়েছিল। এবারও একই আলামত শুরু হয়েছে। অব্যবস্থাপনার ফলে দু’বছরেই পুঁজিবাজার ও মানি মার্কেট দুটোকেই সরকার অস্থির করে ফেলেছে। ফলে অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। ১৯৯৬-এর মতো বর্তমানে সরকারের ছত্রছায়ায় পুঁজিবাজারে চলছে লুটপাট। একটি চক্রকে লুটপাটের সুযোগ করে দিতে সরকারের একেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বারবার পুঁজি হারাচ্ছেন। সরকারদলীয় এ চক্রটিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে বিতর্কিত নির্দেশনার মাধ্যমে কখনও দরপতন আবার কখনও দর-উত্থানের খেলা এখন সবার কাছেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মূলধন কেড়ে নেয়ার এ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। মানি মার্কেটে কলমানির সুদের হার ইতিহাসের সর্বোচ্চ, প্রায় ২শ’ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। মূলত শাসক দলের সদস্যদের মালিকানাধীন কয়েকটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণহীন আচরণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ভারতীয় এয়ারটেলের কাছ থেকে কোনো ট্রান্সফার ফি গ্রহণ না করার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বিটিআরসি চেয়ারম্যান ব্যাখ্যা প্রদান করেন, ভারতীয় এয়ারটেল মাত্র ৭০ লাখ টাকায় অর্থাত্ ১শ’ টাকার প্রতিটি শেয়ার ৬ পয়সা দরে ক্রয় করেছে। আমি দুর্নীতির রাহুগ্রাস সম্পর্কে সামান্য কিছু ইঙ্গিত দিলাম। আগামীতে বিস্তারিত বলব ইনশাল্লাহ।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে : আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর চিত্র তুলে ধরে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নাকি আইনশৃঙ্খলা এখন ভালো। দেশবাসীই জানে এ তথ্য কতটা সত্য! এ ব্যাপারে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন বেগম জিয়া। তিনি বলেন, সরকারি হিসাবেই গত দু’বছরে খুন হয়েছে ৮ হাজারের বেশি মানুষ। ধর্ষণের ঘটনা ৫ হাজারের বেশি। গত অক্টোবর-নভেম্বর এ দু’মাসেই ১৮৯ জন গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রায় ৫শ’ নিহত ও প্রায় ২৭ হাজার লোক আহত হয়েছেন। গতবছর ইভটিজিংয়ের ঘটনায় ৫ শতাধিক আহত এবং প্রতিবাদ করায় ১৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে জীবন দিয়েছেন প্রায় ২শ’ মানুষ। বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন প্রায় আড়াইশ’। সীমান্তে শুধু গত বছরই শতাধিক বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে। এর কোনো প্রতিবাদ করার সাহসও সরকার রাখে না। এ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও পাঠ্যবই বিতরণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দাবি করা সাফল্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই শিক্ষানীতি প্রণয়নে একটি বিশেষ মত ও পথের শিক্ষাবিদদের নিয়েই কেবল কমিশন গড়া হয়েছিল। তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিক ও দেশের স্বীকৃত আলেম-ওলামাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। ফলে এটি জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। গতবছর ভারত থেকে ছাপিয়ে আনা পাঠ্যবইয়ের অর্ধেক এখনও দেশে এসে পৌঁছায়নি। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নতুন শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই এখনও পাঠ্যবই থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
প্রশাসনকে অস্থির করে তোলা হয়েছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, সারাদেশে অসংখ্য যোগ্য সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার এবং আনসার-বিডিআরকে প্রায়ই সরকারি দলের ক্যাডাররা বিভিন্ন স্থানে মারধর করছে। পাবনায় সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা সারাদেশে আলোচিত হয়েছে। অথচ সেসব সন্ত্রাসী সবাই মুক্তি পেয়ে গেছে।
জাতীয় সংসদ অকার্যকর : জাতীয় সংসদকে সরকারই অকার্যকর করে রেখেছে অভিযোগ করে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, আমরা সংসদকে কার্যকর করতে চাই। এর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চাই। এজন্যই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পরও প্রথম সংসদ অধিবেশনেই আমরা অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে কী ধরনের অশালীন উক্তি করা হয়েছে—তা সবাই জানেন।
জনগণের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা সংসদে বহু প্রস্তাব ও নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু এর একটিও গ্রহণ করা হয়নি। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য সরকারের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায় প্রচার করা হয়নি। দেশ-জাতির সমস্যা নিয়ে যে সংসদে কথা বলার সুযোগ নেই, সেই সংসদের প্রতি মানুষের কোনো আস্থা থাকে না। এখন বিচার বিভাগ পর্যন্ত বলছে এ সংসদ সার্বভৌম নয়। এরপর আমাদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনো কথা বলার মুখ থাকে কি? তিনি অবিলম্বে সংসদে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করার আহ্বান জানান।
ভারত সফর ও চুক্তির পরবর্তী অবস্থা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কেন স্থান পায়নি জানতে চেয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী নানারকম চুক্তি করে ভারত সফর শেষে ফিরে এসে বলেছিলেন : ‘আমি জয়ী হনু আজ।’ আশ্চর্যের বিষয়, দু’বছর পূর্তির ভাষণে ভারত সফর ও চুক্তি নিয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। এতে সবাই হতবাক হয়েছে। তাহলে কী এতদিন পর তিনি বুঝতে পেরেছেন—জয়ী নন, তিনি পরাজিত হয়ে এসেছিলেন? ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাওয়ার প্রবক্তারাও এখন নিশ্চুপ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বিদেশ থেকে চাকরি হারিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশী নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসছে। বিদেশে জনশক্তি প্রেরণের হার এরই মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ কমেছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনো উদ্বেগ কিংবা উদ্যোগ নেই।
নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ না দেয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, দেশবাসী জানতে চায়—এই অঙ্গীকার গত দু’বছরে প্রতিপালন করা হয়নি কেন? আগেরবার ক্ষমতায় এসে নিজেরা দেশকে বিশ্বের এক নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত করেছিলেন। এবার ক্ষমতায় এসে নিজেদের দুর্নীতির সব মামলা খারিজ করাচ্ছেন বা তুলে নিচ্ছেন। আর আমাদের বিরুদ্ধে দিচ্ছেন নতুন নতুন মামলা। এই অবিচার ও বৈষম্যের বিচার কোনোদিনই হবে না বলে কি নিশ্চিত হয়েছেন?
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বিডিআর ধ্বংস করা হয়েছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার আজও হয়নি। প্রকৃত অপরাধীরা অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। জ্বলন্ত নানান প্রশ্নের কোনো জবাব দু’বছরে মেলেনি। ন্যায্য প্রশ্ন তোলার দায়ে অনেকে নির্যাতিত হয়েছেন, চাকরি হারিয়েছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, শাসক দল আজ সমঝোতা, সৌহার্দ্য ও জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন এবং প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের নামে তারা রক্তপিপাসা মেটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা, মর্যাদা আজ ভূলুণ্ঠিত। জাতীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। ধর্মপ্রাণ নাগরিকরা আক্রান্ত। এ পরিস্থিতিতে দেশ বাঁচাতে, মানুষ বাঁচাতে আমাদেরকে গড়ে তুলতে হবে গণমানুষের সার্বিক ঐক্য ও প্রতিরোধ। চরম এই দুঃসময়ে সব দেশপ্রেমিকের কাছে সেই নিবিড় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান খালেদা জিয়ার।
এ ভাষণের সময় আরও উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম শামসুল ইসলাম, ড. আরএ গনি, এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ.স.ম. হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল প্রমুখ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×